লেখার শুরুতে ভাবছি নতুন কোনো অচেনা দেশে গেলে কেমন হয় সে অনুভূতি? ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন অচেনা মানুষ, ভিন্ন সংস্কৃতি সেখানে এক নতুন আগন্তুকের মুখোমুখি হয় একেবারেই এক নতুন জগৎ। সন্দেহ নেই ব্যক্তিবিশেষ সে অভিজ্ঞতারও নানা ব্যপ্তি এবং বৈচিত্র্য। তবে তেমন অভিজ্ঞতা কখনও কখনও হয় আনন্দের কিংবা বেদনার। আমার প্রথম দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। নেদারল্যান্ডসে পড়তে গিয়েছিলাম। অবশ্য এর পরে চাকরি, লেখাপড়া, ভ্রমণ নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরতে হয়েছিল। থাকতে হয়েছিল উল্লেখযোগ্য সময়ে। বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছিলাম নিজেকে। কত বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশে কত বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে, যাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্ণিল স্মৃতি।
তাদের অনেকের সঙ্গেই আর তেমন যোগাযোগ নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবাই হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেই স্মৃতিবিজড়িত কর্মকাণ্ড আমার অভিজ্ঞতাকেই করেছে অনেক সমৃদ্ধ। এই লেখাতে আমার কিছু স্মৃতি এবং উপলব্ধি কথা এই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরছি। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলাম কানাডার অটোয়াতে। সেখানের দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া দু-একটি স্মৃতি উল্লেখ করব।
একবার আমার এক বন্ধুর সংস্থার একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন। আমরা প্রায়ই বিকেলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে আড্ডা দিতাম। চলচ্চিত্র নির্মাণে আমার আগ্রহ ও কিছু প্রশিক্ষণ থাকায় কাজটি আমাকে চাপিয়ে দেওয়া হলো। মজার ব্যাপার হলো, আমার কোনো ক্যামেরা, প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট ছিল। না। আমি যতই বোঝালাম এটি একটি টেকনিক্যাল বিষয়, প্রয়োজন নানা প্রফেশনাল ইক্যুইপমেন্ট, কিন্তু সবাই আগ্রাহ্য করল। বন্ধু তার বাড়িতে ব্যবহূত একটি শৌখিন হাইএইচ ভিডিও ক্যামেরা এনে দিয়ে বলল, এটা দিয়েই শুরু করুন। কত ভালো কাজে খুব স্বল্প যন্ত্রপাতি দিয়েই কত বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজ করেছেন, আপনি কেন পারবেন না। আমাকে এক রকম জোর করেই শুরু করতে বাধ্য করল। শুরু করলাম কাজ। কোনো লাইটিং ও সাউন্ড রেকর্ডিং ইক্যুইপমেন্ট ছাড়া। লিখিত স্ট্ক্রিপ্ট নেই। বিষয় কমিউনিটি শিক্ষার ওপর। অটোয়ার ক্যারিয়ার স্টেশনের মিসেস বার্ব বুথ অবশ্য খুবই ইন্সপায়ার করলেন। মন খুবই খারাপ। নিজের মতো মাথায় একটি স্টোরি তৈরি করে বিভিন্ন লোকজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা ও স্টিল ও সহজলভ্য সঙ্গীত সংযোজন করে রাতভর জেগে তৈরি করলাম চলচ্চিত্র ‘চিল্ড্রেন অব দ্য লাইট’। অফিসিয়ালি এটি প্রদর্শনের আগেই দেশে চলে আসি। পরে আমার বন্ধু মেইল করে জানালেন, ওই অসম্ভব টেকনিক্যালি দুর্বল চলচ্চিত্রটি কানাডার পার্লামেন্টে তাদের সমবায় কার্যক্রম বিষয়ে এক বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হলে সবাই নাকি সেটার প্রশংসা করছিলেন। এই কাজে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা হলো- যে কোনো কাজেরই মূল্যায়ন অন্তত প্রবাসের অভিজ্ঞতায় এটা বুঝেছি তাহলো, তাদের কাছে আইডিয়া বা কনটেন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। পরে তার কারিগরি মান বিচার করে থাকে। তবে কারিগরি দিকটি দেখার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রয়েছে অনেক যোগ্য জনবল। চলচ্চিত্র নিয়ে আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। বিকেলে আমার এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করছি আর মাসালা চাখছি। এমন সময় দেখলাম পাশের টেবিলে লম্বা চুলের দেখতে ভারতীয় এক ছেলে এবং একটি বাদামি চুলের মেয়ে বসে গল্প করছে। তখন অটোয়াতে বে-টাউন থিয়েটারে চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছিল। ওরা ওখান থেকেই বিরতিতে ডিনারে এসেছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটির ইংরেজি উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে সে ফরাসি। সে ছেলেটিকে প্রশ্ন করল- তুমি তো ভারতীয়। ছেলেটি ভুল শুধরে দিয়ে বলল না, আমি বাংলাদেশি। মেয়েটি তার কাছে বাঙালি কোনো ভালো চলচ্চিত্রকার এবং সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলতে বলল। আমি পাশের টেবিলে ওদের কথা খুব ভালোভাবেই শুনতে পাচ্ছিলাম। ছেলেটি বলল, দেখ সমসাময়িক বা আধুনিক চলচ্চিত্রে বাঙালিরা তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। তাই তেমন বলার কিছু নেই। ছেলেটির কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু নিজের দেশের ছেলের ওই মন্তব্যটা আমি নিতে পারিনি তাই অশোভন ভেবেও আমি পাশের টেবিলে গিয়ে বললাম, দুঃখিত আমি তোমাদের কথোপকথন শুনছিলাম যা ঠিক নয়। কিন্তু তুমি তোমার বন্ধুকে বাংলা চলচ্চিত্র ও সাহিত্য সম্পর্কে প্রশ্ন করছিলে এবং তোমার বন্ধু যে দেশের মানুষ আমি সেই দেশ থেকেই এখানে এসেছি। চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমার আগ্রহ আছে এবং তুমি যদি অনুমতি দাও তবে তোমার পাশের চেয়ারটায় বসে তোমার বন্ধুর জবাবটা আমি দিতে চাই। আমি নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করতে পারব। মেয়েটি আমাকে বসতে বললে আমি তাকে বললাম সত্যজিৎ রায়ের কথা। তার অনবদ্য সৃষ্টির কথা তাকে জানালাম, চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তার অস্কার পাবার কথা। তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, খোদ প্যারিসবাসী সত্যজিতের চলচ্চিত্র সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেছিল। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য প্রথম পাঁচজন চলচ্চিত্র পরিচালকের মধ্যে সত্যজিৎ একজন।
জাপানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কুবোসাওয়ার সঙ্গে পাশাপাশি একই মর্যাদার বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনে অধিষ্ঠিত। আর বাংলা সংস্কৃতির পুরোধা রবীন্দ্রনাথ প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রথম এশিয়ান যে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাজ নিয়ে সত্যজিৎ যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তেমনি এখনও তার কাজ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়ে থাকে। ছেলেটি আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছিল। সে হাসির মানেটা আমি বুঝিনি তবে মেয়েটি তার নোটবুকে ‘ট্যাগোর ও সত্যজিৎ’কে লিখে নিয়েছিল তাদের কাজের ওপরে ইন্টারনেট ঘেঁটে ধারণা নেবে বলে। খুব ভালো লাগছিল আমার সেদিন। ওই প্রবাসে দু’জন বাঙালির অবিস্মরণীয় কর্মকাণ্ড আমি অহঙ্কারী বাঙালির মতো সেই তরুণীর বিস্ময়ভরা মনের কাছে তুলে ধরতে পেরেছিলাম। আজ ভেবে কষ্ট পাই, প্রবাসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ নিজ দেশের ওপর কিছু বলতে হলে ভারতীয় চায়নিজ ছাত্ররা যেভাবে নিজের দেশকে গর্বিতভাবে তুলে ধরে, সেখানে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখি। কেন এমন হয়। ভেবেছি অনেক। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। সম্ভব্য কারণ হিসেবে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, একজন বাংলাদেশি এবং বাঙালি হিসেবে কেন সে গর্বিত নাগরিক হবে সে সম্পর্কে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা না থাকা। আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে যেমন ছাত্রদের সম্যক ধারণা দেওয়া হয় না, ঠিক তেমনি তার সম্মুখে গর্বিত হওয়ার জন্য কোনো উদাহরণ রাখা হয় না। সব ঐতিহ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক্ষেত্রে ভারতীয় ও চায়নিজ ছাত্ররা ভাগ্যবান। তাদের দেশে তাদের সম্মুখে ছড়িয়ে আছে তাদের ঐতিহ্যের সংরক্ষিত নানা উপাদান।
পাঠ্য সিলেবাসে, তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির গৌরবগাথা অন্তর্ভুক্ত। আর আমাদের ছেলেদের সেই পরিবেশ আমরা দিতে পারিনি। আবার এমনও হয়েছে, শুধু ইংরেজি ভাষাগত দুর্বলতার জন্য উপস্থাপন করতে পারছে না। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি আমাদের দ্বিতীয় অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ। কিন্তু ইংরেজিকে পাঠ্যক্রমে কম গুরুত্ব দেওয়ার ফল আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভোগ করতে হচ্ছে। সিঙ্গাপুরে চাকরিকালীন আমি সিঙ্গাপুর পার্লামেন্ট সাইট পরিদর্শনের সময়ে এক কৌতূহলী সাইট প্রকৌশলী আমাকে আমি বাংলাদেশি বলে প্রশ্ন করলেন- আচ্ছা এই সাইটে তোমার দেশ থেকে আগত বেশ কয়েকজন শ্রমিক দাবি করছে যে, তারা গ্র্যাজুয়েট। তাই যদি হবে তবে ওরা ইংরেজি বলতে পারছে না কেন? আমি কাজ শেষে যে উত্তরটা দিয়েছিলাম সেটাই উল্লেখ করছি- দেখ ভারতে বা তোমার দেশে নানা ভাষাভাষি মানুষের বাস। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই ইংরেজি ভাষায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। খোদ ভারতেও ৫০টি অধিক ভাষা আছে যার বর্ণমালা রয়েছে। সেখানে এক প্রদেশের মানুষ চাকরির কারণে অন্য প্রদেশে গেলে ইংরেজি ছাড়া উপাই নেই। কিন্তু বাংলাদেশে বাংলা ভাষাভাষী ছাড়া অন্য ভাষার লোকজন তেমন নেই বললেই চলে। আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীও অন্যত্র বাংলায় কথা বলে। এর মাঝে আবার পাঠ্য সিলেবাসে ইংরেজির গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ইংরজি লেখা বা বলার সুযোগ কম থাকায় সম্ভবতই ছাত্ররা ইংরেজিতে দুর্বল থেকে যায়। তবে তারা তাদের কাজে যথেষ্ট দক্ষ ও মেধাবী। খুব দ্রুতই তারা ভাষাটি আয়ত্ত করে নেবে আশা করি।
অটোয়াতে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করছি। আমি একটি কর্মক্ষেত্রে নতুন যোগদান করেছি। সেই অফিসপাড়ায় যেতাম পাবলিক বাসে করে। আমেরিকাতে নাইন ইলেভেনের ঘটনার পর পর। ওখানে কাজে যোগদান করার পর জানলাম এই সংস্থার স্বত্বাধিকারী ও প্রধান একজন ইহুদি। তার ছেলে ও আমি একই সঙ্গে কাজ করছি। লাঞ্চ আওয়ারে আমাকে ও প্রশ্ন করছে- আমাদের দেশে ইহুদিদের সম্পর্কে ধারণা কী? আমি বললাম, দেখো ফিলিস্তিনের বিষয়ে সাধারণ মানুষ মনে করে তাদের ভূমি থেকে ইসরায়েল তাদের বিতাড়িত করেছে। আর ধর্মীয়ভাবে আমার ততটা জানা না থাকলেও শুনেছি যে, ইহুদিরা মুসলিমদের সঙ্গে যতগুলো সন্ধি করেছিল, তার প্রায় সবগুলোই ভঙ্গ করেছে। তাই ইহুদিরা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে এ বিষয়ে আমার তেমন পড়াশোনা নেই। ছেলেটি বলল, দেখো ফিলিস্তিনিদের বিষয়েও আমাদের অভিযোগ রয়েছে। তারা খুবই উচ্ছৃঙ্খল। আমি অবশ্য কথা বাড়ালাম না। বললাম হতে পারে। এ বিষয়ে আমার তেমন ধারণা নেই। ওইদিন বিকেলে বাসে ওঠার আগেই ওই সংস্থার এইচআরডির সুন্দরী তরুণী অফিসার আমার সামনে গাড়ি থামিয়ে বলল, রহমান আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি মাথা নাড়াতেই বলল, আমি তোমার ওই দিকেই যাব। চলে এসো তোমাকে ড্রপ করে দেবো। উঠে বসলাম ওর পাশের সিটে। নানা বিষয় আলাপ চলল। কেন এদেশে এসেছি। কী করতাম ওখানে। পরিবার আছে কি-না ইত্যাদি। হঠাৎ করেই আমার মনে একটা খটকা লাগল। আমি হেসে বললাম, দেখো তোমার ওহঃবৎারব-িতে নিশ্চয়ই আমি পাস করেছি। আশা করি নিশ্চয়ই তুমি আমাকে প্রতিদিন ড্রপ করবে না। মেয়েটি মুচকি হেসে বুঝিয়ে দিল যে, আমি যা ভেবেছি তাই। অর্থাৎ আমি মুসলিম হয়ে ওই ফার্মে কাজ করতে এসেছি। ইহুদি মালিক তাই তার ছেলে ও এই মেয়েটিকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিলেন যে, আমি কোনো সন্ত্রাসী নই। মজার ব্যাপার হলো এই যে, এর কয়েক মাস পরে আমি একটি কলেজে ভর্তি হলে চাকরিটা ছেড়ে দিই। যেদিন চলে আসি, সেদিন কেন যেন সবার জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করলেন স্বয়ং অফিস প্রধান। ইহুদি ভদ্রলোক আমাকে বললেন, কোন কোন খাবার আমি খেতে পারি আর কোনটা আমার খাওয়া ঠিক হবে না। তিনি আমাকে হার্ডড্রিঙ্ক ও পোর্কের ডিশগুলো দেখিয়ে তা অ্যাভয়েড করতে বললেন। আমাকে বললেন, শোনো রহমান, মদ কিন্তু আমাদের জন্যও বারণ। কিন্তু আমরা পান করি। আমি জেনে অবাক হলাম। সেদিন তিনি আমাকে এসেট ক্রিস্টালের তৈরি গ্লাস উপহার দিলেন। ইহুদি মালিকের অফিস থেকে এভাবেই একজন মুসলিম হিসেবে বিদায় নিয়েছিলাম। বলতে লজ্জা নেই, আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। এই ক্ষুদ্র পরিসরে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে যা লিখে শেষ করা হয়তো কখনও সম্ভব হবে না। একটি লন্ডনে ও অন্যটি নেদারল্যান্ডসে ঘটেছিল। লন্ডনে সহপাঠীদের সঙ্গে দু’দিনের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলাম। থেকেছি সস্তার ১০ পাউন্ডের হল্যান্ড স্ট্রিটের এক-চিতকাত হোস্টেলে। অর্থাৎ কারও বাড়ি যেটাতে বাক্স বেডের মতো প্রতিটি রুমে কয়েকটি বেডের সংস্থান করা হয়েছে। আমার চৌকস সাউথ আফ্রিকান বন্ধুর সহায়তায় এ ব্যবস্থা। যাই হোক শহরের মাঝখানে সন্ধ্যার দিকে একা বাসস্টপেজে অপেক্ষা করছি হল্যান্ড স্ট্রিটের বাসের জন্য। এমন সময় এক বৃদ্ধ আমার পাশে এসে দাঁড়াল। সেও উঠল আমার সঙ্গে। বাসে উঠেই জানতে চাইল আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। আলাপকালে বৃদ্ধ বলল, সে ইরানি। ছেলের এখানে বাধ্য হয়ে থাকছে। তার এখানে ভালো লাগছে না। ফিরে যেতে চায় তার সব বৃদ্ধ বন্ধুদের কাছে। কিন্তু তার স্ত্রী বেঁচে না থাকায় ছেলের এখানেই তাকে থাকতে হচ্ছে। ফিরে যেতে চায় সে। কিন্তু সে সুযোগ তার কোনো দিন হবে না হয়তো। তাই প্রতিদিন এই বাসস্টপেজে দাঁড়িয়ে সে কোনো এশিয়ান দেখলেই নিশ্চিত হতে চায় সে ইরান থেকে এসেছে কিনা? যদি তার শহরের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আমি তাকে বললাম, আপনি একদিন নিশ্চয়ই হয়তো আপনার শহরের কাউকে পেয়ে যাবেন। সেই শুভদিন আসুক আমি সেই কামনা করছি। বৃদ্ধের চোখ কেন যেন ভিজে আসে। বাসের টিকিটওয়ালী মেয়েটি ভারতীয়। বলল, ভারতীয়? না বাংলাদেশি। হল্যান্ড স্ট্রিট যাব। ইতিমধ্যে ইরানি বৃদ্ধ নেমে গেল কিন্তু মেয়েটি আমাকে নামতে দিল না। বলল, তোমাকে আমি ঠিক তোমার হোটেলের কাছে নিয়ে যাব। অপেক্ষা করো।
অর্থাৎ, এই বাসটি শেষ স্টপেজের পরে ঘুরে এসে যেখানাটায় থামবে, সেখান থেকে আমার হোটেলটি দেখা যায়। অগত্যা আমি বসে রইলাম। বাসের ভারতীয় মেয়েটি আর আমি নেমে গেলাম। হেঁটে চলেছি। আমার হোটেলের কাছে আসতেই বলল, খুবই ভালো লাগল তোমার সঙ্গে কথা বলে। ভারতীয় যে কাউকে দেখলে আমার কৈশোরের কথা মনে পড়ে যায়। আশা করি, তোমার লন্ডন ভ্রমণ সুখের হবে। আমি ধন্যবাদ দিয়ে আমার চিতকাত হোটেলের দরজায় ঢুকতে দেখি আমার সাউথ আফ্রিকান বন্ধু এক মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বিড়ির মতো করে কী যেন ফুঁকছে। নেদারল্যান্ডসের আমার এক সহপাঠীর কথা বলে এই লেখার ইতি টানছি। একই সঙ্গে পড়তাম ও আর আমি। খুবই ধার্মিক ও যাজিকাদের মতো। নিজেকে বলে ব্রহ্মকুমারী। এই বিদেশিনী আবার বিকেলে একটি শহরের একটি সেন্টারে নিয়মিত প্রার্থনা করতে যেত। আমাকে সে সপ্তাহে দু’তিন দিন ওখানে গেলে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইত। আমরা হেঁটে যেতে নানা বিষয়ে আলাপ করতাম। তার আগ্রহ ভারতীয় ইতিহাস ও মিথলজি এবং দর্শনের ওপর। সে বিষয়ে সে ভালোই জানত। আমার আগ্রহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র এবং শিল্প সম্পর্কে। এ বিষয়ে দু’জনেই শেয়ার করতাম ওই প্রার্থনা সেন্টারে যেতে যেতে। সে ভেতরে চলে গেলে আমি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতাম। ফেরার সময় একদিন আমাকে অন্য চমৎকার একটি গির্জা দেখাতে নিয়ে গেল।
দেখাল আমার আগ্রহের পাইপ অর্গান, স্টেইন গ্লাসের ব্যাগ। সেই সঙ্গে বলল, আমি যেন অন্য দিন তার জন্য একটা মজার জায়গা খুঁজে রাখি যেখানে আমি তাকে নিয়ে গিয়ে সারপ্রাইজ দেব। এটা একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল। ও আর আমি একেকদিন নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে চমক দিতাম। আমাদের কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার আগে আমি একটা কিবোর্ড কিনেছিলাম। ও সঙ্গেই গিয়েছিল আমাকে সহায়তা করার জন্য। আমরা যেদিন যার যার কোর্স শেষে বাড়ি ফিরে যাব, তার আগের দিন বিকেলে এই নতুন জায়গায় ঘুরিয়ে নেওয়ার শেষ দিন। সেদিন তার টার্ন। ও নিয়ে যাবে আমাকে। সন্ধ্যার বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। খুবই অবাক হয়েছিলাম আমরা। এই প্রথম ওই শহরে বৃষ্টি হতে দেখলাম। আমাকে অদ্ভুত সুন্দর এক কাঠের ব্রিজের কাছে নিয়ে গেল ও। বলল, দেখো কী সুন্দর এই ব্রিজটি। ছবির মতো তাই না। রহমান কাল সকালেই আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি বলেছিলে যে, তুমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবে। তার সঙ্গীত তুমিই কম্পোজ করবে। তুমি একটা কাজ করবে, তুমি যখন সঙ্গীত কম্পোজ করা শুরু করবে, তখন আমার জন্য একটা সঙ্গীত কম্পোজ করবে এই ব্রিজটির বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার কথা মনে করে। যেহেতু আমি একজন সন্ন্যাসিনী, তাই তোমার সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ থাকবে না। তবে সঙ্গীতটি হয়ে গেলে তা তুমি আমাকেই উৎসর্গ করবে। আমি হয়তো কোনো দিন সেটা পেয়েও যেতে পারি। দেশে এসে আমার সঙ্গীত রচনা করা হয়নি। তবে একদিন আমি কথা রাখবোই। বৃষ্টির অপেক্ষায়।