বিয়ের উপহার

বিয়ের উপহার

দীর্ঘদিন ধরে জ্যাক ব্রদলি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন যে, ইহজনমে তিনি বিয়ে করবেন না। আত্মীয়-বন্ধুমহলে তিনি সগর্বে বলে বেড়াতেন, চিরটাকাল নির্ঝঞ্ঝাট কুমারজীবন কাটিয়ে দেবেন। তারপর আচমকা একদিন ঘোষণা দিলেন, খুব শিগগির তিনি কুমারজীবনের অবসান ঘটিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছেন!

আসলে ব্যাপারটা হঠাৎ করেই ঘটে গেল। সেবার গরমের এক রোদজ্বলা দিনে সমুদ্রতটে লম্বা হয়ে শুয়ে শুয়ে স্নানরত মহিলাদের আনাগোনা দেখছিলেন জ্যাক ব্রদলি। তাঁর পাশ দিয়ে হেঁটে-যাওয়া, জলেভেজা একজোড়া কোমল নিটোল পায়ের দিকে তাঁর চোখ আটকে গেল। পায়ের পাতায় লেগে থাকা গুঁড়ো গুঁড়ো বালু। বালুতে মিশে থাকা অভ্রের কুচির ওপর রোদ পড়ে কেমন ঝিকিমিকি করছে। চোখ তুলে তাকাতেই পায়ের অধিকারিণী মহিলার সম্পূর্ণ অবয়ব নজরে এলো; আধভেজা সিল্কের নরম বাথরোবে জড়ানো এক তরুণী, সামুদ্রিক বাতাসের উথালপাথাল ঝাপটা থেকে দুহাতে বাথরোবটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টারত, ভেজা সোনালি চুল লেপটে আছে গালে, রোদের তাপে লালচে গোলাপি হয়ে উঠেছে গালদুটো, আধফোটা গোলাপ কুঁড়ির মতো লাল টুকটুকে ঠোঁটে ফুটে আছে একফালি সলাজ হাসি। জ্যাকের হৃদয় আনন্দে নেচে উঠল, এই প্রথম কোনো মহিলার প্রতি শুধুই জৈবিক টান অনুভব না করে, তাঁর মনে জেগে উঠল প্রেমরস। জীবনে এই প্রথম প্রবলভাবে তিনি প্রেমে পড়লেন। তরুণীর নাম ব্রেথ লেনিস।

সময় নষ্ট না করে জ্যাক ব্রেথের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলেন, নানাভাবে তাঁদের মুগ্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। যতবার দূর থেকে ব্রেথকে সমুদ্রতটে দেখেন, জ্যাকের লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় শিহরণ বয়ে যায়, উত্তপ্ত রক্ত চঞ্চল হয়ে ছুটে ছুটে বেড়ায় তাঁর ধমনিজুড়ে। কিন্তু যেই ব্রেথের কাছাকাছি হন, তিনি আর কথা খুঁজে পান না, খেই হারিয়ে ফেলেন; এমনকি চিমত্মাশক্তিও যেন লোপ পেয়ে যায়। তাঁর হৃৎপি- যেন ধুকপুক করতে ভুলে যায়, কানের ভেতর বেজে চলে অগণিত ঝিঁঝি পোকার ঝাঁ ঝাঁ আওয়াজ। মন ধেয়ে চলে অজানা দিশায়!

ব্রেথের মা-বাবা, বেশ কিছুদিন জ্যাকের প্রস্তাবে মোটেও আমল দেননি। তাঁরা খুব ভালো করেই জ্যাকের নারীঘটিত অসংখ্য কেলেঙ্কারির মুখরোচক কাহিনি জানেন। এমন লম্পট লোকের হাতে মেয়ে দেওয়ার চেয়ে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়াও ভালো!

মেয়েলোকের প্রতি জ্যাকের ছিল দুর্বার আকর্ষণ, এ-ব্যাপারে তাঁর কোনো বাছবিচার নেই। কত অসংখ্য মেয়ে যে তাঁর জীবনে এসেছে আর চলে গেছে, তার হিসাব জ্যাকেরও জানা নেই। তবে শোনা যায়, পুরনো এক প্রেমিকার সঙ্গে এখনো ওর ক্ষীণ সম্পর্ক রয়ে গেছে, মাঝেমধ্যেই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটে, আবার মিটেও যায়। আসলে এই একটিমাত্র মেয়ের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা অন্যদের চেয়ে বেশি স্থায়ী হয়েছিল। তবে ইদানীং বেশ কিছুদিন ধরে দুজনের মধ্যে আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই। জ্যাক তাঁর উকিলকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, মেয়েটিকে যেন নিয়মিত কিছু কিছু খোরপোশ পাঠানো হয়। ব্যস ওই পর্যন্তই। মেয়েটির সম্পর্কে আর কিছু জানার বা শোনার কোনো আগ্রহই জ্যাকের নেই। বরং এমন ভান করেন, যেন এমন মহিলার সঙ্গে তাঁর আদৌ কোনোদিন পরিচয়ই ছিল না। যদিও প্রতি সপ্তাহে মেয়েটি তাঁকে নিয়মিত চিঠি পাঠাত, মেয়েটির হাতের লেখা চিঠি দেখলেই জ্যাকের আপাদমস্তক রাগে জ্বলে উঠত। আক্রোশভরে চিঠিখানা না খুলেই কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতেন, নিতান্ত ঘৃণাভরে। কখনো পড়েও দেখেননি জ্যাক, পরিত্যক্ত মেয়েটির লেখা চিঠির একটি হরফও, কখনো জানার চেষ্টা করেননি মেয়েটির ভগ্নহৃদয়ের আকুতি!

এমন লোকের হাতে মেয়ে দিতে চাইবে কোন মা-বাবা, কিসের ভরসায়? শীত পেরিয়ে বসন্ত এলো, আবার চলেও গেল। অবশেষে ভাগ্যের শিকা ছিঁড়ল জ্যাকের জন্য, মে মাসের প্রথমদিকে বিয়ের দিন ধার্য হলো, বিয়ে হবে প্যারিসে।

জ্যাক কিংবা ব্রেথ কেউই চাননি তাঁদের বিয়েতে খুব বেশি জাঁকজমক হোক, নিমন্ত্রিত অতিথির তালিকায় থাকবে শুধু উভয়পক্ষের ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয়, আর কাছের কিছু বন্ধুবান্ধব। সাদামাটা হবে বিয়ের অনুষ্ঠান, রাতভর নেচে ক্লান্ত হওয়ার দরকার নেই, তার চেয়ে রাত বেশি গভীর হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে, যাতে ভোরসকালে উঠেই হানিমুনের জন্য রওনা দেওয়া যায়, গন্তব্য সেই সমুদ্রতটের পাশের শহরে, যেখানে প্রথমবার দুজনের দেখা এবং প্রেম হয়েছিল।

ব্রেথের মা-বাবার বাড়িতেই সাজানো হয়েছে বিয়ের বাসর, জাপানি সিল্কের চাদর-বিছানো মাখননরম শয্যায় ছড়ানো লাল গোলাপের পাপড়ি, সারা ঘর সাজানো হয়েছে লাল গোলাপ আর সাদা অর্কিডে। মৃদু মোমের আলোয় ঘরময় স্বর্গীয় আভা। খোলা জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া বয়ে আনছে বাসমত্মী সুগন্ধি!

জ্যাক আর ব্রেথ পরস্পরের হাত ধরে মুখোমুখি বিছানায় বসা। দুজন দুজনের হাত ধরে আছেন, দুজনেই চুপ, যেন কী বলবেন ভেবেই কূল করতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে হাতধরা হাতে আলতো করে চাপ দিয়ে মনের কথা ব্যক্ত করছেন।

ব্রেথের চোখে স্বপ্নিল চাহনি, জীবনের এমন একটা বাঁকে পৌঁছে যেন খানিকটা দিশাহারা, মুখে হাসিকান্না-মাখানো প্রলেপ, আনন্দ-আতিশয্যে তিনি বোধহয় কেঁদেই ফেলবেন, অথবা জ্ঞান হারাবেন, কেঁপে কেঁপে উঠছে তাঁর শরীর এবং মন, হৃদয় পাত্রখানি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে জ্যাকের প্রতি গভীর ভালোবাসায়।

জ্যাকের মুখে অফুরান হাসি, কত কথাই যে তাঁর বলতে ইচ্ছা হচ্ছে ব্রেথকে, মনে হচ্ছে কথার তুবড়ি ছোটান, কিন্তু কী বলবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। নিজের হাতে ধরে রাখা ব্রেথের হাতখানায় মৃদু মৃদু চাপ দিচ্ছেন মাঝেমধ্যে আর অস্ফুটস্বরে ডাকছেন ব্রেথের নাম ধরে। জ্যাকের দিকে একপলক চেয়েই চোখ নামিয়ে নেন ব্রেথ, লজ্জায় মুদে আসে তাঁর আনত নয়ন। অথচ আর কেউ তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলও না, তারপরও ভাব বিনিময়ের মতো ভাষা যেন ছিল অধরা দুজনের কাছেই!

এমন সময়, হঠাৎ করে দরজা খুলে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় বাড়ির কাজের লোকটি, হাতেধরা রুপার ট্রের ওপরে রাখা একখানা মুখবন্ধ খাম, জানাল এইমাত্র একজন পত্রবাহক এসে দিয়ে গেছে, বলেছে খুবই জরুরি চিঠিখানা, তা না হলে এমন সময় সে তাঁদের বিরক্ত করত না। জ্যাকের হাত কেঁপে গেল চিঠিখানা হাতে নিতে, অজানা আশঙ্কায় শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল হিমপ্রবাহ, অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন চিঠিখানার দিকে, যেন ওতে রয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরোয়ানা। বড় দুর্বোধ্য লাগছিল তাঁর সবকিছু, অজানা হাতের লেখা চিঠিখানা খোলার মতো মনের জোর জোটাতে পারছিলেন না কিছুতেই, পড়ার ইচ্ছাও হারিয়ে ফেলেছিলেন। একবার মনে হচ্ছিল, না খুলে, না পড়েই পকেটে লুকিয়ে রাখেন, নিজের মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলেন, ‘কাল নয় পড়ব’ক্ষণ যখন এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব তখন!’

কিন্তু চিঠিখানার এক কোণে বড় আর স্পষ্ট করে লেখা ‘অতি জরুরি’, নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেওয়া – স্পষ্টতই জ্যাকের হাত-পা কাঁপতে শুরু করল এবার। চিঠিখানা খোলার মতো শক্তিও যেন তাঁর হাতে অবশিষ্ট নেই!

অস্পষ্টস্বরে ব্রেথকে বললেন, ‘পিস্নজ কিছু মনে করো না, সোনা।’

কাঁপা কাঁপা হাতে, একটানে খামটা ছিঁড়ে ফেললে­ন। পা-ুর মুখে চিঠিটার লেখার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন, যেন এর মাথা-মু-ু কিছুই বুঝতে পারছেন না, যেন ওটা কোনো অচেনা ভাষায় লেখা, অথবা যেন প্রতিটা অক্ষর বানান করে করে পড়তে হচ্ছে তাঁকে।

মাথা তুলে যখন ব্রেথের দিকে তাকালেন জ্যাক, তাঁর মুখের অভিব্যক্তি আমূল বদলে গেছে ততক্ষণে, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল তাঁকে। আমতা আমতা করে বললেন, ‘ব্রেথ লক্ষ্মীটি, তুমি কিছু মনে করো না পিস্নজ, আমাকে এক্ষুনি একবার হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। আমার… আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃত্যুশয্যায়, আমাকে একবার শেষবারের মতো দেখতে চাইছে সে। যাব আর আসব, এই ধরো আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব।’

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্বের মতো হয়ে পড়েছিলেন ব্রেথ, বিড়বিড় করে বলেন, ‘আহা রে, একটা মানুষের এত বড় বিপদ, না না যাও তুমি, আমি কিছু মনে করব না!’

এর বেশি কথা জোগায় না তাঁর মুখে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার পুরনো বউ সে। এত হিম্মত তাঁর নেই স্বামীকে জেরা করার যে, কে এমন বিশেষ বন্ধু ওনার, যার জন্য জীবনের এমন আকাঙিক্ষত মধুর মুহূর্তকে পায়ে দলে ছুটে যেতে হবে, সদ্য বিবাহিতাকে ফেলে। হাতের নাগালে যে টুপি আর কোট উঠে এলো, তা নিয়ে পলকে জ্যাক উধাও হয়ে গেলেন, একেকবারে তিনটি করে সিঁড়ির ধাপ টপকে রাস্তায় এসে পৌঁছালেন তিনি। অস্থির হাতে চিঠিটা খুলে গ্যাসের স্বল্প আলোয় মেলে ধরলেন, ওতে লেখা :

‘মসিয়ে জ্যাক,

আপনার পুরনো প্রণয়ী রেবেকা, কিছুক্ষণ আগে একটি কন্যাসমত্মানের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, আপনি এই সদ্যোজাত শিশুটির পিতা। শিশুটির মা এই মুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা, একবার আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান, তিনি আপনার দয়া ভিক্ষা করছেন। রেবেকার বিনীত অনুরোধে, তাঁর হয়ে এই চিঠিখানি আমি লিখছি। রেবেকার হাতে আর খুব বেশি সময় নেই, তাঁর আয়ু খুব দ্রম্নত ফুরিয়ে আসছে। যদি সম্ভব হয়, দয়া করে এই হতভাগিনীকে একবার শেষবারের মতো দেখা দেবেন আশা করি।

নিবেদক

ডা. বার্নার্ড।’

জ্যাক যখন আঁতুড়ঘরে ঢুকলেন, রেবেকা ততক্ষণে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছেন, ধুঁকে ধুঁকে কোনোরকমে তখনো তাঁর জান টিকেছিল মাত্র। প্রথমে জ্যাক কিছুতেই রেবেকাকে চিনে উঠতে পারছিলেন না। একজন ডাক্তার আর দুজন নার্স ওর দেখাশোনায় ব্যস্ত, ঘরের মেঝেময় ইতস্তত ছড়ানো-ছিটানো বরফ আর
রক্তেভেজা বিছানার চাদর-কম্বল, গজ, তুলা। পায়ের তলার কার্পেট ভিজে চুপচুপে; সুদৃশ্য মোমদানে জ্বলছিল দুটি মোম; রোগিণীর মাথার পাশে রাখা ছোট্ট একখানা কটে শোয়ানো তুলতুলে পুতুলের মতো একটি শিশু; থেকে থেকে শিশুটি কেঁদে উঠছিল। যতবার শিশুটি কেঁদে ওঠে, শিশুটির মা যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখ অতিকষ্টে খুলে তাকানোর চেষ্টা করেন। প্রচ- ঝড়ে পড়া পাতার মতো থিরথির করে কেঁপে কেঁপে ওঠে বরফের ব্যান্ডেজের তলায় তাঁর ক্ষীণ দেহখানি। দীর্ঘ প্রসববেদনা আর মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ সহ্য করতে করতে অবসন্ন হয়ে পড়েছেন রেবেকা, ক্রমশ মৃত্যুর দিকে পলপল এগিয়ে চলেছেন তিনি!

রেবেকা কিন্তু জ্যাককে দেখামাত্র চিনতে পেরেছেন। হাত তুলে ওর দিকে ইশারা করতে চাইছিলেন। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে ওর শরীর। পা-ুর মুখে চোখের কোল বেয়ে ঝরে পড়ছে গরম নোনাজল অঝোর ধারায়। জ্যাক ধুপ করে হাঁটুমুড়ে বসে পড়েন রেবেকার বিছানার ধার ঘেঁষে। ওর ঠান্ডাপ্রায় হাতটা তুলে নিয়ে চুমু খেতে থাকেন। ধীরে ধীরে রেবেকার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়েন জ্যাক। সে-মুখে ততক্ষণে মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। নার্সের হাতেধরা মোমের আলোয় ডাক্তার দেখলেন রেবেকার সময় বড় দ্রম্নত ফুরিয়ে আসছে।

খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে কথা বলার চেষ্টা করেন রেবেকা। মনে হয় যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সে-আওয়াজ, ‘আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে জ্যাক, দয়া করে আমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত থাকো! অন্তত শেষবারের মতো খানিকটা সময় আমার পাশে থাকো!’

জ্যাকের হৃদয় মুচড়ে ওঠে। ঝুঁকে রেবেকার মুখে, চুলে চুমু খান, মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। ভারি গলায় বলেন, ‘চিমত্মা করো না, এখানেই আছি আমি, কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে ফেলে।’

অনেকক্ষণ চুপ থেকে কথা বলেন রেবেকা, বড় মস্নান শোনায় তাঁর কণ্ঠ – ‘ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করে বলছি, ও তোমারই মেয়ে, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি কোনোদিন ভালোবাসিনি। কথা দাও, আমার মৃত্যুর পর ওর দেখাশোনা করবে তুমি।’

মৃত্যুপথযাত্রী রেবেকার শরীরখানা দুহাতে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেন জ্যাক। বুকের ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে উঠছিল তাঁর। গলায় আটকে আছে কষ্টের দলা-পাকানো ঢেউ। কান্না-জড়ানো গলায় বলেন, ‘ঈশ্বরের নামে প্রতিজ্ঞা করে বলছি, ওকে কখনো নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখব না। ওকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসব। কখনো ওর আদর-যত্নের ঘাটতি হবে না।’

‘বাচ্চাটাকে একবার আমার সামনে কোলে নাও, ওকে আমার হয়ে একটু আদর করো পিস্নজ’, ফিসফিসিয়ে বলেন রেবেকা।

জ্যাক উঠে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন। সযত্নে রেবেকা আর তাঁর মাঝখানে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। শিশুটির কান্না মুহূর্তেই থেমে গেল। ‘কোথাও যেও না যেন’, রেবেকা বিড়বিড় করে বলেন!

নিজের উষ্ণ হাতে রেবেকার বরফশীতল হাতটি তুলে নিয়ে জ্যাক চুপটি করে বসে থাকেন। হুবহু একই রকমভাবে, যেভাবে এই কিছুক্ষণ আগে ভালোবেসে ধরে ছিলেন তাঁর নবপরিণীতা তরুণী বধূটির নরমকোমল হাতখানি। কিছুক্ষণ পরপর ঘড়ির দিকে চোরা চাউনিতে দেখছিলেন, ক্রমে মধ্যরাত পেরিয়ে রাত দুটোর কাঁটা ছুঁইছুঁই!

ততক্ষণে ডাক্তার বাড়ি ফিরে গেছেন, কর্তব্যরত নার্সদুজন সারাদিনের খাটাখাটুনিশেষে ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে বসেই ঘুমিয়ে কাদা, বাচ্চাটিও প্রশান্ত মুখে ঘুমাচ্ছিল। রেবেকার চোখদুটিও বোজানো, মনে হয় যেন বিশ্রাম নিচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে ওর বুক ওঠানামা করছিল।

হঠাৎ মনে হলো, পর্দার পেছনে যেন মৃদু আলো জ্বলে উঠল। রেবেকা এমনভাবে ছটফটিয়ে উঠে সেদিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করল যে, আর একটু হলেই শিশুটি খাট থেকে ছিটকে পড়ে যেত। ওর গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছিল, তারপরই একেবারে চুপ। নার্স ছুটে এসে পরীক্ষা করে বলল, ‘সব শেষ!’

শেষবারের মতো একবার রেবেকার দিকে চাইলেন জ্যাক, একদিন এই মহিলাটিকে তিনি ভালোবেসেছিলেন। তারপর ঘড়ির দিকে চাইলেন, ভোর হয়ে এসেছে প্রায়, শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন, পেছনে পড়ে রইল তাঁর টুপি আর ওভারকোট, সেগুলো নেওয়ার কথা তাঁর মনেও পড়ল না।

ওদিকে জ্যাক চলে যাওয়ার পর ব্রেথ শান্তমনে অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে একাকী বসেছিলেন সাজানো বাসরঘরে। নানা দুশ্চিমত্মায় ছটফট করতে লাগল তাঁর মন! সময় পেরিয়ে যায়। দ্রম্নত ঘুরে চলে ঘড়ির কাঁটা। বাইরে তখনো বেশ কয়েকজন আত্মীয় গল্প-গুজব করছিল। ব্রেথ সেখানে গিয়ে বসেন। প্রাণপণে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করেন।

ব্রেথের মায়ের ওর দিকে নজর পড়তেই এগিয়ে আসেন, ‘কী ব্যাপার, এভাবে একা এখনে বসে আছো কেন, জ্যাক কোথায়?’

‘জ্যাক শোবার ঘরে, আসবে একটু পরেই’, – বলেন ব্রেথ।

এরপর আরো একটি ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, জ্যাকের দেখা নেই। এবার সবাই মিলে নানা প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে তোলে ব্রেথকে। বাধ্য হয়েই ওকে, জ্যাকের চিঠি পাওয়ার কথা বলতে হয়। বলতে হয়, আধাঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসছে বলে সেই যে জ্যাক গেল, এখনো এলো না। স্বামীর কোনো বিপদ হলো কিনা, তাই নিয়ে যে ওর মনে ঝড় বইছে, তাও জানায় সবাইকে।

সবাই একসঙ্গে জ্যাকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ক্রমে রাত গভীর হলো তবু জ্যাকের ফেরার নাম নেই। নিমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে বিদায় নিলেন। রয়ে গেল শুধু ঘনিষ্ঠজনেরা। মধ্যরাতও পেরিয়ে গেল। সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ব্রেথকে বিছানায় এনে শুইয়ে দিলো। এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। ততক্ষণে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তাঁর। মা আর দুই মাসি মিলে পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ব্রেথের বাবা গেছেন পুলিশ স্টেশনে, যদি কোনো খবর মেলে এই আশায়। অবশেষে ভোর পাঁচটায় নিচের হলঘরের দরজা খোলার ও বন্ধ করার মৃদু আওয়াজ হলো। আচমকা শব্দহীন নিস্তব্ধ বাড়িতে, বেড়ালের বাচ্চার মতো মিয়াও একটা আওয়াজ শোনা গেল!

মা-মাসি সবাইকে পেছনে ঠেলে দিয়ে, দৌড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেলেন ব্রেথ, পরনে তাঁর শুধু রাতপোশাক। বিশাল হলঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছেন জ্যাক, অনাগত ভয় আর উৎকণ্ঠায় তাঁর প্রায় শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম, হাতে জড়ানো সদ্যোজাত শিশুটি। তিনজন মহিলার দৃষ্টি এখন জ্যাকের দিকে, বিস্ময়ে হতবাক সবাই!

সহসা ব্রেথ এগিয়ে আসেন। খানিকটা সাহসে ভর করে জিজ্ঞেস করেন, ‘এসব কী? কী হচ্ছে এসব?’

‘এ আমার… আমার মেয়ে। এই কিছুক্ষণ আগে ওর মা মারা গেছে’, বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন আনমনা স্বরে বলেন জ্যাক। বাচ্চাটা ততক্ষণে তারস্বরে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে!

কোনো কথা না বলে শিশুটিকে একপ্রকার ছিনিয়েই নেন ব্রেথ জ্যাকের কোল থেকে। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলেন শিশুর মুখটি। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন পরম আশেস্নষে। জলভরা চোখ তুলে চান জ্যাকের দিকে, ‘কী বললে তুমি, ওর মা মারা গেছেন?’

‘হ্যাঁ… এই… তো, মাত্র কিছুক্ষণ আগেই। আমার হাতের মধ্যেই মারা গেল, গত বছর গ্রীষ্মের পর থেকে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল না, কোনো যোগাযোগও ছিল না। বিশ্বাস করো, ডাক্তারের চিঠি পাওয়ার আগে আমি জানতামই না যে, রেবেকা গর্ভবতী ছিল।’

ব্রেথের কানে জ্যাকের সব কথা আদৌ পৌঁছাল কিনা কে জানে, উৎফুলস্ন গলায় তিনি বলেন, ‘হয়েছে বাবা হয়েছে, আজ থেকে ও শুধু আমাদের। আমরা দুজনে মিলে ওকে পালব।’

সূত্র: কালিও কলাম

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত