মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে । হাসিটায় অসম্ভব মায়া জড়ানো । আজকে দেখতেই হবে মেয়েটা কে ! কাবীর সেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করে ছুটছে । প্রাণপণে ছুটেও মেয়েটার কাছে পৌঁছাতে পারছে না । এক পর্যায়ে হাসতে হাসতেই অন্ধকারে মিশে যায় মেয়েটি । হুড়মুড় করে জেগে উঠলো কাবীর । ঘড়িতে রাত আড়াইটা দেখাচ্ছে । জোড়ে জোড়ে শ্বাস চলছে । মাথার উপর ফ্যান বিরক্তিকর কট কট আওয়াজে ঘুরছে । তবুও শরীর ঘেমে একাকার হয়ে আছে ।
হ্যাঁ, ঠিকই আছে, আজকেও সেই একই স্বপ্ন। আজো মেয়েটাকে চিনতে পারলাম না । কে এই রহস্যময়ী ? বার বার কাছাকাছি এসেও ধরা দিচ্ছে না । আর আমিই বা কেনো তার হাসির মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি ? এইসব ভাবতে ভাবতেই কাবীর পুনরায় বিছানায় গা এলিয়ে দিলো । ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার লহরী একটা ছোট্ট গ্রাম । এই গ্রামেই কাবীর তার মা কে নিয়ে বসবাস করে । পৈতৃক জমিজমা না থাকায় বাবার মৃত্যুর পর কাবীরের মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায় । কাবীর অনেক কষ্টে এসএসসি পাশ করে । ভালো ছাত্র না হওয়ায় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় । প্রায় চার পাঁচ বছর যাবৎ কাবীরও মানুষের জমিতে চাষার কাজ করে পরিবারের ভরনপোষণে কিছু অর্থ জোগান দিচ্ছে । তিন ভাই, মা সহ দুই বোনের এতো বড় পরিবারে এই অল্প অর্থে কিছুই হচ্ছে না ।খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিন পার করতে হচ্ছে ।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সুসংবাদ এলো কাবীরের ঘরে । তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বিদেশে থাকে । ওনি কাবীরের মাকে ফোন করে বললো, “খুব ভালো একটা ভিসা আছে । কাবীর যেতে পারলে মোটা টাকা ইনকাম করতে পারবে । সব কিছুর জন্য মোটামুটি লাখ পাঁচেকের মতো খরচ হতে পারে । যদি তোমরা চাও তবে আমি লাখ দেড়েকের মতো সাহায্য করতে পারি । তোমরা আমার আত্মীয় তাই নিজে থেকে বললাম । অন্য কেউ হলে অনায়াসে এই ভিসা দিয়ে দেড় দুই লাখ টাকা ইনকাম করতে পারতাম ।আমি তোমাদের আর কষ্টে দেখতে চাই না ।সুখে শান্তিতে জীবন কাটিয়ে কয়টা ডাল ভাত খেয়ে মরতে পারো এটাই চাই ।” কাবীরের মার চোখে পানি এসে গেলো । এই বুঝি আল্লাহ তাদের দিকে চোখ তুলে তাকালো । তবে আরেকটা দিক মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো । দেড় লাখ টাকা পাওয়া গেলেও বাকি সাড়ে তিন লাখ টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে ? নুন আনতে যেখানে পান্তা ফুরোয় সেখানে সাড়ে তিন লাখ টাকা আকাশ সমান ।
ব্যাপার টা কাবীরের মা কাবীরকে জানালে খুশির থেকে মন খারাপ ই বেশি করলো ।রাতে ঘুমাতে গেলো । স্বপ্নে আবার সেই মেয়েটি । আজকে হাসছে না । হাটুর ভাঁজে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কপাল হাটুতে ঠেকিয়ে রাখলো । বুঝা যাচ্ছে তার মন খারাপ । কাবীরেরও মনটা খারাপ হয়ে গেলো । মেয়েটা আর দূরে সরে যাচ্ছে না । কাবীর কাছে গিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটা মাথা না তুলেই হাত দিয়ে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো । একটা চিঠি । কাবীর চিঠির লেখাটা পড়তে আরম্ভ করলো, প্রিয় কাবীর, জানো ! তুমি চলে গেলে আমার কতো কষ্ট হবে ? আমি অনেক কান্না করবো । তবুও তোমার ভালোর জন্য আমি সব সহ্য করে নেবো । আমি জানি তোমার অনেক টাকার প্রয়োজন । তোমার জন্য আমি ছোটো একটা ব্যবস্থা করেছি । আশা ত্রান ও কল্যান তাহবিল থেকে লটারির মাধ্যমে একটা বিশেষ অর্থ প্রদান করা হবে । তুমি সেখানে আবেদন করো । বাকিটা আমি দেখবো । ভালো থেকো ।
ইতি
তোমার রহস্যময়ী চিঠিটা পড়া শেষ হতেই কাবীরের ঘুম ভেঙে গেলো । মনে মনে একটা ভয় শুরু হলো ।এটা কি হচ্ছে ? আসলেই এই রহস্যময়ী আমার জন্য টাকার ব্যবস্থা করতে পারবে ?নানান ভাবনা মাথায় ঘুরতে লাগলো । সারা রাত আর ঘুমাতে পারেনি কাবীর।সকালে উঠেই কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলো আশা ত্রান ও কল্যান তহবিল অফিসে। আবেদন করলে জানিয়ে দেওয়া হলো পনেরো দিন পর ফলাফল দেয়া হবে। কাবীর দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরলো।ব্যাপারটা কাউকে জানালো না। পনেরো দিন পরে, কাবীর ত্রান অফিসে গিয়ে যা শুনলো তাতে যেনো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো ।কাবীর সেই ত্রানের পক্ষ থেকে প্রথম পুরষ্কার সাড়ে চার লক্ষ টাকা পেয়েছে ।কাবীর খুশিতে কেঁদে ফেললো । মনে মনে সেই রহস্যময়ীকে ধন্যবাদ দিতে লাগলো ।
কাবীর রাতে ঘুমালে মেয়েটি স্বপ্নে দেখা দিলো । মেয়েটি অন্ধকারে লুকিয়ে আছে । চেহারা অস্পষ্ট । মুচকি হাসতে লাগলো । জোর করে হাসলেও মুখে একটা বিষাদের ছাপ লেগে আছে মেয়েটির । কাবীর সেটা বুঝতে পারলো । কাবীর মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিলে সে ঘাড় ফিরিয়ে দৌড়ে কোথায় হারিয়ে গেলো। মাস খানেকের মধ্যে সব ব্যবস্থা হলো । পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা করতে কিছুটাকা ব্যয় হলো । পরের মাসের তেরো তারিখ রাত দশটায় ফ্লাইট । ফ্লাইটের আগের দিন রাতে আবারো স্বপ্নে দেখা দিলো মেয়েটি । আজ অঝোর ধারায় কান্না করছে । মেয়েটার হাসি ব্যতীত কান্নাও দেখতে হবে এটা কখনো ভাবে নি কাবীর । মেয়েটার কান্না দেখে কাবীরও ডুকরে কেঁদে উঠলো । কান্না জড়িত কন্ঠেই কাবীর জিজ্ঞাসা করলো
“আপনি আর আমাকে দেখা দিবেন না?”
“না, তোমার সাথে যাওয়ার আমার উপায় নেই।”
“কিন্তু কেনো ? আমার তো আপনাকে ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছে না ।”
মেয়েটি কান্না বাড়িয়ে দিলো।আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
“আপনার নামটা জানতে ইচ্ছে করছে ।”
“নিরা”
“আজো কি আধারে রয়ে যাবেন ? দেখা দেবেন না আমায় ?”
মেয়েটা আস্তে আস্তে আলোয় আসতে লাগলো । কি অপূর্ব মায়াবী চেহারা । এই চেহারার দিকে তাকিয়ে যেনো হাজার বছর কাটিয়ে দেয়া যায় । প্রয়োজনের তাগিদে শিকড় ছিঁড়ে চলে যেতে হবে, তা যেনো মানতেই পারছে না কাবীর । সকালে ঢাকার উদ্দেশ্য বাড়ি ছাড়লো কাবীর । বাড়ির সবাইকে ছেড়ে যেতে যতোটা না কষ্ট হচ্ছে তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে । বাধ্য হয়েই ভুলার চেষ্টা করলো সে ।
রাত ন’টার দিকে এয়ারপোর্টের ভিতর ঢুকে গেলো কাবীর । মানুষজনের গুনগুন আওয়াজে এয়ারপোর্ট মুখরিত হয়ে আছে । এর মধ্যেই কাবীর হঠাৎ শুনতে পেলো কে যেনো তাকে পিছন থেকে ডাকছে । কাবীর কান খাড়া করে রাখলো । আবার ডাকশুনতে পেলো, “কাবীর, কাবীর এমন মায়াভরা মুখে কখনো কাবীরকে কেউ ডাকেনি । এটা তো সেই মেয়েটির কণ্ঠ । কাবীর একটু থমকে দাঁড়ালো । চারদিকে চোখ ঘুরালো । এমন কাউকে দেখতে না পেলো না । হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো কাবীর । এক এক করে মেয়েদের সাথে কথা বলতে লাগলো । ফ্লাইটের কথা যতোক্ষনে স্বরন হলো ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ফ্লাইট ছেড়ে দিয়েছে। কাবীর মনে মনে হতাশ হলো । এতোগুলো টাকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা অদৃশ্য ডাকের জন্য ফ্লাইট মিস হলো ! এই মুখ বাড়িতে কিভাবে দেখাবে ! চোখের সামনে মা, ভাই বোনের অসহায় চেহারাটা ফুটে উঠলো কাবীরের । এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তার উপর এসে দাঁড়ালো কাবীর ।
পরের দিন সকালে কাবীরের সেই আত্মীয় কাবীরের মাকে ফোন করে টিভিতে খবর দেখতে বলে, কাবীরের মা সকাল নটার সংবাদ দেখতে বসেছে । নয়টার সংবাদে খবর পড়ছে এক মহিলা, “গতকাল রাত দশটার ফ্লাইটের বিমানটি ঝড়ের কবলে পড়ে ধ্বংস হয় । এতে বিমানের পাইলট, কো-পাইলট সহ সকল যাত্রী নিহত হয় ।” খবর পুরোটা শুনতে পারলো না । একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো কাবীরের মা । বাড়িতে একটা মৃত্যুর শোক নেমে এলো । বিকেলের দিকে কাবীর বাড়ি ফিরলে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো । কাবীর পুরো ঘটনা শুনালে কাবীরের মা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া প্রকাশ করলো । রাতে কাবীর ঘুমিয়ে আছে । স্বপ্নে মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে । কি মায়াভরা হাসি !
গল্পের বিষয়:
গল্প