মাছরাঙ্গা

মাছরাঙ্গা

আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাহরিন রেদওয়ানি মাছরাঙা হতে চেয়েছিল। বেবি, নিনা, আলাল, বাবর, ইউসুফ ও আমি তখন যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম।

নাহরিন রেদওয়ানির মাছরাঙায় রূপান্তরিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পেছনে গ্রিসের একটা মর্মস্পর্শী জনশ্রুতি জড়িয়ে ছিল। মধ্য গ্রিসের ত্রাকিস নামের এক রাজ্যের রাজা সিয়েক্সের মৃত্যু হয়েছিল ইজিয়ান সাগরে, জাহাজডুবিতে। সিয়েক্সের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় সহমরণে প্রবৃত্ত হয়েছিল তার প্রিয়তমা স্ত্রী আলসিয়োন। উত্তাল ইজিয়ান সাগরের বুকে সে ঝাঁপ দিয়েছিল। আলসিয়োনের দুর্ভাগ্য, তখন ভয়ানক অপরাধবোধের জন্ম দিয়েছিল দেবতাদের মনে। সাগরে ডুবে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে দেবতারা আলসিয়োনকে নীল পিঠ আর সাদা বুকের একটা মাছরাঙায় রূপান্তরিত করেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, Ñপ্রিয়ার সঙ্গে মিলনের জন্য মৃতদের ভূমি থেকে তাঁরা পুনরুত্থিত করেছিলেন মৃত সিয়েক্সকে। সেই থেকে ইজিয়ান সাগরের ত্রাকিস এলাকার সাগরবেলায় সুন্দর নীল মাছরাঙাদের জোড়া বেঁধে ঘুরতে দেখা যায়। ঢেউয়ের দোলায় ভাসতে থাকা খড়কুটোর বাসায় শীতের শুরুতে স্ত্রী মাছরাঙা চকচকে সাদা ডিম পাড়ে। ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায় মাছরাঙা-যুগল।

গ্রিসের এই পৌরাণিক গল্প আমাদের জানা ছিল না। বই পড়ে আমরা কেবল জানতাম যে মেসোপটেমিয়া ও গ্রিসের বিভিন্ন পুরাণ, লোকগাথা বা মহাকাব্যে লেখা আছে যে মরণশীল মানুষ পশুপাখিতে রূপান্তরিত হতে পারে এবং ঘটতে পারে উল্টোটাও। যেমন একজন মানুষ রাতারাতি নেকড়ে হয়ে গেল অথবা একটা ব্যাঙ একলহমায় হয়ে গেল সুদর্শন এক রাজপুত্র। বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে অবশ্য প্রাণীদের এমনতরো রূপান্তর মেনে নিতে পারাটা কঠিন। এই সবকিছুই কবির কল্পনা অথবা নিছকই অনুমান হতে পারে বলে আমি তখন নাহরিন রেদওয়ানিকে বলি। আমার যুক্তিকে ‘একচোখা’ বলে আখ্যায়িত করে নাহরিন রেদওয়ানি বলেছিল: এত অবিশ্বাস ভালো নয়! এই জগতের রহস্যের কতটুকুই বা মানুষ জানতে পেরেছে?

ত্রাকিস থেকে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে আনাতোলিয়ার আইওনিয়া উপকূলে যাচ্ছিল ত্রাকিসের রাজা সিয়েক্স। তার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার অ্যাপোলো-মন্দিরের ভবিষৎদ্রষ্টার পরামর্শ নেওয়া। আইওনিয়াতে পৌঁছানোর আগেই প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে সলিলসমাধি ঘটে সিয়েক্সের। দুঃসংবাদটা ত্রাকিসের রানি আলসিয়োনকে এমনভাবে দিতে হবে যেন তার কোমল হৃদয় ভেঙে খানখান না হয়ে যায়! গ্রিক দেবী হেরা তাই দেবদূত আইরিসকে পাঠান ঘুমের দেবতা হিপনোসের কাছে। হেরার অনুরোধ: স্বপ্নের ঘোরের ভেতরে আলসিয়োনকে যেন তার জোড়ের মৃত্যুর খবরটা দেওয়া হয়। হিপনোস তখন তার পুত্র, স্বপ্নের দেবতা মোরফিয়াসকে গভীর ঘুম থেকে জাগ্রত করে। মানুষের রূপ ধারণে পারদর্শী মোরফিয়াস তখন মৃত সিয়েক্সের রূপে ঢুকে পড়ে আলসিয়োনের স্বপ্নের ভেতর।

ঘুমে আচ্ছন্ন আলসিয়োন তার প্রিয়তম সিয়েক্সের ছায়া দেখতে পায়। আমার শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নগ্ন সিয়েক্স। তার ঘন চুল থেকে টপটপ করে ঝরছে জল। পাণ্ডুর তার গাত্রবর্ণ! এমন বিবর্ণ দেখাবে কেন আমার প্রিয়তমকে, যার রূপ সর্বজনবিদিত? ভোরের তারা লুসিফারের পুত্র আমার প্রিয়তম। আমার প্রিয়তমের গাত্রবর্ণ তো তার পিতার গাত্রবর্ণের মতোই উজ্জ্বল নীল! আজ এত অনুজ্জ্বল কেন দেখাচ্ছে আমার প্রিয়তমকে?

আর আমার মুখের খুব কাছে এসে সিয়েক্স কেন বলছে, প্রিয়তমা আলসিয়োন! এই দেখো, মৃত্যু হয়েছে আমার ইজিয়ান সাগরের গভীরে! ঝড়ে ডুবে গিয়েছিল আমার জাহাজ। আমি যেন সমুদ্রভ্রমণে নিরাপদ থাকি, সেই জন্য তুমি দেবী হেরার কাছে কতই না প্রার্থনা করলে! তোমার প্রার্থনা ব্যর্থ হয়েছে, দেখো! এবার ঘুম থেকে ওঠো প্রিয়তমা আমার! আমার শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করো। তোমার অশ্রুপাতের ভেতর দিয়ে আমি মৃতদের ভূমিতে চলে যেতে চাই।

এটুকু বলার পর ত্রাকিসের রানি আলসিয়োনের স্বপ্নের অন্দর থেকে মিলিয়ে যায় সিয়েক্সের ছায়া। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে যায় আলসিয়োনের। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে। দাসীরা তার কান্নার আওয়াজ শুনে ঘরে এসে দেখে, হাহাকার আর বিলাপের ভেতরে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে শোকাগ্রস্ত আলসিয়োন দেয়ালে মাথা ঠুকছে; তার কপাল বেয়ে দরদর করে ঝরছে রক্ত; উন্মত্ততায় সে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলছে তার বসন, বুকের ওপরে সে হাত চাপড়াচ্ছে ক্রমাগত। কাঁদতে কাঁদতে সে বলছে, প্রিয়তম সিয়েক্সের মৃত্যুর পর আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে?

আমরা ভাবছিলাম, এটাই সত্য যে নাহরিন রেদওয়ানির মৃত স্বামী তৌফিক আলম মৃতদের ভূমি থেকে আর ফিরবে না। ১৯৭১ সালে পাবনার বড়াল ব্রিজের সম্মুখযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয় গেরিলাযোদ্ধা তৌফিক আলম,Ñআমাদের জেলাপাড়ার তৌফিক ভাই। রিট্রিটের সময় তৌফিক আলমের সহযোদ্ধারা তার লাশটা আর নিয়ে আসতে পারেনি। তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের চাইনিজ রাইফেল, এসএলআর এবং মেশিনগান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে হাজার হাজার গুলি ছুড়েছে।

স্কুলজীবন থেকেই নাহরিন রেদওয়ানি প্রেম করেছিল তৌফিক আলমের সঙ্গে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করার পরে তৎকালীন হাবিব ব্যাংকের পাবনা শাখায় যোগ দেয় তৌফিক আলম। তখনকার বাজারের মাপে ভালো চাকরি বলেই নাহরিন রেদওয়ানির পিতা-মাতা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গিয়েছিল তাদের বিয়েতে। সেটা ১৯৭০ সালের কথা। তখন এডওয়ার্ড কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে নাহরিন রেদওয়ানি।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে নগরবাড়ী ঘাটের পতন ঘটে। তারপর তৌফিক আলম তার বন্ধুদের সঙ্গে কুষ্টিয়া হয়ে ভারতে চলে যায় গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। নাহরিন রেদওয়ানি তাকে যেতে দিতে চায়নি। তৌফিক আলমকে নাহরিন রেদওয়ানি বলেছিল তাকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না একমুহূর্তও! তবু জোর করেই বাড়ি ছাড়ে তৌফিক আলম। যাওয়ার সময় সে নাহরিন রেদওয়ানিকে অভয় দেয় এই বলে যে, সে সাবধানে থাকবে, সর্বদাই যাতে করে শত্রুর হাতিয়ার তাকে কখনোই বিদীর্ণ করতে না পারে। কেঁদেছিল অনেক নাহরিন রেদওয়ানি; বলেছিল: জোড় ছাড়া জীবন কি মূল্যহীন নয়?

প্রিয়তম সিয়েক্সের মৃত্যুর পরে আমার আর বেঁচে থেকে কী লাভ হবে, বলো? এই বলে আলসিয়োন কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যাচ্ছে সাগরপাড়ে, যেখান থেকে এই কিছুদিন আগেই সে তার প্রিয়তমকে বিদায় দিয়েছিল। সাগরের ধারে আলুথালু হয়ে বসে সে যখন বিলাপ করছে, তখন সাগরে নিমজ্জিত সিয়েক্সের প্রাণশূন্য লাশটা সাগরবেলায় ফিরে আসে। দেবতারা সিয়েক্সের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিল। সবার লাশ তো আর স্বজনেরা ফিরে পায় না!

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ১৯৭১ সালে, আমরা বন্ধুরা কেউই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিইনি। তৎকালীন দালাল সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আয়োজন করলেও বাংলাদেশের বেশির ভাগ ছাত্রই তা বর্জন করে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে, ১৯৭২ সালে, আমরা জেলাপাড়ার বন্ধুরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, ভালো প্রস্তুতি নাÑথাকার ফলে টেনেটুনে পাস করি এবং আমরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে ভর্তি হয়ে যাই। আমি, নিনা আর বেবি এডওয়ার্ড কলেজেই থেকে যাই; বাবর পড়তে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে; আলাল ঢাকা মেডিকেল কলেজে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউসুফ। স্বামীর মৃত্যুর শোকে নাহরিন রেদওয়ানি তখন এতই মুহ্যমান ছিল যে সে আর আমাদের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিতে তার দুই বছর লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪-এ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে পারার শক্তি সঞ্চয় করতে পারে সে। মাঝারি মানের ফলাফল দিয়ে সে সহজেই ঢাকা অথবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনার্স কোর্সে ঢুকে যেতে পারত। কিন্তু সে ভাবে, এত হাঙ্গামার দরকার কী? দুই বছরে ডিগ্রি পাস করে সোজা কোনো একটা চাকরিতে ঢুকে পড়তে পারলেই হলো! দিনের পর দিন তো আর জজকোর্টের সেরেস্তাদার পিতার গলগ্রহ হয়ে থাকা যায় না!

বেবি, নিনা, নাহরিন ও আমি প্রতিদিন বিকেলে নাহরিনদের পুরোনো দোতলা বাসার চাতালে বসে গল্প করি; হাঁটাহাঁটি করি জেলাপাড়ার ভেতরের রাস্তায়। মৃত তৌফিক আলমের সঙ্গে তার স্মৃতি নিয়ে তখন কোনো আলাপই করে না নাহরিন রেদওয়ানি। তবু জোড়হারা একজন নারীর হাহাকার আমরা ঠিকই বুঝতে পারি এবং সে কারণে তাকে উজ্জীবিত রাখাটাই তখন আমাদের পরম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। নিজের মৃত সহোদরের কথা কখনো মনে পড়ে আমার। রাব্বি ভাই—আমার মেজদাÑশহীদ হয়েছে হিলি দখলের যুদ্ধে। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানে অনার্স পড়ত। আমি জানি, বেবিও তার সহোদরা টুসি আপার অকালমৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে যখন ঢাকা শহরে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালায় দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যরা, টুসি আপা তখন রোকেয়া হলেই ছিল। তারপর থেকে টুসি আপার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। কিংবা নিনার প্রেমিকÑআমাদের জেলাপাড়ার শাহিনের কথাই ধরা যাক। নগরবাড়ী ঘাটে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছিল গেরিলা শাহিন। শাহিনকে নৃশংসভাবে জবাই করেছিল রাজাকার আর পাকিস্তানি সৈন্যরা মিলে। যুদ্ধ শেষে বাবর ও ইউসুফ যখন ফিরে আসে, তাদের মুখে সে সময় আমরা শাহিন-হত্যার খবর পেয়েছিলাম। বাবর ও ইউসুফ একই গেরিলা দলের সদস্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া এসব ক্ষতি নিয়ে আমরাও কখনো কোনো আলোচনা করি না। আমরা কেবল এটুকু বুঝতে পারি যে মৃত স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো একটা উপায় আমাদের চাই।

সেই সময়ে নাহরিন রেদওয়ানি একটা বাইনোকুলার খুঁজেছিল। পাবনার মতো ছোট একটা শহরের দোকানগুলোতে যেসব বাইনোকুলার পাওয়া যেত, সেগুলোর রেঞ্জ ছিল বড়জোর তিরিশ গজ। গজ পঞ্চাশেক রেঞ্জের একটা বাইনোকুলার খুঁজছিল সে। কাজেই আমাদের বন্ধু ইউসুফ ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ষাট গজ রেঞ্জের একটা বাইনোকুলার কিনে এনে দিয়েছিল নাহরিন রেদওয়ানিকে। বাইনোকুলারটা নিয়ে নাহরিন রেদওয়ানি মাছরাঙা দেখতে নেমেছিল।

পরপর দুই বছর শরৎ ও বসস্তকালে সময় পেলেই মাছরাঙা দেখতে গেছি নাহরিন রেদওয়ানি আর আমি। আরিপপুর নামের এক শহরতলিতে পদ্মা নদীর একটা প্রশাখা তখনো জীবিত ছিল। ওটাই আমার বাপ-দাদার ভিটা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর ধারে বসে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে বিচিত্র রঙের মাছরাঙাদের পর্যবেক্ষণ করছে নাহরিন রেদওয়ানি, তার পাশে নিঃশব্দে বসে আছি আমি। নদীর ধারের গাছগুলোর ডালে, ঝোপঝাড়ের মাথায় চুপচাপ বসে থাকছে মাছরাঙারা মৎস্য শিকারের আশায়। সুযোগ পেলেই তারা ধীরগতিতে স্থির পানিতে ঝাঁপ দিয়ে লম্বা ঠোঁটে তুলে আনছে ছোট ছোট মাছ। তা ছাড়া তারা ঠুকরে খাচ্ছে পোকামাকড়, ফড়িং, কেঁচো, ব্যাঙ, সাপের ছানা ইত্যাদি। নদীর খাড়া পাড়ের গর্তগুলোতে একটু পরপর ঢুকেও পড়ছে মাছরাঙারা। তার পরের ঘটনাগুলো আমরা আর দেখতে পারছি না। কখনো তারা গাছের ডালে বসে অবিরাম পিউপিউ করে ডেকে চলেছে। নাহরিন রেদওয়ানি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মাছরাঙাদের সেই ডাক আমি চিনি কি না। আমি আসলেই জানতাম না তাদের সব আওয়াজের গূঢ় অর্থ। হাসতে হাসতে নাহরিন রেদওয়ানি তখন আমাকে বলেছিল, ‘বকুল, তুমি একটা আস্ত মূর্খ! ওরা জোড় খুঁজছে।’

এভাবে আমরা বাংলাদেশের মাছরাঙাদের চিনতে শুরু করি: পাতি মাছরাঙা, নীলকান মাছরাঙা, সাদাবুক মাছরাঙা, বাদামিডানা মাছরাঙা, লাল মাছরাঙা, মেঘ হও মাছরাঙা। এডওয়ার্ড কলেজের লাইব্রেরি থেকে একটা বই ধার করে এনে বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙাকে আমরা চিহ্নিত করি। নীলাভ সবুজ পিঠের মেঘ হও মাছরাঙাদের দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগে আমার। মাঝে মাঝে তারা ‘মেঘ হও, মেঘ হও’ বলে ডাকতে ডাকতে সঙ্গী খোঁজে। মানুষদের ভেতর একজন পুরুষ তো আর কোনো নারীকে এভাবে মেঘ হয়ে যেতে আমন্ত্রণ জানায় না! এদিকে নীল পিঠ আর কমলা বুকের ছোটখাটো পাতি মাছরাঙার প্রেমে পড়ে নাহরিন রেদওয়ানি। নীলের এত উজ্জ্বলতা আর কি দেখা যাবে কোথাও? তাই নাহরিন রেদওয়ানি আবারও ঘোষণা দেয়, সে আসলে পাতি মাছরাঙাতেই রূপান্তরিত হয়ে যেতে চায়।

একদিন মাছরাঙা দেখতে দেখতে আমাকে প্রশ্ন করে নাহরিন রেদওয়ানি: যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়, তাদের যদি অপঘাতে মৃত্যু না হয়ে থাকে, তবে কি তারা পাখি হয়ে যায়? অথবা একটা গগনশিরীষ? আকাশের তারা? এ জন্যই হয়তো নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আমরা আর আমাদের সাদাচোখে দেখতে পাই না! পদার্থবিজ্ঞান তো বলছেই যে বস্তুর কোনো ধ্বংস নেই,Ñএক রূপ থেকে আরেক রূপে বস্তুর রূপান্তর হয় মাত্র। মানবিক শাখার ছাত্রী বলে নাহরিন রেদওয়ানির সেই প্রশ্নের কোনো লাগসই উত্তর দিতে পারি না আমি। আমি বরং ভাবতে বসি আমার মৃত মেজদার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে? মৃতদের ভূমিতে যারা একবার চলে যায়, তাদের তো আর ফিরে আসতে দেখিনি কখনো! মেজদার সঙ্গে একটু দেখা করতে হলে আমাকেও কি তার মতো করে চলে যেতে হবে মৃতদের অন্ধকার এক ভূমিতে?

নাহরিন রেদওয়ানি আমাকে আবারও শোনায় গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি: সিয়েক্সের লাশটাকে যথাযথভাবে সৎকার করেছিল তার স্ত্রী আলসিয়োন। তারপর তার মন একবারেই শূন্য হয়ে যায় এবং উত্তাল সাগরে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেবে বলে। এমন করুণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে বিচলিত হয়ে পড়েন দেবতারা এবং আলসিয়োনের মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে তাঁরা আলসিয়োনকে সুন্দর একটা মাছরাঙা বানিয়ে দেন। মৃতদের ভূমি থেকে দেবতারা জাগিয়ে তোলেন সিয়েক্সকে এবং সিয়েক্সকেও তাঁরা সুন্দর একটা পুরুষ-মাছরাঙায় রূপান্তরিত করে ফেলেন।

রাজবাড়ীর জনৈক ডাক্তারের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। জোড়হারা নাহরিন রেদওয়ানি ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে এই ভেবে আমার মন সরে না। পাত্রপক্ষ যেদিন আমাকে মাপজোখ করে যায়, সেদিন রাতে আমি কথাটা নাহরিন রেদওয়ানির কাছে পাড়ি। সে খুব খুশি হয়। সে আমাকে বলে, ‘জোড় পেয়ে যাওয়াটা যে কী আনন্দের ঘটনা তা তো তুমি বুঝলেই না! যদি মনের মিল পড়ে যায় তাহলে তুমি দেখবে অকারণেই তোমার বাগানে হাজারটা ফুল ফুটতে থাকবে সকল সময়ে!’

পরের শরতে নাহরিন রেদওয়ানির সঙ্গে আমার আর মাছরাঙা দেখতে যাওয়া হয় না। নাহরিন রেদওয়ানির চিঠিতে আমি জানতে পারি, শ্মশানঘাটের কাছে ইছামতী নদীতে সে গিয়েছে মাছরাঙাদের খোঁজে। এবার তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আলাল ও নিনা। বরগুনা শহরের এক ভাড়া বাসায় শুয়েবসে সময় কাটাই আমি। চেম্বার থেকে কখন স্বামী ফিরবেন, সেই প্রতীক্ষা তো থাকেই এবং আমি খেলি বিছানায় শুয়ে ছোট ছোট হাত-পা নাড়তে থাকা আমার সন্তানের সঙ্গে। বিষণ্নও হই আমি, কেননা আমার স্বামীর সঙ্গে আমার মনের মিল পড়েনি। আমার বিয়ের আগে নাহরিন রেদওয়ানি এমন একটা আশঙ্কার কথা বলেছিল বটে।

ডিগ্রি পাস করে নাহরিন রেদওয়ানি পাবনা শহরের একটা বেসরকারি মধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ঢুকে যায়। স্বাধীনভাবে চলতে পারার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে নাহরিন রেদওয়ানিকে আমি দীর্ঘ একটা চিঠি লিখি। আমার হতাশা লক্ষ করে সে আমাকে উত্তর দেয়, ‘মানিয়ে নাও, বকুল!’

আরেকবার নাহরিন রেদওয়ানি আমাকে লেখে, ‘আজকাল আয়নাতে নিজেকে প্রায়শই দেখি আমি। নাহ্! ইচ্ছেশক্তির বলে তো আমার পিঠে পাতি মাছরাঙার মতো সুন্দর কোনো নীল ডানা গজাচ্ছে না! আমিই যদি মাছরাঙা হতে না পারি, তবে মৃতদের ভূমি থেকে কীভাবে পুনরুত্থান ঘটবে আমার জোড়ের? এই বিরহ তো আর আমি সহ্য করতে পারছি না! তৌফিককে আমি দেখিনি নয়-নয়টা বছর!’ আমি উত্তর দিই: সবুর করো।

বরগুনা থেকে আমি আমার জেলাপাড়ার বন্ধু আলাল, নিনা, বাবর, ইউসুফ আর বেবিকেও চিঠি লিখি। ইউসুফের চিঠিতে জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ইউসুফ দিনাজপুর সরকারি কলেজে পড়াতে ঢুকেছে। নাহরিন রেদওয়ানিকে একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখেছে ইউসুফ, যার সারমর্ম: ‘চলো, বিয়ে করে ফেলি। এভাবে কি সারা জীবন একাকী থাকবে তুমি?’ ইউসুফের প্রস্তাব শুনে আমি উল্লসিত হই: যাক! তবে মুখ ফুটে কথাটা বলতে পেরেছে ইউসুফ! কিন্তু নিনা আর বেবি আমাকে লেখে, ‘নাহরিন রেদওয়ানি বিয়েতে রাজি নয়। তুমি জলদি পাবনাতে আসো।’

এক বছরের একটু বেশি সময় পর পাবনাতে গিয়ে আমি দেখি, নাহরিন রেদওয়ানি—আমাদের জেলাপাড়ার সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে—স্বাস্থ্য হারিয়েছে: মিলিয়ে গেছে তার সুন্দর দেহবল্লরির খাঁজগুলো; কাটাকাটা মুখমণ্ডলে আয়ত চোখের নিচে কালি ধরেছে; ফুরিয়ে গেছে শ্যামবর্ণার ত্বকের উজ্জ্বলতা! তাই নাহরিন রেদওয়ানির ভবিষ্যৎ ভেবে আমি ব্যস্ত হয়ে যাই তাকে ইউসুফের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি করাতে। বেবি, নিনা আর আলালও আমার সঙ্গে যোগ দেয়। বিফল হই আমরা শেষতক। নাহরিন রেদওয়ানি উল্টো আমাদের বোঝায়: ইউসুফ তার বাল্যবন্ধু বলেই তাকে সে ঠকাতে পারবে না।

বেশ! তবে ইউসুফ ভিন্ন আর কারও সঙ্গে থাকা যায় নাকি? তাকে প্রশ্ন করি আমি।

‘না বকুল, যায় না। তোমরা বুঝতে পারছ না যে আমি মাছরাঙা হয়ে যেতে চাই!’

পাবনা শহর থেকে বরগুনা ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরে বেবির ট্রাঙ্ককল আসে। কাঁদতে কাঁদতে বেবি আমাকে জানায়, গেল প্রায় চার দিন ধরে সাতাশ বছর বয়সী নাহরিন রেদওয়ানি নিখোঁজ। পুলিশ এখনো তার কোনো খবর বের করতে পারেনি। বেবি আমাকে বলে, এক সকাল থেকে নাহরিন রেদওয়ানিকে আর দেখতে পায়নি তাদের বাসার মানুষেরা। শত ভাঁজে কুঁচকে আছে নাহরিন রেদওয়ানির বিছানার চাদরটা। বালিশ ফেটে বিছানায় ছড়িয়ে আছে অজস্র তুলো। কোলবালিশটা গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। আর এলোমেলো বিছানায় পড়ে আছে ছোট্ট একটা নীল পালক।

সূত্র: প্রথম আলো

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত