শপথ

শপথ
নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি এমন সময় পাশের ঝোপঝাড় থেকে মেয়েলি গোঙ্গানোর শব্দ কানে আসলো। আমি শিকারী পশুর মতো কানটা আরেকটু খাড়া করতেই বুঝলাম ভুল শুনিনি। রাস্তাটা বেশ নির্জন এই রাস্তা দিয়ে সচরাচর আশা হয়না কিন্তু আজ অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি থাকায় এই শর্টকাট রাস্তা ব্যবহার করতে হলো। আমি বুকে ভয় নিয়ে শব্দের সূত্র ধরে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম। যতই সামনে এগোচ্ছি শব্দের তীব্রতা ততই যেনো প্রকট হচ্ছে। ডান হাত দিয়ে ঝোপের গাছগুলো সরাতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। দুটি ছেলে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করছে। একজন মেয়েটির মুখ শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে অন্যজন মেয়েটির বস্ত্র হরণের প্রয়াস চালাচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিৎ আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। আশেপাশে চোখ বুলাতেই হঠাৎ রাস্তার পাশে একটি সুঁচালো লোহার শিক দেখতে পেলাম। আর অপেক্ষা না করে শিকটি হাতে নিয়ে ২য় ছেলেটির গন্ডদেশ বরাবর শিকটা ঢুকিয়ে দিলাম। ছেলেটি ক্যাঁৎ করে একটি আওয়াজ করার পর নিস্তেজ হয়ে পরে রইলো। যেই ছেলেটি মেয়েটির মুখ চেপে ধরেছিল সে আমার এহেন হিংস্রতা দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। তবুও প্রতিরোধ বলে একটি কথা আছে তাই তার কোমরে গোজা চাকুটি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলো। আমি শিকটি দিয়ে ছেলেটির হাতে আঘাত করতেই চাকুটি মাটিতে পরে গেল সাথে ছেলেটিও লুটে পরলো মাটিতে। এই সুযোগে শিকটি পেট বরাবর ঢুকিয়ে দিলাম। ছেলেটির আত্মচিৎকারে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পেঁচা আর বাঁদুড় গুলোও ভয়ে উড়াল দিলো।
লোহার শিকটা পাশে ফেলে দিয়েই মেয়েটির দিকে তাকালাম আমি। মেয়েটি কোন এক ভয়ে বারংবার কাঁপছে।
হঠাৎ আমার মনে পরে গেলো দুবছর আগের সেই বেদনাদায়ক ঘটনা এরকমই সেদিন আমি কোন এক নির্জন রাস্তা দিয়ে বোনকে বান্ধবীর বাসা থেকে আনতে গিয়েছিলাম। সেদিন রাতে এমনই একটি মেয়ের গোঙানোর আওয়াজ আমার কানে এসে বিঁধেছিল। সেদিন আমার চোখের সামনে আমার বোনকে ধর্ষণ করেছিল এই নরপশুরা। কিন্তু আমার একটুখানি বোকামীর কারণে আমার বোনকে আমি বাঁচাতে পারিনি। যখন দুর থেকে দেখলাম কয়েকটি নরপশু একটি মেয়েকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিলো তখন আমি ভয়ে সামনে এগোতে পারিনি। আরেকটু কাছে গেলেই হয়তো আমার বোনের আতঙ্কিত চেহারাটি দেখতে পেতাম। কিন্তু আমার মস্তিষ্কে তখন খেলা করেছিল ভয় এবং বারবার বলছিলো, একটি মেয়ের জন্য নিজের জীবন সন্নিকটে ফেলিস না মারুফ। সত্যি বলতে সেদিন মনের বিরুদ্ধে আমি যেতে পারিনি। যখন বোনের বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলাম,
-মারিয়া কোথায়? মেয়েটি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
-মারিয়াতো আপনার আশার অপেক্ষা না করে বাসায় চলে গেছে। আমি বারবার নিষেধ করতেও শুনলোনা আমার কথা।
মেয়েটির কথা শুনে হঠাৎ আমার বুকের বাম পাশে এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। মুহূর্তেই আমার মুখটা ঘামে ভিজে এক পরিশ্রমী রাখালের রূপ নিয়েছে। আমি আর সেখানে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে পাগলের মতো ছুটলাম সেই স্থানে। সেদিন পৌছাতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো আমার। আমি আমার বোনের রক্তমাখা নিস্তেজ দেহটা দেখে পাথরের মতো বসে ছিলাম ওর পাশে। চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম সেদিন। কিন্তু কিছু জিনিস হারিয়ে গেলে কী আর পুনরায় ফেরত পাওয়া যায়? সেদিন মৃত বোনের হাত ধরে আমি শপথ করেছিলাম যে আমার হৃৎপিন্ড যতদিন সঁচল থাকবে ততদিন আর কখনো ভয়ে পিছপা হবোনা আর কোন বোনের ইজ্জত হরণের সুযোগ দিবোনা। অতীতের ভাবনার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরলাম মেয়েটির ডাক শুনে।
-ভাইয়া।
ভাইয়া ডাকটা শোনার সাথে সাথেই কেনো যেনো আমার রুক্ষ হৃদয়টা মুহূর্তেই বরফ গলা পানির মতো ঠান্ডা হয়ে গেলো। চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু ঝরতেও ভুললোনা। এই ডাকটা কতদিন আমার কানে বাজেনা তা বলাই বাহুল্য।
আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের শরীরের কোটটা পরিয়ে দিলাম। মেয়েটিকে নিয়ে রাস্তায় উঠতেই দুর থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। মেয়েটি ছেলেটিকে দেখামাত্রই দৌড়ে গিয়ে ভাইয়া বলে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। ভাইবোনের এই ভালোবাসা সে এক অপরূপ দৃশ্য। ছেলেটি বললো,
-কী হলো কাঁদছিস কেনো? আর বান্ধবীর বাসা থেকে আসতে এতো দেরী লাগে?
-ভাইয়া কয়েকটি ছেলে আমাকে আর বলতে পারলোনা হু হু করে কান্না করে দিলো। ছেলেটির বুঝতে বাকী রইলনা। হঠাৎ আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো।
-এই ভাইয়া আমাকে বাঁচিয়েছে নয়তো আজ আমি বেঁচে ফিরতামনা। ছেলেটি এবার উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা নেই আমার। আপনি না থাকলে হয়তো আজ আমার বোনের। আচ্ছা আপনার নাম্বারটা দিন আপনার মতো এরকম মহান পুরুষকে দেখলে অবশ্যই আমার বাবা মা খুশি হবেন। যদিও এই ঋণ শোধ হবার নয় তবুও আমি ছেলেটিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম,
-আমি একাজ কোন প্রাপ্তির জন্য করিনা। দুবছর আগে ওর মতোই আমার বোনকে চোখের সামনে ধর্ষণ চেষ্টা করা হয়। সেদিন নিজের বোকামী ও ভীত মস্তিষ্কের কারণে নিজের বোনকে সেই নরপশুদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আর নয় এক বোনকে হারিয়েছি আর কোন বোনকে হারাতে পারবোনা, এটাই আমার শপথ। এই বলে নির্জন রাস্তার পথ ধরে হাঁটা দিলাম। ছেলেটি হয়তো আমার যাওয়ার পথে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। রাস্তার পাশ ঘেসে হাঁটছি আর ভাবছি, মৃত বোনের হাত ধরে যে শপথ করেছি তা ততদিন পর্যন্তই সচল থাকবে যতদিন না আমার স্নায়ুকোষগুলোর কার্যক্ষমতা হ্রাস পাবে। ওহে নরপশুরা অপেক্ষায় থাকো হয়তো কোন একদিন তোমার সাথেও দেখা হয়ে যেতে পারে তোমার লিঙ্গ দুভাগ করতে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত