আলো রোজ দিন দ্যাখে। এই সময়টাতেই আসে ছেলেটা। ‘ডিম টোস্ট’ বলে কুড়ি টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় বীণামাসির দিকে। তারপর সামনের বেঞ্চটায় বসে, ব্যাগ থেকে একটা ইংরাজি খবরের কাগজ বের করে পড়তে থাকে, শেষ পাতাটা। ট্রেন থেকে নেমে, দোকানটায় একটু জিরোতে আসে আলো। একটা বিড়ি খায়। একটা লাল চা। একটু পিঠ টানটান। দোকানের মাঝবরাবর একটা পর্দা টানানো। তার অন্যপাশে একটা চৌকি, ছোট, একজনের শোয়ার মতো। পর্দা পেরিয়ে, চৌকিতে গা এলায় আলো। পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরেটা ছেঁড়া ছেঁড়া দ্যাখা যায়। ছেলেটা কাটা চামচ দিয়ে টোস্টের একটা টুকরো মুখে পুরল। সাদা জামা, গাঢ় নীল প্যান্ট, পিঠে ব্যাগ। ভেতরে অন্ধকার, ছেলেটা আলোকে দেখতে পায় না। মাঝেমধ্যে বীণামাসির নধর দেহটা ঢেকে দিচ্ছে বাইরেটা। টাকার বাক্সটা থাকে পর্দার ছেঁড়া দিকটায়। টাকা খুচরো করে, দশবার গুণে বীণামাসি যখন সরল, তখন ছেলেটা আর নেই। আলো কী আর করে ওপাশ ফিরে চোখ বুজল।
ঘুম ভাঙল ৩টায়। একটু আড়মোড়া ভেঙে বাইরে এলো আলো। বীণামাসি, খেতে বসেছে বাইরের বেঞ্চে। আলোকে দেখে বললেন, ‘দু মগ ঢেলে আয়। খেয়ে নে। কাল কি হোল-নাইট খেটেছিস? রাবণের মতো ঘুমলি।’ যদিও কৃতিত্বটা কুম্ভকর্ণের পাওয়া উচিত। শিক্ষা প্রসারের অভাবে রামায়ণের কিঞ্চিত এদিক-ওদিক স্বাভাবিক। সেসবে মাথা না দিয়ে, রেললাইন পেরিয়ে আলো এগোল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। প্ল্যাটফর্মের মাঝবরাবর একটা ছোট পাবলিক টয়লেট। একদিক পুরুষদের, মহিলাদের একদিক। টয়লেটের একটা ঘর স্নানের জন্য। একটা পাইপ, একটা সস্তার সাবান। ঘরের বাইরে একজন দেহাতি মহিলা বসে টেবিল নিয়ে। টেবিলের ওপর খুচরো পয়সা গুছিয়ে রাখা। মূল্য অনুযায়ী আলাদা করা প্রতিটা মুদ্রা। মহিলাটি সেপটিপিন দিয়ে দাঁত খুঁটছেন। আলো তার সামনে পাঁচ টাকা রেখে ঘরে ঢুকল। ঘরে একটা হুক পোঁতা। জামাকাপড় হুকে ঝুলিয়ে, মাটিতে পড়ে থাকা পাইপটা হাতে তুলে, হাঁক পাড়ল আলো—জল ছাড়ো। পাইপের মুখটা নিজের মুখের কাছে মাইকের মতো ধরে। জলের দমক এসে লাগে মুখে। স্রোতের কাছে মুখ পেতে থাকে সে। একটা সময় গোটা শরীরটা ধুয়ে যায়। স্নান সেরে, জামা গলিয়ে দাঁড়ায় বাইরে এসে। এই সময় বেজে ওঠে মোবাইলটা। স্ক্রিনে নাম দেখায়—লকা। আলো পড়তে শিখেছিল।
— হ্যালো।
— সোনারপুর। ১ নম্বর গেটের কাছে থাকব। ৫টা।
ফোনটা কেটে গেল। রুমাল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাইরে এলো সে। লাইন পেরোনোর সময় দেখল, সেই ছেলেটা। ১ নম্বর স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে বসে। সঙ্গে একই ড্রেসের একটা মেয়ে। আলোর বয়সীই হবে। আলো চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, সেদিকে তাকিয়ে। ট্রেনের শব্দে চমকে উঠল। তার ভেজা চুলে ধুলো আটকে ট্রেন ঢুকল ১-এ। আলো ঢুকল বীণামাসির দোকানে। বাটি থেকে একটা লঙ্কা, আধখানা পেঁয়াজ নিয়ে থালা উলটে, ডাল ঢালা ভাত বের করল। বীণামাসি শুয়েছিল চৌকিতে, অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে। আওয়াজ পেয়ে এদিক হলেন, ‘আজ কোথায়?’ ‘সোনারপুর।‘ মুখভর্তি ভাত নিয়ে উত্তর দিল আলো।
সোনারপুর ১ নম্বর রেলগেটের কাছে আলো যখন পৌঁছল, দিনের আলো কমে এসেছে। শীত। পৌনে ৫টাতেই বিকেল গড়ায়। লকা বাপনের পানের দোকানে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল। আলোকে দেখে হাত নাড়ল। আলো কাছে যেতে একটা বিড়ি এগিয়ে দিল, সঙ্গে লাইটার। একটান দিয়ে, আলো ফেরত দিল লাইটারটা। ‘কেমন?’ ভ্রু নাচাল লকা।
— কড়া না।
— আরে লাইটারটা।
— দেখতে ভালো। কোথায় পেলি?
— পাবো কেন? কিনেছি।
লকার একটু গায় লেগেছে, বুঝল আলো। আড়চোখে লকার দিকে তাকাল, মুখের ভাবটা বুঝতে। আর তখনই দেখল, সেই ছেলেটা। দূর থেকে আসছে। একটা হলুদ গেঞ্জি আর কালো জিন্স। আলো তাড়াতাড়ি বিড়িটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ঘসে দিল। সেটা খেয়াল করল লকা।
— কি রে?
— কিছু না। চল কোথায় যাবি।
লকা এসব বোঝে না। আলো তার থেকে কিছুটা ছোট। গেল বছর নরেশদা নিয়ে এসেছিল ওর কাছে। সাউথের এই দিকটা লকাই দ্যাখে। আলোকে পৌঁছে দিয়েই আবার যাদবপুর ছুটবে। সেখানে মনামিকে টাইম দেওয়া ৬টা। লকা কথা না বাড়িয়ে একটা রিক্সা ধরল। জায়গাটার নাম বলল, রিক্সায়ালাকে। আলো শুনল, কিন্তু বুঝল না। ছোট থেকেই আলো একটু অন্যমনে থাকে। কিছুই ভাবে না, কিন্তু কোথায় যেন থাকে। সেখানে সবটাই শূন্য। শব্দ নেই, সবটাই সাদা। রিক্সাটা একটা গলির মুখে দাঁড়াল। গলির দুপাশে ফ্ল্যাট বাড়ি। তারই একটার সামনে এসে দাঁড়াল লকা। ‘তিন তলা, ৩০১ নম্বর’। আলো উঠে গেল। গেটের ওপর নম্বরটা দেখে কলিং বেল টিপল। যিনি দরজা খুললেন, চুলে পাক ধরা শুরু করেছে। মোটা নন, কিন্তু ভুঁড়ি আছে। গায়ে চাদর, পাজামা। যেটা অবাক করে আলোকে, মুখটা খুব চেনা লাগে ওর। কোথায় যেন দেখেছে। লোকটা ইশারায় আলোকে সোফাটা দেখিয়ে দিল। তারপর টেবিল থেকে একটা বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, “একটু পর গিয়ে স্নান করে নিও। সাবান, শ্যাম্পু করো। বাথরুমে তোমার কাপড় রাখা আছে। সেটা পরো।” বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
আলো দু ঢোক জল খেয়ে উঠে গেল বাথরুমের দিকে। একটা ছাপার শাড়ি টানানো হ্যাঙারে। আর সায়া। শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখল, সায়াটা নামিয়ে—যদি একসঙ্গে থাকে, কিন্তু ব্লাউস, ব্রেসিয়ার পেলো না।
স্নান সেরে যখন ঘরে ঢুকল, লোকটা খাটে শুয়ে বই পড়ছিল। ঘরটা বড়। সুন্দরভাবে সাজানো। আলোকে দেখে ইশারায় কাছে এসে বসতে বললেন। ‘কী নাম তোমার?’
— আলো।
— বাড়ি কোথায়?
আলো চুপ করে থাকে। বাড়ি ছিল ওপার বাংলায়। বাবাকে দেখেনি। মা মারা যায় আগের বছর। পাড়ার এক মাসি নিয়ে যায়, লালুর কাছে। লালু এপারে আনে নরেশের কাছে। এখানে থাকার জায়গা বলতে ওই চায়ের দোকান। লকাই চিনিয়ে দেয়। দুপুরে ওখানে শোয়। রাতে একেক দিন একেকজনের বাড়ি। এখনো অবধি কোন রাত খালি যায়নি। ‘কী খাবে বলো?’ আলো চুপ করে থাকে। ‘বিরিয়ানি ভালোবাসো?’ আলো ঘাড় নাড়ে। লোকটা ফোন করে, এক প্যাকেট বিরিয়ানি, একটা ভেজ মিল। ‘তুমি টিভি দেখ?’ আলো ঘাড় নাড়ে আবার, একই দিকে। ‘কী দেখবে দেখো’ রিমোট এগিয়ে দেয়। আলো চ্যানেল ঘোরাতে থাকে। একটা চ্যানেলে এসে থেমে যায়। একটু পরে আলো হেসে ওঠে, লোকটাও হাসে সঙ্গে, টিভি দেখতে দেখতে।
খাওয়ার পর হাত ধুয়ে পাশের ঘরে ঢোকে আলো। ঘরটা অন্ধকার। চুপচাপ। কিছু চোখে পড়ে না। অনেক দূর অবধি যেন কিছু নেই। শূন্য। আলো ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঘরের ভেতর। দূর থেকে দু একটা শব্দ ভেসে আসে কানে, অস্পষ্ট। আর একটা গন্ধ। “পায়েস” অস্ফুটে বলে আলো। মা তার জন্মদিনে পায়েস বানাত। ভাত ফুটতো যখন হাড়ির ভেতর, ধোঁয়া উঠে ছড়িয়ে যেত ঘরের ভেতর, আলো দেখতে পায় ধোয়া পেরিয়ে মা’র মুখ, এক মনে চাল টিপে দেখছে সিদ্ধ হল কিনা। ‘মা’ ডাকে আলো। মা মুখ তুলে তাকায়। স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল? মায়ের মুখের সঙ্গে কথা মেলে না। মুখ যেন আগে নড়ে যায়। শব্দগুলো পরে আসে। আলো মাথা নাড়ে। হাত মুখ ধুয়ে নে। একটু মুড়ি দি খা? দাওয়ায় নামে আলো। কল পাড়ের দিকে এগোয়। কল পাড় কত দূর আসে না। হাঁটে আর হাঁটে। কল পাড়ে পৌঁছয় যখন, কারা ঢোকে দাওয়ায়। আলো চিনতে পারে না। এগিয়ে যায় রান্না ঘরের দিকে। দূর থেকে থালা বাসনের আওয়াজ আসে। বাসনের আওয়াজের সঙ্গে মিশে আসে মায়ের গলা। মা যেন তাকে ডাকছে, আলো দৌঁড়ে যাচ্ছে সেদিকে কিন্তু যতই পা ফেলছে সে পিছিয়ে আসছে।
কলপাড়, কলা বন পেরিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। শিবমন্দির পেরিয়ে আরো পিছিয়ে আসছে আলো। দূরে, মায়ের গলা তীক্ষ্ণ হচ্ছে। আরো তীক্ষ্ণ। এ সময় কে পেছন থেকে আলোর পিঠে হাত রাখে। আলো ফিরে দ্যাখে পাড়ার এক মাসি। মাসি হাতের মুঠো চেপে ধরে আলো। গোটা পাড়াটাই পিছিয়ে যেতে থাকে আলোর থেকে। মাসির হাত তখনও ধরা। পেছতে পেছতে হুমড়ি খেয়ে পরে আলো, মাসির হাত ছিটকে যায়। তার শরীরটা ছিটকে নামে মাটির ওপর। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে আরো কটা শরীর। হঠাৎ যোনিদ্বারে ব্যথা ওঠে। আলো কেঁপে ওঠে। জলের ঢেউয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া চাঁদের মতো ভাসতে থাকে সারা রাত। রাত আর ফুরোয় না। একসময় আলো স্থির হয়। লোকটা সরে যায় আলোর ওপর থেকে, গা-টা এলিয়ে দেয় আলোর পাশে।
নাইট ল্যাম্পের অল্প নীল আলোয়, লোকটার মুখ আবার খুব চেনা লাগে আলোর। অন্ধকারটা আবার গাঢ় হয়ে ওঠে। আলোর সামনে একটা ডালা হাট করে খুলে পড়ে আছে এক রাশি পুরুষের পোষাক। খাটের অনেক গভীরে একটা ট্রাঙ্কে বন্ধ ছিল এত দিন। সেই সব জামার পাহাড় সরতে সরতে একটা ফটোফ্রেম, সাদা কালো একটা ছবি। এতো অন্ধকার ভালো দেখা যায় না। মাসটা আষাঢ়। বিদ্যুৎ চমকে ওঠা স্বাভাবিক। সামান্য সময়ের সেই আলোয়, সে দ্যাখে, একটা মুখ। পোকায় কাটা একটা মুখ। পেছন থেকে তখনই মা ঢোকে ঘরে। ‘এটা কার ছবি মা?’ হিংস্র থাবায় ছিনিয়ে নেয় মা। কেন বার করেছিস? আবার বাজ পড়ে। সেই শব্দে পাশের লোকটা উঠে পড়ে, শীতকালে মেঘ ডাকছে! কী যুগ পড়ল! ঘরের হালকা নীল আলোয়, আলো দেখল, ছবিটার চুলে হালকা পাক ধরেছে। সাদা কালো ছবিটায় হালকা রঙ এসেছে যেন, পরনে সাদা জামা, গাড় নীল প্যান্ট আর পিঠে একটা ব্যাগ। একটা ডিম টোস্ট ছিঁড়ে খাচ্ছে, কাটা চামচে।