আমার বন্ধু মাহবুব বিয়ে করার জন্য পাত্রী খুঁজছে। বিয়ে করার জন্য তার যে করেই হোক একটা ভার্জিন মেয়ে লাগবে। কিন্তু কিছুতেই সে কোনো ভার্জিন মেয়ে খুঁজে পাচ্ছে না। মাহবুবকে নিয়ে তার মা, মানে আমাদের খালাম্মা বেশ টেনশনে আছেন। গত জানুয়ারিতে বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেল কিন্তু এখনো ছেলের বিয়ে দিতে পারছেন না। মানুষজনকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে টেনশন করতে হয়; কিন্তু খালাম্মা ছেলেকে নিয়ে পড়েছেন মহা বিপদে।
কিছুদিন আগে মাবুব ইটালি থেকে দেশে ফিরল। এবার খালাম্মা বেশ ভালোভাবেই পিছু লেগেছেন। যেভাবেই হোক ছেলেকে এবার তিনি বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। কোনোভাবেই এবার ছেলেকে তিনি আর একলা দেশ থেকে ছাড়ছেন না। বিমানবন্দরে চৌকাঠ পার হতে হলে অবশ্যই জোড়া হয়ে পার হতে হবে। মাহবুবের এমন একরোখামীর পিছনে তার লজিক হলো— এত বছর ইউরোপ আমেরিকায় থেকে এখন পর্যন্ত সে কোনো একটা মেয়ের হাত পর্যন্ত টাচ করল না, তাহলে সে কেনো একটা ভর্জিন মেয়ে পাবে না! কথা সত্য, লজিক আছে। সামান্য পাপ-তাপ করলে নাহয় আমরা করেছি। মাঠে-ঘাটে দৌড়াদৌড়ি করলে নাহয় আমরা করেছি। কিন্তু মাবুব তো ঐগুলার ধারে কাছেও ছিল না। সে তো ফুলের মতো পবিত্র। এখনো ভার্জিন, মানে পৃথিবীর একমাত্র ভার্জিন পুরুষ। তাহলে ওর সাথে কেনো এরকম অন্যায় হবে! ও অবশ্যই একটা ভার্জিন মেয়ে ডিজার্ভ করে। নইলে তা হবে অন্যায়, ঘোরতর অন্যায়।
আর আমরা বন্ধুরা থাকতে কখনো আমাদের একটা বন্ধুর সাথে এমনটা হতে দিতে পারি না। তাই সবাই মিলে আমরা মেয়ে খুঁজা শুরু করলাম, মানে ভার্জিন মেয়ে। মিশন ভার্জিন পাত্রী সন্ধান। কিন্তু কোনোভাবেই কোথাও কোনো ভার্জিন পাত্রী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব ঠিকঠাক; কিন্তু একদম শেষ মুহুর্তে হলেও মেয়ের কিছু না কিছু বের হয়ে আসছেই। হয়তো কোনো সহপাঠী ফোন করে কিছু বলছে অথবা কোনো প্রতিবেশী বা বন্ধু অথবা কখনো কখনো আত্মীয়-স্বজনও। এখন এগুলো সত্যি নাকি মিথ্যে সেগুলো পরের ব্যাপার; কিন্তু আমরা তো মাহবুবের বেলায় কোনো প্রকার রিস্ক নিতে পারি না। শত হোক দুধে ধোয়া ছেলে আমাদের। অমন সোনার ছেলে। ইউরোপ আমেরিকার থেকেও আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে টাচ করা দূর থাক হাতটা পর্যন্ত ধরেনি ! এই খবর জানাজানি হলে তো ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়ে যাবে। গিনেস বুকে নাম উঠে যাবে। বিশ্ব মিডিয়া তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে।
বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় না হলেও আমার মাথায় ঠিকই তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। আমার ঐ এক বদ স্বভাব, কোনো কাজ ঠিকঠাক মতো করতে না পারলেই অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। আমার এরকম অস্থিরতা দেখে আমার স্ত্রী মিতু কারণ জানতে চাইল। মিতুকে সব খুলে বললাম। মাহবুবের সাথে মিতুর জানাশোনা নেই। আমাদের বিয়ের সময় মাহবুব ইতালি ছিল। সব শুনে আমার স্ত্রী অনেকক্ষণ হাসল। তারপর বলল, এটা নাকি কোনো ব্যাপারই না, তার কাছে নাকি এমন পাত্রী আছে। আমার স্ত্রীর ভাষ্যমতে তার দূর সম্পর্কের এক কাজিন আছে। তার নাম জেরিন। মেয়ে দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি পরহেজগার। ঠিকমতো নামাজ কালাম পড়ে। আর মেয়ে পড়ালেখায়ও বেশ ভালো। এমনকি বিভিন্ন হাতের কাজেও পারদর্শী।
বাহ্! বেশ ভালো সংবাদ। এক নিমিষেই আমার সব টেনশন দূর হয়ে গেল। মিতু যা যা বলেছে মাহবুবকে গিয়ে সব খুলে বললাম। সব শুনে মাহবুবও মেয়ে দেখতে রাজি হলো। তবে তার একটা শর্ত আছে। তা হলো— মেয়ের সাথে আগে রেষ্টুরেন্টে দেখা করবে। তারপর পছন্দ হলে মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হবে। আর সব ঠিকঠাক থাকলে তবেই পারিবারিক ভাবে দেখতে যাওয়া হবে। কারণ এর আগে নাকি চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে মেয়ে দেখতে গিয়ে তার অনেক টাকা লস হয়ে গিয়েছে।
মিতুকে বলে-কয়ে মাহবুবের কথা মতোই সব ম্যানেজ করলাম। কথা হলো আগামীকাল আমরা উত্তরায় ব্লু-মুন নামে একটা রেষ্টুরেন্ট সবাই মিলে ডিনার করতে যাব। মাহবুব সন্ধ্যায় আমার অফিসে চলে আসল। একটু গল্প গুজবের পর আমি মিতুকে ফোন দিলাম। মিতু প্রায় রেষ্টুরেন্টের কাছাকাছি। আমি আর মাহবুবও বেরিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি মিতু একা বসে আছে। ওর সাথে মাহবুবের পরিচয় করিয়ে দিলাম। দুজনের মধ্যে হাই-হ্যালো হলো। তারমধ্যে জেরিনও চলে আসল। জেরিনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। আমাদের বিয়ের সময় জেরিনও উপস্থিত ছিল না। তার ডিপার্টমেন্ট থেকে কী না-কি একটা ট্যুর ছিল। কথার মাঝেই কিছুক্ষণ পর মিতু আমায় ইশারায় একটু আড়ালে ডাকল। আমি ভাবলাম, হয়তো ওদেরকে একটু আলাদা করে কথা বলার জন্য স্পেস দিচ্ছে।
-কী ব্যাপার, হঠাৎ এভাবে ডাকলে যে! ওরা কী ভাববে? মিতু একটু নিচু গলায় বলল, ‘আচ্ছা অনিক, এটাই কী তোমার বন্ধু মাহবুব? ওর জন্যই এভাবে ভার্জিন মেয়ে খুঁজছ?’
-হুম, ও-ই…খুব ভালো ছেলে, আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের হাত পর্যন্ত ধরেনি।
-হুম। আসলেই খুব ভালো ছেলে, আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের হাতও ধরেনি, শুধু আমাকে নিয়ে একদিন লিটনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল।
-মা-মা-নেএএএ…
-মানে কিছুই না। তোমার বন্ধু মাহবুবই আমার এক্স। ও ইটালি যাওয়ার আগে আমাদের রিলেশন ছিল। ইতালি যাওয়ার কিছুদিন পরেও সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই ও ঐখানকার এক মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে যায়। তখন আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে। তখন আমার মাথায় কিছুই আসছিল না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী, মানে আমার স্ত্রী মিতুকেও চিনতে পারছিলাম না। এমনকি কয়েকবার চেষ্টা করে আমার নিজের নামও মনে করতে পারিনি। মাথায় তখন শুধু একটা লাইনই ঘুরছিল। সুকুমার রায়ের ছড়ার লাইন— চলে হন হন, ছোটে পনপন, ঘুরে বনবন, বনবন, বনবন, বনবন আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আমার স্ত্রী মিতু বলল, ‘বুঝতে পারছি তোমার মাথা চক্কর দিচ্ছে। নাও কোক খাও। ঠিক হয়ে যাবে।’ আমার হাতে কোকের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে মিতু গিয়ে আবার ওদের সাথে বসল। আমি কয়েক চুমুক খেয়ে আবার মিতুকে ডেকে নিয়ে আসলাম।
-কী ব্যাপার অনিক! বারবার এভাবে উঠে আসলে ওরা কী ভাববে বলো তো?
-আচ্ছা মিতু! ঐটাই তো তোমার কাজিন জেরিন?
-হুম, ও-ই জেরিন। ভালো মিষ্টি একটা মেয়ে। দূর সম্পর্কের কাজিন হলে কী হবে, ছোটবেলা থেকেই আমাদের চোখের সামনে মানুষ। চিটাগং থাকতে ওদের আর আমাদের বাসা পাশাপাশি ছিল।
-আসলেই অনেক ভালো মেয়ে!
-মানে! তুমি ওর মধ্যে কী অমন কমতি দেখলে? দেখতে শুনতে ভালো। ভালো মেয়ে। ভালো ছাত্রী। এমনকি ভালো হাতের কাজও জানে।
-হুম! ভালো হাতের কাজ যে জানে সেটা আমিও জানি। আর মেয়ের সবই ভালো…শুধু বাসায় একবার ব্যাচ ট্যুরের কথা বলে আমার সাথে তিনদিনের জন্য কক্সবাজার গিয়েছিল। আমার কথা শুনে আমার স্ত্রী মাথা চক্কর দিয়ে প্রায় পড়ে যেতে নিচ্ছিল। আমি কোনোক্রমে তাকে ধরে বললাম, ‘নাও কোক খাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আমার স্ত্রী কোনোক্রমে পাশের চেয়ারটায় বসল। তারপর শাড়ির আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘জেরিন তাহলে তোমার এক্স?’
-হুম..
-তোমাদের ছাড়াছাড়ি হলো কী জন্য?
-চাহিদা বেশী। আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি। ডিমান্ড ফুলফিল করতে পারছিলাম না। আমার থেকে বড়লোক একজনকে দেখে ঝুলে পড়ল।
-ওহ্আ মি আর আমার স্ত্রী দুজনেই উঠে কোকের গ্লাস হাতে ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর আমাদের কথাবার্তা অনেকটা এরকম….
-শুনো, অনিক..জেরিন নিজের বোন বলে বলছি না। ওর মতো ভালো মেয়ে খুব কমই হয়! জেরিন তোমার বন্ধুর জীবনে এলে তোমার বন্ধুর জীবনটা সত্যিই আলোকিত হয়ে যাবে…
-সে আর বলতে! সেটা উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। অত ভালো হস্তশিল্প জানে, এছাড়া এত এত ট্যুর দিয়ে কতকিছু শিখেছে, এরকম মেয়ে কারো জীবনে আসলে তার জীবন আলোকিত না হয়ে আর উপায় আছে! মিতু কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। আমি ও-কে থামিয়ে দিয়ে আবার বললাম, ‘আর আমার বন্ধুও কিন্তু একেবারে কম না। আজ পর্যন্ত অন্যকিছু দূর থাক কোনো মেয়ের হাত পর্যন্ত ধরেনি।’ মিতু আমাকে চোখ টিপ দিয়ে বলল, ‘সেটা তো উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। দেখেই বুঝা যায় এই লোক একেবারে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা।’
আমাদের দুজনের মুখে প্রশংসা বাক্য শুনে মাহবুব আর জেরিন লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে আর একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। পুনশ্চ: আমার আর আমার স্ত্রীর চেষ্টায় গত শক্রবার বাদ জুম্মা মাহবুবুর রহমান ও জেরিন তসলিমের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এক ও একমাত্র বা সবচেয়ে ভার্জিন দম্পত্তির বিয়ে। আচ্ছা, বিয়েতে যে খাসির মাংস খেলাম, সেই খাসিটা ভার্জিন ছিল তো? না, মানে..ভার্জিন দম্পত্তির বিয়ের খাসি বলে কথা!
গল্পের বিষয়:
গল্প