যখন থেকে শুনেছি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বিয়ে ভাঙার জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার প্রেমিক নেহালকে ব্যাপারটা বলতে পারছি না। সদ্য একটা বেসরকারি চাকরিতে জয়েন করেছে। বেতন এতটাও বেশি না যাতে সংসার চলবে। ভাগ্যিস ওর বাবা এখনও রিটায়ার্ড করেন নি। তাই বাবা ছেলের আয়ে সংসার ভালোভাবে চলছে। নেহাল আরেকটু ভালো চাকরিতে জয়েন করার চেষ্টা করছে।
ওর বর্তমান যা অবস্থা তাতে আমার বাবা ওর সাথে আমার বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। তাই বাবাকে ওর কথা বলতে পারছি না। আবার ওকে এই কথা জানালে বেচারা পাগল হয়ে যাবে। না না, ওকে এতটা প্রেসার দেওয়া ঠিক হবে না। আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। সেদিন ইউটিউব আর গুগলে মৃগী রোগীদের লক্ষণ দেখলাম। তারপর শুরু করলাম মৃগী রোগীর অভিনয়। প্রথমে বিষয়টা কেউ আমলে নেয় নি। দুই তিন দিন অভিনয় করার পর বাড়ির সবাই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো আমাকে। ডাক্তার লক্ষণ শুনে ওষুধ দিলেন। আর আমাকে চোখে চোখে রাখতে বললেন। ফলাফলস্বরূপ পড়লাম বিপদে।
এখন আমাকে রাতে একা ঘুমাতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি কারও সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে পারি না। দোষটা অন্য কারো নয়, আমারই। ঘুমের মধ্যে আমি এত বেশি হাত পা ছোড়াছুড়ি করি যে আমার পাশে যে থাকে সে প্রায় ক্ষত বিক্ষত হবার উপক্রম হয়। তাই আমি একা ঘুমাই, আর এখন তো একা ঘুমানোর এমন অভ্যাস হয়েছে যে কারও সাথে ঘুমালে আমারই ঘুম আসে না। কিন্তু এখন? আমার রুমে মা অথবা ছোটবোনটা ঘুমাচ্ছে। আমার বিছানায় না, মেঝেতে বিছানা করে ওরা ঘুমাচ্ছে। মা থাকলে তো সারারাত ঘুমানই না। একটু পর পর চেক করেন আমার কোন সমস্যা হল কি না। ফলে নেহালের সাথে কথা বলতে পারছি না। সারাদিন কেউ না কেউ সাথে থাকছে, রাতেও। কিভাবে কথা বলব? এর চেয়ে তো নেহালের সাথে পালিয়ে গেলেই ভালো করতাম।
– মা, একটা কথা ছিল
– বল মা
– যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আর তার পরিবার কি জানে যে আমার মৃগী অসুখ হয়েছে?
– তোর কি মাথা খারাপ? এই কথা বললে বিয়েটা হবে?
– ওদের কাছে এত বড় কথা লুকাবে?
– অনেক সময় ভালো কিছুর জন্য খারাপ কিছু লুকাতে হয়
– কিন্তু বিয়ের পর যখন জানতে পারবে তখন?
– একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর কিছু করতে পারবে না
– এটা ঠিক হবে না মা
– তুই চুপ থাক তো। আমাদের চেয়ে বেশি বুঝিস? নাহ, প্ল্যানটা কাজ করলো না। এবার কি করা যাবে? বান্ধবিকে কল দিলাম।
– তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে
– কি কথা?
– ফোনে বলা যাবে না। মেসেঞ্জারে আয়
– আজব তো! কল দিয়ে আবার বলছিস ফোনে বলা যাবে না?
– আহা তুই মেসেজ চেক কর। ওখানে বলছি।
– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।
বান্ধবিকে মেসেজে সব বুঝিয়ে বললাম। আরেকটা প্ল্যান করেছি। যদি লেগে যায়, আমার বিয়ে দেবে সেই সাধ্যি কার? খুশিতে ড্যান্স দিতে লাগলাম। সন্ধ্যায় বান্ধবি আম্মুকে কল দিলো,
– হ্যালো কে বলছেন?
– আন্টি আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।
– কিভাবে চিনো?
– নিসার কাছে আপনার অনেক ছবি দেখেছি।
– আমার মেয়ের কাছে আমার ছবি তো থাকবেই। তো মা তুমি কি ওর বান্ধবি?
– জি আন্টি শুধু বান্ধবি না, তার চেয়েও বেশি কিছু
– ও আচ্ছা, বুঝেছি। বেস্ট ফ্রেন্ড তাই তো?
– আন্টি তার থেকেও বেশি।
– ও আচ্ছা, মানে অনেক ভাল বন্ধুত্ব তাই তো? অনেক ভালোবাসো তোমরা একে অপরকে?
– জি আন্টি এই তো বুঝেছেন। আমরা একে অপরকে এতটাই ভালোবাসি যে আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– সে তো খুব ভালো। নিসার বিয়ে তো ঠিক করেই ফেললাম। তো মা, তোমার বিয়ে কবে?
– আন্টি আপনি বুঝেন নি। আমি আর নিসা একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি
– কি??? ফাজলামি করছো বেয়াদব মেয়ে?
– ছি ছি আন্টি ফাজলামি করবো কেন? আমরা একে অপরকে খুব বেশি ভালোবাসি আমরা ঠিক করেছি আমরা বিয়ে করবো, সংসার করবো। আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।
– বেয়াদব মেয়ে। কি যা তা বলছো। আমার মেয়ের এমন কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া ও একটা ছেলেকে ভালোবাসে।
– আন্টি আপনার মেয়ে আর আপনিই জানেন না যে ও লেস***? আমরা বিয়ে করবো খুব শীঘ্রই। কেউ আমাদের ভালোবাসায় বাধা দিতে পারবে না। আমরা এক হবই।
– স্টুপিড মেয়ে কোথাকার। ফোন রাখো।
মা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। বান্ধবি আমার অভিনয়ে সেরা, ঠিক আমার মত। ওর নিঁখুত অভিনয়ে মা বিশ্বাস করেই নিয়েছেন যে আমি লেস বাবার সাথে রাতে খাবার পর মা আলোচনায় বসলেন। আমি দরজার আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করছি।
– এখন কি হবে গো?
– আরে তুমি ওই মেয়েটার কথা বিশ্বাস করছো?
– মেয়েটার কথা শুনে মিথ্যা মনে হয় নি। যদি সত্যি হয় তাহলে কে বিয়ে করবে আমার মেয়েকে?
– কথাটা জানাজানি হওয়ার আগেই নিসার বিয়ে দিতে হবে। বিয়ের তারিখ এগিয়ে নিয়ে আসবো। ওদের বলব বিয়ে সামনের মাসে না, এই মাসেই হবে।
– কিন্তু ওরা মানবে তো?
– সে আমি বুঝবো। তুমি তোমার মেয়ের খেয়াল রাখো। ওর ফোনটা নিয়ে নাও। ফোনে যেন কারও সাথে কথা বলতে না পারে। আর সারাক্ষণ ওর সাথে কেউ না কেউ থাকবে। খুব কড়া নজর রাখবে। কোন রকম উল্টা পাল্টা যেন না করতে পারে। আর যাই কোথায়? আগে তো মেসেজে বান্ধবির সাথে কথা হচ্ছিলো। এখন ফোনটাও কাছে নেই। প্রথমে ফোনটা খোলা থাকলেও যখন মা দেখলেন বান্ধবিরা বারবার ফোন দিচ্ছে উনি ফোনটা বন্ধ করে রাখলেন। কোনভাবেই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। নেহাল বেচারার কি অবস্থা কে জানে! যে পাগল! না জানি কত ছটফট করছে কথা বলতে না পেরে।
বিয়ের আর তিনদিন বাকি। এবার নতুন বুদ্ধি আটলাম। পাগলের অভিনয় করতে শুরু করলাম। একা একা জোরে জোরে হাসি, আবার কান্না করি। মেঝেতে গড়াগড়ি দেই। কাগজ, টিস্যু চিবিয়ে খাচ্ছি। ফ্লোরে পানি ফেলে তারপর উপর খেলা করি। নিজের চুল ছিড়ছি। লিপস্টিক সারা মুখে মেখে ভূত সেজে ঘুরছি। রাতের বেলা হো হো করে হেসে আবার সাথে সাথে কান্না শুরু করছি। সবাই তো অবাক। বাবা মা ধরেই নিয়েছেন যে আমি আমার লেস**** প্রেমিকার শোকে পাগল হয়ে গিয়েছি। ওনারা শুধু অপেক্ষা করছেন বিয়ের দিনটা কবে আসবে। আমার বিয়ে হয়ে গেলেই হয়তো আমি ঠিক হয়ে যাবো। আজ বিয়ে। আমাকে সাজানো হচ্ছে। যতবার সাজানো হচ্ছে পাগলামির অভিনয় করে ততবারই মেকাপ নষ্ট করছি। অনেকবার চেষ্টা করেও যখন দেখলাম আমাকে সাজানো বন্ধ হচ্ছে না তখন রাগ করে পাগলামি করা বন্ধ করে চুপচাপ সাজাতে দিলাম। বরপক্ষ চলে এসেছে। সব মিলে বিশ জনের মত এসেছে ওরা। আর আমাদের পরিবারের সদস্যরা। আমাকে ঘোমটা দিয়ে বরের পাশে নিয়ে বসানো হল। এত রাগ হচ্ছে কি বলবো।
মোবাইলটা এখনও আমার হাতে আসে নি। নেহালকে একবার জানাতে পর্যন্ত পারলাম না যে আমি অন্য কারও হয়ে যাচ্ছি সারাজীবন এর জন্য। না জানি কত অভিশাপ দেবে ছেলেটা আমাকে। অনেক বেশি ভালোবাসে নেহাল আমাকে। মাথা নিচু করে বসে আছি। আধ হাত ঘোমটা টানা। আমার ছোটবোন সামনে একটা আয়না রেখে বললো, “দেখো তো আপু, তোমার বরটা কত হ্যান্ডসাম”। গা জ্বলে যাচ্ছে ওর কথা শুনে। একে তো জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। তার উপর আবার আদিখ্যেতা। বরের দিকে তাকালামই না। হবু বর পাশ থেকে একটা ধাক্কা দিলো। এবার খুব রাগ হলো। আয়নায় হবু বরের দিকে কটমট চোখে তাকালাম। দেখে তো আমি অবাক। নেহাল!! ঘোমটা ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বরপক্ষের লোকজন আর আমার পরিবারের সবাই তাকিয়ে পড়লো। এভাবে ঘোমটা ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম কেন?
– মা, তুমি আমাকে বলবে না যে নেহালের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছো?
– প্রথমে ভেবেছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দেবো। কিন্তু পরে তোর অসুস্থতা আর সবকিছু দেখে ভাবলাম….
– একবার বললেই পারতে যে নেহালের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। তাহলে এত কষ্ট করে বিয়ে ভাঙার জন্য মৃগী রোগী, লেস***** আর পাগলামির অভিনয়গুলো করতে হতো না। সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আর আমি ভাবছি বিয়ের দিনও হয়ত মায়ের খুন্তি আর ঝাড়ু থেকে রেহাই পাবো না।
গল্পের বিষয়:
গল্প