গালিব সেদিন এক দল মুসল্লির সাথে আসর নামাজের জামাতে শামিল হয়েছিল। সে লক্ষ্য করে, নামাজরত অবস্থায়ই দু’একজন প্রার্থনাকারী অহেতুক এবং অনাবশ্যকভাবে সরবে বলতে থাকে, ‘হায় বাবা. হেই বাবা, আমার দয়াল বাবা’ এরূপ নানা রকম নিরর্থক শব্দ, যা তাকে রীতিমতো কিছুক্ষণের জন্য চিন্তান্ব্বিত ও বিস্ময়াভিভূত করে তোলে। ছোটবেলা থেকেই নামাজ সম্পর্কে তার কিছুটা ধারণা রয়েছে। নামাজ অল্প-স্বল্প বোঝে কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। সে যেমন উগ্রবাদী ইসলামিক গ্রুপকে ভীষণ অপছন্দ করে; তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতিও রয়েছে তার সমান সহানুভূতি। তার মতে, আইএসসহ অন্যান্য উগ্রবাদী ইসলামী দল ইসলাম বোঝেই না। তার অভিমত- যে ব্যক্তি যে ধর্মই পালন করুক- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
ব্যক্তিগতভাবে গালিবের পৃথিবীর বহু দেশ সফর করার সুযোগ হয়েছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার অনেক দেশ এমনকি মার্কিন মুলুকের মসজিদে উপাসনা করারও সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু কোনো দেশেই এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। ফলে আচম্বিতে এমন নিমিত্ত দেখে সে একেবারে হতবিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
এই মহানগর ঢাকা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার পূর্বাচলে এক দেহাতি শহরে গালিব সেদিন বেড়াতে গিয়েছিল। তার বিশিষ্ট বন্ধু সেলিমের বারবার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শত ব্যস্ততার মাঝেও রাজধানী থেকে মফস্বলের দিকে পা বাড়ানো। সেই বিকেলের অলস অবসরে আজানের আহ্বানে মসজিদে প্রবেশ ও জামাতে শামিল এবং তারপর…।
‘ইমাম সায়েব একজন বিশিষ্ট পীর ও গদিনশিন খলিফা।’ গালিবকে অবহিত করার জন্য সেলিম জানাতে থাকে।
‘তাহলে তো তোমাদের পীরের কেরামতি দেখতে হয়।’ অনুসন্ধিৎসু মনোভাবে প্রত্যুত্তর দেয় গালিব।
প্রতি বিষ্যুদবারেই অনেক ভক্ত ছুটে আসে। এখন মাসিক জলসার সময়। বার্ষিক ওরস তো আছেই। সে এক মানুষের মহামিলন। এই মাসিক জমায়েতেও দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মুরিদ নানা তোহ্ফা নিয়ে ছুটে এসেছে। পীর সায়েবের একান্ত খেদমত ও নজরানা অর্পণের অভিপ্রায়ে।
পরদিন প্রাতরাশের কিছুক্ষণ পরই গালিব কৌতূহলবশত পীর সায়েবের পরিমণ্ডল পরিদর্শনে গমন করে। তারপর এক জায়গায় লক্ষ্য করে, ভক্তকুলের নিরবচ্ছিন্ন বৃত্তাকার বেষ্টনী। অনুরক্ত অনুগামীদের উৎফুল্ল উপস্থিতি। পীর-প্রেমান্ধ ব্যক্তিবর্গ তাদের ধর্মগুরুর নৈবেদ্যে অধিষ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রীর হাদিয়া নিরূপণ করছে। তার মানে, গাছের প্রথম কলা, কদু, জাম্বুরা, চালকুমড়ো, ডিম, হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ ইত্যাদি। ভক্তকুলের সওগাত নিলামে বিকিকিনির জন্য রীতিমতো দর কষাকষি। মুরিদদের মাঝে অপেক্ষাকৃত নিকটতম একজন নিলামে ডাকতে থাকে- ‘আহারে, দয়ালবাবার লাউ মাত্র ৫০০ টাকা। আর কেউ নাই?’ বলতেই একজন লাফিয়ে ওঠে, ‘আমি ৫৫০ ট্যাহা দিমু।’
কদুর দফরফা হলে আবার ডাকতে শুরু করে, ‘এই যে কী সুন্দর হলুদ পেঁপে! পীর সায়েবের মানতের জিনিস। একেবারে খাসা। মাত্র ৪০০ টাকা।’
‘আমারে দেনছে, ৫০০ টাহা দিবাম।’ পেছন থেকে একজন জোর গলায় আব্দার জানায়।
এভাবে পীর সায়েবের অভিষেকে অর্পিত মালপত্র অত্যন্ত চড়াদামে মুহূর্তে বিক্রি হয়ে যায়। তিন টাকার জিনিস তিনশ’ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে।
বছর চারেক আগের কথা। আগত মুরিদদের কার্যকলাপ ও চালচলন দেখে গালিবের আচানক মনে পড়ে যায়- এ তো সেই পীর! যার অনুসারীরা খাবার সময় ব্যক্তিগতভাবে দস্তরখান হিসেবে রুমালের মতো ছোট লালসালু ব্যবহার করে। স্বকীয় দস্তরখান সর্বক্ষণ সঙ্গে বহন করে, মাথায় পাগড়ি দেয়। ক’জন একত্রিত হলেই সশব্দে জিকিরের আসর বসায়। গালিব চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালে এক সহকর্মীর মাধ্যমে এই পীর সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিল। তার সেই সহযোগী ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খলিফা, উপদেষ্টা ও কৌঁসুলি। গালিব তার বাসায় বেড়াতে গেলে তিনি সস্ত্রীক তাদের প্রার্থনা কক্ষে নিয়ে যান। তারা তাকে পীরের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘উনি আমাদের পীর, পথপ্রদর্শক এবং উনি জবরদস্ত কামেল ব্যক্তি।’
ঘরের পশ্চিম দেয়ালে ১৬ বাই ২০ ইঞ্চি সাইজের ফ্রেমে বাঁধাইকৃত পীরের রঙিন ছবিতে দৃষ্টিনন্দন কাগজের মালা। এ ছাড়াও ক’দিন আগে ছবিতে ভক্তি প্রদর্শনের জন্য এক গুচ্ছ বকুল ফুলের মালাও অঞ্জলি দিয়েছিল, যার উপস্থিতি এখনও বিদ্যমান। এই ঘরেই তারা পাঁচবার ধর্মোপাসনা করেন। সহকর্মী ভাবিও আঞ্চলিক মহিলা দলপতি। তিনি প্রায়শ ধর্মোপদেশের জন্য বিভিন্ন মহিলাকে একত্রে জমায়েত করে থাকেন। জমায়েতকৃত আসরে তার ধর্মীয় উপদেশের এক পর্যায়ে সবাইকে চোখ বুজতে প্ররোচিত করে নরকের ভয়াবহ যন্ত্রণার বর্ণনা দিতে থাকেন। এবং এই নারকীয় যন্ত্রণা থেকে উদ্ধারে মনে মনে পীরকে স্মরণ করতে বলেন। সহকর্মী ভাবির চেহারা-মাধুর্য ও সুললিত বাচনভঙ্গির কাছে নারী শ্রোতারা সহজেই ঝুঁকে পড়ে। এ কারণে তার আবাসন এলাকায় অনায়াসে অনেক মহিলা অনুগামী জুটে যায়।
ভাবির বয়স চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই। স্কুল-কলেজ গোয়িং দুটো ছেলে থাকলেও তার লালিত্য বিভূষণ অক্লেশে যে কোনো পুরুষের চোখ টানে। উচ্চতা ও আকৃতির সাথে তার পরিপুষ্ট দেহগত কাঠামো অতিশয় সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাবির মনকাড়া অঙ্গসৌষ্ঠব ও আন্তরিক ব্যবহারের কারণে কোনোভাবে আহ্বান পেলেই গালিব সেখানে ছুটে যেত। আর ভাবিও ভাবত, কোনোভাবে একবার গালিব ভাইকে দলে ভেড়াতে পারলে সুড়সুড় করে ভাবিও দলে চলে আসবে। এ জন্য কোনো ছুতো থাকলেই সহকর্মী দিদার তাকে বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাত।
প্রতি বছর বার্ষিক ওরসের সময় সহযোগী দিদারের সাথে ভাবিও পীর সায়েবের জমায়েতে যোগদান করে। অন্যরা না গেলেও তাদেরকে তো যেতেই হয়। তারা দু’জনেই আঞ্চলিক দলনেতা, পীর সায়েবের কাছের মানুষ। ওরসের সময় মানুষের বিপুল সমাগম থাকলেও তারা দু’জনেই পীর সায়েবের নিজ বাড়িতে অবস্থান করে তার খেদমতে নিয়োজিত থাকে।
ভাবির জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ভক্তি ও বিশ্বস্ততা পীর সায়েবের বহুৎ পছন্দ। পীর সায়েব তার কামালিয়াত ও কারামতি সম্পর্কে ভাবিকে বিভিন্ন সময় বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল করে থাকেন।
জামাল প্রায় চার বছর পূর্বে পীর সায়েবের মুরিদ হয়েছে। সে একজন ভক্তিভাজন অনুসারী। ইতিমধ্যে পীরের অনেকটা নৈকট্য লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। পাঠশালায় শিক্ষকতা করলেও সে ভার্সিটি উত্তীর্ণ একজন তেজি তরুণ। আর উদ্দিষ্ট পীর সায়েবও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন অধ্যাপনা করেছেন। পিতার ইন্তেকালে কামালিয়াতের খেলাফতে আসীন হয়েছেন। এটা অত্যন্ত সম্মানজনক এবং দুনিয়া ও আখেরাতের ফলদায়ক একটা করণীয় কাজ। এ কর্মভার পিতা তাকে প্রদান করে গেছেন।
জামাল অতীতে ওরস বার্ষিকীতে যোগদান করলেও লাখ লাখ লোকসমাগমে ভেতরের অনেক বিষয়ই তার অজানা ছিল। সে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি, পীর সায়েবের নৈবেদ্যে নিবেদিত সামগ্রী প্রকাশ্য নিলামে বেচাকেনা হয়। এবার অপ্রত্যাশিতভাবে মাসিক জমায়েতে এসে বুঝতে পারে। উপঢৌকন সম্ভার বিকিকিনির ঘটনাটি তার কাছে কেমন যেন বিসদৃশ, বিরল ও বৈক্লব্য বলে বোধ হয়, যা তাকে বিব্রত করে এবং সে এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ভাবে, নিলামকৃত সব অর্থই তো খাদেমগণ পীর সায়েবের নিকট জমা করে। আর এভাবেই তো পীর বাবা ট্রান্সপোর্ট, পীর বাবা সিমেন্ট কারখানা, পীর বাবা কটন মিল ইত্যাদি স্থাপিত হয়েছে। তার তেজারতি অনেকটা সেসব চিকিৎসকের মতো, যারা তাদের কাছে কোনো রোগী গেলেই এক হাজার টাকা ভিজিট নিয়ে নিদেনপক্ষে পাঁচটা টেস্ট ধরিয়ে দেয়। প্রতিটি টেস্টের ৩০% টাকা আসে সেসব ডাক্তারের পকেটে। এ-ও তেমনি। পীর সায়েবের অর্জনেও লাভ, উপায়নেও উন্নতি।
জামাল তার রাগ ধরে রাখতে পারে না। সে সরাসরি পীর বাবার কাছে গিয়ে জানতে চায়, ‘হুজুর, এসব কী হচ্ছে! আপনার মানতের জিনিস ফল-ফলারি, সব্জি, ডিম, মুরগি চড়াদামে বেচে লোকজন ব্যবসা করছে। আপনি ওগুলো দেখেন না! এর সব লাভই তো আপনার। এইটা ঠিক না।’
বাসস্থানের সদরেই বড় হলরুমের মতো বিশালাকার কক্ষই পীর সায়েবের আস্তানা। সেখানে বসেই জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ এবং মুরিদানের মুশকিল আসান করে থাকেন। এই ধর্ম মন্ত্রণাস্থানের সামনেই একটি সমকোণী বর্গাকার জলাশয়। শান বাঁধানো ঘাট। তার পাশেই পীর সায়েবের পিতার প্রতিষ্ঠিত মসজিদ।
প্রতিবাদী যুবকটির অলক্ষুুণে ও কুপিত ধৃষ্টতা দেখে পাশে বসা এক অনুরাগী ভক্ত বলে ওঠে, ‘হুজুর, আপনার বদনসিব; মুরিদ জামালে কী কয়?’
‘অরে একটু পুকুরের পানিতে চুবাইয়া লইয়া আয়। মাথাডা ঠাণ্ডা অইব। মাথা গরম অইছে।’ পীর তার আঞ্চলিক ভাষায়ই বলতে থাকেন। মাঝে মাঝে লোক বুঝে জবরদস্ত চলতি ভাষাও ব্যবহার করেন।
হুজুরের এ কথা শুনে চার-পাঁচজন তাগড়া জোয়ান অনুসারী জামালকে ধরে নিয়ে যায়। এবং ক্রমাগত পুকুরের শীতল জলে চুবাতে থাকে। বারবার মাথাটা পুকুরের হিমজলে ডুবিয়ে ধরে রাখে ও টেনে তোলে। অবিরত জলে মাথা ঠেসে রাখার ফলে দ্রুত জামালের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে জীবন সাবাড় হয়ে যায়।
জামালের মৃতদেহ পুকুরে ডুবিয়ে রেখে ভক্তকুল চলে যায় পীর সায়েবের কাছে। শীর্ষস্থানীয় ভক্তটি বলে, ‘আপনার কমবখত্ সাগরেদকে ফিনিশ কইরা ফালাইছি। অহন কী করণ লাগব, হেইডা কন।’
‘তরার কি আমি শ্যাষ করবার লাইগা কইছিলাম? কইলাম, পুকুরে চুবাইয়া সাইজ কইরা লইয়া আয়। আচ্ছা যাউকগা. যা অইছে অইছে। অর আত্মীয়স্বজনরে খবর পাঠা। জানা, পুকুরে গোসলে গিয়া মইরা গ্যাছে গা। আর একজন যা, থানায় গিয়া পুলিশ লইয়া আয়। আর ওসিরে যাইয়া আমার কথা ক। সাঁতার না জাননে পুকুরে গোসলে যাইয়া মারা গ্যাছে। গড়বড় করলে থানা সামাল দিতে যা লাগে, একটুও কিপটামি করবি না। সব মনে থাকে য্যান।’
কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে। ডেডবডির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা হয়। সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদন লিখে পুলিশ ডেডবডি বহনের জন্য রুট পারমিট পর্যন্ত লিখে দেয়।
এর মাঝে জামালের আত্মীয়স্বজন এসে বিলাপ করতে থাকে। পীর সায়েব দরদভরা কন্ঠে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে থাকেন। হুজুরের দয়ার শরীর। অল্পক্ষণের ভেতরে পীর সায়েবের আদেশে অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। পীর সায়েবই ভাড়ার ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়াও জামালের বউয়ের জন্য অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা আগত পরিজনদের হাতে ধরিয়ে দেন। ষাটোর্ধ্ব পীর সায়েব জামালের জন্য আফসোস করতে থাকেন, ‘সে ছিল আমার অতি আদরের, নিজ সন্তানের মতো। আমার খুব কাছের মানুষ। তার জন্য আমার দিলে যে কী চোট লাগছে, এইটা একমাত্র খোদাতায়ালাই ভালো জানেন। সেইটা আমি কারে বুঝাই, কীভাবে বুঝাই!’
সংঘটিত ঘটনার পরদিনই গালিব ঢাকা চলে আসে। হৃদয়হীন, নির্মম ী নিষ্ঠুর এ ঘটনায় তার মন উদ্বিগ্ন. বিপর্যস্ত এবং অবাধ্য হলেও পরে ভাবে, এ পৃথিবীতে সবাই সম্পদের সেবক। তা ছাড়া তার পেছনে রয়েছে দেশের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি।
চট্টগ্রামে কর্মরত তার সহকর্মী দিদারের সাথে তার প্রায়শ সেলফোনে কথা হয়। সে কখনও ভুলেও বলেনি তাদের পূজনীয় পীরের ক্ষমাহীন ক্রূরমতি কাহিনী। বলেই বা লাভ কী! পীর-প্রমান্ধ ভক্ত তা কখনও বিশ্বাস করবে না। এই শ্রেণির লোক অনেকটা দলদাসের মতো। মৈত্রীবদ্ধ দল যত অন্যায়ই করুক, সেটা তাদের চোখে পড়ে না।
গালিব পীর আস্তানাঞ্চলে অবস্থান করাকালে সশরীরে দু’একজন মুরিদের সাথে কথা বলে জানতে পারে। পীর বাবা তার মুরিদদের মঙ্গল-অমঙ্গল সবই বুঝতে পারেন। কেউ তার চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। খোদা তার দিলের ভেতর রোশনাই জ্বালিয়ে রেখেছেন। সেই জ্যোতিতে সমুদয় বস্তুই তার নজরে আসে। তিনি খোদার একেবারে খাস বান্দা। এ জন্য অনেক গায়েবি খবরই তিনি বলে দিতে পারেন। তিনি তার মুরিদানকে সব সময় অভয় বাণী শোনান- দুনিয়াতে তোমরা জীবিত থাকাকালে আমার ওপর ভরসা রেখে খোদার পথে ধাবিত হও। খোদাপ্রাপ্তির পথে জান-প্রাণে অগ্রসর হও। এ অবস্থায় যদি তোমাদের পরিপূর্ণতা নাও আসে, তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। আমি তো আছি। এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে যদি তোমাদের ‘ছায়েবে ছুলুফ’ সম্পন্ন না-ও হয়, তবু তোমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তোমরা কবরে গেলে তালিম দিয়ে যোগ্য করে তোলা হবে। স্বর্গ তোমাদের জন্য অবধারিত।
তখন ছিল ২০১৪ সালের অগ্রহায়ণ মাস। হেমন্তের সেই নাতিশীতোষ্ণ বিকেলে দিদার ভাবি গালিবের বাসায় আসে। বিভিন্ন কথাবার্তার পর ভাবি সবিনয়ে উত্থাপন করে, ‘আগামী মাসে আমাদের পীর বাবার ওরস। এবার চলেন আমাদের সাথে যাই। বহু লোকজন যাচ্ছে। অনেক বাড়িতেই আমি গেছি। সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। তা ছাড়া যারা পীর বাবার অনুসারী, তাদেরকে তো যেতেই হবে।’
‘কী জন্য যেতে হবে ভাবি, বিষয়টা তো বুঝলাম না।’ গালিবপত্নী বিস্ময়বোধ করে।
‘ওরস কাজা করলে তার মুরিদানদের এক বছর অনেক বালা-মুসিবতের সম্মুখীন হতে হয়। নানা ধরনের বিপদাপদ এসে নাজেহাল করে।’
‘এই মুশকিল থেকে আপনাদের পীর সায়েব কীভাবে পরিত্রাণ করেন?’
“দুনিয়ার যাবতীয় বাধা-বিপত্তি থেকে সহজেই পীর বাবা মুরিদানকে হেফাজত করতে পারেন। মুর্শিদে কামেল তার ভক্তদেরকে ‘কুওতে এলাহি’র মাধ্যমে অনায়াসে তার জিম্মায় রাখতে পারেন। তার ভক্ত পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থান করুক না কেন, খোদা তাকে এই রূপ কারামতি দান করেছেন; শুধু তার মুরিদকে নয়, তার আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি, মালসামান- সবকিছু তিনি তার কুওতি কেল্লায় বন্দি করে রাখেন।”
‘আমরা তো সন্দেহবাতিক মানুষ। আপনাদের পীর সায়েবের কাছে গেলে আমাদের মুরিদ করবে তো?’
‘পরকালে মুশকিল আসানের জন্য যে কোনো ধর্মাবলম্বী তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে মুরিদ হলেই পীর বাবা তাকে তরায়া নিতে পারে। তার প্রতি বিশ্বাস রেখে তার কাছে গেলে কেউ খালি হাতে ফেরে না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কাউকেই পীর বাবা বিমুখ করেন না।’
‘ঠিক আছে ভাবি, দেখি চিন্তাভাবনা করে। আপনার ভাইকেও বুঝিয়ে বলি। এবার যেতে না পারলেও ভবিষ্যতে যে যাব না, তা বলছি না।’ দিদার ভাবিকে নিরাশ না করে কৌশলে তাকে এড়িয়ে যেতে চাইল।
তবু দিদার ভাবি বর্ণনা করতে থাকে, ওরসের সময় যে কত নামি-দামি লোক সেখানে যায়, তার ইয়ত্তা নেই! দামি-দামি গাড়ির বহর। সবাই পীর বাবার তোহ্ফার জন্য ব্যাগভর্তি অর্থকড়ি নিয়ে হাজির হয়। চাল-ডাল, গরু-ছাগল-মোষ এমনকি উটও কেউ কেউ নিয়ে আসে।
পীর বাবার দোয়া আর দাওয়া নেওয়ার জন্য কত বড় বড় আমলা, মন্ত্রী, যশস্বী ব্যক্তি হুমড়ি খেয়ে পড়ে! এ দেশের প্রেসিডেন্টও একবার সেখানে গেছলেন। সবাই সেখানে যান জীবদ্দশায় উন্নতি আর পরকালে নাজাতের আশায়।
২০১৫ সালের জুন মাসে দিদার সায়েবের একজন ঘনিষ্ঠ কলিগ বদলি হয়ে ঢাকায় আসে। অভিন্ন চাকরিতে সংযুক্ত থাকায় ক’দিন পরই গালিবের সাথে তার দেখা হয়। কথা প্রসঙ্গে বলে, ‘আপনারা শুনছেন নাকি? দিদারের বউকে ওদের পীর সায়েব বিয়ে করেছেন?’
‘কবে? কীভাবে বিয়ে হলো?’ বিশ্বাসের অযোগ্য মনে না হলেও তার কাছ থেকে জানতে কৌতূহলী হয় গালিব।
বারবার যাতায়াতের ফলে দিদার ভাবি পীর বাবার দৃষ্টিক্ষেত্রের ভেতরে আসে। তা ছাড়া ভাবির ভরাট ফিটফাট চেহারা যে কোনো পুরুষেরই চোখ টানে। পীর বাবার বয়স হলেও প্রাত্যহিক উপাদেয় খাবার গ্রহণের ফলে তার তাগদ এখনও তেজদীপ্ত। বাস্তবিক পক্ষে বিষয়টা অপ্রাকৃত হলেও বিয়েতে কোনো অনাসৃষ্টি হয়নি। বিয়ের আগে পীর বাবা একদিন ভাবিকে বলেন, ‘আপনি এখন কামালিয়াতের যে পর্যায়ে পৌঁছেছেন, আপনার আর দিদার সায়েবের সাথে থাকা চলে না। আপনি একজন খাঁটি আবেদা। আপনাকে এখন এখানেই মানায়।’
‘আমার তো ছেলে-সন্তান আছে, তা ছাড়া এতদিনের সংসার!’
‘সংসার তো মায়ার খেলা। একদিন সবকিছু ফেলে চলে যেতে হবে। নিজের চিন্তা করতে হবে। তা ছাড়া আপনার সন্তান দু’জনেই ছেলে; চিন্তা কিসের?’
‘দিদার সায়েব কী ভাববেন?’ সংশয় নিয়ে পীর সায়েবকে জিজ্ঞেস করে। হয়তো ভাবিও তখন পীরের আশেকে দেওয়ানা।
‘সে ভাবনা আমার ওপর ছেড়ে দেন।’ নিঃসংশয়ে পীর তাকে আশ্বাসের ধ্বনি শোনান।
সুলতানুল বঙ্গ, পীরে পীরান নামে খেতাবধারী পীরও হয়তো বহুকাল পূর্বে রচিত অমর কথাসাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের ‘হুজুর কেবলা’ গল্পের কাহিনী জানতেন। সেখানে পীর মুরিদের পুত্রবধূর ওপর আসক্ত হয়, শত বিপত্তি ও পুত্রবধূর কান্নাভেজা কণ্ঠে তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও নফ্সের খায়েশে অন্ধ হয়ে কৌশল অবলম্বন করে তাকে শাদি করে। আর এখানে পীর মুরিদের স্ত্রীর সাথে প্রেম করেন অন্তরায়হীনভাবে এবং অনায়াসে বিয়ে করতে চাইছেন।
মাসিক সম্মেলনের সময় এক ঘনিষ্ঠ মুরিদের মাধ্যমে পীর অপর মুরিদের স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। সুচতুর সাগরেদ খুব সাবধানে এবং সহজভােেব পীর-প্রেমান্ধ দিদারের কাছে তার অভিপ্রায় উপস্থাপন করে, ‘আপনার স্ত্রী তো আশেকার আশরাফ মর্যাদায় উত্রে গেছে। এত উঁচু স্তরে যে, আপনার কাছে তাকে আর মানায় না।’
‘কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? খোলাসা করে বলেন।’
‘আপনার স্ত্রী কামালিয়াতের যে দরজায় পৌঁছে গেছে, তাতে সে আপনার জন্য এখন হারামের পর্যায়ে চলে গেছে।’
‘কী যা তা বলছেন! উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। চলেন হুজুরের কাছে। এখনই নালিশ দেব।’
‘চলেন।’
পীর বাবা বসে বসে সুগন্ধি মসলাযুক্ত পান চিবুচ্ছিলেন। দু’জন অন্তরঙ্গ সাগরেদের বিষণ্ণ বদন দেখে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমার পীর ভাইদের হঠাৎ কী হলো? মনটা একেবারে গোসা গোসা লাগছে!’
প্রধান খাদেম জইমুদ্দি বলতে থাকে, ‘হুজুর, আপনার চট্টগ্রাম অঞ্চলের খলিফা আমার ওপর খালি খালি চটে যাচ্ছেন।’
‘তুমি তাকে কী বলেছ?’
‘ভাবির কামালিয়াতের কথা।’
‘শোনেন পীর ভাই দিদার হোসেন। খাদেম জইমুদ্দি তো ভুল কিছু বলেনি। তাক্মিল অর্জন করা বড় শক্ত কাজ। আপনার স্ত্রী এখন আশেকার উচ্চ স্তরে উপনীত। তার জন্য মুর্শিদে কামিলের একান্ত সান্নিধ্য প্রয়োজন। আমার প্রধান খাদেম জইমুদ্দির একজন অল্পবয়স্কা সুন্দরী বিধবা বোন আছে। আমি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছি। নিজ কামালিয়াত পূর্ণ করার জন্য তাকেই আপনার বিয়ে করতে হবে। নচেৎ সব পয়মাল। সারাজীবনের সব সাধনা ভেস্তে যাবে।’
ঘনিষ্ঠ ভক্ত গরিবুল্লাহ সেখানে উপবিষ্ট। গরিবুল্লাহ সম্পর্কে জইমুদ্দির জ্ঞাতি ভাই। সে বৃত্তান্ত শুনে তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি ভাষায় বলতে থাকে, ‘দিদার সায়েব, এখন আপনার ইমান-আমান আর পীর বাবার প্রতি মহব্বত বজায় রাখতে হলে আপনার স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। আর হুজুরকে বাধ্য হয়েই আপনার বিচ্ছিন্ন স্ত্রীকে গ্রহণ করতে হবে।’
পীর-প্রেমান্ধ দিদার আর এ নিয়ে বেশি কথা তোলে না। বাড়াবাড়ি বা পীর সায়েবের অসম্মান হতে পারে। তা ছাড়া তার স্ত্রীরও যেহেতু অনেকটা ইচ্ছে এবং নিজেও পঁয়তাল্লিশ-ঊর্ধ্ব বয়সে একটা অল্প বয়সী যুবতী কচি বউ পাচ্ছে; এ কারণে বিষয়টি সহজেই মেনে নেয়।
দিদারের স্ত্রীকে পীর সায়েবের মহব্বতের কথা জানতে পেরে সুযোগ বুঝে জইমুদ্দি একদিন তার পাঁচ বছর পূর্বে বিধবা বোনের কথাটি পাড়লে হুজুর শুনে খুব খুশি হন এ জন্য যে, পীর সায়েবও একটা যুক্তি তুলে ধরতে পারবেন। দিদারের নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। পুরনো বিবি দিয়ে অনেকটা নতুন প্রেয়সী পাচ্ছে। জইমুদ্দিরও একটা ঝুলন্ত আপদ ঘাড় থেকে নেমে যাচ্ছে। অধিকন্তু দিদার একজন সরকারি চাকরিজীবী। একেবারে সোনায় সোহাগা। আর শিকারও হলো এক ঢিলে দুই পাখি।
সূত্র: সমকাল