জীবনকৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণ দুই ভাই। সমাজের চোখে ওরা নিম্নবর্ণের। মূল পেশা কৃষি কাজ হলেও কচ্ছপ ধরা, শুয়োর পালন, বন্যশুয়োর শিকার করা, গরু-ছাগল পালা ওদের গোত্রীয় পেশা। কেউ কেউ পাঁঠাও পালন করে। ওরা খুব কর্মঠ। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কৃষি জমিতে কাজ করে। সুঠাম দেহের অধিকারী ওরা খুব বলবান। গায়ের বর্ণ নিম্ন শ্যামলা থেকে কালো। সাধারণ দেহের চেয়ে ওরা একটু বেশি উঁচু। কাজকর্মে ওরা খুব বিশ্বস্ত। তাই হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষক ও মহাজনদের নিকট ওদের কদর অনেক বেশি। কেউ কেউ মহাজনের ঘরে ভারবাহী শ্রমিক বা কুলির কাজ করে। দুই-আড়াই মণ চালের বস্তা ওরা সহজেই বহন করে। ওরা কাজে ফাঁকি দেয় না। ওদের গোত্রীয় প্রবাদ, ‘মালিক বাঁচলে আমাদের ভাতের অভাব নেই’। স্থানীয়দের নিকট ওরা বুনো নামে পরিচিত। মালিকের কাজ ওরা ধর্মের মতো মনে করে। ওরা হেলায় সময় নষ্ট করে না।
কাজ না থাকলে বর্শা আর মাজায় মোটা সুতার তৈরি খানিকটা জাল বেঁধে বের হয়ে পড়ে। গ্রামের ডোবা-নালা, মজাপুকুরে সেকালে প্রচুর কচ্ছপ পাওয়া যেত। সারাদিন ডোবা-নালায় বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে কয়েকটি কচ্ছপ নিয়ে বাড়ি ফিরত। জীবনকৃষ্ণ ও রামকৃষ্ণ দুই ভাই এ পেশায় পটু। সময় পেলেই ওরা বর্শা নিয়ে বের হয়ে পড়ে। ওরা ডোবা-নালার কিনারা দিয়ে হাঁটে আর বর্শা দিয়ে খোঁচায়। বর্শার মাথায় শক্ত কিছু পড়লে শব্দ হয়। আবার কখনও শব্দ হয় না। তবে ওরা বুঝতে পারে বর্শার মাথায় কী পড়েছে। ইট-পাথর, খাপরা, কাঠ, বাঁশ যাই পড়ূক ওরা বুঝতে পারে। বর্শার সরু ধারালো মাথা কচ্ছপের শক্ত পিঠে আঘাত লাগলে কিছুটা শব্দ হয়। এই শব্দ ভিন্ন। শিকারি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে এটা কচ্ছপ। যদি বর্শার আঘাত কচ্ছপের নরম পায়ে লাগে তখন খচ্ করে শব্দ হয়। শিকারি বুঝতে পারে কচ্ছপের পায়ে লেগেছে। যেখানেই আঘাত লাগুক কচ্ছপ যেতে পারে না। বর্শায় চাপ দিয়ে ধরে। এরপর এক পা দিয়ে চাপ দিয়ে রেখে, হাত দিয়ে ধরে কচ্ছপ মাজায় বাঁধা মোটা সুতির জালে রাখে। ছোট, মাঝারি আট-দশটি কচ্ছপ নিয়ে ওরা বাড়ি ফেরে। কচ্ছপের মাংস বুনোদের প্রিয় খাদ্য। কচ্ছপকে ওরা জলখাসি বলে থাকে। সেকালে গ্রাম ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ জনপদ। জঙ্গলে প্রচুর ডোবা, নালা, ছোট-বড় খাল ছিল। এসব জলাশয়ে প্রচুর মাছ ও বিষহীন সাপের সঙ্গে কচ্ছপ থাকত। অন্য কোনো গোত্রের মানুষ কচ্ছপ খায় না। তাই বুনোদের মতো নিম্ন গোত্রের মানুষের পুষ্টির অভাব হয় না।
এটা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকের কথা। তখন গ্রামের জঙ্গলে প্রচুর শূকর বাস করত। বন্যশূকর মানুষের ফসল বিশেষ করে পাকা ধান নষ্ট করত। শূকর সুযোগ পেলে মানুষ আক্রমণ করত। একা পেলে শুয়োরের দল মানুষ মেরেও ফেলত। বন্যশূকর দলবেঁধে খাদ্যের সন্ধানে এসে মানুষের ফসল নষ্ট করত। শুয়োরের অত্যাচার থেকে ফসল রক্ষার জন্য মানুষ দলবেঁধে লাঠি, ফলা এবং টিনের বাজনা নিয়ে এদের দলে আক্রমণ করত। টিনের বাজনা শুনলে শুয়োর দল ভয়ে পালাত। বিপদে পড়ে মানুষ শুয়োর হত্যাও করত। এ কাজে বুনোরা খুব বেশি পটু ছিল। বুনোরা শুয়োর পালন করত। তাই শুয়োর পরাস্ত করার সব কৌশল ওদের জানা। শূকরের অত্যাচার বেশি হলে কৃষকরা বুনোদের নিকট ধরনা দিত। জীবনকৃষ্ণ আর রামকৃষ্ণ দুই ভাই এ কাজে খুব দক্ষ। দুই ভাই একসঙ্গে অনেকবার শুয়োর দল প্রতিরোধ করেছে। এ কাজে দুই ভাই সবসময় একসঙ্গে থাকে। কখনও একা শুয়োর মারতে যায় না। আবার শুয়োরের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় দুই ভাই সবসময় পাশাপাশি থাকে, কখনও বিচ্ছিন্ন হতো না। মানুষ নিয়ে শুয়োর মারতে বা তাড়াতে গেলেও দুই ভাই কখনও আলাদা হতো না। জীবনকৃষ্ণ কৃষকদের করা নির্দেশ দিত শুয়োর মারার সময় তাদের দুই ভায়ের মধ্যে না আসতে। শুধুই পাশে থাকার নির্দেশ দিত। দুই ভাই পাশাপাশি থাকায় তাদের মনে থাকত দুই ডজন যুবকের শক্তি। শুয়োর দলের পক্ষে এমন দুই ভাইকে পরাস্ত করা ছিল অসম্ভব।
সেদিন বড় ভাই পিসির বাড়িতে বেড়াতে যায়। পিসির বাড়ি কয়েক গ্রাম পর। কৃষকদের ধান আধা পাকা হয়ে আসছে। তাদের মুখে হাসি। আর না খেয়ে কষ্ট করতে হবে না। কয়টা দিন তাই ধান পাকবে। কতদিন হলো ছেলেমেয়েরা পেটপুরে খেতে পায় না। মসুর সিদ্ধ, ছোলা সিদ্ধ, কালাই সিদ্ধ, গম আর যবের খিচুড়ি, পায়েস খেয়ে তিন মাস কাটাতে হয়েছে। আষাঢ় বছরের শেষ মাস নয়। প্রধান খাদ্য আউশ ধান পাকে শ্রাবণ মাসে। তাই কৃষকদের নিকট বছরের শেষ মাস আষাঢ়। এ সময় শুয়োরের উপদ্রব বেড়ে যায়। শুয়োরের উপদ্রবে ক্ষেতে প্রচুর ধান নষ্ট হয়।
গ্রামের মুরব্বিদের সঙ্গে কয়েকজন যুবক আসে রামকৃষ্ণদের বাড়িতে। বৃদ্ধরা বলে, বাবা রামকৃষ্ণ আমাদের বড় বিপদ। সারা বছরের খাবার শুয়োরের অত্যাচারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা গেলে আমাদের ধান রক্ষা পায়। রামকৃষ্ণ বলে, কাকা ক্ষমা করবেন, দাদা বাড়ি নাই আমি যেতে পারব না। বৃদ্ধ বলে, তোমার দাদা বাড়ি নাই তো তোমাকেই যেতে হবে। না কাকা এ কাজে একা যেতে নাই, গুরুজনের নিষেধ আছে। তাছাড়া দাদা ছাড়া আমি কোনোদিন এ কাজে যাইনি।
বাবা এখন তো বড় হয়েছ, ভগবান গা-গতরে অনেক শক্তি দিয়েছে। গ্রামে তোমার মতো শক্তিশালী দেখাও তো আর একটা আছে নাকি?
কাকা ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে। কোনো ভালো খাবার আমি না খাওয়া পর্যন্ত দাদা খায় না। সব কিছুতেই দাদা আমার জন্য বড় ভাগটা রেখে দিয়ে নেয় ছোট ভাগ। এই দেখেন নতুন গামছা। গতকাল আজুদিয়ার হাট থেকে কিনে এনেছে তার নিজের জন্য। দেখেন আমাকে নতুন গামছাটা দিয়ে আমার পুরান গামছা নিয়ে দাদা পিসির বাড়ি বেড়াতে গেছে। সবকিছুতেই আমার দাদা এমন।
খুব ভালো বাবা, এ জন্যই তো বাবা কিছু রেখে না গেলেও তোমরা সুখে আছ। তো বাবা, আমাদের ধান রক্ষা করতেই হবে। নইলে সারা বছর আমাদের ছেলেমেয়েদের না খেয়ে থাকতে হবে। তুমি একা গেলেই চলবে। অন্তত ২০ জন যুবক তোমার দুই পাশে থাকবে।
এক যুবক বলে, বল কী দাদা, শুয়োর মারব তো আমরা। তুমি শুধুই আমাদের মাঝে থেকে পরিচালনা করবে। তোমার কোনো ভয় নাই।
-না করো না বাবা, আমরা তোমাকে দুই গুণ টাকা দেব। আর তোমার দাদা জীবনকৃষ্ণ, আমরা ওকে বুঝিয়ে বলব, রামের কোনো দোষ ছিল না। আমরাই ওকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
-যাই বলেন কাকা আমার দাদা মনে খুব কষ্ট পাবে। আমি কোনোদিন দাদার কথার অবাধ্য হইনি। আজ অবাধ্য হব! তা হয় না কাকা। আমাকে ক্ষমা করবেন।
-না, তুমি আমাদের ক্ষমা কর। তোমার বাপ-বয়সের মানুষ আমি। মুরব্বির কথা অমান্য করাও তো পাপ বাবা।
-কাকা আমাকে বিপদে ফেললেন। এক শর্তে আমি যেতে পারি। আমার দাদার কছে কয়েক দিনের জন্য কথাটি গোপন রাখতে হবে। আর টাকা কয়েকদিন পরে আমার দাদার কাছেই দেবেন। যদিও এ কাজ আমরা অগ্রিম নিয়ে করি। মা বাড়ি নাই, ওপাড়ায় ঘুরতে গেছে, তাকে কিছুই বলা যাবে না।
রামকৃষ্ণ ঘরের ভিতর গিয়ে বর্শাটা নিয়ে বের হয়ে আসে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মা আছে কি-না তা দেখে নিয়ে লোকগুলোর সঙ্গে চলে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে লাঠি-ফলা নিয়ে কণ্ঠগজরার কৃষকরা হাজির হয়। রামকৃষ্ণ তার বাহিনী সাজিয়ে নিল। প্রথা অনুযায়ী রামকৃষ্ণ সবাইকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল। শুয়োর না মেরে ফিরবে না, কেউ কাউকে রেখে ফিরব না। রামকৃষ্ণ মালকোঁচা মেরে গামছা পাকিয়ে মাজায় শক্ত করে বাঁধে। এরপর কালীর নাম নিয়ে শুয়োর দলের দিকে তাকিয়ে ডাক ছাড়ে। শুয়োরের দলও হাঁক ছেড়ে শব্দ করতে থাকে। ওরা বোঝে এমন হাঁক-ডাক ওদের তাড়ানোর জন্য। বুনোরাও শুয়োরের ভাষা বোঝে। শুয়োর পালিয়ে যাওয়ার এক শব্দ, আর মানুষের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরেক শব্দ। রামকৃষ্ণ লক্ষ্য করে শুয়োরের দল তার দিকে এগোচ্ছে। রামকৃষ্ণ টিন বাজিয়ে শব্দ করার নির্দেশ দেয়। টিন পিটিয়ে প্রচুর শব্দ করা হয়। শুয়োরের দল দাঁড়িয়ে যায়। সামনা-সামনি দুই বাহিনী, শুয়োর আর মানুষ। শুয়োরদের চোখ দেখে, হাবভাব দেখে রামকৃষ্ণ বুঝে ফেলে, এ শুয়োরের দল তারানো কঠিন হবে। মুহূর্তে দাদার কথা মনে পড়ে। প্রশ্ন যাগে এত মানুষ, আমার পেছনে শেষ পর্যন্ত থাকবে তো? আবার চিন্তা করে, এখন আর এলোমেলো চিন্তা কেন, জিততেই হবে। এখন সামনে এগোতে হবে। এ ছাড়া অন্যকিছু ভাবার সুযোগ নেই। রামকৃষ্ণ হাঁক ছেড়ে সামনে এগিয়ে যায়। শুয়োরের দল একটু পেছায়, আবার দাঁড়ায়, আবার একটু সামনে এগোয়। শুয়োর দলের নেতা থাকে, তাদের মাদার বলা হয়। মাদার আকারে একটু বড় এবং বেশি শক্তিশালী। মাদার সবসময় দলের অগ্রভাগে থাকে। মাদারের নির্দেশে দল চলে। দলের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে শাস্তি দেয়। মাদারের নেতৃত্ব কঠিন। সবাই তাকে মানে। আবার নিজের জীবন থাকতে মাদার অন্যের ওপর আঘাত লাগতে দেয় না।
হঠাৎ একটা মাদার ছুটে আসে রামকৃষ্ণের দিকে। রামকৃষ্ণ সড়কি দিয়ে সেটা বধ করে। দুই পাশের যুবক দল তাকে সাহায্য করে। রামকৃষ্ণের সাহস ও বিশ্বাস বেড়ে যায়। দূর থেকে কৃষকরা বাহবা দিতে থাকে। রামকৃষ্ণের রক্ত টগবগ করে ওঠে। শুয়োরের দল পেছাতে থাকে। রামকৃষ্ণ এগোতে থাকে। নাগালের মধ্যে পেলেই বধ করে। এভাবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। শুয়োরের দল যতই পেছায় রামকৃষ্ণরা ততই এগোয়। হঠাৎ কয়েকটি শুয়োর ঘুরে দাঁড়ায়। আঘাত পাওয়া শুয়োর প্রচণ্ড হিংস্র হয়। শুয়োরগুলোর দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওরা বুঝতে পারছে রামকৃষ্ণই শুয়োর দলের মূল শত্রু। রামকৃষ্ণের গতি থেমে যায়। একটি শুয়োর রামকৃষ্ণকে আক্রমণ করে। রামকৃষ্ণ অসীম সাহসে সড়কি শুয়োরটির বুকে ঠেকিয়ে বধ করে। শুয়োরটি লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে মাটিতে পড়ে যায়। গোঁ গোঁ করতে করতে মারা যায়। এমন সফলতায় রামকৃষ্ণ জীবনের প্রতি খেয়াল হারিয়ে ফেলে। শ্রেষ্ঠ বীর হওয়াই এখন তার লক্ষ্য। সে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ কয়েকটি শুয়োর হুঙ্কার দিয়ে একযোগে ভিড়ে যায়। তখনই ঘটে বিপত্তিটা। হঠাৎ শুয়োর দলের এগোনো দেখে পেছনের লোকজন ভয়ে পালিয়ে যায়। রয়ে যায় দু’পাশের মাত্র চার যুবক। তারা দেখে, একটার পর একটা আসছেই। কয়েকটি তারা বধ করে। কিন্তু শুয়োরের দল কিছুতেই থামছে না। ভয় পেয়ে তারাও পালিয়ে যায়। সে দিকে রামকৃষ্ণের খেয়াল নাই। একটার পর একটা শুয়োর তাকে আক্রমণ করতে থাকে। কিন্তু সহযোগী ছাড়া শুয়োরের আক্রমণ প্রতিহত করা যায় না। একটা শুয়োরের আক্রমণ প্রতিহত করতে না করতেই আর একটা আক্রমণ করে বসে। রামকৃষ্ণ কয়েকটি প্রতিহত করার পর একটা শুয়োর দ্রুত আক্রমণ করে তাকে ফেলে দেয়। উঠতে না উঠতেই আরেকটি এসে আক্রমণ করে। এবার আর রক্ষা নাই। রামকৃষ্ণ মাটিতে পড়ে যায়। শুধু একটিবার চিৎকার দিয়ে বলে দাদা।
এই ডাক আর কেউ শুনতে না পেলেও কয়েক মাইল দূরে পিসির বাড়িতে দাদা জীবনকৃষ্ণ আর বাড়িতে তার মা ঠিক শুনতে পায়। পিসির বাড়িতে যখন সবার সঙ্গে জীবনকৃষ্ণ হাসি-তমসায় মশগুল তখন হঠাৎ তার বুক ফেটে কান্না আসে। সে ভাবে, আমার এমন লাগছে কেন? এমন তো লাগার কথা নয়। তবে কি বাড়িতে মায়ের কিছু হলো, না-কি রামকৃষ্ণের। আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, আমি একি আজেবাজে চিন্তা করছি যা আলাইডি-বালাইডি। বাড়িতে রামকৃষ্ণের মায়ের মনেও কেমন যেন একটা অজানা আতঙ্ক তৈরি হয়। তার শরীর কাঁপতে থাকে। হাত থেকে হাঁড়ি পড়ে যায়। মা ভাবে, আমার এমন লাগছে কেন? জীবন গেছে পিসির বাড়ি। আমার রাম কই? গরুর ঘরে যায়। পতিতে পাঁঠা বাঁধা আছে, সেখানে যায়। কিন্তু রাম নাই। পাড়ার ছেলেদের কাছে জিজ্ঞাস করে, কিন্তু কেউ বলতে পারে না। এক মেয়ে এসে বলে, রাম দাদাকে সড়কি হাতে কয়েকজন মানুষের সঙ্গে আজুদিয়ার দিকে যেতে দেখেছি। মা বুঝে ফেলে, নিশ্চয়ই শুয়োর মারতে গেছে। কিন্তু জীবনকে ছাড়া! হায় ভগবান! নিশ্চয়ই ওর কিছু হয়েছে। রাম আর জীবনের মা কাঁদতে থাকে।
অশুভ খবর বাতাসের আগে ওড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে খবর আসে, শুয়োর মারতে গিয়ে রামকৃষ্ণ মারা গেছে। শুয়োরের দল কামড়িয়ে চাবা চাবা করে রামকৃষ্ণকে মেরে ফেলে চলে যায়। গ্রামের লোকরা রামকৃষ্ণের মৃতদেহ নিয়ে কণ্ঠগজরা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে শুয়ে রেখেছে। একটা সাদা কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা। গ্রামের মাতবর এসে জীবনকৃষ্ণ ও তার মাকে আনার ব্যবস্থা করেন। মা খবর পেয়ে আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বুকে থাপ্পড় দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে থাকে। ওদিকে খবর পেয়ে জীবনকৃষ্ণ কাঁদতে কাঁদতে দ্রুতই ফিরে আসে। দুই যুবকের কাঁধে ভর দিয়ে জীবনকৃষ্ণ ঠ্যাং ভেঙে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে ভাইয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্য দিয়ে ছোট ভাইকে সে বড় করেছে! এদিকে মা জ্ঞান হারিয়েছে। মানুষ তার মাথায় পানি ঢালছে। হঠাৎ জীবনকৃষ্ণ দুই যুবকের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়ায়। এরপর এক দৌড়ে ভাইয়ের কাছে গিয়ে ভাইয়ের বুকের পাশে খুব জোরে একটা লাথি মেরে ‘রামকৃষ্ণরে’ বলে চিৎকার দিয়ে লাশের ওপর পড়ে যায়। ভাইয়ের বুকের ওপর মাথা রেখে বলে, ক্যান তুই ভাই ছাড়া শুয়োর মারতে গেলি, মায়ের পেটের ভাই ছাড়া ক্যান তুই শুয়োর মারতে গেলি। তুই কেন ভুলে গেলি বিপদে ভাই ছাড়া কেউ এগোয় না। ভাইরে বাবার মরণে আমি এতিম হই নাই, এইবার আমি সত্যি এতিম হইলাম।