প্ল্যান

প্ল্যান
ড্রয়িং রুমের পরিবেশ থমথমে। নিঃশ্বাসের আওয়াজটুকুও পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না, অথচ রুমভর্তি জন বিশেক মানুষ। সৈয়দা নিঃশব্দে হেঁটে এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন তার শশুর আহসান খানের দিকে। চা দিয়ে একটু পিছু হটতেই টেবিলের সাথে বাড়ি খেয়ে সামান্য আওয়াজ তুলতেই বড় বৃত্তের মতো চোখ বড় বড় করে চোখ রাঙানি দিলেন আহসান খান। সৈয়দা ভয়ে ভয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে চুপ মেরে গেলেন। আহসান খান এবার রুমভর্তি লোকদের দিকে তাকিয়ে শুধু “খক, খক”করে আওয়াজ তুললেন। মুহুর্তেই রুমের প্রত্যেকটা মানুষ বলতে শুরু করে দিলো তাদের পেটে জমানো কথার তুবড়ি। এতক্ষণ যেনো তাদের দম বন্ধ ছিলো। তাদের মাঝের একজন শুধু ভাবলেশহীন। তার যেন এসবে কোনো মাথাব্যথাই নেই। সে হলো আহসান খানের একমাত্র নাতনি অত্রী। বোনের মেয়েকে কোলে নিয়ে বেলুন হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
একেকজন একেকরকম কথা বলতে শুরু করলো, ‘আপনি জানেন না খান সাহেব, আপনার নাতনি কী করেছে!’ ‘আপনার নাতনির জন্য আমার ছেলেটা অপমানে গোলাপী হয়ে গেছে, ঘরে এসে মেয়েদের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। যেই ছেলে কিনা বুক ভর্তি সাহস নিয়ে সবার সামনে চলাফেরা করে সেই ছেলেটিকে সকলের সামনে এভাবে অপমান করার সাহস কোথায় পেল আপনার নাতনি? হুঁ?’ ‘আমাদের মানসম্মানটা পুরো ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে আপনার নাতনি।’ কাউকেই থামাতে পারছেন না আহসান খান। গম্ভীর মুখে আস্তে করে বললেন,
-“থামো সবাই।” তার কথার কেউ যেনো তোয়াক্কাই করলো না। করবেই বা কেন? তিনি তো কথা বলার লাইসেন্স দিয়েই দিয়েছেন প্রথমে। এখন আর কোনো থামাথামি নেই। ট্রেনের মতো চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে একজন মহিলা মুখে কাপড় গুঁজে বিলাপের সুরে বলতে লাগলো,
-“আমার দুধের বাচ্চাটা এমনভাবে কেঁদেছে যে নিজেও কান্না থামাতে পারিনি। আহারে বাচ্চাটা আমার, সেই ছোটবেলা থেকে বাচ্চাটার কোনো অভাব রাখিনি, একটু ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি সেই বাচ্চাটা কেমন কেঁদেছে আমার! আহারে দুধের বাচ্চা আমার!” অত্রী কিছুটা হেয়ালীভাবে বললো,
-“তা আপনার একুশ বছরের দুধের বাচ্চাটা কি এখনো ফিডার খায়? নাকি স্ট্রলারে বসে হিসু করে ওয়া ওয়া করে কাঁদে?” মহিলাটি কটমট চোখে তাকিয়ে শক্ত মুখে বললো,
-“এই মেয়ে এই, কথা বলো কোন মুখ নিয়ে? আমার বাচ্চাটার অপমান করেও কি ক্ষান্ত হওনি? তোমার কারণেই কেঁদেকেটে বাচ্চাটা আমার বিছানা ভিজিয়েছে। আহারে বাচ্চাটা আমার!”
-“ওমা! এই জন্যই তো বলি, কোথা থেকে যেনো হিসুর গন্ধ আসছে। ভেবেছি তো কোনো কুকুর টুকুর হেগে মুতেছে। এখন তো দেখ‌ি না, আপনার ছেলে বিছানা ভিজিয়েছে। ছিঃ কি গন্ধ!”
-“তোমার সাহস তো কম না, আমার বাচ্চাটাকে কুত্তা বলা? আর কি বললে তুমি? আমার বাচ্চা হিসু করে? কথা বলতে শেখার পর থেকে আমার বাচ্চাটা এই কাজ জীবনেও করে নাই। হুহ অত্রীর বড্ড হাসি পাচ্ছে। এই মহিলাকে জ্বালাতে তার বেশ লাগে। আর কয়েকদিন পর যখন পার্মানেন্টলি এই মহিলার বাসায় উঠবে তখন আচ্ছা করে জ্বালানো যাবে। ভাবতেই ফিক করে হেসে দিলো অত্রী। তার হাসিটি যেনো চৌধুরী পরিবারের সবার গা জ্বালিয়ে দিলো। আবার শুরু হলো তর্ক। একজন এটা বলছে তো আরেকজন সেটা বলছে। কেউ যেনো কাউকে ছাড় দিতে চাইছে না। আহসান সাহেব গলা পরিষ্কার করে আবারও বললেন,
-“আমার কথা শুনো সবাই। থামো।” কেউ শুনলোই না তার কথা। কথা বলতেই থাকলো। মোটা মোটা গলার কথার মাঝে মমতাজ বেগমের বিলাপ যেনো পরিবেশটাকে আরো ভারী করে তুলেছে। মহিলাটা পারেও বটে। উফফ আহসান সাহেব গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বললেন,
-“তোমাদেরকে থামতে বলেছি না? থামো বেয়াক্কেলের দল।”
সবাই বাদে অত্রী লক্ষ্য ‌করলো তার দাদা রেগে বোম হয়ে আছে। আরেকটু বাদে যেনো ঠুস করে ফেটে যাবে এমন অবস্থা। তাও এদের থামার নাম নেই। অত্রীর খান পরিবার আর চৌধুরী পরিবার সবাই একসাথে তর্কের যুদ্ধে নেমে পড়েছে। পারে না তো হাতাহাতি পর্যন্তও করে। এমনিতেও চৌধুরী আর খান পরিবারের মধ্যে রয়েছে সাপে নেউলে সম্পর্ক। কোনো এক অজানা কারণেই দুই পরিবারের কেউ কাউকে দেখতে পারে না। তবুও এখানে একটা ঘটনার সমস্যা সমাধানের জন্য এসেছে কারণ এই ঘটনাটার মূল অত্রী। তার কারণেই তো ঝামেলা লেগেছে। অবশ্য তার ভালোই লাগছে। এই সুযোগে প্রিয় মানুষটার ঝগড়াও দেখছে। উঁহু, ঝগড়া করছে না। একপাশে হাত ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। মুখে চিন্তার রেশ স্পষ্ট। সুঠাম দেহের ছেলেটি অর্থাৎ সীমান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে অত্রীর বেশ ভালোই লাগছে। সবাইকে থামাবার আর কোনো উপায় না পেয়ে অত্রী হাতের বেলুনটাকে ঠাস করে ফাটিয়ে ফেললো। মুহুর্তেই সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো অত্রীর দিকে। এবার যেনো একটু শান্তি পেল আহসান খান। গম্ভীর কন্ঠে আবারও বললেন,
-“চৌধুরী পরিবারের সবাই ডানপাশের সোফাগুলোতে বসো। আর আমার পরিবার অর্থাৎ খান পরিবারের সবাই বামের চেয়ারগুলোতে বসো। বসেছো তো? হু! এবার চৌধুরীর পরিবার, বলো কী এমন করেছে আমার নাতনি? যার জন্য তোমারা বিচার নিয়ে এসেছো আমার কাছে? যেহেতু এই গলির একমাত্র মুরব্বী আমি সেহেতু সবার প্রবলেম সলভ করার চেষ্টায় থাকি। তেমনি তোমাদের সমস্যাও সমাধান করবো। বলো, কি সমস্যা? চৌধুরী পরিবার থেকে নিজাম চৌধুরী বললো,
-“আপনার নাতনি আমার ছোট ছেলে সিয়ামকে পুরো গার্লস কলেজের রাস্তার সামনে অপমান করেছে। ছেলে আমার সেই অপমান সইতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে শেষ।” মমতাজ বেগম কাপড়ে মুখ গুঁজে আবারও বিলাপ করে বললেন,
-“জানেন না খান সাহেব আপনি। আমার দুধের বাচ্চাটা কি কষ্টই না পেয়েছে। আমার বাচ্চাটা…”
-“আহ্! কোনো কান্নাকাটি নয়। থামো। সব কিছু খুলে বলো আমায়।” চৌধুরী পরিবারের ঘরের এক কর্মচারী সখিনা চোখজোড়া গোল আলুর মতো করে বললো,
-“অ্যা? আন্নে কিডা কন খান সায়েব? এহন কি বেক্কে শরমের মাথা খাইয়া বেক্কেগো পরনের কাপড় চোপড় খুইলা কত কইবো নাইক্কা? না না, আঈ বাইচে থাকতে এই বেশরইম্মা কাম হইতে দিয়াম না।” সখিনার কথা শুনে অত্রী পারে না তো হেসে ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়। আহসান খান সখিনাকে ধমকে বললেন,
-“আর একটা বাজে কথা বললে থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো। বেয়াক্কেল কোথাকার!” আহসান খানের ধমকে চুপসে যায় সখিনা। মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে বিড়বিড় করে আহসান সাহেবের গোষ্ঠী উদ্ধার করছে সে। আহসান খান আবার বলেন,
-“যেহেতু সমস্যা হয়েছে আমার নাতনিকে নিয়ে। সেহেতু ও-ই বলুক আসল ঘটনাটা। বলো অত্রী দাদাভাই, কি এমন করেছো তুমি?” অত্রী একবার আড়চোখে চৌধুরী পরিবারটাকে দেখে নিয়ে থেমে থেমে বললো,
-“কালকে কলেজ থেকে যখন ফিরছিলাম তখন সিয়াম ভাই আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। এমনিতেও তাকে প্রায়ই কলেজের সামনে দেখতে পাই, আর অনেকবার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করেছিলো। তো কালকে পথে দাঁড়িয়ে একটা গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আর কতো আমায় ইগনোর করবে? এবার দয়া করে আমার ভালোবাসাটাকে গ্রহণ করে নেও না অত্রী সোনা।’ বললাম, আমি এসব প্রেম ভালোবাসায় জড়াতে পারবো না। আমার দাদা আমায় এসব শিক্ষা দেয়নি। তিনি এসব পছন্দ করেন না, আর আমিও আমার দাদার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারবো না।” অত্রীর কথা শুনে গর্বে বুক ফুলে উঠেছে আহসান খানের। মুখে ইয়া বড় হাসি ঝুলিয়ে বললো,
-“তারপর কি হয়েছে?”
-“তারপর সিয়াম বললো যে তিনি আমায় বিয়ে করবেন। তাতে রাজী না হলে তিনি বলেন, ‘তুমি যা বলবে আমি সব করবো। সব। তবুও আমার হয়ে যাও। তুমি যদি চাও তাহলে আমি তোমার জন্য জানটাও দিতে পারি।’ পাশের ময়লার ডাস্টবিনে থুথু ফেলে বললাম, ‘জান টান কিছুই দেওয়া লাগবে না। আপনি যখন বলেছেন আমার জন্য সবকিছু করতে পারবেন তাহলে ঐ যে মাত্র ডাস্টবিনে থুথু ফেললাম না? সেই থুথু আপনি চেটে খাবেন। ব্যস এটুকু করতে পারলেই আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজী হবো।’
এটা বলার পর আমার পাশে থাকা বান্ধবী ওয়াক ওয়াক করে বমি করে দিয়েছিলো সিয়ামের উপর। সিয়ামও বমি দেখে ইয়াক ইয়াক করে পা পিছনে বাড়াতেই ঠুস করে ময়লার ডাস্টবিনসহ বড় ড্রেনটাতে পড়ে গেল। ঐ ড্রেনটাতে তখনই একজন হিসু করছিলো আর সেই হিসু সোজা সিয়ামের মুখে পড়ছিলো। রাস্তায় সকল মেয়েরা ছিলো। তারা সবাই এমনকি আমার বান্ধবী বমি ভরা মুখ নিয়েই হেসে দিয়েছিলো। রাস্তার কয়েকজনের সহায়তায় সিয়াম উঠে ময়লা শরীর নিয়েই দৌড়ে চলে গেল বাসায়। তারপর এই কাহিনী।” এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো অত্রী। আহসান খান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“এখানে তো আমার নাতনির কোনো দোষ-ই দেখতে পাচ্ছি না। সব দোষ তো আপনাদের ছোট ছেলে সিয়ামের। তার উচিত হয়নি আমার নাতনিকে সকলের সামনে প্রস্তাব দেওয়া।” চৌধুরী পরিবার থেকে সিয়ামের বাবা নিজাম চৌধুরী উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
-“এখন তো নিজের পেয়ারের নাতনির দোষ খুঁজে পাবেন-ই না। আপনার নাতনি যদি থুথু চাটার কথা না বলতো তাহলে আপনার নাতনির বান্ধবী বমিও করতো না। আর বমি না করলে আমার ছেলেটা ড্রেনে পড়ে এতো অপমানিতও হতো না।” এবার অত্রীর বাবা আরিফ খান তেড়ে এসে বললেন,
-“বেয়াক্কেলের মতো কথা বলবেন না। আপনার গুণধর পুত্র যদি আমার মেয়েটাকে প্রস্তাব না দিতো তাহলে আমার মেয়ে এই কথাটা বলতো না। নিজের ছেলের দোষটা আগে দেখুন। তারপর আমার মেয়ের দোষ দিবেন।” আরিফ সাহেব দ্বিগুণ তেড়ে গিয়ে বললেন,
-“এই মিয়া! বেয়াক্কেল কাকে বলেন হ্যাঁ? এইখানে সব দোষ আপনার মেয়েটার। মানলাম সিয়াম তাকে প্রস্তাব দিয়েছে। তাই বলে আপনার মেয়েটা কি পারতো না সেই প্রস্তাব গ্রহণ করতে? আমার ছেলেটাকে বিয়ে করলে কি এমন হতো?” এবার যেনো মমতাজ বেগম তেঁতে গেলেন।
-“কি বললে তুমি? ঐ মেয়েটাকে আমার ছোট ছেলের বউ করবো? কক্ষনো না। মরে গেলেও না। এই মেয়েটা অনেক ঝগড়ুটে। সারাক্ষণ আমার সাথে খালি ঝগড়া করার বাহানায় থাকে।” মমতাজ বেগমের কথা শুনে অত্রীর মা সৈয়দা চড়া গলায় বললেন,
-“আমার মেয়েকে ঝগড়ুটে কোন দিক দিয়ে লাগে? হ্যাঁ? এই পুরো এলাকায় কেউ বলতে পারবে না যে আমার মেয়ে কারো সাথে ঝগড়া করে এই আমি সৈয়দা জমিনে দাঁড়িয়ে বলে দিলাম। হুহ!” আবার শুরু হলো দুই পরিবারের রেষারেষি। একজন একটা বলছে তো আরেকজন মুখের উপর এসে দশটা বলছে। এতক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকা সিয়াম এসে থামালো তাদের। তারা থামলেও চোখে চোখে ঝগড়া যেনো চলতে থাকলো। তারপর গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে, এমন গলায় সিয়াম বললো,
-“এখন যা হয়েছে তো হয়েছে। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আ‌শা করি এই সিদ্ধান্তে দুই পরিবারের-ই মঙ্গল হবে। দাদাসাহেব যদি অনুমতি দেন তো সিদ্ধান্তটা বলতে সাহস পাই।” পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। আহসান সাহেবের অনুমতি পাওয়ার পর কয়েকটা দম নিয়ে সিয়াম বললো,
-“এখন এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়। আর তা হচ্ছে বিয়ে। আমার আর অত্রীর বিয়ে।” নীরবতা যেনো মুহুর্তেই ঝড়ে পরিণত হলো। অত্রীর মা উঁচু আওয়াজে বলতে লাগলো,
-“কিহ্? বিয়ে? তাও আবার এই পাগল পরিবারের কাছে। জীবনেও না। এই পাগলা পরিবারে কখনোই আমার মেয়েকে দিবো না।” মমতাজ রাগান্বিত হয়ে বললেন,
-“এহ্। আসছে আমাদের পাগল বলতে। নিজের পরিবার যে ঝগড়ুটে সেটা তো একবারও স্বীকার করলো না কেউ। যত্তসব ঝগড়াইট্টার দল!” সিয়াম তার মাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-“আহ্ মা! পুরো কথাটাতো আগে শুনবে। তারপর নাহয় যা ইচ্ছা বলো।” আহসান খান তার বৌমাকে চোখের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। সিয়াম বলতে শুরু করলো,
-“এখন বিয়েটাই একমাত্র সমাধান। এলাকার সব লোক যেহেতু জানে যে খান আর চৌধুরী পরিবারের মধ্যে বনিবনা নেই আর তার মাঝে খান পরিবারের মেয়ে চৌধুরী পরিবারের ছেলেকে বাজে অবস্থায় ফেলেছে সেহেতু সকল লোকেরা আমার পরিবার অর্থাৎ চৌধুরী পরিবারকে নিয়ে নিন্দা করবে। এতে আমাদের মানসম্মান থাকবে না আর।
আর এতে হয়তো আপনাদের সুবিধা হবে তবে এটা ভেবে দেখুন এই ছোট্ট একটা ইস্যুর কারণে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের আরো বেশি অবনতি হবে। আর কোনো একসময় হয়তো আমার পরিবার প্রতিশোধ নিতে আপনাদের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। এতে তো জল আরো বেশিদূর গড়াবে। তাই সবচেয়ে বড় সমাধান হচ্ছে অত্রীকে আমাদের পরিবারে বিয়ে দেওয়া। বিয়ে দিলে দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যাবে। এতে এলাকার কেউ দুই পরিবারের বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারবেনা। দাদাসাহেব, আপনি তো যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আপনি বুদ্ধি দিয়েই ভাবুন একবার আমার কথাটা। আর কিছু বলছিনা আমি।” সিয়ামের যুক্তিতে দুই পরিবারের মাঝেই ভাবনাচিন্তা এসে ভর করলো। আহসান খান আর যাই করুক তার জন্য আরেকটা পরিবার সামাজের সামনে ছোট হয়ে যাবে তা মানতে পারবেন না। বেশ কয়েকমিনিট কাটার পর আহসান খান বললেন,
-“সিয়ামের কথা আসলেই যৌক্তিক। ভেবে দেখলাম এতে দুই পরিবারেরই মঙ্গল। তাই অত্রীকে সিয়ামের সাথেই বিয়ে দেওয়া হবে।” চৌধুরী পরিবারও যেনো এখন এটাই ভাবছিলো। সবাই একমত হলেন শুধু মমতাজ বেগম ছাড়া। তার কথা হলো, এই মেয়ে অনেক ঝগড়ুটে। আর ঝগড়ুটে বউ হলে শাশুড়ির সাথে সবসময় ঝগড়া করবে। যদিও এই বিষয়টাকে তেমন কেউই পাত্তা দিলো না। আহসান খান অত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“অত্রী দাদাভাই! এই বিয়েতে তোমার মতামত আছে তো?” অত্রী একটু লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
-“আপনি যখন রাজী আছেন তাহলে আমারও আপত্তি নেই। তবে…”
-“তবে কি?”
-“যেহেতু সিয়াম বাড়ির ছোট ছেলে আর ও এখন পড়াশোনা করে সেহেতু ওকে বিয়ে করা কি ঠিক?”
-“সমস্যা হবে না। দরকার পড়লে আরো কয়েকবছর অপেক্ষা করা যেতে পারে।” সিয়াম তড়িঘড়ি করে বললো,
-“না না দাদাসাহেব। আসলে আরো কয়েকবছর হয়তো অপেক্ষা করা যাবে, তবে এলাকার মানুষদের কি করে বোঝাবেন? তারা তো এখন দেখলেও কানাকানি শুরু করবে আমাদের পরিবার নিয়ে। তাই এই সপ্তাহের মাঝেই বিয়ে হলে ভালো হয়। না মানে পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেই বলছি আরকি।” আহসান খান সহ এবার সবাই ভাবতে লাগলো। এমনকি মমতাজ বেগমও। যতই হোক, এই মেয়েতো এখন ঘরের বউ হতে চলছে। অত্রী বললো,
-“দাদা, এই বিয়েটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমিও জানি তবে বিয়েটা যদি সিয়ামের সাথে হয় তাহলে অনেক কথাই শুনতে হবে।”
-“কেমন?”
-“এই যে, সিয়াম বেকার। আর বেকার ছেলের হাতে খান সাহেব তার নাতনিকে তুলে দিয়েছেন। এতে এলাকার লোকেরা বলবে, শেষে কিনা এলাকার মুরব্বী তার নিজের নাতনিকে বেকার ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন? আর ছেলেটাও অনেক ছোটো। এতো অল্প বয়সে বিয়ের জন্যও কথা শুনতে হবে। আবার সিয়ামের বড় ভাই সীমান্ত ভাইয়ের বিয়ে না হয়েই ছোট ছেলের বিয়ে হয়ে গেল, এটা নিয়ে তো মানুষ আরো বেশি কানাকানি করবে। অনেকে ভাববে সীমান্তের বিয়ে না দিয়েই অল্প বয়সের ছেলেটাকে বিয়ে দিলো? সীমান্তের কি কোনো সমস্যা টমস্যা আছে নাকি! এমন অনেক কিছুই ভাববে অনেকে। এতে তো আরও বেইজ্জতি হতে হবে। আর আমি চাইনা এই কারণে কারো বেইজ্জতি হোক।” বলেই দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে দাদার দিকে চেয়ে রইলো। আহসান খানের বুক যেনো গর্বে আরো অনেক বেশি ফুলে উঠে। বাহ্! তার নাতনি কতো বুদ্ধিমতী! সবার কথা কত্ত চিন্তা করে! আরিফ চৌধুরী বললেন,
-“তাহলে এক কাজ করা যাক, সীমান্তের সাথেই অত্রীর বিয়েটা দেওয়া হোক। এতে দুই পরিবারেরই সম্মান বাঁচবে।”
আরিফ চৌধুরীর কথা সকলের মনে ধরলো। এমনকি সীমান্তও না করতে পারলো না। আহসান খান নাতনি আর সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“তোমাদের দুজনের বিয়ে তো হলো না। এতে তোমরা কষ্ট পেয়েছো?” সিয়াম একটু কষ্ট পেয়েছে এমনভাবে বললো,
-“একটু কষ্ট পেয়েছি। তবে সীমান্ত ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলে যদি পরিবারের সম্মান বাঁচে তাহলে তাই-ই হোক। পরিবারের সম্মানের কাছে এই কষ্ট পাওয়াটা কিছুই না।” মমতাজ বেগম গর্বিত কন্ঠে বললেন,
-“আমার দুধের বাচ্চাটা যেনো মুহুর্তেই কতো বড় হয়ে গেছে!” অত্রী ভেংচি কেটে বললো,
-“হরলিক্স খেয়েছে তো তাই বড় হয়েছে। নিয়মিত হরলিক্স খাওয়াবেন বাচ্চাটাকে। বেড়ে ওঠার ডোজ, রোজ রোজ।”
অত্রীর কথা শুনে সকলেই হেসে ফেললেন। রিসিপশনে বর বউয়ের আসনে বসে আছে সীমান্ত আর অত্রী। অত্রীর খুশি দেখে কে? অবশেষে কাঙ্খিত মানুষটাকে পেয়েই গেল সে। সীমান্তর মুখেও মুচকি হাসি। সেও মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে অত্রীকে। সকলেই তাদের সাথে ছবি তোলায় ব্যস্ত। সিয়াম এক ফাঁকে অত্রীর কানে কানে বললো,
-“দোস্ত, অবশেষে তোর প্ল্যান কাজে লাগলো বল! তোর প্ল্যান অনুযায়ী ভাইয়ের সাথে তোর বিয়েও হলো আবার দুই পরিবারের সম্পর্ক ঠিক হলো। যাকে বলে এক ঢিলে দুই পাখি।”
-“দেখতে হবে না দোস্ত কার? সেদিন যদি ঐ ড্রেনে পিছলে না পড়ে যেতি তাহলে তো এই প্ল্যানটা মাথাতেই আসতো না। তোকে ড্রেনে পড়ে যেতে দেখেই তো নাটকটা সাজালাম। আর নাটকটা অবশেষে টিভিতে রিলিজ হয়েই গেল কি বলিস!” বলেই চোখ টিপ মারলো অত্রী। হেসে উঠলো দুজনেই। মমতাজ বেগম তাদের হাসতে দেখে বললেন,
-“কি হয়েছে? এতো হাসাহাসি কিসের হ্যাঁ?” অত্রী জোরে জোরে বললো,
-“আপনার বাচ্চাটা যাতে প্রতিদিন হরলিক্স খায় সেই আদেশ দিচ্ছি। বাচ্চাটাকে বড় হতে হবে তো!” অত্রীর কথা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল পুরো লোকারণ্যের মাঝে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত