চৈত্রসঙ্গ

চৈত্রসঙ্গ

‘আপা, আপনে থাকেন। আমরা জুমা পইড়া আসি। ভয় পাইয়েন না যেন। পাককোঠায় আয়নাবু আছে।’

আমি তাদের অভয় হাসি দিয়ে বিদায় জানালাম।

আজ জুমা বার। আমরা এখানে, মানে এই সরকারি রেস্ট হাউসে পিকনিক করতে এসেছি। এখন এই রেস্ট হাউসের দিকে তাকালে অবশ্য কেউ পিকনিকের রেশও দেখতে পাবে না। অথচ একটু আগেই যখন পৌঁছলাম, এখানে গমগম করছিল চারদিক। অহেতুক হাসির ফোয়ারা বইছিল। সেলফি-কুলফির হিড়িক তো ছিলই। যাত্রা শুরুর পর বাসের জানালায় যে চুলগুলো বেয়াদবের মতো উড়ে উড়ে যেতে চাইছিল বারবার, তাদের আবার ঠিকঠাক করে নেওয়া, ঠোঁটের রঙ আরেকবার উজ্জ্বল করার দ্রুত চেষ্টা ছিল। তার পর যখন তাদের উদ্দেশে ঘোষণা করা হলো- ‘ঠিক দুটোয় লাঞ্চ ব্রেক, আশপাশে ঘুরে আসতে পারো।’ মুহূর্তে রেস্ট হাউস ফাঁকা! দশ মিনিট হাঁটলেই যে জাফলঙের জিরো পয়েন্ট! আর তাদের পায় কে!

আমি কোথাও যেতে পারছি না। এখানে পৌঁছানোর পর বাস থেকে নামার সময় শাড়ি আর স্যান্ডেল পেঁচিয়ে বাম পায়ের রগে ভয়ানক টান খেলাম। আপাতত ভয়ে আর হাঁটতে চাইছি না। একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছি রেস্ট হাউসের বারান্দায়। সামনে মেঘালয়ের রহস্যময় পাহাড়ের সারি। চৈত্রের রোদে মেঘের খেলা নেই বলে যেন একটু মন খারাপ ওদের।

পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে তাকালাম। এই তাহলে আয়নাবু! লম্বা। একহারা গড়ন। লাল-কালো ছাপার শাড়ি পরা। পান খাওয়া খয়েরি ঠোঁট। পঞ্চাশের ওপর হবে বয়েস।

‘আপা, কিছু লাগবো আপনের?’

‘না। বসেন।’

‘পায়ে নাকি দুখ পাইছেন?’ বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে আমার পাশেই বসলেন আয়নাবু।

কথা বা আচরণে কোনো জড়তা নেই।

‘একটু লেগেছে। তেমন না।’

‘আমারে দেখান তো’, বলেই আমার পায়ের দিকে হাত বাড়ালেন।

কী মুশকিল! এমন বয়সের কেউ পায়ে হাত দিতে চাইলে অস্বস্তি লাগে। আমি শাড়িটা একটু টেনে তাকে ব্যথা পাওয়া জায়গাটা দেখালাম। একটা রগ সামান্য একটু ফুলে আছে। আসলে অতি সতর্কতার জন্যই আমি না হেঁটে এমন পা তুলে বসে আছি। হয়তো কিছুক্ষণ বসে থাকলেই ব্যথাটা কমে যাবে। এর মধ্যে অনেকটা কমেছেও। কিন্তু এসব কথা তাকে বলার আগেই উনি আমার পায়ে হাত বোলাতে শুরু করলেন। তারপর খেয়াল করলাম, কী যেন বিড়বিড় করে বলছেন!

এ বাবা! কার পাল্লায় পড়লাম! ওঝা নাকি এই মহিলা? আমি তো এসব বিশ্বাস করি না। এসব করতে নিষেধ করব কি, অলরেডি দু’বার পায়ে ফুঁ দিয়ে ফেললেন। আঙুলের চাপ পরিবর্তন করলেন। সব মিলিয়ে দুই-তিন মিনিট হবে। আমার রীতিমতো বিরক্তি লাগছে। তার পর থেমে বললেন,

‘রাগ কইরেন না আপা। আমি সামান্য ঝাড়তে পারি। বহুত মানুষ আমার ঝাড়নে ভালো হইছে।’

আমি কেন যেন রাগ করতে পারলাম না। কিছু বললামও না।

‘দেইখেন, এট্টু পরই পায়ে আরাম পাইবেন।’

মনে মনে বললাম, সে তো আমি নিজেও জানি।

‘এখানেই থাকেন আপনি?’

‘না, না। রাস্তার ওপারে একটা মসজিদ দেখছেন? আমাগো বাড়ি ওইখানে।’

‘এখানেই আসল বাড়ি? আপনার কথা কিন্তু এই এলাকার মতো না।’

‘ঠিকই কইছেন। আমরার আসল বাড়ি কুমিল্লায়। আব্বায় নাকি ছুডোকালে এইহানে আইছিল।’

‘এখানে কী করেন? রান্নাবান্না?’

‘হয়, রান্ধি; ঝাড়ূ দেই।’

‘বাবুর্চির চাকরি?’

‘না, না। পারমেন না। শহর থিকা স্যারেরা আইলে রান্ধন লাগে। ঠিকা বেতন দেয় না।’

‘তবে?’

‘চুক্তিত দেয়। মনে করেন, স্যারেগো জন্যে দুইদিন দুইবেলা রানলে পাঁশশো দেয়।’

‘এই আয়ে চলে আপনার? কোনো স্যার যদি না আসে তাহলে তো আয় বন্ধ।’

‘একলা মানুষের পেট। বেশি কিছু তো লাগে না।’

‘একা?’ বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেললাম! এটা তো তার ব্যক্তিগত জীবন। এমন প্রশ্ন তো অভদ্রতা। কিন্তু সেসব ভদ্রতা হয়তো কেবল শহুরে মানুষের বেলায় খাটে। এরা সেসব ভদ্রতার ধার ধারে না। আর শহুরে মানুষেরাও হয়তো আমারই মতো, শহরের সীমানা পার হলেই খোলস খুলে পড়ে। যেসব কৌতূহলে শহরে তার দম আটকে যায়, ভদ্রতার মুখোশ এঁটে থাকে বলে প্রকাশ করতে পারে না, সেসব কেমন অনায়াসে বলে ফেলতে পারে।

‘উনিশ বছর আগে স্বামীর ঘর ছাইড়া আইছি।’ বলেই হেসে ফেলেন তিনি।

‘কেন? খারাপ মানুষ?’ আর কোনো আড়াল নেই আমার, আর কোনো খোলস নেই।

‘না না, মানুষ ভালা।’

‘তবে?’

‘দুই দুইটা সন্তান হইলো; বাঁচলো না। আর হইলোও না। কেমনে আর স্বামীর ঘরে ভাত খাই, কন?’

‘আপনাকে তাড়িয়ে দিল? আপনার দোষ কী? সন্তান না বাঁচলে আপনি কী করবেন? কী অসুখ হয়েছিল বাচ্চাদের?’

‘দোষ আমারই আপা। আমার দোষেই বাচ্চা দুইটা বাঁচে নাই!’

‘মানে! কোনো মা কি নিজের বাচ্চাদের মারতে পারে?’

‘আমি মারি নাই। কিন্তু আমার দোষেই তাদের জান গেছে। সব না শুনলে আপনে বিশ্বাস করবেন না। আর শুনলেও বিশ্বাস না-ও হইতে পারে। আপনেরা শহরের মানুষ তো।’

আমার শুনতে ইচ্ছে করছে। টিলার ওপর এই রেস্ট হাউসে আমি আর এই মহিলা ছাড়া আর কেউ নেই এখন। এমন কি এতক্ষণ একটা কুকুর-বেড়ালও চোখে পড়েনি। এমনটা হওয়ার কথা না। সরকারি রেস্ট হাউসগুলোতে দু-চারটা নাদুস-নুদুস বেড়াল থাকেই। এমনকি দুপুরের নির্জনতা ভেঙে একটা পাখিও ডেকে উঠল না!

‘আপনার নাম কী, বলেন তো? এরা আপনাকে কী বলে যেন ডাকলো…ভালো করে বুঝতেই পারলাম না।’

‘এই তো আসল কথা জিজ্ঞাসা করছেন। আমার নাম আয়নামতি। আমার আব্বায় রাখছিল। জন্মের সমায় নাকি অনেক সুন্দার ছিলাম! আব্বায় নাকি কইছিল, আমার মাইয়ার সুন্দার রূপ দেইখা আয়না ভাইঙ্গা যাইবো।’

আমি আয়নামতির দিকে ভালো করে তাকালাম। রোদে কিংবা চুলার আগুনের আঁচে পোড়া তামাটে চামড়া। তবে বোঝা যায়, এক সময় ভালোই ফর্সা ছিলেন। নাকটাও খুব বেশি খাড়া না। পান খাওয়া দাঁত। কিন্তু চোখটা সত্যিই একটু অন্যরকম। কী রকম, তা ঠিক বোঝানো যাবে না। একবার মনে হচ্ছে, চোখ-ভর্তি অনেক দুঃখ। আবার মনে হচ্ছে, কিছু একটার ওপর খুব রাগ। আবার মনে হচ্ছে, একটু উদাস। কোনোভাবেই কিন্তু আয়নামতির অতীত চিন্তা করে আহামরি সৌন্দর্য খুঁজে পেলাম না। বুঝলাম, গ্রামে তো আজও সুন্দর বলতে ফর্সাকেই বোঝায়। শুধু কি গ্রাম? শহরেও তো।

‘বুঝছেন আপা, খালি আয়না ভাঙ্গে নাই। কপালডাও ভাংছে।’

‘বিয়েটা আপনার মা-বাবা দিয়েছিল?’

‘হয়। তের বচ্ছর বয়সে আমার বিয়া হইছিল। গেরস্ত ঘর। কোনো কিছুর অভাব নাই। কিন্তু কপালে তো আমার শান্তি নাই।’

‘তারপর?’

‘আমার গায়ের রঙ দেইখা শ্বশুরে পছন্দ করছিল। খালি রঙ না, চুলও আছিল কোমরের নিচ পর্যন্ত।’ বলেই আয়নামতি অর্ধ ঘোমটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে খোঁপাটা খুলে ফেলে।

চমকে উঠি আমি! কয়েক গাছি চুলের সাথে একটা বিশাল জট!

‘ভয় পাইছেন? আমিও প্রতথোম প্রতথোম ভয় পাইতাম। ভয়ে একবার কাইট্টাও ফালাইছিলাম। হের বাদে মরতে নিছিলাম।’

‘স্কিনের ডাক্তার দেখান নাই? মানে, চামড়ার ডাক্তার?’

হেসে ফেললেন আয়নামতি। আমি কি হাস্যকর কোনো কথা বলে ফেলেছি? নিশ্চয় দীর্ঘদিন চুল ভালো করে না ধোয়ায় কোনো একটা স্কিন ডিজিজ থেকে এমন হয়েছে। সময়মতো ডাক্তার দেখালে এমন হতো না।

‘আপা, এই অসুখ পৃতথিবির কোনো ডাক্তারে সারাইতে পারবো না। বাসর রাইতে বাতাস লাইগা এই রোগ হইছিল!’

‘কিসের বাতাস?’ আমার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই- বাতাস লাগলে চুল এমন হবে কেন! এই যে একটু আগে পিকনিকের বাসে এত এত মেয়ে বাতাসে চুল উড়িয়ে এলো। প্রতি বছরই তো এমন করে। তাদের কি এমন জট পড়ে!

‘উপড়ির বাতাস। আপনেরে কেমনে বোঝামু, আপনেরা শিক্ষিত মানুষ। এইসব বিশ্বাস করবেন না।’

‘না না, আপনি বলেন।’

‘আমার বিয়াতে অনেক খরচা করছে আমার শ্বশুরে। অনেক লোক খাওয়াইছে। পাঁচখান সোনা দিছিল…কানে, গলায়, নাকে, হাতে আর একখান আংটিও। এই দেখেন, কানেরখান এখনও আছে।’ বলেই দুই কানে হাত দিয়ে দেখান আয়নামতি। কানপাশা। ওজন খারাপ হবে না।

‘বাকিগুলো?’

‘বেইচ্চা খাইছি।’ একটু থামেন আয়নামতি। আমার মনে হলো, একটা ঢোক গিললেন। তারপর শুরু করলেন।

‘বাসর রাইতে, মনে করেন আয়জানের আগে আগে প্রস্রাব করার জন্যে উঠছি। পয়লা ওই বাড়ি গেছি, কোনখানে কী কিছুই তো জানি না। শরমে কাউরে ডাকও দেই নাই। দরজা খুইলা বাইরে পাও দিসি আর মনে হইলো, বাতাসের একটা ধাক্কা খাইলাম। আমার চুল খোলা আছিল, এইডা ঠিক। কিন্তুক মাথায় ঘোমটা আছিল। মনে হইলো, কেডা যেন আমার চুল ধইরা জোরে একটা টান দেল। খালি মনে আছে, একটা চিক পাইড়া আমি বেহুঁশ হইয়া গেছি।’

‘তারপর?’

‘খাড়ান আপা, পানের বাটাটা আনি। আপনে খাইবেন?’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভেতরে রান্নাঘরের দিকে চলে যান আয়নামতি। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। মাত্র আধা ঘণ্টা পার হয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ে, এই খোলা বারান্দায় আমিও তো চুল খুলে বসে আছি। তাতে কী হলো? আমাকেও উপড়ির বাতাসে ধরবে! কীসব ভাবছি! ফিরে আসেন তিনি।

‘একটা পান খাইয়া দেখেন। খাইশ্‌শা পান। কাঁচা সুপারি দিয়া খাইলে ভালা লাগবো।’

‘ওরে বাবা! কাঁচা সুপারি খেলে আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করবে। খাব না। আপনি খান।’

সাদা পাতা আর অর্ধেকটা সুপারি দিয়ে একটা খাসিয়া পান মুখে দিলেন আয়নামতি। তারপর আঙুলের মাথায় চুন নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।

‘সেই বাসর রাইতের পর একটানা দুই মাস আমার জ্বর আর ছাড়ে নাই। এর মইদ্যে পেটে সন্তান আসছে। কিসের কী! আমার শইলে নাই বল। স্বামী কত কিছু আনে, খাইতে পারি না। কেমনে যে দশ মাস কাটাইছি, একমাত্র আল্লা জানে। মিথ্যা বলব না, ডাক্তার-কবিরাজ কোনোডা তারা বাদ দেয় নাই। সব দেখাইছে। সেই সমায়ই চুলে জট পড়া শুরু হইল। সেই থিকা নাপাক কিছু ধরলেই অসুক হয়। কী কমু, নাপাক মাইনষের লগে কতা কইলেও ঝামেলা। শেষে একটা পোলা হইল। পাঁচ দিন কি ছয় দিন বাঁচল।’

‘বাচ্চার কী সমস্যা ছিল? বাচ্চারে ডাক্তার দেখাননি?’

‘বাচ্চাডা হওয়ার পর থিকা একটা মুহূর্তও চুপ থাকে নাই। খালি কানছে! আর হের শইলের রঙ মনে অইছে, একবার সাদা দেহি, একবার কালা!’

‘হাসপাতালে নেননি বাচ্চাটাকে?’

‘কী কমু, আপনেরা শহরের মানুষ, এসব তো বিশ্বাস করবেন না। বাচ্চাডা হওয়ার দিন থিকা আমার মনে হইতো আঁতুড় ঘরে আমার সাথে আরও একজন কেউ আছে। অনেক বড়, কালা, বড় বড় লোম!’

‘কী যে বলেন আপনি! এসব আপনার কল্পনা।’

‘কইছি না, আপনে বিশ্বাস যাইবেন না? বিশ্বাস নিয়া আমার কতা না শুনলে আমি আর কিছু কমু না। আমার ক্ষতি হয়।’

‘প্লিজ, প্লিজ বলেন। রাগ করবেন না। আমি বিশ্বাস করছি।’

আয়নামতির মুখে মনে হলো করুণার একটা হাসি এসেই আবার মিলিয়ে গেল। আমার জন্য করুণা তিনি করতেই পারেন। এখন এই গেস্ট হাউসে তাকে অবিশ্বাসের অপরাধে আমাকে একা ফেলে তিনি যদি অভিমান করে চলে যান, কী বা করার থাকবে আমার! অবশ্য পায়ের ব্যথাটা আগের চেয়ে অনেক কম। আয়নামতির রাগ কমানোর জন্যই বললাম,

‘দেন দেখি একটা খাসিয়া পান, খেয়ে দেখি।’

আয়নামতির মুখ উজ্জ্বল হলো।

‘সাদা পাতা খাইয়েন না। মাথা ঘুরাইবো।’

পানটায় সত্যিই তীব্র ঝাঁঝ। খেতে ভালো লাগছে না। তবু মুখে খুশির ভাব নিয়ে চিবোচ্ছি। আয়নামতির অভিমান কমাতে হবে। আমাকে পানটা খাওয়াতে পেরে অভিমান কমেছে বলেই মনে হলো। আমাকে আর তাগাদা দিতে হলো না।

‘দুই বচ্ছর পর আবার একটা সন্তান আইলো পেটে। আমার শইল ভাইঙ্গা শেষ। দেখলে সবাই মনে করতো- না জানি কত বড় অসুক! আসলে কিন্তু কোনো রোগ নাই। খালি মনে হইতো, মাতাডা ভার… মনের মইদ্যে অশান্তি। দ্বিতীয়বার মাইয়া হইলো। এবারেরজন দুই মাস বাঁচছিল। কিন্তুক হেও আগেরজনের মতোই চিল্লাইতো দিন-রাইত। এই বাচ্চাডা মারা যাওনের পরই ঠিক করছি- স্বামীর ঘর আর করমু না।’

‘কেন, স্বামী কিছু বলেছিল? আপনাকে তালাক দিতে চেয়েছে?’

‘না।’

‘তবে?’

‘আমিই চিন্তা করলাম, আমারে দিয়া তো স্বামীর সুখ নাই। সংসার ছাড়নের আগে তারে কিন্তুক আমি বিয়াও করাইছি। বউ-ভাতও করছি। হের বাদের দিন কাউরে কিছু না কইয়া বাড়ি থিকা চইলা আইছি।’

‘বলেন কী! এত বড় একটা কাজ করলেন, স্বামী আপনাকে ফিরিয়ে নিতে আসেনি?’

‘কই আইবো? আমারে পাইবো কই?’

‘কেন, আপনার বাবার বাড়ি আসেনি সে?’

‘আমি তো বাপের বাড়ি আসি নাই। সোজা গেছি মায়ের নানা বাড়ি। বাপের বাড়ি আইলে তো স্বামী নিতে আইবো।’

‘সেই বাড়ির লোকেরা খবর দেয়নি?’

‘না। হেগোরে কইছি, তোমরা খবর দিলে গলায় ফাঁস দিমু। হেরা ভয়ে কিছু জানায় নাই। তহন তো আর মুবাইল আছিল না।’

‘তারপর?’

‘এদিগে, আমার বাপে, ভাইয়ে মনে করছে- আমারে মাইরা স্বামী আরেকটা বিয়া করছে। বাপে থানায় গেছে কেস দিতে। এইসব লইয়া বহুৎ সালিশ-দরবার। শ্যাষে মায়ের নানা বাড়ি থিকা বাপেরে আর স্বামীরে চিডি দিয়া জানাইছি যে, আমি বাইচ্চা আছি।’

‘তারপর তারা আপনাকে নিয়ে এসেছে?’

‘না। আমি তো চিডিতেই জানাইছি- আমারে যেন কেউ নিতে না যায়। নিতে গেলেই আমি গলায় ফাঁস দিমু। বাপের বাড়ি আইছি পাঁচ-ছয় বচ্ছর পর। বাপের মিততুর খবর পাইয়া। মায়ও মরছে।’

‘স্বামীর সাথে আর যোগাযোগ হয়নি?’

‘না। হের সংসার আছে। তিনডা সন্তান তার।’

‘বাপ-মা নেই। কার সাথে থাকেন?’

‘ছোড ভাইগো সাথে টাকা দিয়া থাকি। তাদের নিজেগোই অভাবের সংসার। বাপেরও তেমন জাগা-জমি ছিল না। তয়, বাপে মায়ের নানা বাড়ি গিয়া অনেক চেষ্টা করছে আমারে আবার বিয়া দেতে। আমি কইছি, নিখোঁজ হইয়া যাবো। আর কুনোদিনও খোঁজ পাইবেন না।’

‘ভালোই করেছেন।’

‘এই তো আপা, এতক্ষণে আপনে একজন শিক্ষিত মানুষের মতো কতা কইলেন। আমি মানুষটা গরিব হইতে পারি, কিন্তুক আমার জানডা তো আর গরিব না!’

কথাটা শেষ না হতেই দেখি হৈচৈ করতে করতে টিলার ঢাল বেয়ে দশ-বারজন ছেলেমেয়ে উঠে আসছে। ডাউকির পাথুরে ঠাণ্ডা জলে তারা সবাই ভিজে একাকার।

আয়নামতি উঠে দাঁড়ান। হয়তো ভেবে নেন, তার সঙ্গ এখন আর দরকার নেই আমার।

সূত্র: সমকাল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত