এক নতুন মেয়ে

এক নতুন মেয়ে
আজ মায়ের সাথে নিজেকেও সাজাতে হচ্ছে! এই প্রথম আমার সাজতে ভালো লাগছে না। কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট কান্না হয়ে বের হয়ে চোখ হয়ে ঝড়ে যেতে চাইছে। আমিই হয়তো একমাত্র অভাগী যে তার মায়ের বিয়ের সাক্ষী হবে, তাকে নিজ হাতে সাজিয়ে অন্যের হাতে তুলে দিবে! অনেক আত্মীয় তো বলাবলি করছে, “যে বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা সেখানে মা বসছে বিয়ের পিড়িতে।”
-“আসলেই, কি দরকার ছিল মায়ের বিয়ের করার?” যার সাথে মায়ের বিয়ে হবে তাকে মোটেও আমার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু আমি তো অসহায়। বারবার শুধু জানতে ইচ্ছে করছে,
-“একা একা বাকিটা জীবন কি কাটিয়ে দেওয়া যেত না?” বিয়ের পর মায়ের সাথে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হলো লোকটার বাড়িতে। একরকম বাধ্য হয়েই আসা, বাবাকে সেই ছোটবেলায় হারিয়ে মাকে জড়িয়েই বেঁচে আছি, তাকে ছাড়া কি করে থাকব একা? বিয়ের আগে মায়ের শর্ত ছিল আমাকে কন্যা হিসেবেই তার দায়িত্ব নিতে হবে। তিনিও তাই করেছেন। নতুন বাড়ি, নতুন জায়গা, নতুন মানুষের ভিড়ে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে। লোকটা আমার কাছে নিয়ম করে আসেন, আমার খোঁজখবর নেন, আমার কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করেন। আমি উত্তরে শুধু বলেছি, “যাই করেন, আপনি আমার বাবা হতে পারবেন না।”
লোকটা বিস্মিত না হয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, “না মা! তোমার বাবা হতে হবে না, তবে তুমিই আমার মেয়ে।” উত্তরটা অসহ্য লাগলেও কেমন যেন হৃদয় জুড়িয়ে দিয়েছিল, অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছিল! এদিকে লোকটা আমার বাবা না হতে পারলেও আমার মা কিন্তু আরেকজনের মা হয়ে গেছেন। হ্যা, ওই লোকটার ছয়/সাত বছর বয়সী একটা ছেলেও আছে। যে আমার মাকে এখন মা বলে ডাকে। খুব হিংসে হয় যখন দেখে মা নিজের কোলে তুলে তাকে আদর করে, তাকে খাইয়ে দেয়, তাকে গোসল করিয়ে দেয়, তার চুল আচঁড়িয়ে দেয়। এই ছেলেটার তো কোথাও কোন সমস্যা হয় নি অপরিচিতা একজন মহিলাকে নিজের মা ভাবতে! আমার কেন অসুবিধা হচ্ছে তার বাবাকে নিজের বাবা ভাবতে? নাহ! আমার বাবা একজনই, যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, আর তিনি আমার বাবা হতে পারেন না, তিনি হচ্ছেন আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী।
কিন্তু সেদিন ছেলেটা তার পছন্দের খেলনাটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল ‘তুমি আমার বুবু হবে?’ কিন্তু এই পুতুলটা তাকে কোনদিন হাতছাড়া করতে দেখি নি, খাওয়ার সময় পুতুলটা লাগবে, ঘুমানোর সময়ও লাগবে এই পুতুল!
সেদিন ওর প্রতি সব হিংসে উবে গিয়েছিল, খুব মিষ্টি ছেলেটা। বিস্ময় কাটিয়ে আমিও তাকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, “তোমার বুবু হতে হলে কি করতে হবে?” সেও বাচ্চাদের মতই বলেছিল, “খেলতে হবে আমার সাথে, সারাক্ষণ খেলতে হবে!” তারপর থেকে আমি একজন ভাইয়া পেলাম, আর ছেলেটা খুঁজে পেল একজন খেলার সাথী আর একটা বুবু। এখন আমরা একসাথে খেলি, ঘুরি, একসাথে খাই, একসাথে ঘুমাইও। আমি নাকি তার প্রিয় পুতুল বুবু। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম লোকটা আমার মাকে স্ত্রী করেছেন নিজের সন্তানের মা করার জন্য। আমারো শত রাগ, অভিমানে খানিকটা ভাটা পড়েতে শুরু করলো! খুব ভোরে এসে ডাকতেন আমাকে নামাজ পড়ার জন্য। বলতেন “উঠে নামাজ পড়, নামাজ পড়ে নিজের বাবার জন্যই না হয় দোয়া কর, তুমি দোয়া না করলে কে করবে?” কথাটা হৃদয়ে আজো বিঁধে আছে! আসলেই মানুষ বড্ড আজিব কিসিমের প্রাণী, যাদের জন্য শত রাগ, অভিমান তারাই একদিন ভালোবাসার একজন হয়ে যায়।
বৃষ্টিতে ভিজে একবার আমার জ্বর হয়েছিল, তিনিও নাকি মায়ের সাথে রাত জেগেছিলেন, পালাক্রমে আমার মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছেন, ঔষধ খাইয়েছেন। আবার যখন একটু সুস্থ হলাম তখন খুব করে বকুনিও দিয়েছেন, করেছেন শাসন। সেদিনের সেই শাসনে কোন বিরক্তি ছিল না, ছিল অন্যরকম কিছু। প্রথম যেদিন নিজের হাতে রান্না করলাম, করলার তরকারি তার অপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে কি তৃপ্তি নিয়ে খেলেন, একবারও মনে হয় নি করলা তার অপছন্দের। বেঁচে থাকলে আমার বাবাও হয়তো এইভাবেই খেতেন। শুনেছি কাছের মানুষের জন্য অনেক অপ্রিয় জিনিসও নাকি প্রিয় হয়ে উঠে। আসলেই হবে হয়তো, একদিন যেই মানুষটাকে দুচোখে সহ্য হতো না, আজ তার মধ্যে নিজের বাবাকে দেখতে পাই।
এখন সম্পর্কটা অনেকটা বাবা-মেয়ের মতই। আমরা এখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে এখন লুডু খেলি। মা আর রাফসান, আমি আর আংকেল। কি মনোযোগ দিয়ে খেলেন, যেন আমাকে জেতানোই তার একমাত্র লক্ষ্য। এখন ঘরে রাফসানের জন্য কিছু আনলে আমার জন্যও একটা নিয়ে আসেন। হোক সেটা জামা,আইসক্রিম কিংবা চকলেট। সেদিনও যখন চকলেট এনে আমাকে দিলেন, মা একটু মজা নিয়ে বললেন, “ক’দিন পর যে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে তাকে এনে দেন চকলেট?” তিনিও তখন বললেন, “সন্তানরা আবার মা বাবার জন্য বড় হয় কখনো?” সত্যিই সেদিন বাবাকে যেন খুঁজে পেয়েছিলাম তার মাঝে, তার মানসিকতায়।
আজো মনে আছে আমার বিয়ের দুইদিন আগ থেকে তিনি ঘুমান নি, কত ব্যস্ততা, যেভাবে একজন বাবা ছুটাছুটি করেন তার মেয়ের বিশেষ এই দিনে। কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও কিছুক্ষণ বাদে বাদে দরজার ওপাশ থেকে এক বাবাকে দু’চোখ ভরে নতুন বউয়ের সাজে নিজেকে দেখতে দেখেছিলাম! এখনো বিদায় বেলার সেই দৃশ্য চোখে ভাসে, সেদিন তিনি যেভাবে কেঁদেছিলেন মনে হচ্ছিল যেন আমার বাবাই কাঁদছেন। সেদিন তার কান্নায় আমার হৃদয়ে আংশিক থেকে থাকা সংকোচ বোধটাও হয়তো ধুয়ে মুছে গিয়েছিল। সেদিনই প্রথমবার তাকে বাবা বলে ডেকে ফেলেছিলাম, তাকে মেয়ে হয়ে জড়িয়েও ধরেছিলাম। তিনি বাবা ডাকটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেছিলেন, ”বড় অবেলায় বাবা বলে ডাকলি রে মা, যাওয়ার বেলায় এভাবে মায়া বাড়িয়ে গেলি!” আমিও অভিমানী সুরে বলেছিলাম, “তো কি হইছে এখন থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে দুইবেলা ফোন দিয়ে বাবা ডাকব!”
সেদিন এক নতুন মেয়ে কেঁদেছে, কেঁদেছে তার বাবাও। এরপর নিয়ম করে বহুবছর ফোন করে বাবাকে ডেকেছি, তিনিও ফোন নিয়ে মুখিয়ে থাকতেন। আমার বাবা ডাক শুনবে বলে, তারপর ছোট্ট রাফসানটা তার পুরো দিনের জমিয়ে রাখা প্রত্যেকটা ঘটনা রিপোর্টের মত পড়ে শুনাতো আর আমি বুবু হয়ে শুনতাম। আজ অনেকদিন বাবা বলে ডাকিনা, যাকে ডাকতাম তিনি যে ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু আজও ভোর হলে মনে হয় তিনি যেন ডেকে বলছেন, “ওঠ মা! নামাজ পড়ে আমাদের জন্য দোয়া কর!” শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে আমার জন্মদাতার পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। সুবিধাই হয়েছে। এখন আমার সব দোয়া, ভালোবাসা গিয়ে ভিড় করে আমার দুই দুইজন বাবার কাছে একই জায়গায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত