কী? দোনলা একটা বন্দুকও আছে তার?
-জি হুজুর। আরও আছে বেশুমার ক্ষেত-খামার। ধানী জমিই তো হবে কমসে কম দুইশো বিঘা।
পাশের গ্রামের একটি বিত্তশালী কৃষক পরিবারপ্রধান বাদল মিয়া। সম্প্রতি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে থানা সদরের কাছাকাছি এক খণ্ড জমি কিনে বাড়ি করে সেখানে উঠে এসেছেন। তার সম্বন্ধে বড় চৌধুরী আর নায়েব গোছের এক অনুগতের মধ্যে এভাবেই কথাবার্তা শুরু হয়।
-বুঝেছি। চাষাভুষো মানুষ। তো গ্রামের সেসব ক্ষেত-খামার আর বাড়িঘর ফেলে এখানে এই শহরের কোলে এসে শেষ বয়সে বাড়ি করা কেন?
-মনে হয়, গ্রামের বাড়িতে ইদানীং উৎপাত দেখা দিয়েছে। সম্পত্তি আর সম্পদের উপর তো হুজুর খারাপ-ভালো সকলেরই নেক নজর পড়ে। তা ছাড়া-
-থামো।
তিনি অসহিষ্ণু পায়ে পায়চারি করতে থাকেন।
-হুজুর!
তিনি পায়চারি থামিয়ে তার দিকে তাকান। নায়েব কিছুই বলে না দেখে তিনি তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন। কাছে গেলে তিনি তার কানে মুখ ঢুকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কিছু কথা বলেন। তার পর মুখ সরিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন, কি? মনে থাকবে তো?
-হুজুর, গায়ে পড়ে লোকটার এমন ক্ষতি করবেন? সে তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনি।
হাত কচলাতে কচলাতে মুখ কাঁচুমাচু করে কথাটা বলতেই তিনি ধমক দেন, চোপ্। যা বললাম তাই করো।
এমন সময় গোমস্তার মতো আরেকজন ছুটে এসে ভেতরে ঢোকে এবং নায়েবের মতোই হাত কচলাতে কচলাতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানায়,
-হুজুর, নয়নপুরের বিশু মণ্ডলের লোকজন বলাবলি করছে- নয়নপুর তল্লাটে আপনাদের যত ধানের ভুঁই আছে তার তামাম ধান নাকি বিশু মণ্ডল এবার কেটে নেবে। তার জন্য আগামী শুক্রবার দিন ধার্য করা হয়েছে।
-কী! এত বড় সাহস? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? তোমরা তাহলে আছ কী করতে? যাও, এই মুহূর্তে ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায়, হাটে-বাজারে, থানায়, রেল স্টেশনে- সব জায়গায় সবাইকে জানিয়ে দাও- আগামী পরশু নয়নপুরের মাঠে চৌধুরী বাহিনীর সাথে ওই ফকিরনির বাচ্চা বিশু মণ্ডল বাহিনীর যুদ্ধ হবে। যে পক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে মেরে রক্তাক্ত করতে পারবে, সেই পক্ষই হবে ধানের মালিক।
রাগে গজরাতে গজরাতে ফিরে দাঁড়াতে চৌধুরীর চোখ গেল ভিতরের দরজার দিকে। সেখানে ঘোমটা মাথায় দাঁড়িয়ে গিন্নি সালমা বেগম। সালমা একটু নিচু কণ্ঠে কাশি দিয়ে বললেন, এদিকে একটা কথা শুনে যান।
-যাও।
নায়েব-গোমস্তাকে হুকুম দিয়ে চৌধুরী তার কাছে এগিয়ে যান। সালমা প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বলেন,
-ছেলেটা এসে বসে আছে।
-কোন ছেলেটা?
-ওই যে .. ফিরোজ।
বলে গিন্নি স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
-শহরে মিলির কলেজের …
চৌধুরী ফোঁস করে উঠলেন,
-বন্ধু, তাই না?
গিন্নি মাথা নাড়লেন।
-মিলি লেখাপড়া করে তার খালার বাড়িতে থেকে। ছেলেটা কোথায় থাকে জানি না। বন্ধুত্ব হয় কী করে?
-আহা, পড়ে তো একই কলেজে।
-ওহ্! আমাকে এখন তার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে যেতে হবে, তাই না?
-আহা! এখনই তা কেন? এমনি মুরুব্বি হিসাবে আপনার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে এসেছে –
-হুম!
চৌধুরী আর কিছু না বলে বসার ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। বসার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে দেখলেন, শান্ত-শিষ্ট চেহারার এক যুবক কাঠের হেলান বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে। চৌধুরীকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। চৌধুরী মুখে প্রত্যুত্তর না করে শুধু হাত নেড়ে তাকে বসতে বলে সামনের একটি কাঠের চেয়ার টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন। কোনো কথা না বলে শুধু ছেলেটির পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটির ধুলায় ধূসরিত দু’পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল। তার চেয়ারের পেছনে গিন্নি বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করছেন। তারও পেছনে ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে চৌধুরীকন্যা মিলি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কথা বলার জন্য মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত নেড়ে মুখ নেড়ে নানা ইশারায় ছেলেটির মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কিন্তু ছেলেটি কোনোদিকে দৃষ্টিপাত না করে চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে। চৌধুরী এক সময় উঠে গেলেন। গিন্নিও তার পিছু নিলেন। আড়ালে গিয়ে চৌধুরী দাঁত কটমট করে গিন্নির দিকে ফিরে বললেন,
-যত্তসব নাবালক চাষাভুষোর সাথে আমাকে আলাপ করতে পাঠাও, না?
গিন্নি নিরুত্তর। তিনি জানেন, এ প্রসঙ্গে এখন কিছু বলতে গেলেই তিনি খিস্তি- খেউড় শুরু করবেন। ওইসব কু-বচনের সামনে নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কোনোমতেই সম্ভব না। তিনি শুধু নিঃশ্বাস চেপে ভেতর ঘরের দিকে চলে গেলেন।
আমি প্রায় অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। গল্পটা যে আমাকে শোনাচ্ছিল, তার মুখে এতটুকু শোনার পর আমি একটু রগড় করে বললাম, মিস্টার নজরুল করিম, ‘হুজুর হুজুর’ শুনে মনে হচ্ছে এ তো সেই মান্ধাতার আমলের ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতার গল্প। নজরুল সাথে সাথে বিনয়-মাখা কণ্ঠে বলল, ‘ভাই, অধৈর্য হবেন না। আগে শেষ করতে দেন। দেখবেন, এটি এমন একটি গল্প, যা অবশ্যই আপনার কাছে নতুন মনে হবে। দ্যাখেন না, কিছুক্ষণ বাদে স্বাধীন বাংলাদেশের গল্পও এতে ঢুকে পড়েছে।’ আমাকে টানটান রহস্যের জালে আটকে ফেলে নজরুল এবার নিজেই কথক সেজে বলতে শুরু করল।
বুঝলেন ভাই, ব্রিটিশ আমলের মাঝারি গোছের জোতদার শ্রেণির প্রতিভূ এই চৌধুরী বংশ। জমিদার না হলেও আভিজাত্যের নামে ঠাট-বাট জমিদারের মতোই। কালের পরিক্রমায় আর প্রজন্মের পরম্পরায় সব যেতে যেতে এখন খাড়া আছে শুধু ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি ওই দোতলা বাড়িটা আর শত্খানেক বিঘা ধানী জমি। বর্তমান প্রজন্মে আছেন তিন ভাই- বড় চৌধুরী, মেজো চৌধুরী আর ছোট চৌধুরী। আমাদের যখন বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে, ব্রিটিশরা যখন এদেশ ছেড়ে চলে যাব যাব করছে, তখন থেকে এবং পরেও বহু বছর ধরে দেখেছি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসে আছেন ওই বড় চৌধুরী। ইউনিয়ন পরিষদের এক চিলতে বারান্দাওয়ালা অফিসঘরটা ছিল বাজারের মধ্যে, একেবারে রাস্তার ওপর। লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে প্রায়ই বারান্দায় বসে গড়গড়া টানতে টানতে আলাপ-সালাপ করতে দেখা যেত। আমাদের ছোটবেলায় সাপ্তাহিক হাটের দিনে আমরা মাথা নিচু করে তার সামনে দিয়ে চলে যেতাম। কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। তবে এটাও ঠিক, বড় হয়েও আমরা এই চৌধুরীদের দ্বারা গ্রামের লোকজনের ওপর তেমন কোনো অত্যাচার-নির্যাতনের কথা শুনিনি। আবার তেমনি কোনো রকম দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোরও তেমন কোনো গল্প কারও কাছে শুনিনি। তার দোষের মধ্যে ছিল, তিনি যাদেরকে তার সমকক্ষ বলে ভাবতেন; শুধু শুধু তাদের পেছনে লাগতেন। এই ছিল তার বদ অভ্যাস। যেমন নয়নপুরের বিশু মণ্ডলের পরিবারের সাথে রেষারেষিটা তাদের বাপ-দাদার আমল থেকেই নাকি ছিল। কারণ বিশু মণ্ডলদের প্রভাব দিন দিন বাড়ছিল। এটা তাদের সহ্য হচ্ছিল না। ঠিক তেমনি বাদল মিয়ার কেস। বাদল মিয়া কেন তার ধারেকাছে এসে পাকা দালান বাড়ি করবে; বাদল মিয়ার কেন বন্দুক থাকবে; কেনই বা সে শখের শিকারে যাবে ইত্যাদি। এসব তার সামনে স্পর্ধা প্রদর্শনের শামিল ভাবতেন। ভদ্রলোক নিশ্চয় হীনমন্যতায় ভুগতেন।
মেজো চৌধুরী লোকটা ছিলেন একটু ভিন্ন রকম। শখের হোমিও ডাক্তার। বিনা পয়সায় দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দিতেন। চেয়ারম্যান বড় চৌধুরী যখন ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় বসে গড়গড়া টানতে টানতে বিচার-সালিশ কিংবা গল্পগুজব করছেন, তখন মেজো জন বারান্দার আরেক কোনায় বসে পুরিয়া বানাচ্ছেন। সামনে দাঁড়ানো দরিদ্র কয়েকজন রোগী। এক সময় পুরিয়াগুলো রোগীর হাতে দিয়ে বলতেন, খবরদার! যা বললাম মনে রাখিস। সকালে বাসি পেটে কুলি করে এক পুরিয়া খাবি। ওষুধ খাওয়ার এক ঘণ্টা পর অন্য খাওয়া-দাওয়া। তারপর দুপুর আর রাতেও ওই রকম ওষুধ খাওয়ার আগে-পরে এক ঘণ্টা মুখ খালি। কেমন? রোগীরা ওষুধ নিয়ে কৃতজ্ঞতায় মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানিয়ে চলে যেত।
সবচেয়ে মজার লোকটি ছিল ছোট চৌধুরী। দেখলে মনে হতো শরৎচন্দ্রের কোনো উপন্যাসের চরিত্র। বয়সের দিক দিয়ে যৌবন ছাড়িয়েছেন। কিন্তু বিয়ে বা ঘর-সংসারের নাম নেই। সর্বদা পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল মার্কা এক জোড়া স্যান্ডেল। পরনে লুঙ্গি। তার উপর আঁটসাঁট বুকের বোতাম খোলা হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট। মাথার ঠিক মাঝখানে সিঁথি। সমান দু’ভাগ করে চুল আঁচড়ানো। চোখে সোনালি ফ্রেমের দামি চশমা। সব সময় মুখে তালা। কারও সাথে কোনো রকম দৃষ্টি বিনিময় বা কথাবার্তা নেই। জমিদারদের ধুতির খুঁট ধরে হাঁটার মতো করে তিনি লুঙ্গির খুঁট ধরে পায়ের স্যান্ডেলে বাড়ি খাইয়ে থপাশ-থপাশ শব্দ তুলে জোর কদমে হেঁটে বাজারের এমাথা-ওমাথা করতেন। গমকে গমকে হাঁটার সময় তার মাথার দু’পাশের চুল নাচতে থাকত। এই হাঁটার উদ্দেশ্য কী বা নিছক শখের হাঁটা কি-না, তা কেউ জানে না। তার শখ একটা অবশ্য মাঝেমধ্যে চোখে পড়ত। মাসের মধ্যে এক-আধদিন তিনি বাড়ির পাশে পুকুরে দু’তিনখানা বিশাল ছিপ ফেলে মাছ ধরার আশায় বসে থাকতেন। তখন তার মাথার উপরে লাঠিতে বাঁধা ছাতা ছায়া দিত। পাশে থাকত দামি সিগারেটের কৌটো আর দিয়াশলাই। মুখেও সর্বদা সিগারেট। হাতে একখানা চটি ইংরেজি বই। তিনি সেটা মনোযোগের সাথে পড়তেন আর মাঝে মাঝে নিজের মনে হাসতেন। তবে মাছ নিয়ে ফিরতে তাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি।
আমি আর ধৈর্য রাখতে পারি না। বললাম, ভাই নজরুল, তাড়াতাড়ি শেষ কর তো। আমার চোখেমুখে অস্বস্তি দেখে নজরুল গড়গড় করে বলা শুরু করল, ভাই আপনি যে এত অধৈর্যের মানুষ- তা তো জানতাম না! শোনেন তাহলে। আপনি তো ভালো করেই জানেন, ১৯৭১ সালের কয়েকটা তারিখ এদেশের ইতিহাস থেকে কখনও মোছা যাবে না। যেমন ধরেন মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের কথা। একটা মানুষ, যিনি সামরিক-বেসামরিক কোনো রকম শাসন ক্ষমতায়ই নেই অথচ তারই আঙ্গুলি হেলনে দেশ চলছে, দেশের মানুষ তার কথায় ওঠাবসা করছে; ব্যাংক বলেন আর সরকারি-বেসরকারি অফিস বলেন- সবকিছু তার নির্দেশ মেনে চলছে। এমন উদাহরণ কি দুনিয়ার কোনো দেশে আছে? নেই। সেই তার কথায় ৭ মার্চ থেকে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই তো স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত- সবকিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর তখন থেকেই চৌধুরীদের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। বড় চৌধুরী ইউনিয়ন পরিষদের অফিস বা বারান্দায় আর বসেন না। মাঝে মাঝে বসে থাকেন তার বাড়ির দোতলার ছাদখোলা বারান্দায়। চোখ-মুখ থমথমে। হতবিহ্বল হয়ে চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখেন। তার পর এক সময় ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। এই যেন তার নিত্যদিনের রুটিন বাঁধা কাজ।
তারপর ২৫ মার্চ রাতে তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। চারদিকে মিলিটারিদের ঘোরাফেরা। গ্রামে গ্রামে তাদের অত্যাচার, শান্তি কমিটি গঠন। তখন আবার বড় চৌধুরীকে নড়াচড়া করতে দেখা গেল। কারণ তিনি মুসলিম লীগের প্রতিনিধি। কাজে কাজেই তিনিই হলেন তার থানা এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান। এদিকে পরিবারে ভাঙন ধরল। মেজো চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন। ছোট চৌধুরী যে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন, সে খবর নেওয়ার অবসর কারোরই হলো না। ওদিকে মেয়ে মিলিরও কোনো খবর নেই। প্রথম প্রথম উৎকণ্ঠা থাকলেও গিন্নির মুখে কোনো রা নেই দেখে বড় চৌধুরী অবাক হন। চোখে নানা সন্দেহর ছায়া। তবে তিনিও আর কিছু ঘাঁটাতে চান না। দিন দিন সব যেন গা-সওয়া হয়ে গেল।
শোনা যায়, কিছুদিন যেতে না যেতে বড় চৌধুরীকে এক নতুন ব্যারামে পেয়ে বসে। একদিকে মিলিটারি, আরেক দিকে মুক্তিযোদ্ধা। এদের কারও না কারও হাতে প্রাণ হারানোর ভয়ে তিনি সব সময় তটস্থ থাকতেন। স্ত্রী সালমা বেগম তাকে হাজার সান্ত্বনা দিয়েও তার মনোবল ফিরিয়ে আনতে পারেন না। এক সময় তিনিও কিছুটা মুষড়ে পড়েন।
এর পর এক মাস দু’মাস পার করে নয় মাস পরে অবশেষে পাকিস্তানের যখন পতন হলো তখন যেমন মিলিটারিদের পিছু হটার পালা তেমনি হুড় হুড় করে গ্রাম-গঞ্জে-শহরে ঢুকে পড়ল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার দল। এতদিন যারা জলে-জঙ্গলে কাটিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, না খেয়ে মরণপণ লড়াই করেছে; তাদের উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। কিছুটা বেসামালও বলা যেতে পারে।
এই এলাকায় ১৭ কি ১৮ ডিসেম্বর হঠাৎ একদিন ভোরবেলায় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল। একনাগাড়ে অনেক গোলাগুলি। গ্রামবাসীর সব বোঝা হয়ে যায়। ভয়-ভীতির বদলে সবার চোখেমুখে আনন্দ-উল্লাস। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই ঘর ছেড়ে ছুটে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ধরে। তাদের অনেকেই বয়সে তরুণ। তবে সবারই প্রত্যয়দীপ্ত চেহারা। সবার মুখে অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি। মলিন বেশ। প্রত্যেকের হাতে রাইফেল-এলএমজি-এসএমজির কোনো না কোনোটা। তারাই সমানে আকাশ তাক করে গুলি ছুড়ছে। যতবার তারা গুলি ছোড়ে ততবার গ্রামবাসী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে।
মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে আছে বাদল মিয়ার ছেলে ফিরোজ। গ্রামের কেউ কেউ উঁকিঝুঁকি মেরে অন্যদেরও চিনতে চেষ্টা করে। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ছোট চৌধুরী আর বড় চৌধুরীর মেয়ে মিলিকে দেখে মানুষ অবাক হয়। তারাও যে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারে- তা ভাবতে যেন কষ্ট হয়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক বুড়ো নিজের মনেই ফিসফিস করে আক্ষেপের সুরে বলতে থাকে, আহা! বাদল মিয়াকে বড় চৌধুরী কীভাবে যে উৎখাত কইরলো! তার বন্দুকটা বেহাত হলো, এখেনকোর বাড়িঘরও গেল। শেষমেশ আবার সেই গিরামের বাড়িত্ ঠাঁই নিতি হলো।
মুক্তিযোদ্ধার দল ইউনিয়ন পরিষদের অফিস পিছনে ফেলে যেখানে এসে দাঁড়ায় তার সামনেই দোতলা চৌধুরী ভবন। ভবন বলতে আগুনে পোড়া একটা কাঠামো মাত্র। দরজা-জানালা কিচ্ছু নেই। ভিতরে কোনো জিনিসপত্রও চোখে পড়ে না। মিলির দু’চোখ ছাপিয়ে পানি উপচে পড়ে। কম্পিত গলায় ‘চাচা!’ বলে সে ছোট চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে। এমন সময় দূর থেকে বয়স্ক এক অনুগতের চিৎকার শোনা যায়, ‘হুজুর … হুজুর।’ সে এক দৌড়ে কাছে এসে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, হুজুর সব শেষ হয়ে গেছে। ছোট চৌধুরী ধমক দিয়ে বলেন, ‘চোপ্। আগে বলো কী হয়েছে?’
-হুজুর, গ্রামের মানুষ জানতে না পারে কিন্তু মিলিটারির চোখ সব জায়গায়। বড় হুজুরের সাথে তো তাদের দহরম মহরম কম ছিল না। তাদের ইশারাতেই তো বড় হুজুর চলতেন। কিন্তু যখন জানতে পারল, পরিবারের দুই দুইজন মানুষ মুক্তি হো গিয়া। তাও আবার একজন হলো যুবতী লাড়কি; তখন কি আর ধর্মের পিরিতি থাকে হুজুর! একদিন রাতের আঁধারে দল ধরে এসে বাড়ির উপর একের পর এক বোমা ফেলতে লাগল। বাড়ি আগুনে ছারখার হয়ে গেল। বড় হুজুরকে চিৎকার করে ‘সালে গাদ্দার’ বলে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলল। গিন্নিমা কান্নাকাটি করে ঠেকাতে গেল। হারামজাদারা তখন তাকেও গাড়িতে ভরল। দুইজনই চিরকালের জন্য গেল হুজুর।
বলতে বলতে লোকটা হু-হু করে কাঁদতে থাকে। ছোট চৌধুরী তার পুরনো অভ্যেসমতে কিংবা উত্তেজনায় দ্রুত পায়চারি শুরু করেছেন। মিলি তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। ফিরোজ তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মিলির কাঁধে হাত দিয়ে আলগোছে চাপ দেয়। মিলি মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। অশ্রুভেজা চোখ। ফিরোজ নীরবে মাথা নেড়ে সান্ত্বনা দেয়। মিলি ফিরোজের বুকে আছড়ে পড়ে বলে, ‘ফিরোজ, তুমিই আমার শেষ আশ্রয়।’ ফিরোজ তার পিঠ চাপড়িয়ে আদর করতে থাকে।
গল্পটা শোনার কয়েক দিন বাদে নজরুল করিমের দোকানে বসে পুদিনার পাতা ভাসানো চা খেতে খেতে বললাম, ‘ভাই নজরুল, খোলা মনে একটা কথা বলবে?’
-বলেন, বলেন ভাই। নজরুল ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিল।
-তোমার সেদিনকার গল্প শুনে একটা কথা জানতে মন চাইছে। অনেক ধনী, প্রতাপ ও প্রভাবশালী পরিবার যারা পাকিস্তানের কোলাবোরেটর হিসেবে কাজ করেছিল, তারা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই বিশ্বাস করত না। অথচ দেশ স্বাধীনের পরপর তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ তাদেরই সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করে তাদেরকে আরও প্রতাপের সাথে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিল। কথাটা কি …
মুচকি হেসে কথা শেষ না হতেই নজরুল হো হো করে হেসে উঠল। বলল,
-কী যে বলেন ভাই! ভাই, আপনি তো কিছুটা হলেও আমাকে বিশ্বাস করেন। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই সুবাদে বহু মুক্তিযোদ্ধার সাথে এ নিয়ে আলাপ হয়েছে। এসব বিয়ের প্রায় সবই ছিল প্রেমঘটিত এবং তা যুদ্ধের আগে থেকেই। হ্যাঁ, পরিবারের কাছে আগে হয়তো ছেলেটির কদর ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা হওয়াতে কদর পেয়েছে বা আদায় করেছে। এইটুকুই। তবে এও ঠিক, বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রীর সাথে সেই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা কতটুকু ছিল তা বোঝার বিষয়।
বলেই সে সুড়ূত করে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটি দিয়ে যোগ করল- আরও ক’টা দিন আপনার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত না হলে আশা করি এমন আরও অনেক গল্প আপনাকে শোনাতে পারব।
-আচ্ছা, শুনায়ো। তোমাদের মতো মানুষের কাছে আমারও দু’দণ্ড বসতে ভালো লাগে।
বলে আমাকেও কাপের শেষ চুমুকটি দিতে হলো।