বিথি তিন বছরের গোছানো সংসার ভেঙে নতুন করে সংসার গোছাতে ঢাকা যাচ্ছে। সাত দিন ধরে চলছে গোছগাছ। হাড়িধরা থেকে পাপশ, বালিশ থেকে পর্দা, খুন্তি থেকে বঁটি- কম জিনিস সংসারে! মনে হয় কিছুই লাগে না, অথচ প্রতিটি জিনিসই দরকারি। আর কত যে দরকারি, বোঝা যায় প্রয়োজনের সময় পাওয়া না গেলে। চামচের কাজ খুন্তি দিয়ে হয় না, ছুরির কাজ বঁটি দিয়ে হয় না, আর ঝাড়ূর কাজ হয় না ব্রাশ দিয়ে। একদিন প্রতীক রেগে বলেছিল,
‘হওয়ালেই হয়, সংসার করতে এত জিনিস লাগে নাকি? খালি খালি বোঝা বাড়ানো।’
কিছু একটা কিনতে বললেই এটা প্রতীকের কমন প্রতিক্রিয়া। কেনাকাটার ঝামেলার মধ্যে সে যেতে চায় না। তা ছাড়া তার সময়ই বা কোথায়! কিছু পুরুষ আছে বাজার করতে ভালোবাসে। প্রতীক সে ধরনের নয়। আর টাকা-পয়সাও একটা বড় ব্যাপার। তাই কিছু কিনতে বললেই বিরক্ত হয় প্রতীক। জিনিস যা কেনার ঘুরে ঘুরে সস্তার বাজার থেকে কেনে বিথি। তার পরও মাঝে মাঝে বলতেই হয়। আর বললেই সেই বারবার শোনা সংলাপ। একদিন রাগ হয়ে গিয়েছিল বিথির। সে প্রতীককে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। চুলোয় তখন ফ্রাইপ্যানে মাছ ভাজা হচ্ছে। প্রতীকের হাতে একটা চামচ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
‘মাছগুলো উল্টাও তো।’
প্রতীক মুখে বলেছিল, ‘এ আর এমন কী!’ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মাছ উল্টাতে পারেনি। আর তখনই সরোষে বিথি বলেছিল,
‘পারলে না তো? পারবে না। চামচের জায়গায় খুন্তি হলে পারতে। চামচের কাজ জিনিস তোলা; মাছ উল্টানো না। ও কাজ খুন্তির। কেন জানো? খুন্তির আগাটা চ্যাপ্টা। মাছের নিচে সহজে ঢুকে যায়। আর চামচের মাঝখানে গর্ত। কাজেই..’
প্রতীক ঠিকই বুঝেছিল, কিন্তু বুঝেও যে বুঝতে চায় না তাকে আর কী বলা যায়? প্রতীক বদলি হওয়ার পর থেকেই প্রাণান্ত বিথি। একা হাতে সব গোছাতে হচ্ছে তাকে।
‘এটা নিও না, ওটা নিও না, পুরনো জিনিস টানা মানে বোঝা বাড়ানো, এসব ময়লা জিনিস নিলে সাথে তেলাপোকা চলে যাবে, ম্যাট্রেসটা ফেলে দাও, ওটাতে ছারপোকা হয়েছে ইত্যাদি।’ প্রতীক তো ফেলে দাও বলেই খালাস। যাওয়ার পর যখন লাগবে তখন কিনে দিতে বললে সেই অমর সংলাপ- ‘চালিয়ে নাও, চালালেই চালানো যায়।’ সুতরাং ওর কথা মানতে নারাজ বিথি। ও খুঁটিনাটি নিজ হাতে গোছায়। এমনকি ছাইটুকু পর্যন্ত। ঢাকায় মাছ কোটার জন্য ছাই পাবে সে কোথায়! আর এখানে তো ছিল সরকারি বাসায়। কত রকম সুযোগ-সুবিধে! টাকা-পয়সা তেমন নেই, কিন্তু মান-মর্যাদা আছে। পিয়ন-দারোয়ান আছে। বললে এটা-ওটা এনে দেয়। ঢাকায় একটা ভাড়া বাসা নেওয়া হয়েছে, মোহাম্মদপুরের ঘিঞ্জি এলাকায়। সেই পৌনে দুই কাঠার বাসা। না রোদ, না বাতাস। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বিথির। এখানে প্রতীকের অফিস ছিল বাসার কাছে। প্রয়োজনে ডেকে আনা যেত, খবর দেওয়া যেত। ঢাকায় অফিস আর বাসার মধ্যে দূরত্ব কমপক্ষে ২০ কিলোমিটার। কী যে আছে ভাগ্যে কে জানে! বাড়িওয়ালা কেমন, তা-ই বা কে জানে!। ঢাকার বাড়িওয়ালাদের যা গল্প কানে আসে- বাতি জ্বালাতে দেয় না, মেপে মেপে পানি দেয়, বারান্দায় ফুলগাছ রাখতে দেয় না, দেয়ালে পেরেক পুঁততে দেয় না, বাঁধা সময়ের মধ্যে ঘরে ফিরতে হয়। না হলে গেট ‘লক অ্যান্ড কি’, মেহমান এলে গজগজ করে- এমন কত কী! ভাড়া বাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা বিথির নেই। বিয়ে হয়েছে তিন বছর। দেড় বছরের একটা ছেলে আছে তাদের- সৌর। এর আগে একবার বদলি হয়েছে প্রতীক। এটা নাকি ইম্যাচিওর বদলি। রাজনৈতিক কারণে। মন্ত্রী নাকি নাখোশ হয়েছেন। আশ্চর্য! মন্ত্রীরা এত ছোটখাট মানুষের ওপরেও নাখোশ হন!
মোটামুটি সব গোছানো হয়ে গেছে। একটা ট্রাকও ভাড়া করা হয়েছে। ট্রাকের লোকেরাই সব জিনিস ঘরে তুলে দেবে। তাকে ট্রাক নিয়ে আগেই চলে যেতে হবে। প্রতীক যাবে দু’দিন পর। অফিসে নাকি কী সব ঝামেলা আছে! এই দু’দিন সে ডাকবাংলোয় থাকবে। বিথির সাথে অফিসের পিয়ন আমির হোসেন যাবে। সে দু’একদিন থেকে তাকে গুছিয়ে দিয়ে আসবে- এমনই কথা। প্রতীক অবশ্য সেটা নিয়েও চিন্তিত। বারবার বলছে, ‘ট্রাকে বসে অত দূর যেতে পারবে তো? তোমার তো ট্রাকে চড়ার অভ্যাস নেই। তা ছাড়া সাথে সৌর আছে। ট্রাকে যাওয়া একদম ঠিক হবে না। তুমি বরং এক কাজ কর, বাসে চলে যাও। আমির ট্রাকের সাথে যাবে। কোনো অসুবিধা হবে না।’
বিথি রাজি হয়নি দুটো কারণে। বাসে যাওয়া বাড়তি খরচ। এমনিতেই একেকটা বদলি মানে অনেক খরচ। তার ওপর বাসে গেলে শুধু শুধু খরচ হবে, যেখানে সে ট্রাকে যেতে পারছে। তা ছাড়া ট্রাকে গেলে জিনিসপত্র তার চোখের সামনে থাকবে, সে দেখেশুনে নিতে পারবে। আমিরের হাওলায় দিলে কে কোনটা নিয়ে যাবে, তার ঠিক আছে?
বিথি বলে,
‘আরে না না, কোনো অসুবিধা হবে না। আমি ট্রাকে দিব্যি যেতে পারব। নতুন একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে। সৌর আমার কোলে বসবে। আমির সাথে আছে। তুমি ভেবো না।’
‘কিন্তু এতটা রাস্তা কোলে নিয়ে যাওয়া!’
‘অদ্ভুত কথা শোনালে তুমি! বাসে গেলে কি সিটে বসবে? সেখানেও তো সেই কোলেই বসবে। ‘
প্রতীক আর কথা বাড়ায়নি।
গোছগাছ মোটামুটি কমপ্লিট। সকালে ট্রাক আসবে। জিনিস তুলে সাথে সাথে রওনা দেবে বিথি। সমস্যা দাঁড়াচ্ছে দুটো বাঁশ নিয়ে। ও বাঁশ দুটো নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কীভাবে? বেশ লম্বা বাঁশ দুটো। আমির অবশ্য বলেছে, ট্রাকের পাশে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেওয়া যাবে বাঁশ দুটো। বিথি বাঁশ দুটোকে এনে সামনে রাখে, যাতে সকালে যাওয়ার আগে খোঁজাখুঁজি করতে না হয়। বাসায় ফিরে ঘরের সামনে বাঁশ দেখে প্রতীক জানতে চায়, বাঁশ দিয়ে কী হবে? বলব না বলব না করেও বলে ফেলে বিথি। কাল যাওয়ার সময় তো ও দেখবেই।
‘ঢাকায় নিয়ে যাব।’
‘সেকি! ঢাকায় বাঁশ নিয়ে কী করবে?’
‘যদি কখনও গাছ লাগাই, এটা দিয়ে মাচা বাঁধা যাবে।’
‘তুমি কি পাগল হয়েছ? ওই ঘিঞ্জি বাসায় গাছ লাগানো আর মাচা বাঁধা! রাখবে কোথায় এ বাঁশ?’
‘আপাতত বাসার সামনে রাখব। আর চিরকাল কি আমরা ওই বাসায় থাকব নাকি? বাসা কি বদলাব না?’
‘না না; বাঁশ নেবে না তুমি।’
‘আমি নেব। আমি কিছুই ফেলে যাব না। ঢাকায় একটা ঝাড়ূ কিনতে হয় ৬০ টাকায়। আর ঢাকা-ই বা বলছি কেন? এখানেও তাই। যা আছে তা কিনে আমি অযথা অপচয় করব না।’
এক সময় হার মানল প্রতীক। এ মহিলা শোনার লোক না। বলে লাভ নেই।
পরদিন সকালে আরেক ঘটনা। জিনিসপত্র তোলা হয়েছে। বিথি একটা হটপটে কিছু রুটি আর সুজির হালুয়া ভরছে।
প্রতীক এসে তাড়া দেয়।
‘যাও যাও, বেরিয়ে পড়ো। যত দেরি হবে তত বেশি জ্যামে পড়বে। কী নিচ্ছ ওটা?’
‘একটু হালুয়া আর রুটি। যাওয়ার পর কী অবস্থা দাঁড়াবে জানি না তো। তাই সাথে নিয়ে যাচ্ছি। রাতে খাওয়া যাবে।’
‘আরে না, নিও না। নষ্ট হয়ে যাবে। ঢাকায় কি দোকানপাট, হোটেল নেই? সেখানে সবই পাওয়া যায়। আমির এনে দেবে। তা ছাড়া তোমার বোনরা কি আজ রাতে তোমাকে ওই নতুন বাসায় খেতে দেবে? ক’দিনে চুলোয় রান্না বসাতে পার তাই দেখ। তোমাদের যা বোনে-বোনে মিল!’
এ কথা শুনে খুশি হয় বিথি, তবে থামে না। প্রতীকের চোখের সামনেই হালুয়া-রুটি তুলতে তুলতে বলে, ‘অনেক দূরের রাস্তা, ক্ষুধা পেতে পারে। তা ছাড়া এটা হটপট; নষ্ট হবে না।’
প্রতীক আর কথা বলে না। বিথি সব গুছিয়ে ট্রাকের কাছে যায়। ট্রাকের দু’পাশে তখন বাঁশ বাঁধা হয়ে গেছে। বিথি প্রতীককে নানা রকম নির্দেশ দিয়ে ট্রাকে ওঠে। ট্রাকে উঠতে সত্যিই কষ্ট হয়। ও সিটে বসে সৌরকে কোলে দিতে বলে। কিন্তু সৌর চিৎকার করে- ‘আমিল ভাইর থাথে দাব, দাব।’ বাসার কাজের বুয়া আর আশপাশের দু’চারজন হাত নাড়ে। বিথির চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে। এ এক অদ্ভুত মায়া! আজ ক’দিন ধরে ভেতরে ভেতরে যে কান্না বইছিল, এখন সেটা প্লাবিত হতে থাকে। জীবনটাই এমন, এক মায়া কাটিয়ে নতুন মায়ায় বাঁধা পড়তে হয়। সে মায়া কাটিয়ে অন্য মায়ায়। নতুন নতুন বন্ধনে প্রতিনিয়ত বাঁধা পড়ে মানুষ, আর বাঁধন ছিঁড়েও যায়।
এসব অদ্ভুত ভাবনাকে সাথে নিয়ে ঢাকার রাস্তা ধরে বিথি। আমির পেছনে জিনিসপত্রের একপাশে কষ্ট করে বসেছে। তার কোলে জাঁকিয়ে বসেছে সৌর। তিন বছরে জমতে জমতে কম জিনিস হয়নি। কবে যে নিজের একটা বাড়ি হবে! আর ঘাটে ঘাটে নাও ভিড়াতে হবে না।
ঢাকায় তিন বোন থাকে বিথির। বড় আর ছোট বোন। এক ভাইও থাকে। বোনদের মধ্যে খুব মিল। ও ঢাকায় যাচ্ছে জেনে বোনরা খুব খুশি। এবার তিন বোন মহা-আনন্দে থাকা যাবে। প্রতীক বলেছে, জোরেশোরে চেষ্টা করলে কিছুদিনের মধ্যেই একটা সরকারি বাসা পাওয়া যাবে। প্রথমে বিথি ভেবেছিল, জিনিসগুলো দু’বোনের বাসায় ভাগাভাগি করে রাখবে, আর নিজে উঠবে বড় বোনের বাসায়। অনেক ভেবে সে চিন্তা বাতিল করেছে। তার ছেলেটা বড্ড দুষ্টু। যা পায় জানালা দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেয়। কতক্ষণ আর তাকে পাহারা দিয়ে রাখা যায়! বোন খুব খুঁতখুঁতে। ও বাড়িতে জিনিসও ছড়ানো ছিটানো। অনেক ভেবে ও বাসায় থাকার চিন্তা বাতিল করেছে বিথি। ছোট বোন তিথির বাসাটা ছোট। তবে নির্ঝঞ্ঝাট। থাকতে একটু কষ্ট হবে কিন্তু অন্য কোনো সমস্যা নেই। বোন চাকরি করে। সকালে চলে যায়, ফেরে রাতে। ওর একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা কাজের বুয়ার কাছে থাকে। বাচ্চাটা প্রায়ই অসুস্থ থাকে। ওরা ঢাকায় যাচ্ছে জেনে বোন তিথি জোরাজুরি করেছিল, ‘তোরা আমার বাসায় ওঠ ছোটাপু। আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রাখতে পারবি। বুয়া কী খাওয়ায়, না খাওয়ায়! থাকার একটু কষ্ট হবে, কিন্তু তা আর এমন কী? নিজেরা নিজেরাই তো।’
প্রতীকের মত ছিল না কারও বাসায় থাকার। কিন্তু বিথির চাপে রাজি হয়েছিল তিথির বাসায় থাকতে। সেইভাবেই কথা হয়ে ছিল। আচমকা ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে এক দঙ্গল লোক এসে পড়ল আর ওর বাচ্চার অসুস্থতাও প্রচণ্ড বাড়ল। মাঝে মাঝেই হসপিটালে ভর্তি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ওর বাড়ি ওঠা মানে ওর কষ্ট বাড়ানো। এবার আর প্রতীক কিছুতেই রাজি হলো না। তাই আলাদা বাসা নিতে হলো। আলাদা বাসা নিয়েছে ঠিকই, তবে বাসাটা তিথির বাসার কাছেই। বিথি ভেবে রেখেছে, তিথির ছেলেটাকে ও সারাদিন নিজের কাছে এনে রাখবে। সৌরর সাথে এক সাথে থাকবে, খেলবে, ঘুমাবে। বড্ড ভুগছে ছেলেটা। এই তো দু’দিন আগে হসপিটাল থেকে রিলিজ হলো। এই হসপিটালে ভর্তি হচ্ছে, রিলিজ হচ্ছে আবার ভর্তি হচ্ছে। অতটুকু একটা ছেলে! এটা একটা জীবন হলো!
ট্রাক এগিয়ে চলেছে। জিনিস বোঝাই ট্রাক কী ভয়ঙ্কর গতিতে চলছে! বিথির একটু ভয় ভয় লাগছে। দু’চারবার ড্রাইভারকে বলেছে গতি কমাতে। শুনেছে, আচ্ছাও বলেছে, কিন্তু কমায়নি। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে হুস হুস করে বাস চলে যাচ্ছে। আবার কখনও পাশের বাস যেন ট্রাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। তাতে ছেলেটা পেছনে। তার অবিরাম কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। একেকটা বাস পাশ দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে আর ও খলবল করে হাসছে। বিথি মনে মনে বলে, ‘আরে গাধা, আরেকটু বড় হলে আর হাসবি না। তখন বুঝবি ট্রাক কাকে বলে আর বাস কাকে বলে। এখন তো কিছুই বুঝিস না। পারিস খালি হাসতে আর কাঁদতে। তাহলে ভয় যদি তোর নেই, বাতি নেভালে জড়িয়ে ধরিস কেন? আর চেঁচাসই বা কেন?’ বিথি একটু ঘাড় উঁচু করে কষ্টে ড্রাইভারের পেছনের জানালা দিয়ে ট্রাকের পেছনে তাকায়। জিনিসের দঙ্গলে কিছুই দেখা যায় না। ও চেঁচিয়ে বলে, ‘আমির হোসন, আমির হোসেন, সৌরকে দে। ওর দুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।’
আমির হোসেন আর সৌর কী যেন বলাবলি করে, শোনা যায় না। তারপর চেঁচিয়ে বলে, ‘ও বলছে, আপনার কাছে না, আমার কাছে খাবে। বোতলটা দেন, খালাম্মা।’
‘নিবি কী করে?’
‘জানালা দিয়ে বাড়ায়ে ধরেন। আমি নিতে পারব।’
‘সাবধানে কিন্তু, তুই ওকে কোলে করে আসবি কী করে?’
পেছন থেকে ট্রাকের হেলপারদের একজন জানালার পাশে হাত বাড়িয়ে বলে, ‘আমাকে দেন ম্যাডাম।’
বিথি ওর হাতে বোতল ধরিয়ে কিছুটা স্বস্তি পায়। আমির সৌরকে ঠিকই খাইয়ে দেবে, আর খাওয়ার পর ও আমিরের কাঁধে ঘুমিয়ে পড়বে- এটা বিথি মোটামুটি নিশ্চিত।
বিথি বাইরে তাকায়। দু’পাশে দিগন্তপ্লাবী ধানক্ষেত। ক্ষেতের আলে আলে বক আর কত নাম-না জানা পাখি বসে আছে। একটা পুকুরে শাপলা ফুটেছে। বৃষ্টির পানি জমে মাঝে মাঝে ছোট ছোট জলা হয়েছে। সে জলায় কচুরির ফুল ফুটে আছে। ছেলেবেলায় তাদের বাড়ির চারপাশে কত কত কচুরি ফুল ফুটে থাকত! তখন ফিরেও দেখেনি ও ফুল দেখতে কেমন। আর যদিও বা চোখে পড়েছে, ও ফুলের কোনো রূপই চোখে লাগেনি। আজ এই শহরের ব্যস্ত জীবনে কচুরি ফুলের অপরূপ রূপ চোখে লাগে, মনে লাগে। আসলে না পেলেই জিনিসের মান বাড়ে, দাম বাড়ে। এটাই বোধ হয় ধ্রুব সত্য। প্রকৃতি তার রূপের ডালা ঠিকই সাজিয়ে বসে থাকে, কিন্তু সেটা আহরণ করার সাধ্যি ক’জনের থাকে?
এটা ঠিক, এখন আর মাঠের মাঝে দূরে দূরে আগের মতো সেই ছোট কুঁড়েঘর আর মাটি-লেপা উঠোন দেখা যায় না। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে সময়ের আবর্তনে। তারপরও প্রকৃতি যেটুকু জিইয়ে রেখেছে অনেক সময় মানুষ তা রাখতে দেয় না। আর সবকিছুর পর যেটুকু থাকে তাও বাস্তব পৃথিবীর যান্ত্রিক মানুষের চোখে পড়ে না। এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝেই মোবাইল বেজে ওঠে। প্রতীক জানতে চায়, ওরা কতদূর এসেছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না। ট্রাক আস্তে চালানোর কথাও বলে।
বিথি ওকে আশ্বস্ত করে। চিন্তা না করতে অনুরোধ জানায়। এটা প্রতীকের একটা বড় গুণ। বউ ছেলেকে বড্ড ভালোবাসে। সেটা অবশ্য কম-বেশি সবাই বাসে। তবে ও শুধু বউ-ছেলেকে না, মানুষের প্রতিই ওর গভীর দরদ। সে অচেনা মানুষ হলেও বিপদে সাহায্য চাইলে তার পাশে দাঁড়ায়। বড় দায়িত্বশীল আর কর্তব্যপরায়ণ। খুব মমতা ওর মনে।
প্রতীকের সাথে কথা শেষ করেই বিথির মনে হয়, কী কাণ্ড! সে আজ একাই মালপত্র নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। সাথে ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে। দু’বোনই তা জানে। আর তারা একবারের জন্যও খবর নিল না। একবার ভাবে, নিজেই ফোন করবে। তারপর সে চিন্তা বাতিল করে দেয়। মনে মনে তীব্র অভিমান হয়। আশ্চর্য, ওরা কী ভেবেছে? ওরা কি ভেবেছে, ঢাকায় গিয়ে সে ওদের আপদ হবে?
ভাবে, কিন্তু ও জানে, এটা কখনোই ওর বোনরা ভাবতে পারে না। তারপরও ভাবে। আর অনেকক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। দীর্ঘ পথ একে একে পেছনে চলে যায়। কাছে এগিয়ে আসে ঢাকা। এক সময় অভিমান জল হতে থাকে। আচ্ছা, ওরা ফোন করল না কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা না। কোনো বিপদ হয়নি তো ওদের? তিথির ছেলেটা ঠিক আছে তো? ও তো সকালে ভালো হলে দুপুরে মন্দ।
কিন্তু বিপদ হলে নিশ্চয় তাকে জানাত। ঢাকায় কত আত্মীয়স্বজন! আর কেউ না হোক, দাদা তো জানাত। কিছুই হয়নি। বিথির যে খোঁজ নেওয়া দরকার, সেটা ওরা ভাবেইনি। ভাগ্যিস রুটি-হালুয়া নিয়ে এসেছে। রাতে ওদের কারও বাসা থেকে খাবার আসবে বলে মনে হয় না। বিথি প্রতিজ্ঞা করে, কেউ খাবার পাঠালে সে খাবেই না।
সৌর বহুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আর পেছন থেকে খলবলে হাসি, আধো-কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
ঢাকায় প্রবেশ করে ট্রাক আর পড়ে যায় প্রবল জ্যামে। কী কাণ্ড! এই শহরে মানুষ থাকে কী করে! ভাইবোনরা থাকে কী করে! এ শহরে প্রতীক এলো কেন? জ্যাম ঠেলে ঠেলে ট্রাক পিঁপড়ের মতো এগোয়। আবার একটু ফাঁক পেলে কষে টান দেয়। কিন্তু সে টান আবার আটকা পড়ে আচমকা। এই করতে করতে ওরা গুলিস্তান পার হয়। আর তখনই বিথির চোখে পড়ে একটা শবযাত্রা এগিয়ে চলেছে। যাত্রীদের সবার মুখে উচ্চারিত হচ্ছে কলেমা শাহাদাত। বিথি একবার তাকিয়ে দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। ওর কখনোই শবযাত্রা দেখতে ভালো লাগে না। ছেলেবেলায় শুনেছিল, শবযাত্রা দেখলে যাত্রা শুভ হয়। কথাটা অদ্ভুত লেগেছিল ওর। একটা মানুষ চিরকালের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, আপনজন আর পাশের মানুষেরা তাকে চোখের জলে সমাহিত করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে; এ দৃশ্য দেখলে যাত্রা শুভ হয় কী করে! তবু সংস্কারটা বিথির মধ্যে আছে, যেমন অনেক কিছুই আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু অবেচেতনে বিশ্বাস করি। তেমন এটাও মনের মাঝে রয়ে যায়। সাথে সাথে এ চিন্তাও হয়- আহারে, কার আপনজন চলে গেল!
এক সময় ট্রাক এসে থামল নির্ধারিত বাসার সামনে। ততক্ষণে বিথির হাঁটু প্রায় জমে গেছে। ট্রাক থামার সাথে সাথে জেগে উঠে চোখ কচলাতে লাগল সৌর। বিথি কষ্টে ট্রাক থেকে নেমে পাশের বাড়িওয়ালার বাড়িতে নক করে চাবি নিয়ে দরজা খুলল। একটা ভ্যাপসা গুমোট বাতাস ঝাপটা দিল নাক-মুখে। কী স্যাঁতসেঁতে ঘরটা! একটু আলো-বাতাস নেই। ওর মন খারাপ হয়ে গেল। ট্রাকের লোকরা জিনিস নামাতে লাগল। সৌর এতক্ষণে আমিরের কোল থেকে বিথির কোলে এলো। আমির জিনিসপত্রের তদারক করছে। তখনই বেজে উঠল ফোনটা।
বিথি এক হাতে ফোন কানে নিয়ে দু’এক মিনিট কথা বলল। তারপর চেঁচিয়ে আমিরকে বলল, ‘আমির, তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডাক। আমি ছোট খালার বাড়িতে যাব। সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
আমির দ্রুত রিকশা ডাকে। বিথি সৌরকে কোলে নিয়ে রিকশায় উঠতে উঠতে বলে, ‘তুই এদিক সামলা, আমি চললাম।’
‘খালাম্মা, কী হয়েছে?’
‘ছোট খালার ছেলেটা মারা গেছে।’
‘সে কী! কীভাবে?’
‘অত কথা বলার সময় আমার নেই। আমি চললাম।’
দ্রুত ছুটে আসে ট্রাক ড্রাইভার। বলে, ‘আমার ভাড়া…।’
‘ও তাই তো!’
ব্যাগ খুলে দ্রুত টাকা বের করে দেয় বিথি। রিকশা চলতে শুরু করে। বিথি ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
তিথির পাশে বসে আছে বিথি। চারপাশে আত্মীয়স্বজন। সবার চোখে জল। তিথি অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চলছে। এক সময় তিথি চোখ খোলে। বিথিকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরে।
‘ছোটাপু, ছোটাপু, আমার ছেলেটা..’
বিথি তিথির মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদত বলে, ‘আসার সময় একটা শবযাত্রা দেখে ভেবেছিলাম যাত্রা শুভ। তখন কি জানতাম, এভাবে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে!’
এর পর বাকি কথা ও আর বলে না। বলে না যে, ও বাচ্চাটাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল, খাওয়াতে চেয়েছিল, ঘুম পাড়াতে চেয়েছিল। বড় আপা এসে ওদের জড়িয়ে ধরে। তার পর শুধুই কান্নার শব্দ শোনা যায়।
সূত্র: সমকাল