পাত্র সিলেকশনে আমি যখন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারদের ছেড়ে মাত্র ১৫০০০ টাকা বেতনের ইমামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলাম। বাবা মা এই বিয়েতে আমার মত দেয়ার কথা শুনে ভুত দেখার মতো চমকেছিল।আমি অতি সাধারণ হলেও,হুজুর টাইপের লোকগুলোকে কেন যেন আমার ভাল্লাগতো না। কারণ হিসেবে, দাঁড়ি বা একগুঁয়ে প্রকৃতির এমন কিছু ছিল না। নিজেও কখনো ভালো না লাগার কারণ খুঁজে পেতাম না। তবে পাত্র দেখার প্রতিবারই, বাবা আমাকে পাশাপাশি একটা রুমে বসতে বলতেন যেখান থেকে বাবার এবং পাত্রের মধ্যকার সমস্ত কথাবার্তা আমি শুনতে পেতাম। এমনটা করার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, আর সেটা ছিল বাবা জানতে চায়তেন, আমার পাত্রের কথাবার্তায় কেমন লেগেছে?? বা আমি পাত্রকে সিলেকশন করবো কিনা?? মোস্তফার বেলাতেও সেটাই হয়েছিল।
–তোমার নাম??বরাবরের মতোই বাবা মোস্তফাকে প্রশ্ন করেছিলেন।
–জি, মুস্তফা
–বাসা??
—নিমতলি।
—কি করো??
–জি, শহরে, একটা মসজিদে ইমামতি। বাবা ভ্রু কুঁচকে,
—বেতন কত পাও??
জি, ১২ থেকে ১৫০০০ হবে সব মিলে আর কি। বাবার মন থেকে মুস্তফার নামটা তখনি কেটে গিয়েছিল যেখানে পাত্র হিসেবে লাখ টাকা বেতনের চাকরিজীবী কে আমি রিজেক্ট করেছি সেখানে মাত্র ১৫,০০০ টাকা বেতনের মানুষের সাথে সংসার করা আমার পক্ষে পুরোপুরি অসম্ভব।
–এই কয়েক টাকা দিয়ে তুমি আমার মেয়েকে সুখী রাখতে পারবে??
—আংকেল, সুখ দেয়ার মালিক তো আমি বা আপনি না। ওই যে উপরে যিনি আছেন তিনি। এবং তার ইচ্ছাতেই সুখ দুঃখ আমাদের উপর নিপতিত হয়। উনি যদি চান তো ১৫,০০০ টাকা দিয়েই আমি আপনার মেয়েকে সুখী রাখতে পারব। আর উনি না চাইলে ১৫,০০,০০০ টাকা বেতন দিয়েও আপনার মেয়েকে আমি সুখে রাখতে পারব না। তবে আমার ইলমে এটুকু বিশ্বাস আছে, আপনার মেয়েকে কষ্ট দিবো না কখনো।
–কথা তো বলাই যায় বাবা। কিন্তু কাজে?
–আমি আমাদের রাসূলের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তাই ভরসা করতে পারেন। এরপর আরো কিছু বাকবিতন্ডার পরে বাবা মুস্তফাকে বিষয় টার উত্তর পরে জানাবে বলে যেতে বলে। এখন আমার মুখ থেকে এই বিয়েতে আমি রাজি, কথাটা শুনে বাবা মা যেন আকাশ থেকে পড়েছেন।
–মা, তুই আমার ঘরে কখনো অভাব পাসনি বলে বুঝতে পারছিস না যে, অভাবের তীরের যন্ত্রণা ঠিক কতটা কষ্টদায়ক।
–অভাব তো আমাদের রাসুলের ও ছিল বাবা। তার মেয়ে মা ফাতিমার ও ছিল। তাই বলে আমি অভাবের তাড়নায় এমন কিছু হারাতে পারব না যেটা আমার জন্য রহমত পূর্ণ। এরপর বাবা আমাকে আর কোন কথা বলেনি। আমাদের ইচ্ছাটায় উনি পূরণ করেছিলেন।সত্য বলতে বিয়ের কয়েকটা মাস আমাদের অনেক ভালো চলছিল।
কিন্তু ৭ মাস পরে, কোন এক অসুখে আমার শ্বশুড় মশাই মারা যাওয়াতে আমার শাশুড়ি আম্মা একা হয়ে যান। তাছাড়া আমার শ্বশুড় মশাইয়ের হাজার স্মৃতি ওখানে আছে বলে শাশুড়ি আম্মাকে শহরে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম না। আর মুস্তফা যেহেতু একা অর্থাৎ বাবা মায়ের এক সন্তান ছিল তাই একা মাকে ফেলে শহরে থাকা ওর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। শুধু এই একটা কারণেই আমরা গ্রামে চলে আসি। আর মুস্তফা গ্রামের এক মসজিদেই ইমামতির কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু শহরের বেতনের চাইতে গ্রামের বেতনটা প্রায় আধাও ছিল না। অভাব কাকে বলে এবং ওর যন্ত্রণাটা কেমন আমি তখন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম। কোন কোনদিন এমনও গিয়েছে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়েছে। রাত্রে যখন আমি ওপাশ হয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতাম। মুস্তফা তখন আমায় এপাশ করে বলতো,
–কষ্ট হচ্ছে অনু??
–ন, নাহ।
–আমায় ক্ষমা করো অনু।
তোমার বাবাকে দেয়া কথাটা আমি রাখতে পারলাম না।মুস্তফার মুখে হতাশার ছাপ মুস্তফার মুখের সেইদিনের সেই হতাশার ছাপটাই আমায় ধৈর্যধারণ করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল।মুস্তফা আমায় সবসময় বলত, অনু, দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর ভরসাতে প্রতিদিন একটু একটু করে আমি জোরে করে নিশ্বাস নিতে পারতাম। স্বস্থির শ্বাস যেটাকে বলে। বাবার থেকে টাকা নিয়ে কিছু একটা করতে বলতাম মুস্তফাকে। কিন্তু ও আমায় বলতো, এতটাও তো খারাপ অবস্থা না আমার যে শ্বশুড়বাড়ির থেকে তার কষ্টে উপার্জিত টাকা নিবো। হুম নিবো যখন আমার আর কোন পথ খোলা থাকবে না তখন সাহায্যের জন্য তোমার বাবাই তো আছে তাই না?? এরপরের দিন গুলো ছিল ভয়ংকর রকমের কষ্টের।
একদিন গ্রামের মেম্বারের সাথে কয়েকজন লোক এসে দাবি করল যে আমার শ্বশুড় ভিটেমাটি নাকি ওনাদের(চাচা শ্বশুড়দের) দিয়ে দিয়েছেন। যেটা পড়ে আমরা শুনতে পেয়েছিলাম, বেঈমানী করে আমার নিরক্ষর শ্বশুড়ের থেকে চাচা শ্বশুড়রা সবকিছু লিখে নিয়েছিল। মুস্তফার সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। এরই মধ্যে আমি ওকে আমার বাবার থেকে টাকা নিয়ে ভিটেমাটি টুকু রক্ষা করতে বলি। কিন্তু শাশুড়ি আম্মা আমার বলেছিল, যেই মাটিতে বেঈমানদের ছায়া পড়েছে, সেখানে আমি আর এক মুহুর্তও থাকব না। মুস্তফা আমাদের নিয়ে পুনরায় শহরে চলে আসে।
পুরাতন মসজিদে ইমামতির কাজটা করতে চাইলে ওনারা বলে, নতুন ইমামতিকে নেওয়া হয়েছে তাই কাজ টা তারা দিতে পারবে না। তবে পাশের গলির মোড়ে নতুন মসজিদের জন্য একজন ইমামতির প্রয়োজন, তো, তুমি চায়লে সেখানে ইমামতি করতে পারো। বেতন বড় জোর ওরা ১০,০০০ দিতে পারবে। মুস্তফা ঐদিন খুশিমনেই বাসায় ফিরেছিল। ওর হাসিমুখ দেখে আমি নিজেও কোন কারণ ছাড়াই হেসে ফেলেছিলাম। যা কিছু হোক না কেনো, ওর হাসিমুখটাই আমার কাছে সবথেকে বড় পাওয়া ছিল।
ও আমাকে ঐদিন বলেছিল, আজ আমার আর তোমার ধৈর্যের প্রতিদান দিয়েছেন মালিক। এরপর থেকে আমাদের কিছুটা অসুবিধা থাকলেও, সুখের কোন কমতি ছিল না। যেই সুখ, কোটি টাকার বেডে ঘুমিয়েও পাওয়া যায় না। [আজ যারা ভাবছেন টাকায় আমাদের সব সুখের মূল। বিশ্বাস করেন, আপনি যদি কাঙ্খিত টাকাটা পেয়েও যান তবুও আপনি সুখের নাগাল পেতে পারবেন না। কোন না কোন একদিক দিয়ে আপনি অসুখী থাকবেনি। কারণ সুখ আপনার বা আমার হাতের জিনিস না। ওটা দেয়ার মালিক একজনই]
গল্পের বিষয়:
গল্প