লোকাল ট্রেনে তয়মুজ তরফদার

লোকাল ট্রেনে তয়মুজ তরফদার

রেক্সিনের আধময়লা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে তয়মুজ তরফদার স্টেশনের দিকে মেলা দিলে তার একান্নবর্তী পরিবারের মানুষজন প্রমাদ গুনে। কেউ একজন মন্তব্য করে- আবার সে তেলেসমাতি শুরু করলো! তয়মুজ তরফদার সচরাচর চেকের লুঙ্গির সাথে ঢোলাঢালা শার্ট পরে গেরামের বাজারে ঘুরে বেড়ান। আজ তার বেশভূষা একটু ভিন্ন। তিনি প্যান্টের সাথে জংলিছিটের একটি হাফহাতা হাওয়াই শার্ট পরেছেন। খটখটে বাটার জুতা পায়ে ধূলিধূসরিত সড়কের ইটপাথর, গাতাগর্ত বাঁচিয়ে, ডিগি দিয়ে-দিয়ে, হেঁটে তিনি রেলওয়ে স্টেশনের বাঁধানো প্ল্যাটফর্মে ওঠেন। বাড়ি থেকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে, তার তেরো বছরের ভাইগনা ইয়াজুদ্দিকে। সে পেছন থেকে মিনমিনিয়ে বলে ‘মামু’। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ-মুখে দারুণ গোসা ফুটিয়ে তাকে বিরিঙ্গি দেন। তাতে ইয়াজুদ্দি কী করবে বুঝতে না পেরে পিছু হটে।

দুপুরের সজনে-ফাটা রোদে হেঁটে এসেছেন বলে তয়মুজ বেহদ ঘামছেন। তিনি ব্যাগটি ঘাসে রেখে, টিউবলে চাপ দিয়ে ঘাড়-গলায় পানি মাখান। রুমাল দিয়ে মুছে তা ভাঁজ করে গর্দনায় রেখে, কামানো ফ্যাসফ্যাসে দাড়ি চুলকিয়ে- দূরে সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে ট্রেন আসার জন্য ইন্তেজারি করেন। গায়ে-গতরে দশাসই পুরুষ তয়মুজ। লেখাপড়াও করেছেন মেট্রিক অব্দি। চাইলে তার শক্তপোক্ত তনতন্দুরস্তির কারণে আনসারের হাবিলদার হতে পারতেন। এমনকি মাঝেমধ্যে তামাশা-তেলেসমাতিতে লিপ্ত না থাকলে, তয়মুজ হতে পারতেন গেরামের টোকা-ফারগ লিখিয়ে মহুরি। কিন্তু আদতে তয়মুজ পেশাদারি কোনো কাজকর্মের সাথে সংযুক্ত নন একেবারে। তিনি তেমন কিছু করেন না। তার বয়স বিস্তর হলেও ঘর-সংসার হয়নি। ভাইদের একান্নবর্তী পরিবারে বাস করেন। তরফদারদের গ্রামে জমিজিরেত আছে। তার ছোট ভাই হরমুজ তরফদার বাজারে রেশন দোকানের মালিক। চালের আড়তেও তার পুঁজি খাটছে। তার অন্য দুই ভাইদের একজন ওমান ও অন্যজন ইতালিতে প্রবাসী। মাঝেমধ্যে ব্যাংক মারফত তার পরিবারে ফরেন এইড আসে।

পরিবারের সয়সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হলে তয়মুজ একখানা দোকানঘরের মালিক হয়েছেন। দুনিয়াদারির অন্য কোনো কাজে শরিক না থাকলেও তয়মুজ মাসের শেষে দোকানের ভাড়াটা আদায় করেন। আর বাকি সময় গ্রামের বাজারে ঘুরেফিরে তার সময় কাটে। কথাবার্তা বলা তেমন পছন্দ করেন না। তবে হুঁশ যখন ঠিক থাকে, আচরণে তয়মুজ তখন রীতিমতো অমায়িক। বাজারে উঠতি বয়সের ছেলেপিলেদের সাথে ক্যারমবোর্ড খেলেন। তাসের টোয়েন্টি নাইনেও তিনি পারঙ্গম। কখনো-সখনো চায়ের দোকানে কুড়মুড়ে গজার সাথে এক পেয়ালা চা খেয়ে, রমনা সিগ্রেট মুঠো করে ধরে চোখ মুদে কষে দম দেন। তারপর তিনি চুপচাপ হেঁটে যান কাপড়হাটার দিকে। কোনো দোকানে ঢুকে ধুন ধরে শাড়ির ডিজাইন দেখেন। তবে কিছু কেনেন না। দোকানদাররা তয়মুজকে ভালো করেই চেনে। তারা তেমন গা করে না। তবে কাপড়ের নকশা দেখা দীর্ঘমেয়াদি হলে, কোনো দোকানি হয়তো বলে, ‘তুয়মুজ ভাই, মেলা তো কাপড়চোপড় দেখলেন, এবার সরেন, অন্য কোথাও যান।’ তিনি আরেকটি সিগ্রেট ধরিয়ে নীরবে চলে আসেন গরু-ছাগলের পট্টিতে। ছাগলের চেয়ে গাইগরুতেই তার আগ্রহ বেশি। তিনি তাদের গায়ে হাত বোলান। কোনো কোনো গরুর দালাল ফিসফিসিয়ে কিছু বলে তাকে ডেকে নেয় তাদের গবাদিপশুর কাছে। তাদের ধারণা- তয়মুজ নির্দিষ্ট কোনো গরুর গায়ে হাত রাখলে তা ভালো দামে বিকাবে তাড়াতাড়ি।

কখনো ভিড়বাট্টা তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন তিনি জলিল বেপারীর টং দোকান থেকে বাকিতে কেনেন আরেক প্যাকেট রমনা। জলিল জানে যে- মাসের শেষে, দোকানের ভাড়া আদায় করে, তিনি কড়ায়গণ্ডায় তার সিগ্রেটের দাম শোধ করে দেবেন। তাই সে কোনো আপত্তি করে না। তয়মুজের মাঝে টেনশন তীব্র হয়ে উঠলে- তিনি হাতে সিগ্রেট ও দিয়াশলাই মজুদ রাখতে পছন্দ করেন। তারপর তিনি হেঁটে যান বাজারের কাছাকাছি হাসপাতালের লাগোয়া পুকুরের দিকে। তার বাঁধানো পাড়ে বসে, করতলে মুঠো করে সিগ্রেটটি পাকড়ে ডুবে যাওয়া সুরুযের দিকে তাকিয়ে কষে দম দেন।

লোকাল ট্রেনটি আসতে আজ অনেক দেরি হচ্ছে। রেলগাড়ির জন্য ইন্তেজারি করতে করতে তয়মুজ অধীর হয়ে ওঠেন। স্টেশনের অনেকেই তাকে চেনে। প্যান্ট-শার্টের সাথে বাটার জুতাটুতা পরে, ব্যাগ কাঁধে নতুন এক ধরনের ভেক ধরাতে, তারা আনকোরা তামাশার প্রত্যাশা করে। কী ঘটতে যাচ্ছে- এ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য একজন খিলিপান নিয়ে এসে তাকে অফার করে কাছে ভিড়লে- তয়মুজ সতর্ক হন। তিনি চোখ লাল করে তার দিকে তেড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করেন। পানের বোঁটা থেকে চুন খেতে খেতে মানুষটি পিছু হটে। তয়মুজ হেঁটে চলে যান প্ল্যাটফর্মের প্রান্তিকে। এদিকে মানুষজন কম। এখানে দাঁড়িয়ে তিনি সিগন্যালের লাল-সবুজ বাতির কাচের দিকে তাকিয়ে ধরান আরেকটি সিগ্রেট।

তয়মুজের আচরণকে গাঁওগেরামের পাঁচজন তামাশা হিসেবেই দেখে। তবে বিষয়টি সামাজিকভাবে সহনশীলতার গণ্ডি অতিক্রম করলে, তারা তিতিবিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে বলে- ‘তয়মুজ আরবার কিংবা কিসিমের তেলেসমাতি শুরু করলো!’ তার মধ্যে গোলমেলে আচরণ চাগিয়ে ওঠে বছরে দু-একবার। নিকট-অতীতে তিনি এমন কিছু ঘটনা তৈরি করেছেন- যা প্রায়শ চায়ের দোকানে গল্পগাছার খোরাক জোগায়। জোয়ানকি বয়সে তয়মুজ একবার নিজেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন সাপুড়ে হিসেবে। তিনি মাথায় গামছা পেঁচিয়ে বাঁশি বাজানোর মুখভঙ্গি করে সাপের খেলা দেখাতে শুরু করেন। লোকজন ভিড় করে তার তামাশা দেখতে দাঁড়াতো। তিনি ফণাতোলা কাল্পনিক সাপগুলোকে বেতের খাকরায় পুরে, প্যাচপেচে প্যাককাদা মাড়িয়ে যখন হেঁটে যেতেন, তখন তার পেছন পেছন শোরগোল করে ছুটতো গাঁওগেরামের তাবৎ আণ্ডাবাচ্চা। সাপ খেলাতে সমাজের পাঁচজন পয়লা দিকে আপত্তির কিছু দেখেনি। তবে তয়মুজ ইস্কুলে গিয়ে হামেশা খেলা দেখাতে শুরু করলে, শিক্ষকদের ডিসিপ্লিন বজায় রেখে ক্লাস চালানো মুশকিল হয়ে ওঠে। তাঁরা তাকে স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তয়মুজ কথাবার্তা না শুনে, হেডমাস্টারের কামরায় গিয়ে ‘বক্‌খিলারে কাঁচা ধইরা খাওয়ার’ ভঙ্গি করলে, সংস্কৃত পড়ানো তেজি পণ্ডিত মশাই খেপে ওঠে গল্লাবেতের ছড়ি দিয়ে তাকে তাড়া করেন। আক্রান্ত হয়ে তয়মুজ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন। তিনি ছড়ি কেড়ে নিয়ে পণ্ডিত মশাইকে দু’ঘা কষালে, তার আচরণ জটিল হয়ে পড়ে। ছাত্ররা তাকে ধাওয়া করে নিয়ে আসে গেরামের বাজার অব্দি।

পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে থাকলে, ছোট ভাই রেশন দোকানের হরমুজ উলখুড়ির মোল্লাজি হুজুরের দ্বারস্থ হয়। তাঁর দোয়া-তাবিজে উনিশ-বিশ কিছু না হলে, অতঃপর মোল্লাজি সাততক্তি ধাছা বা সাত ভাঁজের পাগড়ি পরে তাকে দেখতে আসেন। খুব জবরদস্ত গোছের জিন-ভূত ছাড়ানো মৌলবি তিনি। উলখুড়ির মাদ্রাসাতে জিন্নেমোমিনরা তার কাছে পবিত্র কালামুল্লার সবক নিতে আসে। এরা তালবে আলিমের লেবাস পরে যখন মাদরসার জয়েলে ঘোরাফেরা করে, তখন জমিনে তাদের কোনো ছায়া পড়ে না। মোল্লাজি তয়মুজের বাড়ির কাছাকাছি এসে, পিতলে বাঁধানো কুঁকড়া লাঠিটি দুপুরের তমতমে আফতাবের দিকে উঁচা করে তুলে ধরে- ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে হাঁক পাড়লে, তামাশা দেখতে আসা গেরামের তাবৎ ইনসানের পিলে চমকে যায়। তিনি আয়নাতে তয়মুজের প্রতিফলিত ছায়ার মাপজোক নিয়ে, হিসাব-কিতাব করে প্রেতের উপরি-লাগা হিসাবে রোগ নির্ণয় করেন। তৎক্ষণাৎ আছর ছোটানোর বন্দোবস্ত করা হয়। মোল্লাজি হুজুর জনাসাতেক জোয়ান তালবে আলিম নিয়ে সদলবলে তাকে ধরে-পাকড়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে নদীজলে চোবান। কিন্তু প্রেতটি স্বভাবচরিত্রে খবিস কিসিমের। সে বাজারের বস্তাপচা গালিগালাজের সাথে মোল্লাজির দিকে থুতুু ছুড়ে দেয়। হুজুর অতঃপর প্রেতের ফাতরামি ছাড়ানোর জন্য জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে তার শরীরে ছ্যাঁকা দেন। তার নাসারন্ধ্রে ঢোকানো হয় প্রচুর পরিমাণে মরিচ পোড়ার ঝাঁঝালো ধোঁয়া। দিন তিনেক চোবানোতে তয়মুজের গতরে দুমদুমা জ্বর আসে। তাপের তীব্র ঘোরে গালিগালাজের সাথে কিছু নাপাকি কালাম উচ্চারিত হতে থাকলে, হুজুর তার মুখে রুমাল গুঁজে, গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে, তিন তালবে আলিমকে কানের কাছে সারারাত জিকির করার হুকুম দেন। এতে প্রেতের চরিত্র সংশোধন হয়। দুই দিন পর মুখ থেকে বান্ধন খুলে দিলে, তয়মুজ আল্লাহর পবিত্র কালাম উচ্চারণ করে মোল্লাজিকে তাজিম করে বলেন, ‘আসসালামু আলায়কুম হুজুর’। এ আচরণে আন্দাজ করা হয় যে, প্রেত পগারের দিকে নিষ্ফ্ক্রান্ত হয়েছে। বাড়ির নয়ানজুলির কাছে একটি ভঁইশানিমের কঁচমা ডালা কোনো কারণ ছাড়া ভেঙে পড়লে, প্রেতের পলায়নের পরিস্কার আলামত পাওয়া যায়। জ্বর-কাশিতে সপ্তাহতিনেক ভুগে অত্যন্ত শীর্ণকায় হয়ে পড়েন তয়মুজ। তার মাথা থেকে তিরোহিত হয় সাপের খেলা দেখানোর আচানক আইডিয়া।

এর পর কিছুদিন তয়মুজ ভালোই ছিলেন। হাটে-বাজারে যান। ছেলেছোকরাদের সাথে ক্যারমবোর্ডের গুটি স্ট্রাইক করেন। কেউ কিছু জানতে চাইলে বাতচিতে বিশেষ উৎসাহ দেখান না। তবে দেদার ধূমপান করেন। তার হাতের গাতায় হামেশা মুঠো করে ধরা থাকে রমনার প্যাকেট ও দিয়াশলাই। হাওন মাসের শেষদিকে, সূর্যগ্রহণের দিন তার মাঝে আবার আছর করে উপরি। তিনি ছকল্লি সফেদ কোর্তা-পায়জামার সাথে কিস্তি টুপি মাথায় বাজারের বাজ পড়া পাকুড় গাছতলায় দাঁড়িয়ে তারস্বরে জিকির করতে শুরু করেন। আওয়াজ শুনে চারপাশে গোল হয়ে মানুষজন দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর জিকিরের সুর বজায় রেখে বকতে শুরু করেন বেশরা কালাম। মুখ থেকে থুথুর সাথে উৎক্ষিপ্ত হয় কিছু খবিস লব্‌জ। পাশ দিয়ে ছাত্তি মাথায় পানের খিল্লি চিবাতে-চিবাতে যাচ্ছিলেন ইউনিওনের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দীন কটাই। জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে তয়মুজকে তিনি তৎক্ষণাৎ বকোয়াস বন্ধ করতে হুকুম দেন। তাতে তয়মুজের আচরণে উনিশ-বিশ কিছু না হলে রাশভারী কটাই মিয়া ছাত্তি দিয়ে পিটিয়ে তার তেলেসমাতি ছাড়ানো হুমকি দেন। তয়মুজ বকোয়াস বন্ধ করে নীরবে পায়জামার নেওয়ার খুলে বিবস্ত্র হয়ে সকলকে দেখান, তার গতরের নানা জায়গায় অঙ্গারের ছ্যাঁকা খেয়ে পুড়ে যাওয়ার দাগ। কটাই মিয়া এতে বিরক্ত হয়ে তাকে পায়জামা পরার হুকুম দিলে, তয়মুজ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন। দিগম্বর হালতে ছাত্তি কেড়ে নিয়ে, কুস্তাকুস্তি করে জখম করেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে। আরও দুয়েকজনের হাত-পা মচকিয়ে ছুটে গিয়ে কামারের দোকান থেকে তিনি তুলে নেয় গনগনে লাল খন্তা। পরিস্থিতি খতরনাক হয়ে পড়লে ছোট ভাই হরমুজ আনসারদের ডেকে আনে। তারা হুইসেল বাজিয়ে ‘হল্ট হুকুমাদার’ রব তুলে তার হাত-পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

ডাণ্ডাবেড়ির কারণে তয়মুজের হাট-বাজারে আওয়ারা চলাফেরা পুরাপুরি বন্ধ হয়ে যায়। হরমুজ তরফদার উলখুড়ির মদরছায় যোগাযোগ করে জানতে পারেন- মোল্লাজি হুজুর ওমরা পালন করতে মক্কা শরীফ গেছেন। এদিকে তয়মুজের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বেড়িগ্রস্ত পায়ে কায়ক্লেশে হেঁটে গিয়ে তরফদার বাড়ির পুকুরপাড়ে তার মায়ের কবরের পাশে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে করুণ স্বরে কাঁদেন। তাতে গাঁওগেরামের মানুষের দিলে পয়দা হয় হামদর্দির। তারা উদ্যোগ নিয়ে দৌলতপাশা গ্রাম থেকে ডেকে আনেন কবিরাজ অঘোরনাথ বাবুকে। আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রে সুপণ্ডিত টিকিধারী কবিরাজ মশাই থেলো হুক্কায় ধূমপান করতে করতে কিছুক্ষণ তয়মুজকে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, ‘ব্যাধি কঠিন কিছু না। শাস্ত্রে একে মনবৈকল্য বলা হয়। সঠিক চিকিৎসায় নিরাময় অবধারিত।’ তিনি তয়মুজের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে, তালুতে কেরাইয়া পাতার বরণ দিতে বিধান দেন। নিজ হাতে তয়মুজকে তিনি খাইয়ে দেন ছাগলের নাদির মতো দেখতে কালচে-খয়েরি বটিকা। চিকিৎসার সপ্তম দিন শুক্রবার সকাল বেলা, রাশি-নক্ষত্র তর্পণ করে, সঠিক লগ্নে কবিরাজ মশাইয়ের তত্ত্বাবধানে তয়মুজের ডাণ্ডাবেড়ি খুলে নেওয়া হয়। কবিরাজ মশাই যৎসামান্য দক্ষিণা নিয়ে বিদায় নিলে ওইদিন ওজু-গোছল করে দুপুরবেলা তয়মুজ বাজারের পাঞ্জেগানা মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যান।

আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় এ যাত্রা নিরাময়ের পর তয়মুজ তরফদার সম্পূূর্ণ সাফ-সুরত হালতে স্বাভাবিকভাবে জিন্দেগি-বন্দেগি শুরু করেন। তার বেশ-ভূষাতেও পরিবর্তন আসে। তিনি পায়জামার সাথে কুঁচকানো খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে বাজারের একটি সেলুনে বসতে শুরু করেন। প্রতিদিন খেউরি করে নরসুন্দরের ঘুরন্টি দেওয়া চেয়ারে বসে থাকেন। সেলুনের দেয়ালে লাগানো পোস্টারে তীর-ধনুক হাতে যুদ্ধংদেহী রাম-লক্ষ্মণের সাথে ধুতি পরা হনুমানের লংকাপুরীতে যুদ্ধযাত্রার চিত্র খুঁটিয়ে দেখেন। নাপিতের রেডিওতে মাঝে মাঝে বিবিসির সংবাদও শোনেন। এ সময় একবার তার মাথায় বাজারের দেয়ালে পোস্টার লাগানোর আইডিয়া আসে। তিনি কোথা থেকে মোটা দাগের আঁক দেনেওয়ালা একটি মার্কার জোগাড় করে গোটা দশেক পোস্টার পেপারে আবজাব কিছু রেখাবহুল নকশা এঁকে তা সাঁটেন বাজারের নানা জায়গায়। চুনকাম করা দেয়ালে তার খদ্দরের ঢোলা পাঞ্জাবি পরা দশাসই সুরতের দীঘল ছায়া পড়ে। দূর থেকে তাকে গণআন্দোলন করা ছাত্রনেতাদের মতো দেখায়। বাজারের আমআদমিরা তার পোস্টার সাঁটা আগ্রহ নিয়ে দেখে বটে, কিন্তু তয়মুজ তরফদার অতীতে যেসব জোরালো তেলেসমাতি ঘটিয়েছেন, সে তুলনায় এ তামাশা খুবই কমজোর কিসিমের। পোস্টারে আঁকা নকশার বাণী নিয়ে কেউ কিছু ভাবে না। বিষয়টাকে মোটেই গুরুত্ব দেয় না মানুষ। তিনিও দিন কয়েক পর পোস্টার লাগানোতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।

এ ঘটনার মাস সাতেক পর, তয়মুজ জংলি ছিটের হাওয়াই শার্ট পরে রেক্সিনের ব্যাগ কাঁধে স্টেশনে আসলেন। একটু আগে লোকাল ট্রেনের ঘণ্টা পড়েছে। টিকিটঘরের জানালায় প্যাসেঞ্জাররা সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। পাইটম্যান লাল-সবুজ নিশান বগলে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে খাড়া হয়েছে। আউটার সিগনাল থেকে ঝিকঝিকিয়ে রোদপোড়া একটি রেলগাড়ি স্টেশনে এসে ঢোকে। তয়মুজের ভাগ্নে আবার মিনমিনিয়ে তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অনুনয় করে। তাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে তিনি ট্রেনে যাত্রীদের ওঠানামা দেখেন। হুইসেল বাজিয়ে রেলগাড়ি ফের রওনা দিলে তয়মুজ চলন্ত গাড়ির সাথে সাথে হাঁটেন। দূরত্ব বজায় রেখে ভাগ্নো তাকে অনুসরণ করছে। গাড়ির গতি একটু বাড়তেই তিনি লাফ দিয়ে সিঁড়িতে পা রেখে দরজার হ্যান্ডেল ধরেন। পেছন থেকে ছেলেটি কমজোর গলায় ডাকে, ‘তয়মুজ মামু।’

ট্রেনের কামরায় আজ ভিড়বাট্টা তেমন নেই। একজন প্রৌঢ় যাত্রী পত্রিকা পড়তে পড়তে চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে তাকে দেখেন। জানালার পাশে বসে তরুণী এক মা দুধদানিতে তোয়ালে পেঁচিয়ে তা তুলে দিচ্ছে বাচ্চার মুখে। অনেক দিন পর তয়মুজ কথা বলেন। তিনি ক্যানভ্যাসারের ভঙ্গিতে রেক্সিনের ব্যাগ থেকে অদৃশ্য কিছু বের করার ভঙ্গি করে বলেন, স্বপ্নে পাওয়া এ ভেষজ বটিকা তিনি তৈরি করেছেন কেরাইয়ার পাতার সাথে হরীতকী ও দারুচিনির মিশেল দিয়ে। এটি সেবনে অম্ল, অর্শ ও ভগন্দর থেকে সান্নিকপাতি অব্দি সমুদয় রোগের নিবারণ হয় অতি সহজে। সচরাচর এ বটিকার দাম সাড়ে সাত টাকা। তবে আজকের ট্রেনে তিনি বিশেষ ছাড় দিচ্ছেন। যাত্রীরা চাইলে মাত্র তিন টাকায় তা খরিদ করে নিতে পারেন। এ পর্যন্ত বলে তয়মুজ মৃদু হেসে যোগ করেন, ‘এ বটিকা খরিদ করে পকেটে রাখলে মনে করা যেতে পারে, নিজ ঘরে বসে আছেন একজন আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রে সুপণ্ডিত কবিরাজ।’

তয়মুজের ব্যাগে বা হাতে বটিকা বলে কিছু নেই, বিষয়টি নজর করে তার মস্তিস্কে যে ব্যাপক গোলমাল হয়েছে, ট্রেনযাত্রীরা তা বুঝতে পারে। দাড়িওয়ালা এক পুলিশ ফ্যানের ফড়ফড়ে বাতাসের নিচে খাকি শার্টের বোতাম খুলে হাওয়া খাচ্ছিলেন। তিনি তয়মুজকে দাবড়ি দিয়ে আজাইরা বকোয়াস থামাতে বলেন। ডাণ্ডাবেড়ির ঘটনার পর থেকে তয়মুজের খাকির প্রতি ডর-ভীতি পয়দা হয়েছে। তিনি ধমক খেয়ে চুঁচেরা না করে খালি একটি সিটে বসে জানালা দিয়ে তাকান। বাইরে গাছপালা, ঘরবাড়ি, সংসারের তাবৎ কিছু ছুটে যাচ্ছে পেছনে। দেখতে দেখতে তয়মুজের মনে হয়, তিনি তার জিন্দেগির যাবতীয় গর্দিশের অকুস্থল থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন দ্রুত। দেহ-মনে তার বেজায় নির্ভার লাগে। তিনি খোশ মেজাজে একশলা রমনা সিগ্রেট ধরান। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে দেখেন, ফ্যানের হাওয়া খেতে খেতে পুলিশযাত্রী তাকে নিরিখ করছেন। এতে তয়মুজের হেলদোল কিছু হয় না। তিনি জানালার চলমান দৃশ্যপটের দিকে স্রেফ তাকিয়ে থাকেন।

সূত্র: সমকাল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত