পতাকা বানাতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলাম এবং চিন্তিত মনে বাসায় ফিরে খবরের কাগজ খুলে ছুটির আমেজটা মাঠে মারা গেল। দুই দিন আগেই যে নদীতীরে চমৎকার সূর্যোদয় দেখে এসেছি, সেই নদী নিজের তীর ঘেঁষে বুলডোজার চালিয়ে তার ওপর নির্ভরশীল গ্রামগুলোর ওপর দখলদারির সীমানা বর্ধন করেছে। তিন হাজার পরিবার সর্বহারা হয়ে ঢাকা বরাবর রওনা দিয়েছে। অথচ নদীর পাড়ে বসে ভেবেছি—নাহ, দেশের নদীগুলো এখনো মরে হেজিয়ে যায়নি। এখনো বাংলাদেশের নদীতে নৌকা ভাসে, মাছ উর্বর ডিম পাড়ে, উলঙ্গ শিশু-কিশোরেরা আজও কাদামাখা শরীরে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কয়েকজন বয়স্ক পৈতাধারী হিন্দুকে সূর্য নমস্কার করতেও দেখে এসেছি, দেখেছি খেয়া পারাপার বন্ধ করে মাঝিদের মাঝ নদীতেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে। কোনটা সত্যি? আমি যা দেখে এলাম তাই? নাকি আমি চলে আসার পর নদী যা করল সেটা? কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক স্বাধীনতা দিবস পালনের আগে এ ধরনের চিন্তা আমাকে নিস্তেজ করে দিতে না দিতেই অধ্যক্ষ ফোন করে পতাকার আদ্যোপান্ত জানতে চাইলেন এবং আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন যে সংসদ সদস্য সাহেবের ইজ্জত যেন থাকে। কারণ ওনার ইজ্জতের ওপর কলেজের ইজ্জত নির্ভর করে। পতাকার দায়িত্বটা সেধেই নিয়েছিলাম ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ইচ্ছা করল। হাসু মল্লিকের ক্ষমাপ্রার্থনার মতো শেষ কথাগুলো এখনো হতচ্ছাড়া মশার প্যানপ্যানানির মতো কানে বাজছে, ‘দ্যাখো মিয়া, তোমার বাপের লাইগা আমি বেলবটম বানাইছি, তোমার ইশকুলের জামা-প্যান্ট ভি সিলাইয়া দিছি, অখন তোমার পোলার কাপড় ভি বুইন্যা দিতাছি। মাগার আমারে পতাকা সিলাইবার কইও না। পতাকা জিন্দেগিতে একবারই বুনছিলাম হালায়। আর বুনবার পারুম না।’ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক বিরাট মাঠ ভাড়া করা হয়েছে। একটি মাঠপ্রমাণ পতাকা দিয়ে মাঠ ঢেকে ফেলার পরিকল্পনার জোগানদাতা আমিই। গতকাল সারা দিন ধরে গজ-ফিতা হাতে নিয়ে মাঠ মেপে মেপে লিখে রেখেছি। মনে তুলনামূলক কম ভরসা নিয়েই অন্য দরজির শরণাপন্ন হলাম এবং পতাকার অর্ডার দিয়ে এলাম।
পরদিন সকালে আবার হাসু মল্লিকের দোকানে গজ-ফিতার হিসাব ছাড়াই ফিরে যেতে হলো, কারণ আমার ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতে গিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেখি, জাতীয় সংগীত শুরু হয়ে গেছে। ছেলে যখন দৌড়ে গিয়ে কাতারে দাঁড়াল, তখন ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’ চলছে। আমার মনে পড়ল, ছাত্রজীবনে এখানেই বেশ কিছু আমগাছ দেখেছি, যেগুলো কেটে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় এবং গত সপ্তাহেই ধুমধাম করে স্কুলের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হলো। ফাগুনে আমের বনের ঘ্রাণ যে সত্যি পাগল করে দেওয়ার মতো, সেটা আমার ছেলে জানবে কেমন করে? যে গান সে গাইছে, চারপাশে তো তা দেখতে পাচ্ছে না। কলেজে যাওয়ার জন্য রিকশা খোঁজার কথা ভুলে আনমনে হাঁটছিলাম। হাসু মল্লিকের প্রত্যাখ্যানের পর থেকেই কী যেন হয়েছে, একেবারেই মনঃসংযোগ করতে পারছি না। তখনই হাসু মল্লিক দোকানের ভেতর থেকে ডাক দিল, ‘ওই রহমানের পোলা, বিত্রে আহো। কতা আছে।’ ঢুকলাম। হাসু মল্লিক বলল, ‘দেখো মিয়া, তুমি আমার লগে গোস্যা কইর না। পতাকাডা তোমার খুব দরকার আমি বুজি। তুমি অন্য কিছু কও, আমি হাসতে হাসতে কইরা দিমু। আমার জন্মই হইছিল হাসতে হাসতে, হেল্লাইগাই তো নাম হাসু। মাগার পতাকা না, মাফ চাই।’
আমি বললাম, ‘গোস্যা করি নাই। কিন্তু আপনি পতাকা বানাতে চাইছেন না কেন? আপনারা তিন পুরুষ ধরে সেলাইয়ের কাজ করেন। আমরাও তিন পুরুষ ধরে আপনার কাছেই কাপড় বানাই। এই এলাকায় আপনার মতো পুরোনো দরজি আর আছে? তা ছাড়া আপনি ইতিহাস দেখেছেন, মুক্তিযুদ্ধও করেছেন জানি। আপনি যে মমতা দিয়ে পতাকাটা বানাবেন, এই এলাকার অন্য কারও দ্বারা সেটা হবে? পতাকা তো প্রফেশনাল জিনিস না, এটা আত্মা দিয়ে বানাতে হয়।’
‘হ। আমরা তিন পুরুষ দইরা সেলাইয়ের কাজ করি। আমার দাদার বাপে ইংরেজ আর নদীভাঙনের দাপটে নিজের জমিতে নীল না বুইন্যা ভাইগ্যা আইছিল চানপুর। এক বছর আছিল, হের পরেই আবার ভাঙন। আইল নারায়ণগঞ্জ। আইয়াই দেহে বন্যা। আবার পানির মদ্যে। তারপরে বিক্রমপুর হইয়া ঢাকা। সেহানেও পানি। সাঁতরানোর মতো পানি বহুত আছে, মাগার খাওনের পানি নাই। তহন আমার দাদায় শুরু করছিল দরজির কাজ। এক বুইড়ার কাছ থেইকা একখান পুরানা তাঁত কিনছিল। মসলিনের তাঁত। বুইড়ার কাছ থেইকা দাদা একটু মসলিন বোনাও শিখছিল। মসলিন তো তখন আর বিক্রি হয় না, আগের মতো সুন্দরও হয় না, সেই তুলাই বা পাইব কই? তা-ও শখ কইরা দুই-চাইরটা বানাইল দাদায়। আমিও দাদা আর বাবার লগে বইয়া তাঁত দইরা টানাটানি করতাম।’
‘আপনি নিজের হাতে মসলিন বুনেছেন? আপনি তো বাংলার ইতিহাসের সাথে মিশে আছেন। পতাকাটা আপনি বুনলে খুব ভালো হতো। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আপনার একটা পরিচিতিও পাঠ করতাম। আপনিও হাজির থাকতেন।’
‘আমি বেবাক টাইমে হাজিরই আছি। আর হাজিরার দরকার নাই।’
‘মসলিন তো হারায়ে গেল। তারপর কী করলেন?’
হাসু মল্লিকের জরাগ্রস্ত বুক যেন খানিকটা ঠেলে বেরিয়ে এল, ‘হারাইব না ক্যালা? মসলিন কি পাবলিকের শইল্যে উঠছে? মসলিন পরছে জমিদারের বউ-ঝিরা, সৈন্যরা মসলিন মাথায় দিয়া যুদ্ধে গেছে, মসলিন দিয়া ইংরেজ-রানিরা মশারি বানাইছে। পাবলিকের গায়ে উঠছে মোটা কাপড়। মোটা কাপড় কি হারাইছে? সেই দিনও ছিল, আইজও আছে। যদ্দিন বাঙালি থাকব, মোটা কাপড় ভি থাকব। মসলিন রাজারা চাইছে, রাজাগো লাইগাই আমরা বুনছি। হেরা গেছে গা, মসলিনও গেছে গা। তাঁতিরা চাইছে বিদেশিগো লাইগ্যা যত পাতলা কাপড় বানান্ যায়, পারলে গায়েবি কাপড় বানায়। তো গায়েবি কাপড় তো গায়েব হয়াই যাইব। নিজেগো লাইগা আমরা যা বুনছি, হেইডাই আমাগো লগে আছে। পতাকাডাও যদি হগলতের অইত, তাইলে আইজ এত বড় পতাকা বানানোর দরকার পড়ত না তোমার। আমার পতাকাডাও আমি মসলিন দিয়াই বুনছিলাম।’
নড়েচড়ে বসলাম, ‘বলেন।’
‘যে বুইড়ার কাছ থাইকা দাদায় তাঁত কিনছিল, হ্যার কাছে চার গজের একখান মসলিন কাপড় আছিল। হে পাইছিল হ্যার দাদার কাছ থাইকা। হ্যার দাদা অর্ডারের মাল থাইকা একটু চুরি কইরা রাখছিল। চাবুক খাইছে, মাগার মসলিন চুরির কথা স্বীকার যায় নাইক্যা। পাইক-পেয়াদা যহন তার বাড়ি তল্লাশ করতে আইছে, বুইড়া কী করছে জানো? মসলিনডা হুদা পুকুরে ভাসায়া থুইছে। পেয়াদারা কইলাম এক শবার ওই পুকুরের সামনে দিয়া গেছে-আইছে, মাগার ভাইস্যা থাকা মসলিন হালাগো চোক্ষে পড়ে নাই, এমন পাতলা। বুইড়ার বংশে কেউ আছিল না। হেল্লাইগা কাপড়ডা আমার দাদারে দিয়া গেছিল। দাদার কাছ থেইকা পাইলাম আমি। রেসকোর্সে শেখ সাবের ভাষণ শোনার পরে রক্ত গরম অইল। ওই মসলিনের উফরে মোটা কাপড়ের রঙিন সুতা দিয়া নিজের পতাকা বানাইলাম।’
‘আপনি বলতে চান, উনিশ শ সত্তুরে মানচিত্রঅলা পতাকার পর বাংলাদেশের প্রথম পতাকা আপনি বানাইছিলেন?’
‘না। আমি আমার নিজের পতাকা বানাইছি। হেই পতাকা অষ্টাশির বন্যায় ডুইবা গেল। আমগোরে এলাকাছাড়া করছিল নদীর পানি, আমার পতাকা নিল বন্যার পানি।’
‘বন্যার পানি পতাকা নিয়ে গেল?’
‘হ। আব্রোয়ান আছিল তো, যে পানিতে মিশত, সেই পানিরই রং লইত। বন্যার পানিতে মিশ্যা কহন ময়লা পানি হয়া গেছে, টের পাই নাইক্যা। হেই পতাকা পকেটে লয়া আমি যুদ্ধ করছি, ভাঁজ কইরা দুই আঙুলের মাজখানে রাখলেই গায়েব। মাগার মোটা কাপড়ের সেলাই দিছিলাম দেইখ্যা পকেটে রাখন লাগছে। একবার পাঞ্জাবি আর্মির কাছে দরা খাইলাম। আমার পুরা শরীর বিছরায়া কিছু পায় নাই। পতাকা কিন্তুক আমার লগে, আমার জিব্বার নিচে। আমার মনে হয় পতাকাডা এই এলাকাতই আছে কোনো ম্যানহোলের তলায়। এহানে যখন পেত্থম আয়া দোকান দিলাম, তার চার মাস পরেই বন্যা। বস্তির ঘরে পানি উঠল। পানির লগে আইল ইন্দুর। আমার বউয়ের দুই ভরি গয়না একটা কাপড়ে প্যাঁচানো আছিল, সেইডা কাটল না। কাটল পতাকার থইল্যা। মসলিনের পতাকা তো, এত পাতলা, ইন্দুরেরও চোখে পড়ে নাই। পানিতে মিশ্যা ভাইসা গেছে।’
‘আপনার পতাকাটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ব্যক্তিগত পতাকার কথা এই প্রথম শুনলাম।’
কাপড় কাটায় মন দিলেন হাসু মল্লিক, ‘হগলতেরই নিজের পতাকা আছে। যে খাইতে পারে না, হ্যার পতাকায় খানাখাদ্যের ছবি থাকব। যে নদীভাঙা মানুষ, হে আঁকব আভাঙা নদীর ছবি। যে রাস্তায় থাহে, হ্যার পতাকায় সুন্দর ঘরবাড়ির ছবি থাকব। সবাই বোনে না, আমি বুনছিলাম, আমি দরজি তো। আমার পতাকা তোমারে দেখামু। কাইল আইসো।’
‘পতাকা দেখাবেন কী করে?’
‘এক বিদেশি আমার পতাকার ফটো তুলছিল। কোন পেপার থেইকা জানি আইছিল ঢাকায়। যুদ্ধের মাঝখানে তহন, জুন মাস। কুঁড়িগ্রামের এক গ্রামে আমরা ক্যাম্প করছি। সারা রাইত বৃষ্টি। সক্কালে রোইদ উঠল। সেইখানে দুপুরবেলা ক্যামেরা লয়া হেই সাংবাদিক আইছিল। হ্যার অবস্থা যদি দেখতা। কাদাপানিতে পুরা বাঙালি হয়া গেছে। চুলও বাঙালি কাদায় কালা হয়া ল্যাপ্টায়া গেছে। হে আমার লগে কতা কইতে কইতে পতাকাডা দেখল, ছবি তুলল। আমার ঠিকানা ভি রাখল। স্বাধীনতার পরে ঠিকই সে আমার ঠিকানায় ছবি পাঠায়া দিল। আমার মনে হইল, স্বাধীন দ্যাশের প্রথম চিঠিডা মনে হয় আমিই পাইলাম। পতাকা নাই, পতাকার ফটোডা আমি বান্দাইয়া রাখছি।’
পরদিন পতাকার ছবিটা দেখলাম। শুধু মোটা কাপড়ের নকশাটা দেখা যাচ্ছে। জুন মাসের মধ্য দুপুরেও মসলিনকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। শুধু সূর্যের উল্লম্ব রশ্মিগুলো যেন পতাকার কাছাকাছি এসে অগ্নিবৃষ্টির মতো ঝরঝরে হয়ে গেছে। ছবি পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে হতে পারে অথবা ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে এত সূক্ষ্মভাবে সূর্যালোক ভেদ করে গেছে যে মসলিনের অদৃশ্যমান তৎপরতাকেই বুঝি ত্বরান্বিত করেছে। মোটা কাপড়ের নকশাটা যেন শূন্যে ভাসমান স্বর্গ। দুই পাশে দুটি নিবিড় গ্রামÑঅথবা হতে পারে একই গ্রামের দুটি খণ্ডিত অংশ, মাঝখানে স্পষ্টতই একটি স্রোতস্বিনী নদী। কারুকার্যটা কোথায় ঠিক বুঝলাম না, তবে এক পারের গ্রাম যে জোনাকির ঝাঁকে আলোকিত, সেটা পরিষ্কার। অন্য পারে গ্রামের পেছনের জলাভূমিতে আলেয়ার আলো। কোনো মানুষের ছবি নেই, নদীতে নেই কোনো নৌকা, ঘনসন্নিবিষ্ট গাছগুলোতে পাখির আনাগোনা নেই। আকাশ সূর্যহীন। নদীটি শান্তিময়।
হাসু মল্লিককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবকিছু। সূর্য কই? শুধু জোনাকি আর আলেয়া?’
হাসু মল্লিকের ঘন দাঁড়ি হাসির সঙ্গে সঙ্গে দুপাশে ফাঁক হয়ে যেন কোনো গুপ্তদ্বার খুলে দিল, ‘সূর্য আমগোরে আলো দিছে কবে? জোনাকির সত্যি আলো আর আলেয়ার মিথ্যা আলোই তো আমগো সম্পদ। জোনাকি লইবা না আলেয়া লইবা, হেইডা চিন্তা করো।’
কলেজের অনুষ্ঠান অবশ্য সফলভাবেই শেষ হলো। ঘাসহীন বিশাল মাঠটা পতাকার সবুজে ছেয়ে গেছে। মাঝখানে লাল সূর্য। সংসদ সদস্য এসেই পতাকাকে একটা স্যালুট দিলেন। সেই পতাকা সামনে নিয়ে আমরা জাতীয় সংগীত গাইলাম। কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এলাকার প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। পাতলা পাঞ্জাবির নিচে তাঁর মোটা কাপড়ের হোশিয়ারি গেঞ্জিটা স্পষ্ট। তিনি এমপি সাহেবকে একটি ক্রেস্ট দিলেন এবং এমপি সাহেবের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য উত্তরীয় আর কলেজের শহীদ মিনারটা সংস্কার করার জন্য পাঁচ লাখ টাকার চেক গ্রহণ করলেন। ময়দানজোড়া পতাকার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার চেক গ্রহণের ছবিটা বেশ কায়দা করে তোলা হলো। হাসু মল্লিকের নিষেধ সত্ত্বেও আমি কলেজের অধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, এ বছর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাসু মল্লিককে উত্তরীয় দেওয়া হোক। তাঁর মসলিন পতাকার কাহিনিও শুনিয়েছি। প্রস্তাব করেছি, হাসু মল্লিক যদি এই প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা দিবসে তাঁর এই মসলিন পতাকার গল্প বলেন, তবে কলেজের জন্য সেটা একটা অনন্য ব্যাপার হবে। অধ্যক্ষ মনোযোগ দিয়ে আমার প্রস্তাব শুনে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন, যার দুটির উত্তর আমি দিতে পারিনি। আর একটির মেয়াদোত্তীর্ণ উত্তর দিয়েছি: হাসু মিয়ার কি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আছে? এমপি সাহেব কি তাঁকে চেনেন? তাঁর মসলিন পতাকার কোনো প্রমাণ আছে?
আমি আমার মোবাইলে তোলা হাসু মল্লিকের পতাকার ছবির ছবিটা দেখালাম। অধ্যক্ষ সাহেব চতুর্থ প্রশ্নটি করলেন: এখানে তো কোনো পতাকা দেখতে পাচ্ছি না, নকশিকাঁথার কাঁথাবিহীন নকশি দেখতে পাচ্ছি। সবুজ কই? লাল কই?
এই ঘটনার মাস দুয়েক পর হাসু মল্লিক মারা গেলেন। দোকানের হাল ধরল তাঁর ছেলে। সে-ও আমার এবং আমার ছেলের জামা বুনে চলল এবং ক্রমশ হাসু মল্লিক আমার স্মৃতিতে ঝাপসা হতে লাগল। তারও মাস তিনেক পর কলেজ অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেল। স্মরণকালের ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় নর্দমা ও ম্যানহোল বহু বছরের জমে থাকা পাতাল সম্পদ উগরে দিতে শুরু করলে হাসু মল্লিকের কথা আমার আবার মনে পড়তে থাকে। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকেরা কলেজে যাতায়াত করেন, ঘণ্টা পড়লে খাতাপত্র হাতে শূন্য শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ঘুরে আসেন, নির্ধারিত সময় কোনো রকমে অতিক্রম করতে পারলেই প্যান্ট গুটিয়ে বাসার পথে নামেন। মাঝে মাঝে কলেজে বসে আমি মোবাইলে হাসু মল্লিকের পতাকাটা দেখি। আমাদের মাঠজোড়া পতাকাটা তখন কলেজের গুদামঘরে পড়ে আছে পরের বছর স্বাধীনতা দিবসের অপেক্ষায়। জলাবদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসে আমার ব্যক্তিগত পতাকা কেমন হতো ভাবার অবকাশ পাই। একবার মনে হয় যানজটহীন তিলোত্তমা নগরীই হবে আমার পতাকার নকশা। আবার মনে হয় কাঁচাবাজারে দোকানিরা হাসিমুখে জলের দামে নিত্যপণ্য মধ্যবিত্তের বাজারের ব্যাগে ঢেলে দিচ্ছে এ রকম ছবির কথা। আরেক দিন অবসর বয়সে নিবিড় গ্রামের একটা বাগানবাড়ির বারান্দায় বসে হাসিমুখে আরাম কেদারায় দোল খাওয়ার মুহূর্ত চোখে ভাসে। আবার এমনও মনে হয়, হাসু মল্লিক আর আমার পতাকায় কোনো তফাত নেই। এ রকম একদিন নর্দমা মাড়িয়ে ফেরার পথে হাসু মল্লিকের ছেলে আমাকে দোকান থেকে ডাক দেয়, ‘ভাইজান, একটু আসেন। কথা আছে।’
ভেতরে গেলে হাসু মল্লিকের ছেলে এক খণ্ড গ্রামীণ শূন্যতা আমার হাতে তুলে দেয়। অবাক হয়ে শুধাই, ‘পেলেন কোথায়?’
‘পানিত্ ভাইস্যা যেমন গেছিল, সেরম পানিত্ ভাইস্যা আইছে। আইজ সকালে ঘুম থাইকা উইঠ্যা দেহি বিছনার পাশেই ভাসতাছে। বাবায় যদি এই মোটা কাপড়ের নকশা না করত, বুজতেই পারতাম না যে এইডা সেই পতাকা। আব্রোয়ান তো! বাসার পাশেই ম্যানহোল, অর মদ্যেই কোনোহানে আটকাইয়া আছিল। আফনে দরেন, অসুবিধা নাই, ফোটানো পানিতে ধুইয়া আনছি।’
‘এটা আমাকে দিচ্ছেন কেন? আপনার বাবার স্মৃতি, এবার ঠিকঠাক যত্ন করে রাখেন।’
‘বাবায় কয়া গেছিল আফনের কতা। তাঁর ভরসা আছিল, পতাকা একদিন ফির্যা আইব। আইলে য্যান আফনেরে দিই।’
আমি পতাকার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কার মতো বা কিসের মতো তাকালাম, তার কোনো উপমা হয় না। তবে সাতচল্লিশ বছর পর দেশের মতোই পতাকাও পূর্ববৎ নেই। জোনাকির আলোগুলো স্রেফ নিভে গেছে। হয়তো পতাকা হারানো বন্যায় ইঁদুরগুলো জোনাকি খেয়ে ফেলেছে কিংবা নর্দমার রাসায়নিকে ধুয়ে গেছে। তবে নদীর এপারের ঝোপঝাড়ে আলেয়ার আলো, বুঝিবা কালের পরিক্রমায় রং জ্বলেই আরও ফুটে উঠেছে।
সূত্র: প্রথম আলো