তখন হঠাৎ যদি

অনেকটা পথ ঘুরে, অনেক ক্লান্তির পর বালিগঞ্জের কাঙ্ক্ষিত বাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল। কলেজ স্ট্রিট থেকে সেই সুদূর সকালে খুব প্রাচীন একটা ট্রামে উঠেছি। খুব ধীর-মন্থর গতিতে সেই যন্ত্রযানটি বড় রাস্তায় নয়, মলিন এক ছায়াময় পথে আমাদের নামিয়ে দিল, অথবা বলা চলে আমরা নেমে গেলাম। এই শহরে আমরা এই প্রথম। আমাদের বন্ধু নরেশ সবকিছু রোডম্যাপ ঠিকঠাক বলে দিয়েছিল; কিন্তু আমরা ঠিকঠাক মনে রাখতে পারিনি। আমাদের ভেতর অন্য এক উত্তেজনা কাজ করছিল। উপন্যাসে এসব রাস্তার নাম অনেকবার পড়েছি, কিন্তু রাস্তা চিনতে পারছি না।

এ শহরে এক সময় আমার আসার কোনো ইচ্ছে ছিল না, তেমন কোনো মোহ ছিল না। যখন প্রবল ইচ্ছা ছিল- একদিন অসম্ভব আকর্ষণ বোধ করতাম, তখন কাঁটাতারের তীব্র কঠিন বেড়া ডিঙিয়ে আসাটা খুব সহজ ও দ্রুত ছিল না। হায় রাজনীতি!

এখন নিয়ম-কানুনগুলো কিছুটা শিথিল। ট্রাম যেখানে নামিয়ে দিল, তার বিপরীত রাস্তায় আসিফ আর আমি দৌড়ে পার হলাম। একটা বাইলেনে ঢুকে সেই কাঙ্ক্ষিত রাস্তা, সেই কাঙ্ক্ষিত বাড়ি খুঁজতে লাগলাম। আবার হাঁটতে হলো। বেশ কিছুক্ষণ। মাথার ওপর রৌদ্রময় আকাশ। এখন নিষ্ঠুর এপ্রিল, বাংলা বোশেখ মাস। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। কিন্তু আমার বন্ধু আসিফ বেশ উৎফুল্ল ও আনন্দিত। তার চোখমুখ উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত। তার ভেতর অন্য এক বোধ কাজ করছে। ট্রামে কথা বলেছে বিরামহীন, কিছুটা বাংলায়, কিছুটা ইংরেজিতে। যেসব কথা আগে অনেকবার ঢাকায় থাকতে স্টেডিয়ামের উন্মুক্ত সবুজ ঘাসের প্রান্তরে কোনো কোনো বিকেলে বলেছিল আসিফ। সেই পুরনো-প্রাচীন কথা। পুরানা পল্টন, লেখার স্কুল, উত্তর তিরিশ- এই সব মুক্তগদ্যের কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা।

ঢাকা নিয়ে লেখা বেশ কিছু গল্প ও একটি উপন্যাস বারবার আসিফকে বিহ্বল করে তোলে। সে কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে যায়। আমাকে নয়। নস্টালজিক আসিফকে আমি তখন চিনতে পারি না। আমার বিষয় ভিন্ন। আমি ম্যানেজমেন্টের ছাত্র। আমার ভেতরে সাহিত্যের ছিটেফোঁটা কিছু নেই। করপোরেট কালচার আমার প্রিয় কবিতা। কাস্টমার কেয়ার, হিউম্যান রিসোর্স, নেগোসিয়েশন স্কিল আমার প্রেম।

আসিফ ভিন্ন মানুষ। অন্যরকম মানুষ। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ছে। সে অনেক পড়ে। আর আমাকে সেসব শুনতে হয়। সে চমৎকার বলতে পারে। আমি তখন মুগ্ধ ও নিবেদিতপ্রাণ শ্রোতা। যেন তার ছাত্র। এখনও আসিফ হাঁটতে হাঁটতে দ্রুত কথা বলে যাচ্ছে। এই রাসবিহারী এভিনিউ কবির কোন উপন্যাসে এসেছে, কলকাতার অন্য কোনো কবি বা গল্পকার অথবা ঔপন্যাসিক কেমন করে অমর করে রেখেছেন এই জায়গাগুলো, সেসব কথা যেন ফুরোয় না।

আসিফের সঙ্গে কখন, কবে, কোথায়, কেমন করে পরিচয় হয়েছিল তা ঠিকঠাক মনে নেই। শুধু একটি ম্লান বিকেলের কথা মনে পড়ে। আমি দীঘির জলের মতো শান্ত, নির্জন, নীরব সেই বিকেলকে আজও ভুলিনি।

আহমেদ ছফা একটু পাগলাটে- অসম্ভব মেধাবী আমাদের অগ্রজ এই লেখক একদিন আমাকে নবাবপুরের চৌরাস্তার মুখে দোতলা রেস্তোরাঁ নাইল ভ্যালিতে সাহিত্য অনুষ্ঠানে নিয়ে এলেন। আমার এসব ভালো লাগে না, কিন্তু ছফা ভাইকে ‘না’ বলতে পারলাম না। তখন এক ঝকঝকে তরুণ একটি গল্প পাঠ করছিল। তারপর আরও দু-একজন কবিতা পড়ল। ভালো লাগল না। কিন্তু সেই তরুণের চমৎকার বেশভূষা তার কণ্ঠস্বর, তার ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক উঠে দাঁড়ালেন কিছু বলার জন্য। চোখে ভারী চশমা। ময়লা পাঞ্জাবি উদ্ভ্রান্ত চুলে কতদিন চিরুনির স্পর্শ লাগেনি কে জানে- তার চোখমুখ নিষ্ঠুর, প্রেমহীন। অধ্যাপক গল্পকার যুবকটিকে তীক্ষষ্ট-তীব্র সমালোচনায় নস্যাৎ করে দিলেন। বললেন, এসব গল্প আজকাল চলে না। কলকাতার নারী গল্পকাররা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে এসব গল্প লিখে ফেলেছেন।

তরুণ গল্পকারের পুরো চেহারা নিমেষে অন্ধকার হয়ে গেল। আমি গল্পটা গভীর অভিনিবেশ নিয়ে শুনেছি। গল্পের শেষে নায়ক আত্মহত্যা করে। কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে। কিন্তু গল্পটির চমৎকারিত্ব হলো- কোথাও জীবনানন্দের নাম ব্যবহার করা হয়নি। এই সেই আসিফ। তুখোড়, প্রাণবন্ত, প্রতিভাবান। ছফা ভাই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, তার চোখমুখ তখনও ব্যথিত ও বিষণ্ণ। হাতে হৃদয়ের উষ্ণতা। সে চমৎকার উচ্চারণে বলল, গ্ল্যাড টু মিট ইউ। আমি দক্ষিণ মৈশণ্ডিতে থাকি। আমি থাকি নারিন্দার শরৎ গুপ্ত রোডে। এই শুরু। এভাবে সম্পর্ক ধাপে ধাপে এগোতে লাগল। আসিফের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের গভীর আন্তরিক সম্পর্ক। কলকাতার এই কবির সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের পত্রালাপ। কবি আসিফকে তার একটি গল্পগ্রন্থ ‘ভাসো, আমার ভেলা’ পাঠিয়েছেন। সেই বইটি আমাকে পড়তে দিয়েছেন। সব গল্প পড়িনি, পাতা উল্টে দেখেছি। দু’তিনটি ভালো লেগেছে।

এইভাবে আসিফ ক্রমেই আমার ওপর প্রবল প্রভাবের ছায়া ফেলতে থাকে। ঢাকা শহরে তখন এত মিটিং- মিছিল ছিল না। রাস্তায় এত ভাসমান মানুষও ছিল না। সেই ঢাকা শহর আমি আর আসিফ চষে বেড়াতাম। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, নিউমার্কেটে ‘সোসাইটি’ চায়ের দোকান, বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং।

বালিগঞ্জ, ২০২ রাসবিহারী এভিনিউ অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল। কবির নামে একজন রাজনৈতিক নেতা বাস করেন এই এলাকায়। কবিকে কেউ চেনে না। নেতাকে সবাই চেনে। কবি তো তার সেলিব্রেটি নন। দুপুর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, তার পর ঘরে ফেরা। সামান্য বিশ্রামের পর লেখালেখি। এটা তার নিয়মিত রুটিন। তারপর সন্ধ্যায় তুমুল আড্ডা। তার ছাত্র নরেশ গুহ আসেন, সুবীর রায় চৌধুরী আসেন, মাঝে মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী আসেন। শুধু কবিতাবিষয়ক একটি সাহিত্যপত্র বের করার তোড়জোড় প্রস্তুতি চলছে। এর আগে তিনি ‘প্রগতি’ বের করেছেন। সেখানে সবকিছু ছিল। কিন্তু এখন বিশুদ্ধ কবিতাপত্র বের করতে চাচ্ছেন।

বালিগঞ্জের একতলা বাড়িটায় আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা পড়ে এসেছে। বাড়ির গেটের মাথায় গাছপালা। দরজার বেল টিপতেই চোখে চশমা, শ্যামলা মতো ছিপছিপে এক যুবক আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। যখন শুনলেন আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমাদের অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন। কবি আমাদের সম্ভাষণ জানালেন খুব আন্তরিকভাবে। আসিফের স্বপ্নের পুরুষ। তার আইডল। ক্রিম রঙের প্যান্ট, গেরুয়া রঙের নাগরা, মেরুন রঙের হাফশার্ট, চুলগুলো পাতলা ও সুন্দর, চোখ দুটো অসম্ভব স্বপ্নিল। বিছানায় শুয়ে আছেন তার রুগ্‌ণ স্ত্রী। চোখ দুটো নিমীলিত। কিছুক্ষণ পর ট্রেতে করে চা বিস্কুট নিয়ে এলেন দীর্ঘকায় লাবণ্যময়ী এক যুবতী, তার চোখ দুটো কবিতার মতো মায়াবী। ‘কবিতার মতো মায়াবী’ কথাটা পরে আসিফ আমাকে বলেছে, এটা আমার কথা নয়, কবি বললেন, তিনি ‘মহাভারত’-এর ওপর বিশাল এক গবেষণা গ্রন্থ লিখছেন।

আমি অপলক চেয়ে রইলাম, যুবতীর ওই দুটি চোখের দিকে। এত সুন্দর মায়াময় চোখ আমি অনেকদিন দেখিনি। তিনি বললেন, ‘আপনারা এমন দিনে এলেন, যেদিন মায়ের অসুখ।’

চমৎকার বিরতি দিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন। আমার আবারও মুগ্ধ হওয়ার পালা। আসিফ সাহিত্যের কী সব জটিল তত্ত্বকথা নিয়ে আলাপে মেতে উঠেছে কবির সঙ্গে। আমি কৌতূহলী হলাম তার প্রতি। তার পেলব ঠোঁট, তার অবয়ব, তার কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দাবলি আমাকে নিয়ে গেল অন্য জগতে।

আসিফ কবিকে ব্যক্তিগতভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন। কবির ভেতর কী যেন হলো। তিনি স্বপ্নের ভেতর হারিয়ে গেলেন। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। ইংরেজি সাহিত্যে রেকর্ড মার্ক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলকাতার অনেক কবি-সাহিত্যিককে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু কবিকে কেউ ডাকেনি। অভিযোগ উঠেছিল- কবি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবল উচ্ছ্বাস দেখাননি। এই প্রথম নয়, কবি বারবার তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। এটা কবির কাছে নতুন কিছু নয়। নিজ হাতে গড়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ’ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন।

চলচ্চিত্রের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো স্মৃতিময় টুকরো টুকরো ছবি মনের ওপর দিয়ে, চেতনার ভেতর দিয়ে ভেসে উঠে দ্রুত মিলিয়ে গেল। আমরা তখন বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। খুব দ্রুত ছুটতে ছুটতে একজন ব্যক্তি এলেন। কবি পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ কুমার ঘোষকে। আসিফ তার নিরীক্ষামূলক গল্প এবং উপন্যাস ‘জল দাও’ পড়েছে। তিনি শুনে খুব খুশি হলেন। তিনি এসেছেন ‘মহাভারত’-এর কিস্তি নিতে, যা ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’-এ ছাপা হচ্ছে।

বাইরে এসে দেখলাম গেটে দাঁড়িয়ে নীরব-নিঃশব্দে বিদায় জানাচ্ছে দুটি চোখ। কলেজ স্ট্রিটের নরেশের হোস্টেলে ফিরেও আমি স্থির থাকতে পারলাম না। সব কথা, পুঞ্জীভূত ভালো লাগা ও বেদনার যে কবিতা ২০২-এ সৃষ্টি হলো, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ আসিফকে বললাম।

সে রহস্যময় হাসল।

আমি তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। সে বলল এসব কষ্ট এবং নীল বেদনা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ লেখালেখি। তখন কলেজ স্ট্রিটের বুক চিরে একটা ট্রাম কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। আমি ব্যালকনিতে এসে দেখি অন্য আকাশে গোলাকার খুব চেনা কিন্তু অচেনা এক চাঁদ জেগে আছে, তার চোখে জল।

সূত্র: সমকাল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত