সকাল সকাল আমার গার্লফ্রেন্ড মালিহা ফোন দিল। আমি চোখ ডলতে ডলতে রিসিভ করলাম। ঐ পাশ থেকে বিড়ালের মতো মিনমিনে সুরে বলল, ‘হ্যালো বাবু?’ ঘুমের ঘোরে প্রথমে আমি একটু কনফিউশানে পড়ে গেলাম। ভাবলাম কে ডাকে এভাবে, মা? নাহ্..এখন তো বড় হয়ে গেছি, মা তো আর এমন করে বাবু বলে ডাকে না। শিওর হওয়ার পর বললাম, ‘হুম জান, বলো।’
-তুমি না খুব পঁচা।
-কেনো, আমি আবার কী করলাম?
-কী করো নাই সেটা বলো!
-মানে?
-মানে..মানুষের বয়ফ্রেন্ড মানুষকে কত্তো সুন্দর সুন্দর শাড়ী কিনে দেয়। এইতো, গতকাল আঁখির বফ ওরে কী সুন্দর ম্যাজেন্টা কালারের একটা শাড়ী গিফট করল। তুমি তো আমাকে কক্ষনো শাড়ী কিনে দাও না।
-কিন্তু তুমি তো শাড়ী পরো না।
-পরি না; কিন্তু তাই বলে কক্ষনো পরব না না-কি? মানুষের মুড কী সবসময় এক থাকে, চেঞ্জ হয় না? সুইং হয় না?
বুঝলাম আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বান্ধবী আঁখির বয়ফ্রেন্ড শাড়ী গিফট করছে মানে আমাকেও করা লাগবে। মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে করে আঁখির বয়ফ্রেন্ডের তো আরো তিনটা গার্লফ্রেন্ড আছে। আমিও আরো কয়েকটা প্রেম করি। কিন্তু বলা যায় না। চাইলেই সব বলা যায় না। বিটিভি বা সরকারি চাকুরিজীবীদের মতো মাঝেমধ্যে অনেক কিছুই চেপে যেতে হয়। এইদিকে আমার পকেটের অবস্থা তথৈবচ। মানিব্যাগটা যক্ষা রোগীর মতো মুমূর্ষু। যদিও বাবার প্যাকেট মানেই আমার প্যাকেট। যাইহোক কোনোক্রমে দু’চারটা মুখে দিয়ে নিউমার্কেট গেলাম। তার আগে পাশের ফ্ল্যাটের আপুর কাছ থেকে ভালো একটা ব্র্যান্ডের শপিং ব্যাগ নিয়ে নিলাম। নইলে পাঁচশো টাকার শাড়ী পয়ত্রিশ শ বললে বিশ্বাস করবে না। মার্কেটে ঢুকতে না ঢুকতেই মালিহা ফোন দিল, ‘হ্যালো বাবু, কই তুমি? এত সাউন্ড কিসের?’
-এই তো..একটু মার্কেটে আসছি।
-নিশ্চয় তুমি আমার জন্য শাড়ী কিনতে গেছ, না? তোমাকে না একটা কিছু বলে শান্তি নাই। ধুররররর! তোমাকে সকালবেলা আমার বলাটা-ই ঠিক হয় নাই। মনে মনে বললাম ওরেএএএ অভিনয় রে..ক্যাথরিন হেপবার্নও ফেল। এসব কথা সরাসরি বলা যায় না বা বলার মতো দুঃসাহসও আমার নেই। তাই কন্ঠে কোকিলের সুর এনে বললাম, ‘আরে ধুরররর..তোমাকে দিব বা তো কাকে দিব আমি! যাইহোক কোন কালারের কিনব বলো তো?
-উমমম..কিনবেই যখন নীল কিনো। অনেক দামাদামি করে নীল একটা শাড়ী কিনলাম। দোকানদার কিছুতেই পাঁচশ টাকায় দিবে না। শেষে মানিব্যাগ খুলে দেখালাম আমার কাছে আর কিছু নাই। আমার চেহারা দেখে মায়া হওয়ায় দিয়ে দিল। মার্কেট থেকে বের হতে না হতেই আবার মালিহার ফোন। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ বাবু, কিনছ?’
-হুম।
-কই দেখি দেখি..একটা ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে দাও তো।
-আরে অত ছবি তুলার কী আছে! আমি এক্ষুণি তোমার বাসার দারোয়ানের কাছে দিয়ে যাচ্ছি।
-উফফফফ! এই ছেলে এত আনরোমান্টিক ক্যান? যা বলছি তাই করো তো। কী আর কারার! ছবি তুলে পাঠালাম। সাথে সাথেই ফোন আসল, ‘আচ্ছা তুমি এত কিপ্টা ক্যান বলো তো?
-মানে?
-মানে..গার্লফ্রেন্ডরে মানুষ শুধু শাড়ী দেয়? চুড়ি, টিপ, পায়েল এইগুলার কথাও কী আমাকে-ই বলে দেয়া লাগবে?
তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। সারাজীবন আমার কপালে অনেক কষ্ট আছে। আবার মার্কেটে ঢুকলাম। প্যান্টের চোরাই পকেটে রাখা টাকা দিয়ে নীল চুড়ি, নীল টিপ, পায়েল কিনলাম। কিনে মালিহাদের বাসার দারোয়ানের কাছে দিয়ে আসলাম। বাসায় ঢুকতেছি। সিঁড়িতে এখন। মালিহা ফোন দিল। রিসিভ করলাম।
-হ্যালো, শাড়ী পাইছ?
-হুম, সায়মা মাত্র নিয়ে আসল।
-কী, মুখ ভার ক্যান? শাড়ী পছন্দ হয় নাই?
-হইছে।
-তাহলে?
-আচ্ছা, তুমি কী কোনোদিনও ঠিক হবা না?
-মানে..আবার কী করলাম রে বাবা?
-তুমি কী কোনোদিনও একটু রোমান্টিক হবা না? গার্লফ্রেন্ডরে শাড়ী দিলে তার সাথে যে একটা গোলাপ দেয়া লাগে এই ন্যূনতম কমন সেন্সটাও কী তোমার নাই?
আবার শাহবাগ ছুটে গেলাম। কাঠগোলাপ কিনলাম। মালিহা ওদের বাড়ির কাজের মেয়ে সায়মাকে পাঠাল ফুল নিতে। সায়মার হাতে ফুল তুলে দিলাম। কিন্তু বুঝলাম না রাস্তার পাশের দোকানদারগুলা এমন মিটমিট করে হাসছে ক্যান। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই রাগে-ক্ষোভে মালিহাকে ফোন দিলাম, ‘শুনো, তোমার আমার কাছ থেকে কিছু নেয়ার থাকলে তুমি সরাসরি এসে নিয়ে যাবা। ঐ সায়মাকে আর পাঠাবা না।’
-ক্যান রে বাবা, কী এমন হইছে?
-আরে তোমাদের বাসার আশেপাশের লোকজন তাকায়া থাকে। ভাবে আমি কাজের মেয়ের সাথে লাইন মারার ট্রাই করতেছি।
-ছি রাকিব ছি! তুমিও এরকম..তোমাকে তো আমি এমনটা ভাবি নাই। তুমি কাজের মেয়ে বলে সায়মাকে ঘৃণা করছ?
হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও, আমি ঢুকে যাই। এই মেয়েকে বুঝানো সম্ভব না। আর বুঝাতে গেলামও না। বাসায় এসে খেয়েদেয়ে একটা ঘুম দিলাম। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম মালিহা হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। আমি নক দিলাম।
-শাড়ী পরছিলা?
-হুম।
-ছবি পাঠাও তাহলে।
-পাঠাইছি তো আবার ভালো করে দেখলাম। দেখে বললাম, ‘আরে এইগুলা না। তোমার ছবি পাঠাও। ভালো করে পাঠাও। বুঝা যায় না তো।
-তুমি না রাকিব আসলেই একটা গোবর গণেশ।
-ক্যান, এখন আমি আবার কী করলাম?
-আরে ধুররররর! আমি কী আমার ছবি তুলার জন্য শাড়ী পরছি না-কি?
-তাহলে?
-আরে..কয়দিন ধরেই ভাবতেছি হুমায়ূন আহমেদের নবনী বইটা পড়ব। তো পড়ার আগে বইয়ের উপর চুড়ি, টিপ, গোলাপ রেখে একটা এস্থেটিক ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়া লাগবে না?
-তুমি এজন্য আমারে দিয়ে ঐগুলা কিনাইছ?
-হুম।
-বইটা পড়ছ?
-না।
-কবে পড়বা?
-দেখি..
কিন্তু আমার আর কিছুই দেখার বা বলার থাকল না। আমি শুধু মালিহার পাঠানো এস্থেটিক ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি। একপাশে একটা শাড়ীর আঁচল বিছানো। আর ছবিতে মালিহার শুধু হাতটা দেখা যাচ্ছে। হাতের সাথে বইটা। বইয়ের উপর চুড়ি, টিপ, পায়েল। আর সাইড দিয়ে কয়েকটা কাঠগোলাপ ছিটানো।
গল্পের বিষয়:
গল্প