অহংকার

অহংকার
বিয়ের এক মাস পর নীলা বললো,’তোমার বোনটাকে বাড়ি থেকে বের করতে হবে।অন্যথায় আমিই তোমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া মানে তো বুঝোই? আমার নিজের পথ আমি দেখবো। তোমার সাথে আমার কাট কুট হয়ে যাবে আর কি!’
আমি তখন অফিসে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছি।সাদা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে দুটো বোতাম লাগিয়েছি মাত্র।এর মধ্যে এই কথাটা বললো নীলা।শুনে আমি চমকে উঠলাম।একটু নয় অনেক বেশিই চমকে উঠলাম।ভেবেও মিলাতে পারছিলাম না এটা আমার স্ত্রী নীলার মুখে বলা কথা।তাই এই কথাটা যে নীলার নয় আমার শোনা কোন ভ্রম তা পরীক্ষা করতে শার্টের বাকী বোতাম গুলো না লাগিয়েই নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম,’নীলা, তুমি তো আমায় কিছু বলোনি না?’
নীলা নাক মুখ এবং চোখ আগুন বর্ণ করে বললো,’আমি জানতাম এইসব কথা তোমার কান দিয়ে কোনদিন ঢুকবে না।মানে তুমি শোনেও না শোনার ভান করে থাকবে। কিন্তু আমি যে অত সরল সহজ কোন মেয়ে নয়। আমি অত ঝামেলা সহ্য করতে পারবো না। তোমার বোনকে আজকেই সাফ সাফ জানিয়ে দিবে তার নিজের পথটা যেন সে নিজে দেখে। এই বাড়িতে একসাথে আমি থাকতে পারবো না। আমরা আলাদা কোন বাড়ি নিবো।অথবা সে আলাদা বাড়ি নিবে। এখন তো আমার কথাটা শুনেছো না?’
তারপর নীলা হু হু করে হাসলো।ওর এই হাসিটা গতরাতের শেষ ভাগেও আমার কাছে জান্নাতের কোন সুগন্ধি ফুলের পাপড়ি দের হাসি ছিল। কিন্তু আজ এখন ওর হাসিটাকে মনে হচ্ছে ভয়ংকর কোন ডাইনি বুঝি আমার পাশে সোফায় বসে থেকে হাসছে।ওর যে ঘুমন্ত চেহারার দিকেও রাতের পর রাত তাকিয়ে থেকে আমি কাটিয়ে দিতে পারতাম সেই চেহারার দিকে এখন তাকাতেই আমার কেন জানি ভীষণ ভয় করছে। মনে হচ্ছে ওর চোখ,নাক এবং মুখ থেকে বের হয়ে আসছে বিষাক্ত কিছু সাপের ফণা। নীলাকে এখন আমি কী প্রতিউত্তর করবো বুঝতে পারছি না। কারণ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না নীলা আমার সাথে এমন করতে পারে।ওর সাথে আমার বিয়েটা ছিল প্রেমের পরিণতি।ওর বাবা আমার মতন বেকারের কাছে কোনদিন তার একমাত্র মেয়েকে তুলে দিতেন না। কিন্তু নীলা যে তার বাবাকে বলেছিলো,’নয়নকে না পেলে আমি সোইসাইড করবো।’
নীলার বাবা মেয়ের হুমকিতে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে। মাত্র এক মাস আগে নীলার সাথে আমার বিয়ে এবং তার বাবার অফিসে একটা মর্যাদা সম্পন্ন চাকরি আমার কপালে জুটে। বিয়ের পর থেকে এই এক মাস বাড়ির সবার সাথে নীলার ব্যবহার ছিল অতি অমায়িক। আমার বিধবা বড় বোন জয়নাবকে সে ডাকতো বুবু বলে।জায়নাবের তিন বছরের মেয়ে নোরা ছিল তার সার্বক্ষণিক খেলার সঙ্গী।ওর সাথে পুতুল বিয়ে খেলতো নীলা।নোরা ডাকতো ওকে মাম বলে। কেন জানি নীলাকে ও মামি বলে ডাকতো না। এতকিছুর পরেও কেন হঠাৎ এমন করলো নীলা! আমি ঠিক করলাম আজ আমি অফিসে যাবো না।তাই শার্টটা গা থেকে খুলে আলনায় রেখে সোফায় ওর পাশে বসলাম আমি। বসে বললাম,’আপু তোমায় কিছু বলেছে?’ নীলা মুখ কালো করে বললো,’আমি তোমার কাছে কোন ইন্টারভ্যু দিতে পারবো না। সোজাসাপ্টা কথা বুঝো না তুমি।বলছি, তোমার আপুর সাথে এক বাড়িতে আমি থাকতে পারবো না।’ ‘কেন থাকতে পারবে না?’
নীলা এবার প্রচন্ড রেগে গেল।তার হাতে যে টিভির রিমোটটা ছিল তাই ছুড়ে মারলো সামনের কাঁচের জানালায়। সঙ্গে সঙ্গে জানালার কাঁচের খানিক অংশ ঝনাৎ করে ভেঙে পড়লো নিচে। জানালার কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনে দৌড়ে আমাদের রুমে এলো আপু।তার পেছন পেছন এলো নোরা। আপু এসেই অস্হির হয়ে বললো,’কী হয়েছে নীলা, কাঁচ টাচ ভাঙলো মনে হলো?’ নীলা তার কথার কোন উত্তর দিল না।সে সোফায় বসে রাগে ফুঁসতে লাগলো।আপু তখন নীলার কাছে এসে ওর একটা হাত ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’তোরা কী ঝগড়া করেছিস?’ নীলা সঙ্গে সঙ্গে আপুর কাছ থেকে এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।
আপু কিছুই বুঝতে পারছে না।সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল নীলার দিকে। এই সময় নোরা মাম মাম বলে দৌড়ে এসে নীলার কোলে বসতে চাইলো। নীলা সঙ্গে সঙ্গে একটা চড় খসিয়ে দিল নোরার গালে। তারপর নিজের হাতেই নীলা ওকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,’ডিসগাসটিং!’ দুপুরে ঘরে কোন রান্নাবান্না হয়নি। আপুর কাছে জিজ্ঞেস করে নীলার সাথে তার কোন সমস্যা হয়েছে এমন কিছুও জানতে পারিনি। আপুও বড় অবাক হয়েছে।সেও ভাবতে পারছে না নীলা কেন এমন করছে।নোরা আমায় জাপটে ধরে কতক্ষণ কেঁদে কেঁদে বলেছে,’মাম আমায় মেরেছে।মাম আমায় মেরেছে!’ আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে আদর করে বলেছি,মামের কাছে এখন আর যেও না কেমন।ওর যে অসুখ! অসুখ কমলে মাম নিজেই তোমায় ডেকে কাছে নিয়ে আদর করবে।’
রাতের বেলা আপু রান্না করে নীলাকে ডেকেছে খাওয়ার জন্য। নীলা আপুর ডাকের কোন সাড়া দেয়নি।এর পরদিন আমি অফিসে যাওয়ার পর নীলা আমায় কোন কিছু না জানিয়ে ওর বাবার বাড়ি চলে গেছে। সন্ধ্যা বেলায় অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি নীলা বাসায় নেই। তারপর আপুকে জিজ্ঞেস করলে আপু বললো,’ও তো ব্যাগ টেগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলেও আমায় কিছু বলেনি। আমার সাথে কোন কথাই বলেনি।’
আপু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে কথাগুলো বললো। আমি নীলাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’তুমি কোথায় আছো?’
নীলা বললো,’জাহান্নামে।’
আমি বললাম,’তুমি কী সুন্দর করে কথা বলতে পারো না?’ নীলা ও পাশ থেকে হেসে ফেললো। হেসে বললো,’না আমি সুন্দর করে কথা বলতে পারি না। সুন্দর করে কথা বলতে পারে তোমার বোন। এখন থেকে রাত দিন ওর কথায় শোন।’ ‘আচ্ছা তুমি এমন করছো কেন?ও তো অসহায়!বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমি আর ও ছাড়া আমাদের আর কেউ নাই।নোরার বাবাটাও মারা গেছে।ওরা আমায় ছেড়ে আর কোথায় যাবে বলো?’ নীলা হেসে বললো,’যেতে বলেছে কে!তোমরা একসাথেই থাকো।’ ‘আর তুমি?’ আমি আমার পথ দেখছি। তোমার বোন প্রয়োজন,বউ না!’ ‘ছিঃ! এমন করে বলছো কেন নীলা?’
সাথে সাথেই ও পাশ থেকে ফোনের সুইচ অফ করে ফেললো নীলা। আমি অনেক চেষ্টা করেও আর ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না।আপু এতোক্ষণ আমার রুমেই ছিল।সে আমাদের কথোপকথন শুনে সবকিছুই বুঝতে পেরেছে।ফোন কেটে দিয়ে আমি যখন ক্লান্ত মানুষদের মতো চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলাম তখন আপু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি অস্হির হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আপু কাঁদতে কাঁদতে বললো,’নয়ন, আমার জন্য তোদের সংসার ভাঙুক আমি তা চাই না রে ভাই! আমার শরীরে এখনও শক্তি সামর্থ্য আছে। কোথাও না কোথাও ঠিক আমি কাজ মিলিয়ে নিতে পারবো ভাই।কাজ করে টাকা হলে থাকার জায়গারও অভাব হবে না।’
আপুর কান্নার সাথে সাথে আমারও কেমন কান্না এসে গেছে। আমার সবকিছু মনে পড়ছে। ছোট বেলায় যখন মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে কাঁচ বিঁধিয়ে আমার পা কেটে ফেলেছিলাম তখন আপুর কী কান্না! কাঁদতে কাঁদতে ও প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো। আম্মা যখন মারা যাবেন তখন তিনি বলে গিয়েছিলেন,’আমি না থাকলে কী হলো তোর তো বোন আছে। আমার জন্য দুঃখ করিস না বাবা।বোনেরাই তো মায়ের ছায়া নিয়ে বড় হয়।মা মরে গেলে বোনেদের কাছ থেকেই ভাইয়েরা মায়ের ছায়া নেয়।’ আমার গলা ভেঙ্গে কান্না আসছে। আমি কাঁদছি। কিছুতেই আপুকে ছেড়ে আমার থাকা সম্ভব নয়।প্রয়োজনে এমন অহংকারী নীলা কিংবা তার বাবার অফিসের চাকরি দুটোই ছেড়ে দিতে পারি আমি। আমার কোন চাকরি না জুটুক।দিন মজুরের কাজ করে হলেও বোনের ছায়ায় মায়ায় থাকতে চাই আমি। তিনদিন পর নীলার বাবার অফিসে রিজাইন লেটার পাঠিয়েছি আমি। আর সাথে একটা চিঠি। সেই চিঠিতে লিখা, আপনার অহংকারী মেয়ের সাথে সংসার করা থেকে অব্যাহতি নিতে চাই আমি।’
সন্ধ্যার পর নোরার সাথে বসে গল্প করছি আমি ঠিক তখন কলিং বেলে কেউ চাপলো।পর পর তিনবার।নোরাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে আমি দ্রুত পায়ে গিয়ে দরজা খুলেই অবাক হলাম। নীলার বাবা এসেছেন। সাথে নীলাও। আমি বাবাকে সালাম দিয়ে বললাম ঘরে আসতে। কিন্তু তিনি ঘরে আসবেন না। তিনি বললেন আপুকে ডাকতে। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম তখন। না জানি তিনি আমার বোনকে অপমান করেন আবার! তাই ভয়ে ভয়ে আমি আপুকে ডাকলাম।আপু এসেই মাথায় কাপড় দিয়ে সালাম দিলো বাবাকে। তারপর ঘরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। কিন্তু তিনি ঘরে গেলেন না। তিনি রাগত স্বরে নীলাকে বললেন,’জায়নাবের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইবে তুমি।ও যতক্ষণ ক্ষমা না করবে ততক্ষণ পা ধরেই বসে থাকবে।’ বাবার কথার সাথে সাথেই নীলা আপুর পায়ে পড়ে গেছে।আপু লজ্জায় তার পা সড়িয়ে নিয়ে নীলাকে টেনে বুকে নিয়ে বললো,’তুমি না আমার বোন। বোনেরা তো বোনেদের পায়ে থাকে না, থাকে বুকে।’ নীলা কাঁদছে। আপুর বুকে থেকে সে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,’সরি বুবু!বুবু আমার ভুল হয়ে গেছে।আমায় মাফ করে দিন প্লিজ!’
বাবা তখন মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’নীলা, তুমি যে তোমার বাবার অর্থবিত্তের অহংকারে তোমার স্বামী কিংবা তার বোনকে এতোটা অপমান করেছো, তাদের ছেড়ে পর্যন্ত চলে গেছো এই অর্থবিত্ত কিন্তু তোমার বাবার একদিন ছিল না।সে ছিল অসহায় এক মানুষ।কুলির কাজও করেছে তোমার এই বাবা।এতো কষ্টের পরেই আল্লাহ তাকে বড় করেছেন। সুতরাং অহংকারের বশে যদি তোমার ঘৃণা হয়ই তবে সর্বপ্রথম আমাকেই ত্যাগ করতে হবে তোমার। কারণ ওদের চেয়েও আমি ছোটলোক।’ কথাগুলো বলতে বলতে বাবার চোখে জল জমে গেছে। তিনি এবার আমায় কাছে টেনে নিলেন। তারপর আমার পিঠে হাত চাপড়ে দিয়ে বললেন,’উত্তম পুরুষ। কিন্তু তোমার চাকরিটা তুমি আবার করবে। কারণ চাকরিটা তোমায় দয়া করে আমি দেইনি।চাকরি পেয়েছো তোমার যোগ্যতায়।’
বাবা ওখান থেকেই চলে গেছেন।তার অনেক তাড়া।নীলা ঘরে প্রবেশ করেছে। কারণ তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। মানুষ তার ভুল বুঝলে তাকে মাফ করে দিতে হয়। নীলা ঘরে প্রবেশ করেই নোরাকে ডাকলো।নোরা ডাক শুনে দৌড়ে মাম মাম বলে এসে তার কোলে বসলো।কোলে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’মামা,মামের কী অসুখ কমে গেছে?’ আমি মৃদু হেসে বললাম,’হ্যা মামনি, তোমার মামের অসুখ এখন কমে গেছে।’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত