অতিকায় ডানাওয়ালা এক থুত্থুড়ে বুড়ো

একটানা তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির ভেতর এখানে- ওখানে অনেক কাঁকড়া মরে পড়ে আছে। নবজাত শিশুটির সারারাত জ্বর ছিল, সবাই ভাবল মরা কাঁকড়ার দুর্গন্ধই এ অসুখের কারণ। পেলাইয়ো ভেজা উঠান পেরিয়ে এসে এগুলো সমুদ্রে ছুড়ে ফেলল।

সেই মঙ্গলবার থেকে পৃথিবীটা গুমোট হয়ে আছে। আকাশ আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার, দুটোই ধূসর ছাই রঙের। মার্চের রাতে যে সৈকতের বালু আলোর গুঁড়ার মতো ঝিকমিক করত, তা এখন কাদা আর পচা-গলা সামুদ্রিক মাছের খোলের মতো দলা পাকিয়ে আছে।

মরা কাঁকড়া সমুদ্রে ছুড়ে পেলাইয়ো ফিরে আসছে। দুপুরবেলায়ও আলো খুব কম, উঠানের পেছনে যে কিছু একটা নড়ছে আর গোঙাচ্ছে, তা এককথায় দেখাই যাচ্ছে না। টের পেয়ে জিনিসটা কী দেখার জন্য পেলাইয়ো খুব কাছাকাছি গেল।

এক বুড়ো, ত্থুথুড়ে এক বুড়ো কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। খুব চেষ্টা করেও অতিকায় দুটো ডানার কারণে সে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। দুঃস্বপ্ন দেখার মতো ভয় পেল পেলাইয়ো, দৌড়ে গেল স্ত্রী এলিসেন্দার কাছে। এলিসেন্দা তখন অসুস্থ শিশুর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিল। পেলাইয়ো তাকে উঠানের পেছন দিকে নিয়ে এলো।

নির্বাক স্তব্ধ দু’জন মানুষ মাটিতে পড়ে থাকা দেহটির দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তার পরনে ন্যাকড়া কুড়ানিদের মতো ছেঁড়া কাপড়। টেকো মাথায় সামান্য কিছু ফ্যাকাশে চুল, মুখে অল্প কয়েকটি দাঁত। তার বাপ-দাদার যদি কোনো রাজকীয় পরিচয় ও ঠাট-বাট জীবন থেকেও থাকে, তার এই দুর্দশাগ্রস্ত ভেজা শরীর দেখে তা মোটেও বোঝা যাবে না।

তার অতিকায় ডানার অর্ধেক পালক ঝরে গেছে, প্যাঁক-কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে, যেন চিরদিনের জন্য মাটিতে গেঁথে গেছে। পেলাইয়ো ও এলিসেন্দা অনেক সময় ধরে বুড়োর দিকে অবাক তাকিয়ে রইল। একসময় ঘোর কাটার পর তাদের মনে হলো এ বুড়ো তাদের চেনা। তারা সাহস করে বুড়োকে কিছু জিজ্ঞেস করল। কিন্তু বুড়ো নাবিকের মতো উঁচুস্বরে এমন এক আঞ্চলিক ভাষায় উত্তর দিল যে, কিছুই বোঝা গেল না।

তারা বুঝতে পারল ডানা নিয়ে প্রশ্ন করলে আসলে কিছুই জানা যাবে না। তাই তারা বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এবার বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু তথ্য বের করল। জানতে পারল বুড়ো আসলে সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজডুবিতে ভেসে আসা এক বিদেশি নাবিক। তারপর তারা প্রতিবেশী এক জ্ঞানী বুড়িকে ডেকে আনল যে কি-না জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে সবই বলে দিতে পারে। একবার তার ওপর চোখ পড়লেই ডানাওয়ালা বুড়ো সম্পর্কে বুড়ি সব বলে দিতে পারবে, কেটে যাবে এতক্ষণের যত ভুল-বিভ্রান্তি। ‘সে একজন দেবদূত’, বুড়ি বলে উঠল- ‘নিশ্চয়ই সে শিশুটির জন্য এখানে আসছিল। কিন্তু বেচারা এতটাই বুড়ো যে, বৃষ্টি তাকে আছড়ে ফেলল।’

পরদিন আশপাশের সবাই জেনে গেল পেলাইয়োর বাড়িতে রক্ত-মাংসের এক দেবদূত আটকা পড়েছে। প্রতিবেশী সেই জ্ঞানী বুড়ির কথা থেকে জানা গেল, অনেক অনেক আগের আমলের কথা। এরা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে যাওয়া পলাতক দেবদূত। তাদের মুগুরপেটা করে হত্যা করা হতো। পেলাইয়ো হাতে মুগুর তুলে নিয়ে সারা বিকেল রান্নাঘর থেকে বুড়ো দেবদূতের ওপর চোখ রাখছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাকে টেনেহিঁচড়ে কাদা থেকে তুলে আনল, তালাবদ্ধ করে রাখল মুরগির খোঁয়াড়ে।

মাঝরাতে যখন বৃষ্টি থামে, পেলাইয়ো ও এলিসেন্দা তখনও কাঁকড়া মেরে চলেছে। এর কিছুক্ষণ পর শিশুটা উঠে বসে, তার গায়ের জ্বর সেরে যায় এবং খেতে চায়। এতে পেলাইয়ো ও এলিসেন্দা দেবদূতের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। তারা ঠিক করল দেবদূতকে একটি মাচার ওপর বসিয়ে তিন দিনের খাবার ও পর্যাপ্ত পানি দিয়ে তার নিয়তির ভরসায় ভরা সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে।

কিন্তু পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই যখন তারা উঠোনে এলো, দেখল সব প্রতিবেশী মুরগির খোঁয়াড়ের সামনে দেবদূতকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে। খোঁয়াড়ের তারের ফাঁক দিয়ে ভেতরে খাবার ছুড়ে মারছে, বিন্দুমাত্র ভয়-ডর নেই। যেন সে কোনো অতিপ্রাকৃতিক সৃষ্টি নয়, সার্কাসের জন্তু।

অদ্ভুত এই সংবাদ পেয়ে ভোর ৭টার আগে পুরোহিত ফাদার গনজাগা এসে উপস্থিত হলেন। ততক্ষণে আরও যেসব দর্শনার্থী ভিড় করল তারা কেউই ভোরের দর্শনার্থীদের মতো এমন ফালতু ছ্যাবলা নয়। তারা এই বন্দির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু করে দিল। ভিড়ের জনতার মাঝে যারা সবচেয়ে সহজ-সরল তারা ভাবল, এই দেবদূতকে ‘পৃথিবীর মেয়র’ ঘোষণা করা উচিত। যারা একটু কঠোর মনের, তারা মনে করল, ভবিষ্যতের সব যুদ্ধে জয়ী হতে তাকে ‘ফাইভ স্টার জেনারেল’ পদে উন্নীত করা দরকার। যারা ভাবুক টাইপের তারা আশা করল, এই দেবদূতকে দিয়ে পাখাওয়ালা জ্ঞানী সন্তান উৎপাদন করা যেতে পারে, যে নতুন প্রজন্ম গোটা বিশ্বকে শাসন করবে।

ফাদার গনজাগা পুরোহিত হওয়ার আগে বেশ তাগড়া এক কাঠুরে ছিলেন। খোঁয়াড়ের তারের বাইরে দাঁড়িয়ে দেবদূতকে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজের মধ্যে প্রশ্নগুলো পুনরায় বোঝাশোনা করে তিনি দরজা খোলার আদেশ দিলেন। ভেতরে একদল মুগ্ধ মুরগির মাঝে দেবদূতকে হাড় জিরজিরে অতিকায় একটি মুরগির মতোই মনে হচ্ছিল। ভোরবেলার দর্শনার্থীদের ছুড়ে দেওয়া ফলের খোসা ও নাশতার টুকরা-টাকরার মাঝে খাঁচার এক কোণে রোদে শুয়ে সে তার ছড়ানো ডানা শুকাচ্ছিল।

মুরগির খোঁয়াড়ে ঢুকে ফাদার গনজাগা লাতিন ভাষায় দেবদূতকে বললেন, ‘শুভ সকাল’। পৃথিবীর বেহায়াপনার সঙ্গে একদম অপরিচিত দেবদূত তখন কোনো রকমে তার পুরনো চোখ দুটো তুলে নিজের আঞ্চলিক ভাষায় বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। পুরোহিতের সঙ্গে থাকা উপাসকরা দেখলেন এই প্রাণী ঐশ্বরিক ভাষা বোঝে না, পুরোহিতের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও জানে না, তখন তারা তাকে ভ মনে করল।

পুরোহিত আরও কাছে গিয়ে দেখলেন- দেবদূত অনেকটা মানুষের মতোই। তার শরীরে বিশ্রী দুর্গন্ধ, পাখার পেছনে পরগাছা গজিয়েছে আর ঝড়-বৃষ্টিতে ডানার মূল পালকগুলো ভেঙে গেছে। এসব আঘাতের কারণে কোনোভাবেই তাকে উজ্জ্বল দেবদূতের মতো মনে হচ্ছে না। পুরোহিত মুরগির খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে এসে উৎসাহী দর্শকদের বয়ান দিলেন এবং তাদের আজেবাজে কথা না বলতে সতর্ক করলেন। তিনি সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন বহুরূপী শয়তান অসতর্ক মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে। শুধু ডানা দেখেই বাজপাখি আর উড়োজাহাজের পার্থক্য বোঝা যায় না। আর আসল দেবদূত চিনতে হলে ডানা তেমন জরুরি বিষয় নয়।

তবুও তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন ব্যাপারটি নিয়ে তিনি উচ্চপদস্থ যাজককে চিঠি লিখবেন, আর তিনি জানাবেন পোপের কাছে। তার পরই সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই অতিকায় ডানাওয়ালা বুড়ো সম্পর্কে রায় জানা যাবে। পুরোহিতের জ্ঞানগর্ভ বয়ান কৌতূহলী জনতার বন্ধ্যা হৃদয়ে সুঁইয়ের মতো বিঁধল।

এরই মধ্যে দেবদূত ধরা পড়ার খবর চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাড়ির উঠান বাজারে পরিণত হয়ে গেল। কৌতূহলী জনতার চাপে বাড়িঘর ভেঙে পড়ার উপক্রম। শেষে কিনা তাদের সামলাতে বন্দুকের ডগায় বেয়নেট লাগানো সৈন্য ডাকতে হলো। বাজারে পরিণত হওয়া আঙিনার ময়লা সাফ করতে গিয়ে এলিসেন্দার শিরদাঁড়া ভেঙে পড়ার অবস্থা।

সব দেখে-বুঝে এলিসেন্দা একটা বুদ্ধি আঁটল। সে উঠানের চারপাশ বেড়া দিয়ে আটকে দিল। কেউ দেবদূতকে দেখতে চাইলে পাঁচ সেন্ট দিয়ে তবে ভেতরে যেতে হবে। বহুদূর থেকে মানুষ আসতে শুরু করল। ভ্রমণে বের হওয়া একটি উৎসবের দল এখানে এসে থামল। তাদের একজন উড়ুক্কু বাজিকরের কসরত দেখিয়ে দর্শক টানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। কারণ বাজিকরের ডানা দুটো দেবদূতের ডানার মতো নয়, বরং খেচর বাঁদুড়ের মতো।

ভাগ্যহারা দুর্ভাগা লোকজন সুস্বাস্থ্যের আশায় এখানে জড়ো হতে লাগল। আসতে লাগল আশপাশ ও দূর-দূরান্ত থেকে। সেই শৈশব থেকে হূৎপিণ্ডের ধুঁকপুকানি গুনতে থাকা যে দরিদ্র নারীর গোনার মতো সংখ্যা ফুরিয়ে গেছে, সেও এসেছে। পর্তুগিজ লোকটিকে আকাশের তারারা হৈচৈ করে ঘুমোতে দিচ্ছে না, তারও সমাধান চাই। ঘুমন্ত অবস্থায় হেঁটে বেড়ানো একজন জেগে থাকা অবস্থায় তার করা সারাদিনের কাজ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। সামান্য রোগবালাই নিয়েও আসছে অনেকে।

একটা জাহাজডুবির কাহিনী পৃথিবী কাঁপিয়ে তুলল। এত ক্লান্তির মাঝেও পেলাইয়ো ও এলিসেন্দা খুব খুশি। কেননা এক সপ্তাহেরও কম সময়ে টাকায় ভরে গেছে তাদের সব ঘর, আর দেবদূতকে দেখার জন্য অপেক্ষমাণ তীর্থযাত্রীর লাইন ততক্ষণে দিগন্তরেখায় গিয়ে ঠেকেছে। এই কর্মযজ্ঞে শুধু একজনই অংশ নেয়নি, সে হলো দেবদূত। তেলের বাতির পিশাচীয় উত্তাপ আর চারপাশে উৎসর্গের মোমবাতির আলো- সব কিছু যতটা সম্ভব নীরবে সয়ে নিচ্ছে ভ্রান্ত দেবদূত।

লোকজন প্রথমে তাকে কর্পূর খেতে দিলেন। জ্ঞানী সেই বুড়ি জানিয়েছেন- এটাই নাকি দেবদূতদের জন্য নির্ধারিত খাবার। কিন্তু দেবদূত ওই খাবার খেলো না। ঠিক একইভাবে সে প্রায়শ্চিত্তকারীদের আনা গির্জার দুপুরের খাবারও ফিরিয়ে দিল। কেউ অবশ্য জানতে পারেনি, সে বার্ধক্যের কারণে না দেবদূত হওয়ার কারণে এসব খাবার ফিরিয়ে দিচ্ছে। কেবল বেগুনের ভর্তা ছাড়া সে আর কিছুই খেলো না।

এখন পর্যন্ত শুধু ধৈর্য ছাড়া দেবদূতের মধ্যে আর কোনো অতিপ্রাকৃতিক গুণ দেখা যায়নি। প্রথম দিনগুলোতে তাকে মুরগি ঠোকর দিল, ডানার নানা জায়গায় নাক্ষত্রিক পরগাছা গজাল, শরীরের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করতে গিয়ে পালক টেনে তুলে ফেলল অনেকে, শোয়া অবস্থা থেকে দাঁড় করানোর চেষ্টা হলো, এমনকি কেউ কেউ পাথর ছুড়ে মারল- সবকিছুতে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে দেবদূত। একটুও নড়ল না, কিছু বলল না।

উৎসুক জনতা কেবল একবারই দেবদূতকে নাড়াতে পারল, যখন গরম লোহার কাঠি তার শরীরের একটা অংশে লাগিয়ে দেওয়া হয়। নিশ্চুপ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জড়ের মতো পড়ে রইল, সবাই ধরে নিয়েছে সে মারা গেছে। তবে শরীর ঝাঁকি দিয়ে সে জেগে ওঠে, তার নিজের ভাষায় কথা বলল এবং চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়তে লাগল।

খোঁয়াড়ের ভেতর দেবদূত কয়েকবার ডানা ঝাপটায়। আর এতে মুরগির বিষ্ঠা, মহাকাশের ধুলো আর যেভাবে চারপাশে আতঙ্ক ছড়াতে থাকে, তা কোনোভাবেই পার্থিব কিছু নয়। তখন আবার অনেকে মনে করে লাগল- এটা আসলে রাগ নয়, বরং দেবদূত যন্ত্রণা পাচ্ছে। এরপর থেকে কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করতে চেষ্টা করেনি। তাদের অনেকেই এবার বুঝতে পেরেছে এই নিষ্ফ্ক্রিয়তা সবকিছু মেনে নেওয়ার কারণে নয়, বরং তা ঝঞ্ঝার পর নীরবতার মতো।

এদিকে ফাদার গনজাগা বন্দির অবস্থা সম্পর্কে সর্বোচ্চ মহলের চূড়ান্ত রায়ের প্রতীক্ষায় আছেন। জনতার খামখেয়ালি ভরা এ ঔৎসুক্যকে তিনি কাজের বুয়ার কৌতূহল বলে মনে করলেন। অবশেষে রোম থেকে পুরোহিতের কাছে একটি পত্র এসেছে, তা পড়ে মনে হলো না বিষয়টি কত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ তা তারা বুঝতে পেরেছেন। বন্দির নাভি আছে কি-না, তার মুখের ভাষা আরামায়িক ভাষার সঙ্গে মেলে কি-না, আলপিনের খোঁচা কয়বার সহ্য করতে পারে, ডানাওয়ালা বন্দি আসলে নরওয়েজিয়ান কি-না- এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে তারা সময় কাটিয়ে দিয়েছে। তুচ্ছ এসব বিষয় নিয়ে পুরোহিতদের চিঠি চালাচালি ও কীর্তিকলাপ বন্ধ হলো হঠাৎ একটি ঘটনায়।

ওই দিনগুলোতে শহরের মেলা ছিল সবার আগ্রহের বিষয়। মা-বাবার অবাধ্য হয়ে মেলায় আসা একটি মেয়ে মাকড়সা হয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখার জন্য যে দর্শনী ঠিক করা হয়েছিল, তা দেবদূতের দর্শনীর চেয়ে কম। ব্যাপারটা এমন যে, উৎসুক জনতা পারে না মেয়েটিকেই এই অসম্ভব রূপান্তর সম্পর্কে যে কোনো ধরনের প্রশ্ন করে! তার এই ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ না রেখে তারা উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করে দেখতে চায়।

মাকড়সাটি ছিল ভেড়া আকৃতির, কেবল মাথার জায়গায় বিষণ্ণ এক নারীর মুখ বসানো। তবে তার আকৃতি নয়, হৃদয়বিদারক ব্যাপারটি হলো- তার নিজের মুখেই হতভাগ্য জীবনের ঘটনাটি শোনা। বলতে গেলে তখন তার শৈশবও কাটেনি। মা-বাবার অনুমতি না নিয়ে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে নাচের আসরে এসেছিল। সারারাত নাচের পর বনের মাঝ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ আকাশ ফেটে বজ্রপাত হলো আর সেই বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে ছুটে আসা গন্ধকের টুকরো সুন্দর মেয়েটির গায়ে পড়ল। আর তাতেই সে মাকড়সায় রূপান্তরিত হলো। এখন দয়ালু মানুষেরা তার মুখের দিকে যে মাংসের টুকরো ছুড়ে দেয়, তা খেয়েই সে বেঁচে আছে।

এই কাহিনীতে রয়েছে নিদারুণ মানবিক সত্য ও ভয়ঙ্কর শিক্ষা। এটা বন্দি দেবদূতের কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। দেবদূত মর্ত্যের মানুষের দিকে একবারও দয়ার চোখ তুলে তাকান না। তা ছাড়া দেবদূতকে কেন্দ্র করে যেসব অলৌকিক ঘটনা চারদিকে প্রচার করা হয়েছে, তাতে কিছু মানবিক ভুলভালও রয়েছে। যেমন- একজন অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার বদলে তার তিনটি নতুন দাঁত গজায়। একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাঁটার শক্তি ফিরে পাওয়ার বদলে জিতে নেয় লটারি। একজন কুষ্ঠরোগীর ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসে সূর্যমুখী ফুল। এগুলো অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং মুখরোচক মজার কৌতুক। যখন মাকড়সায় রূপান্তরিত মেয়ের ঘটনা সবাই জানল, তখন দেবদূতের খ্যাতি একেবারেই কমে গেল, মাকড়সা বালিকা তাকে পুরোপুরি হারিয়ে দিল।

এদিকে ফাদার গনজাগা তার অনিদ্রারোগ থেকে একেবারে সেরে উঠলেন। পেলাইয়োদের বাড়ির উঠান তিন দিনের টানা বৃষ্টি আর শোবার ঘরে কাঁকড়া হাঁটাহাঁটির সময় যেমন জনশূন্য ছিল, ঠিক সে অবস্থায় ফিরে এলো। বাড়ির মালিকদের হা-হুতাশ করার আর কোনো কারণ রইল না। যে টাকা তারা জমিয়েছে, তা দিয়ে ঝুলবারান্দা ও বাগানসহ দোতলা প্রাসাদ বানিয়ে ফেলল। জাল দিয়ে বাড়ির চারদিকটা ঘিরে দিল যেন শীতকালে বাড়িতে কাঁকড়া ঢুকতে না পারে। লোহার পাত বসানো হলো জানালায়, যেন তা ঠেলে দেবদূত ঢুকতে না পারে। শহরের কাছাকাছি একটি খরগোশের খামার তৈরি করে চাপরাশির চাকরিটা চিরদিনের মতো ছেড়ে দিল। আর এলিসেন্দা কিনল উঁচু হিল, চকচকে পাম্পশু, রেশমের বিচিত্র রঙ পোশাক। সেকালের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত নারীরা ছুটির দিনে এসব পোশাকই পরত।

মুরগির খোঁয়াড়টার দিকে কয়েকদিন কারো চোখ পড়েনি। এক সময় এর ভেতরটা ক্রেওলিন দিয়ে ধোয়া হতো, চোখজ্বলা ধূপ দেওয়া হতো। তবে এর কোনোটাই দেবদূতকে সমীহ করে নয়, বরং গোবরবিষ্ঠার দুর্গন্ধ দূর করতে। এ দুর্গন্ধ ভূতের মতো বাড়িটাকে জেঁকে ধরেছে, নতুন বাড়িটা এখন মনে হয় পুরনো কোনো বাড়ি।

বাড়ির শিশুটি যখন প্রথম হাঁটতে শিখল, সবাই সাবধান হয়ে গেল যেন সে মুরগির খোঁয়াড়ের কাছে না যায়। তারপর আস্তে আস্তে তাদের ভয় কমতে লাগল, দুর্গন্ধ সহনশীল হয়ে উঠল। দুই নম্বর দাঁতটি উঠতেই শিশুটি খেলার জন্য খোঁয়াড়ে ঢুকতে শুরু করে দিয়েছে। খোঁয়াড়ের তারগুলো খুলে খুলে পড়ছে। অন্যদের বেলায় দেবদূত যেমন রাশভারী ছিল, শিশুটির বেলায়ও ঠিক তেমনই। নির্মোহ কুকুরের মতো সে সব রকমের তিরস্কার ও লাঞ্ছনা সহ্য করে যাচ্ছে।

দেবদূত ও শিশু, দু’জনের একই সঙ্গে জলবসন্ত হলো। যে বৈদ্য শিশুটির চিকিৎসা করলেন, তিনি দেবদূতের হূৎপিণ্ডের স্পন্দন শোনার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি তার হূৎপিণ্ডের শোঁ শোঁ শব্দ শুনলেন, কিডনিতেও নানা বিচিত্র শব্দ। দেবদূতের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব তিনি ধরে নিলেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন দেবদূতের ডানায়, এটা কোন যুক্তিতে আছে সে ব্যাপারটা তার বোধগম্য হলো না। অথচ খুব প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতোই ডানা দুটো দেহের সঙ্গে যুক্ত। তাহলে এমন ডানা অন্য মানুষদেরও নেই কেন, বৈদ্য বুঝতে পারেন না। শিশুটি ততদিনে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। এদিকে রোদে-বৃষ্টিতে মুরগির খোঁয়াড় গেল ভেঙে।

রাস্তাঘাটে খিন্ন রোগাক্রান্ত মৃত্যুর দিনগোনা মানুষের মতো দেবদূত তার শরীরটা টেনে এখানে-ওখানে পড়ে থাকে। বাড়ির লোকজন ঝাড়ুপেটা করে দেবদূতকে শোবার ঘর থেকে বের করে দেয়, কিন্তু পরক্ষণে দেখা গেল সে রান্নাঘরে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে একই সঙ্গে কয়েক জায়গায় সে অবস্থান করছে। তারা এটা ভাবতে শুরু করল- দেবদূত ঠিক নিজের মতো দেখতে হুবহু আরেকজন দেবদূত সৃষ্টি করতে পারে। সারা বাড়িতে এখন তার মতো দেখতে একেকজন।

এই অবস্থায় ধৈর্য হারিয়ে এলিসেন্দা মুখে যা আসে তাই বলতে শুরু করল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল- দেবদূত দিয়ে ভরা এই বাড়ি জাহান্নাম হয়ে গেছে, এখানে বসবাস করা অসম্ভব। দেবদূত কিছুই খেতে পারছে না, তার পুরনো চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে। খুঁটিতে খুঁটিতে ধাক্কা খাচ্ছে। আর ক্ষয়ে ক্ষয়ে ডানার কিছু পালক কেবল ঝরে যাওয়ার বাকি আছে। এই মুহূর্তে পেলাইয়োর একটু দয়া হলো। সে দেবদূতের দিকে একটি কম্বল ছুড়ে দেয়, ঘুমোতে দেয় ঘরের চালার নিচে।

তখনই তারা টের পায় দেবদূতের জ্বর হয়েছে। বুড়ো নরওয়েজিয়ান জিহ্‌বা জড়ানো শব্দে প্রলাপ বকতে থাকে। আরও দুই-একবারের মতো এবারও তারা আশঙ্কা করল সে হয়তো মারা যাচ্ছে। এমনকি প্রতিবেশী জ্ঞানী নারীও বলতে পারলেন না দেবদূত মরে গেলে কী করতে হবে। এদিকে দেবদূত সেই শীতে শুধু টিকেই রইল না, প্রথম কয়েকদিনের রোদে তার শারীরিক অবস্থার অনেকটা উন্নতিও হলো। উঠানের সবচেয়ে দূরের এক কোণে সে কয়েকদিন সটান পড়ে রইল। কেউ তাকে দেখতেও আসেনি।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে দেবদূতের পাখায় কিছু শক্ত পালক গজাতে শুরু করল। কিছুটা কাকতাড়ুয়ার পাখার মতো। দেখে মনে হবে, জীর্ণ আরেকটি মূর্তিমান আপদ। কিন্তু এ পরিবর্তনের কারণ নিশ্চয়ই দেবদূত জানে। কারণ সে খুব সতর্ক ছিল যেন এই পরিবর্তন অন্য কারও চোখে না পড়ে। তারা ভরা আকাশের নিচে কখনও কখনও সে যে সমুদ্রসঙ্গীত গেয়েছে, কেউ যেন তা না শোনে।

এক সকালে এলিসেন্দা দুপুরের খাবারের জন্য কিছু পেঁয়াজ ছিলছিল। তখন তার মনে হতে লাগল গভীর সমুদ্র থেকে একটি ঝোড়ো বাতাস এসে রান্নাঘরের ভেতর বইছে। এলিসেন্দা জানালার কাছে গিয়ে দেখল। দেখল, দেবদূত ওড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টাটি ছিল অগোছালো, তার আঙুলের নখের খামচিতে সবজির বাগানে বলিরেখার মতো দাগ পড়ে গেছে। পাখার দুর্বল ঝাঁপটায় ঘরের চালা ভেঙে পড়ার অবস্থা। ডানার ঝাঁপটা বারবার ফসকে যাচ্ছে, বাতাসে ভর করতে পারছে না।

তার পরও দেখা গেল দেবদূত বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেছে। এলিসেন্দা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল- নিজের জন্য, স্বামীর জন্য। অসুস্থ শকুনের মতো ঝুঁকি নিয়ে দেবদূত কোনো রকম ডানা ঝাপটে বাতাসে ভর দিয়ে যখন শেষ বাড়িঘরগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে গেল, এলিসেন্দা সেদিকে তাকিয়ে রইল। পেঁয়াজ কাটার মাঝখানে এলিসেন্দা তাকে উড়ে যেতে দেখছে যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। কারণ দেবদূত আর কখনও তাকে বিরক্ত করতে আসবে না, বরং দিগন্তে ছড়ানো সমুদ্রের ওপর একটি কাল্পনিক বিন্দু হয়ে থেকে যাবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত