অসম্ভব না হলেও সচরাচর ঘটে না এমন কিছু ইফতেখার না ঘটালে এবং ওই মুহূর্তে এলাকার যুবনেতা নওশের দলবল সমভিব্যাহারে আন-নূর রেস্তোরাঁয় বৈকালিক চা খেতে না এলে আর সেই সঙ্গে রেস্তোরাঁর মালিক রঞ্জন পালের মানবদৃষ্টির স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা যুক্ত না হলে ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করার কোনো কারণ ছিল না। ছাত্র পড়ানোর পুরো বেতন তুলে নিয়ে ইফতেখার গিয়েছিল আন-নূর রেস্তোরাঁয় চা খেতে। টিউশনির টাকা জমিয়ে কেনা স্মার্টফোনে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বেয়ারাকে সিগারেট আনতে টাকা দিয়েছিল। মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় মানিব্যাগটা আবার পকেটে ঢোকানোর জন্য নিতম্ব উঁচু করার কষ্ট না করে পাশেই রেখেছিল এবং একসময় ওটার অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে খালি পকেটেই মোবাইল টিপতে টিপতে রেস্তোরাঁ ত্যাগ করেছিল। মানিব্যাগের কথা তার মনে পড়ে ঘণ্টাখানেক পর বাসায় পৌঁছে ড্রয়ারে মানিব্যাগ রাখতে গিয়ে। তৎক্ষণাৎ আবার ঘামে ভেজা শার্ট-প্যান্ট পরে আন-নূরের উদ্দেশে দিগ্ভ্রান্তের মতো রওনা হয়। মানিব্যাগ ফেলে যাওয়া বেঞ্চে এখন ছয়জন প্রৌঢ় বসে হইচই করে গল্প করছে, বিষয় রাজনীতি। ইফতেখার টাকার চিন্তায় সৌজন্য ভুলে ছুটে গিয়ে প্রৌঢ়দের বগলের নিচ দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতেই তারা সন্দেহের চোখে অনুপ্রবেশকারীর মুখ-বুকের পরিধি মাপতে থাকে। ইফতেখার রঞ্জন পালের কাছে গিয়ে ঘাটতি পড়া শ্বাসে নিজের কাঙালিয়ানা উন্মুক্ত করে, ‘রঞ্জনদা, মানিব্যাগ ফালায়া গেসি, পাইসেন নিকি?’
রঞ্জন পাল হেসে বলল, ‘না দাদা, কই ফেলসেন?’
‘ওই বেঞ্চে। মহাবিপদে পইড়া যামুরে ভাই।’
রঞ্জন পাল বেয়ারাকে ডেকে বলল, ‘ওই রানা, দ্যাখ দেহি পাসনি।’
ইফতেখারও দৌড়ে গেল বেয়ারার সঙ্গে। বেঞ্চের নিচে উঁকি দিতেই পাওয়া গেল মানিব্যাগ। কালো স্যাঁতসেঁতে মেঝের সঙ্গে ছদ্মাবরণ নিয়ে মিশে আছে। বেঞ্চের নিচে প্রায় বুকে হেঁটে সে মানিব্যাগ পুনরুদ্ধার করল, ভেতরে একবার উঁকি দিয়ে দেখল টাকা ঠিক আছে কি না। প্রৌঢ় লোকগুলো তখন তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসছিল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইফতেখারের চোখে পড়ল রেস্তোরাঁর দেয়ালে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ’ কথাটি মোটামুটি ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে আলাপের ইতিহাস ঝাপসা হয়নি। এই বাক্যের শিল্প-লিপিকারকে এলাকাবাসী চেনে। নিরাপদ আবাসন প্রকল্পের একটা সাইনবোর্ড নিয়ে কর্মরত অবস্থায় দুই রাজনৈতিক দলের দাঙ্গার মাঝখানে পড়ে বছর দেড়েক আগে লোকটা মরে গেছে। দৃশ্যমান মহাবিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে রঞ্জন পালকে তার খুব আপন মনে হওয়ায় মোটামুটি উচ্চ স্বরে একটা ধন্যবাদ দিতেই সেখানে নওশেরের সদলবলে প্রবেশ। সে রঞ্জন আর ইফতেখারের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে শানে নজুল জানতে চায়, ‘কী কাহিনি?’
এলাকার রেস্তোরাঁগুলোর বাণিজ্যিক স্বাধীনতা নওশেরের ওপর নির্ভরশীল বলে রঞ্জন বিগলিত হেসে বলে, ‘কিসু না ভাই, উনি ভুলে মানিব্যাগ ফালায়া গেসে গা। অহন পাইসে। বসেন, চা দিই।’
নওশের তার দলের দিকে তাকালে দলও তার দিকে তাকায়, নওশের নজর দেয় ইফতেখারের দিকে। মানিব্যাগটা কোথায় পড়ে ছিল জেনে নেওয়ার পর নওশের উদ্ভাসিত চোখে বলে, ‘কও কী রঞ্জন মিয়া? চক্ষের সামনে মানিব্যাগ ভরা টাকা, আর কইতাস তুমি দেখোই নাই? তুমি বিনয়ী মানুষ আমরা জানি, আন-নূরের চা তো আজকা থেক্যা খাই না। তুমি ঠিকই নজর রাখস, তুমি জানতা কেউ মানিব্যাগ খুঁজতে আইলে ওইহানেই আগে খুঁজব।’
রঞ্জনের বিগলিত হাসি ম্লান হয় না, ‘না ভাই, সত্যি কথা, আমি দেখি নাই কিসু।’
‘বিনয় দেখাইও না। আচ্ছা কও দেখি, মানিব্যাগ হারানোর পরে কয়জন মানুষ ওই বেঞ্চে বইছে?’
‘পনেরো জন তো কমপক্ষে।’
‘তুমি কইতাছ পনেরো জনের কেউ মানিব্যাগটা দেখে নাই? নাকি দেইখাও নেয় নাই? নাকি তোমার পাহারায় নিতে পারে নাই?’
ইতিমধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা বেঞ্চটি থেকে একজন প্রৌঢ় বলে ওঠে, ‘এগুলান কী কও নওশের? কমিশনারের অপিসে পেত্যেক সপ্তায় তিন দিন তোমার লগে দেহা হয়। তোমার মনে হয় কতগুলা বুইড়া চোর গিয়া কমিশনারের অপিসে বয়া থাকে?’
নওশের চায়ের কাপসমেত হাত নেড়ে বলে, ‘আমি কইতাসি, এই এলাকায় কোনো চোর নাই। কমিশনার স্যার বহু আগে থেইকাই একই কথা কইতাসে, প্রমাণ পাইলাম আইজ। এই এলাকা দুর্নীতিমুক্ত, অশিক্ষা-কুশিক্ষামুক্ত সৎ এলাকা। এই মানিব্যাগ হারানো এলাকার কত বড় একটা ঘটনা বুজতাসেন? রঞ্জন পাল যে ভালো মানুষ আমি দেইখাই বুঝছিলাম, নইলে কমিশনার সাব পারমিশন দিত না। ওর চৌদ্দপুরুষের খবর লয়া আমি স্যাররে রিপোর্ট করছি, পরে রঞ্জন এহানে আইজ হোটেল দিয়া খায়। হোটেলের নামডা কিন্তু আমিই দিছিলাম। রঞ্জন নাম দিতে চাইছিল পাগলচাঁদ। পাগলচাঁদ, মরণচাঁদ, কালাচাঁদ, কানুলাল—এই সব নাম দ্যাখতে দ্যাখতে পইচা গেছি। এই দোকানে এত কাস্টমার আওনের পেছনে কিন্তু আন-নূর নামের একটা অবদান আছে।’
উচ্চ স্বরে কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে বেশ কিছু অফিস ফেরত এবং শ্রমিক শ্রেণির মানুষ জড়ো হয়েছে দেখে নওশের গলা আরও চড়ায়, ‘কমিশনার স্যার কিন্তু এলাকাডারে দুর্নীতিমুক্ত কইরা প্রত্যেক এলাকার কমিশনারের জন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইসিলেন। উনার স্কুলের ফাংশানে উনি কী বলসিলেন মনে আছে? যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আমি মাইক বাজায়া এলাকা কাঁপায়া জানান দিই, তা–ও অনেকেই যান না, উন্নয়নের কোনো খবরও উনাদের অন্তরে পৌঁছায় না। স্যার বলসিলেন, এই এলাকায় কোনো দুর্নীতিবাজ থাকবে না। কোনো ২ নম্বর মানুষ এইখানে বাসা ভাড়া পাবে না, বাড়ি বানাইতেও পারবে না। কেউ বাড়ির কাজে হাত দিলেই আমি নিজে তার পিছের খবর নিই। এলাকাতে তিনটা বড় বড় কোচিং সেন্টার করসে, যাতে কোয়ালিটি শিক্ষক নিয়োগ দিয়া পড়াইতে পারে। সুশিক্ষার সুফলডা দেহেন। নইলে বর্তমান জামানায় ভিড়ের মধ্যে মানিব্যাগ হারায়া কেউ ফেরত পাইসেনি দেহেন তো! আমি একবার থানায় গেসিলাম কাজে। সিগারেটের প্যাকেটটা ওসির টেবিলে রাইখ্যা বাইরে আইসাই আবার ঢুইক্যা দেখি প্যাকেটও নাই, লাইটারও নাই। বুজেন এ্যালা, পাঁচ সেকেন্ডেই হাপিস।’ নওশের এবার দাঁড়িয়ে গেছে, চায়ের কাপ ফিরে গেছে টেবিলে, ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ’ কথাটা তার চওড়া পিঠের আড়ালে ঢাকা পড়েছে, ডান হাতের তর্জনী নাচছে স্প্রিংয়ের মতো, ‘কিন্তু আইজ যে ঘটনা ঘটসে, তাতেই প্রমাণ হয়, স্যারের স্বপ্ন এত দিন পরে পূর্ণ হইসে। যে টাকা নিয়া দুনিয়াতে এত গজব, সেই ব্যাপারে যে সৎ থাকতে পারে, সেই আসল সৎ। স্যার পারমিশন দিলে এলাকাত এইবার ব্যানার লাগামু। আগের কমিশনার যদি আবার ফেরত আহে, তাইলে ট্যাকা ক্যান, একটা ম্যাচের কাডি হারাইলেও ফেরত পাইবেন না।’
ভিড়ের মধ্যে কেউ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগ করে, ‘গত ঈদে আমার বাসায় চুরি হয়েছে ভাই। দুই মিনিট বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে, অথচ বাসায় পানি নাই। বাসা ভাড়ার কোনো কন্ট্রোল নাই। এলাকায় কোনো ফুটপাত নাই। এসব থাকতে আপনি এলাকাকে দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করছেন?’
সরু চোখে খানিকক্ষণ প্রশ্নকর্তার দিকে চেয়ে নওশের বলল, ‘চোর যে এই এলাকার বুঝলেন ক্যামনে? এলাকার একটা চোররে ধইরা আমার সামনে আইনা কইবেন। আর রাস্তা ঠিক করা মানে টেন্ডারবাজি। দুর্নীতি ছাড়া আইজকাল কে টেন্ডার পায় কন! আমরা দরকার পড়লে রাস্তা অবরোধ করমু, তাও ২ নম্বর কন্টাক্টরগো এলাকাত ঢুকতে দিমু না। সবাই চান্দা দিয়া রাস্তা ঠিক করুম নাইলে। কালা টাকায় আরামেরথে সৎ পথে উষ্টা খাওন ভালো।’
শ্রমিক শ্রেণির একজন অবাধ তথ্যপ্রবাহের অধিকার পেশ করে, ‘কিসু ট্যার পাইলাম না, কিসু দেখলাম না, কোনো চেঞ্জ গায়ে লাগল না, ফট কইরা এলাকা টাটকা হয়া গেল?’
‘ফট কইরা হইসে কেডা কইল আপনারে? ম্যালা দিন ধইরা আন্ডারগ্রাউন্ডে প্রসেস চলতাছিল। আপনে জানবেন ক্যামনে মিয়া? কোনো দিন মিটিংয়ে গেসেন? জনগণের উদ্দেশে কমিশনার সাব কী কয় শুনসেন? এই যে দেয়ালে এত কষ্ট কইরা পোস্টার মারি, পড়সেন কোনো দিন খাড়ায়া? উন্নতির খবর কি বাতাসে ভাসে? স্যারের লেটেস্ট স্লোগান জানেন? মসজিদের শহরে দুর্নীতি চলবে না, মানব না। এই স্লোগান নিয়াই আগামী মাসের মহাসমাবেশে আমরা যামু। আপনেরা আস্তে আস্তে সততার দিকে আসতেছেন। চেষ্টা ছাড়াই সৎ—এই পরিবেশটা সৃষ্টি করসে কে? কবি কী বলসে জানেন? গোলাপ নিভৃতে ফুটলেও ঠিকই এক মাইল দূর থেকেও টের পাওয়া যায়। দশ-বারো বছর দইরা কমিশনার স্যার গোলাপের বীজ বুনসে, সার দিসে, পানি দিসে, পোকা মারার ওষুধ দিসে। তহন কেউ তার লগে আছিল না, আমি আছিলাম। এমপি সাব সাক্ষী। আইজ গোলাপ ফুটসে দেইখা সবাই হাঁ কইরা জিগাইতাসেন গোলাপ আইল কোইত্তে! রঞ্জন মিয়া, কতা আছে তোমার সাথে। আসো।’
কমিশনারের কার্যালয়ে যখন ইফতেখারকে ডেকে আনা হয়, সেখানে ইতিমধ্যে সেই ছয়জন প্রৌঢ় রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, রঞ্জন পাল এবং থানার ওসি বসে আছে। গত রাতে নওশেরের বক্তৃতার পর ইফতেখার বাসায় ফিরে ঘুমিয়েছিল এবং আজ বিকেলে ছাত্র পড়াতে যাওয়ার সময় দুজন যুবকর্মী তাকে ডেকে নিয়ে এলে উপার্জনের উৎসটি আজকের মতো ত্যাগ করতে হয়। কিছুক্ষণ পরেই কমিশনারের আগমন। চেয়ারে বসেই জিজ্ঞেস করেন, ‘ইফতেখার কে?’
কেউ সাড়া না দেওয়ায় প্রৌঢ় একজন ইফতেখারকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিলে সে দাঁড়িয়ে বলে, ‘জি স্লামালেকুম।’
‘তুমি কাল রঞ্জন মিয়ার হোটেলে টাকাভর্তি মানিব্যাগ ফেলে এসেছিলে?’
‘জি, বেশি টাকা ছিল না। টাকাভর্তি বলাটা ঠিক…’
ওসি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘টাকা ছিল কি ছিল না? মানিব্যাগে টাকা ভরা ছিল, কাজেই সেটা টাকাভর্তি। আর টাকাভর্তি না হলে আপনি সেটা রিগেইন করতে দৌড়ালেন কেন?’
কমিশনার আবার মুখ খুললেন, ‘সবাইকে চা দিতে বলো। রঞ্জন মিয়া, তুমি তো হিন্দু মানুষ, ব্যবসায়ী। লক্ষ্মীর কসম করে বলো, তুমি দেখেছিলে যে ইফতেখার মানিব্যাগ ফেলে গেছে?’
‘ফার্স্টে দেখি নাই। উনি বাইরনোর পর অন্য কাস্টমার বসার সময় একজনের ছাতার লগে ধাক্কা খায়া মানিব্যাগটা নিচে পড়ল।’
‘তোমার একবারও ইচ্ছা করেনি মানিব্যাগটা খুলে দেখতে?’
‘জে, করসে। একবার চেয়ার থেইকা উঠছিলামও। কিন্তু তহনি মনে পড়ল আমি কোন এলাকায় থাকি।’
নওশের বলে, ‘কিন্তু তুমি ঠিকই নজর রাখসিলা মানিব্যাগটা কেউ ধরে কি না, ঠিক তো?’
‘জে।’
‘প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে যখন ইফতেখার মানিব্যাগটা খুঁজতে আইল, ততক্ষণে সুশীল সমাজের কমপক্ষে দেড় শ কাস্টমারের মধ্যে একজনও মানিব্যাগটার দিকে ফির্যাও চায় নাই, ঠিক?’
‘তা ঠিক।’
ইফতেখার ঠোঁট ফাঁকা করার আগেই কমিশনার এবার প্রৌঢ় ছয়জনকে বললেন, ‘আপনারা কতক্ষণ ধরে সেই বেঞ্চে বসেছিলেন?’
গলা ঝেড়ে নিয়ে একজন বলল, ‘ইফতেখার আসার আগ পর্যন্ত ঘণ্টা দুই তো হবেই।’
‘এত লম্বা সময়ের মধ্যে একবারও আপনাদের চোখ নিচের দিকে যায়নি?’
‘আমরা আসলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়া কথা বলতেসিলাম তো, নজর ওপরের দিকে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে নজরুল ভাইয়ের চোখ নাকি একবার নিচের দিকে গেসিল, যখন আগের কমিশনারের কথা উঠেছিল।’
নজরুল নামের প্রৌঢ়ের কথা বলা এবার বাধ্যতামূলক, ‘আমি দেখসি কালো চারকোনা কী একখান পইড়া আছে। তয় আমরা যে বিষয়ে কথা বলতেসিলাম, ওইটা কী মানিব্যাগ না চ্যাপ্টা পাথর, সেইটা চিন্তা করার ফুরসত পাই নাই।’
কমিশনার ওসিকে বললেন, ‘তাহলে আপনার কী মনে হয়, করা যাবে না?’
‘আমার তো মনে হয় যাবে। বর্তমান জামানায় মানুষ যেখানে কাগজ-কলম থেকে শুরু করে গাছ-মাঠ-পুকুর সবকিছুকেই টাকা মনে করে, সেখানে আপনার এলাকার মানুষ ক্রমেই টাকার কথা বিস্মৃত হচ্ছে, টাকাভর্তি মানিব্যাগকে চারকোনা পাথর মনে করছে। অ্যামেজিং! এসবই নৈতিক উন্নতির লক্ষণ। গত দেড় বছরে এই এলাকার কেউ কোনো মামলা বা কমপ্লেক্স করে নাই। এমনকি জিডিও না। খালি মাঝেমধ্যে টুকটাক মারামারি…’
কমিশনার এবার ওঠার জোগাড় করেন—‘নওশের, এমপি স্যারের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারো কি না দেখো। উনি বললেই কাজ শুরু। ওসি সাহেবের আপ্যায়নটা ভুলে যেয়ো না। মানিব্যাগটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। মোবাইল দিয়ে তুলো না আবার, ফটোগ্রাফার আনাও।’
ইফতেখার-রঞ্জন অধ্যুষিত সততার বৃহত্তম খবরটি কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অত্র এলাকার এবং তার পাশের পথঘাট-অলিগলি উৎসবে আর হিংসায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল। দৈনিকের প্রতিবেদন বলছে, ‘অধিকাংশ এলাকাবাসীরই এলাকার মধ্যে মামলা করার মতো ঘটনাই ঘটেনি, যাকে কিনা সততার আরও বড় উদাহরণ হিসেবে দেখছেন কমিশনার। তাঁর মতে, এলাকায় লোক ঢোকানো হয় ছেঁকে ছেঁকে। আন-নূর রেস্তোরাঁর মালিক রঞ্জন পাল কিছু বলতে রাজি হননি, মানিব্যাগের মালিক ইফতেখার আহমেদের মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি। একটি এলাকার থানায় কোনো অভিযোগ নেই—এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের সুশীল সমাজে বিস্ময়ের ঝড় উঠেছে, দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া…’
অবশেষে ব্যানার উদ্বোধনের দিন ঘনিয়ে আসে। সততা প্রমাণের মূল দুই নায়ক ইফতেখার এবং রঞ্জন পাল, বাদী নওশের, সাক্ষী ছয়জন প্রৌঢ়, সর্বোপরি অনুমোদনকারী কমিশনার রইল মিছিলের পুরোভাগে। আর পুরো মিছিলকে ঘিরে মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরা হাতে জোয়ারের মতো এগোচ্ছে কিছু গণমাধ্যমকর্মী। দ্বিতীয় সারিতে ব্যান্ডপার্টি এবং তারপরই দলের নেতা-কর্মীদের স্লোগানে মিছিল বেরোল এলাকায় প্রচণ্ড যানজট লাগিয়ে দিয়ে। প্রতিটি প্রবেশপথে ব্যানার উদ্বোধন করল এমপি সাহেব। সবশেষে শহরের বাণিজ্যিক এলাকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী প্রধান প্রবেশপথে ব্যানার লাগানো হলো। ইফতেখারের ছাত্র পড়ানো সেদিনও হলো না। একবার সে নওশেরকে বলেও ছিল। কিন্তু নওশের হাত ঝেড়ে বলল, ‘কী কও মিয়া! তোমার কী টিউশনি করা মানায়? তুমি অখন কমিশনারের লোক। সেই দিন মানিব্যাগটা ফালায়া না আসলে তো এই দলীয় অর্জন সম্ভব ছিল না। কী লাগব খালি কইবা।’ সান্ত্বনা এই, অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই গতকাল বেতন দিয়েছে, টাকাগুলো মানিব্যাগ থেকে বের করে রাখারও সময় সে পায়নি। রঞ্জন পালেরও এক দিনের উপার্জন দলের জন্য উৎসর্গ করে সমাবেশ সফল করতে হলো। সভা শেষ হলো কমিশনারের সমাপনী বক্তব্য দিয়ে, আর সেই বক্তব্যের চুম্বক অংশ বলছে,Ñআগামী নির্বাচনে প্রতীক পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন তিনি। এখন থেকে তাঁর মার্কা মানিব্যাগ—এলাকাবাসীর সৎ উপার্জনের এবং ব্যবসায়ীদের আত্মসংযমের প্রতীক। ইফতেখার এবং রঞ্জন একযোগে বুঝতে পারল, তারা জড়িয়ে গেছে। একজনের চাপগ্রস্ত বেকার মনের ভুল এবং অন্যজনের নিজ জীবিকায় মনোযোগ তাদের ধর্ম-জাতি-বর্ণনির্বিশেষে রাজনৈতিক তকমাধারীতে বিবর্তিত করেছে।
কমিশনারের কার্যালয়ে পেট ভরে কাঙালিদের সঙ্গে ভোজন সেরে বাসায় ফিরে মানিব্যাগটা রাখতে গিয়েই ইফতেখার বুঝতে পারল মানিব্যাগ নেই। সারা দিন ঘুরতে থাকা শরীরের ওপর স্থাপিত মাথাটা এবার ঘুরে উঠল। ঘামে ভেজা পোশাক আবার শরীরে চড়িয়ে সে ছুটল তার এ মাসের একমাত্র সম্বল পুনরুদ্ধারের আশায়। ‘দুর্নীতিমুক্ত এলাকা’ ব্যানার লাগানো প্রতিটি প্রবেশপথে সে হন্যে হয়ে খুঁজল। চুরি? নাকি রঞ্জন পালের দোকানে অনুষ্ঠিত ভুলটির মতো কোথাও ছদ্মাবরণ নিয়ে মিশে আছে! নিজেকে ইফতেখারের একটা রক্তমাংসের মানিব্যাগ মনে হতে থাকে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে কমিশনারের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তালা ঝুলতে দেখে পরিতপ্ত মনে পেছনের পকেটে হাত দিয়েই আংশিক নগ্ন নিতম্ব স্পর্শ করল—ভাগ্যিস গায়ে নিতম্ব ঢাকা দৈর্ঘ্যের পাঞ্জাবিটা আছে—এই সান্ত্বনা ধারণ করে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় পাঞ্জাবির কোনা ধরে রঞ্জন পালের দোকানে এসে দুই গ্লাস পানি খেতেই রঞ্জন পাল অসন্তোষ ঝরানো কণ্ঠে বলল, ‘অনাচারডা দ্যাখলেন ভাই? ক্রেডিট খালি মানিব্যাগের? আমার দোকানের বেঞ্চডার কোনো ক্রেডিট নাই? বেঞ্চের ওপরে মানিব্যাগটা রাইখা ফটোডা তোলা যাইত না? আবার রানা হালারপুতেও ক্রেডিট চাইতাসে। ও না থাকলে বলে আপনে মানিব্যাগ বিছরায়া পাইতেন না। কন দেহি। আপনে মুখ কালা কইরা রইসেন ক্যা? কী কাহিনি দাদা?’
‘মানিব্যাগ পাই না।’ বলেই ইফতেখার শেষ ভরসা নওশেরকে ফোন করল এবং দেখল, রঞ্জন পাল সেই মানিব্যাগ হারানো বেঞ্চের নিচে মাথা গুঁজে উঁকিঝুঁকি মারছে। ঘটনা শুনে নওশের বলল, ‘কী? দুর্নীতিমুক্ত এলাকায় তোমার মানিব্যাগ চুরি হইসে? তোমার কারণে আইজ আমরা ব্যানার লাগাইলাম আর তোমারই পকেট কাটসে? আমি স্যাররে কইতাসি। অহনি এমপি সাবরে খবর দিব।’
‘ভাই, মানিব্যাগটা পাব তো?’
‘আরে মিয়া দেহ না কী করি। পাশের এলাকার কমিশনার বহুত চিল্লাচিল্লি করসে, আমরা যে দুর্নীতিমুক্ত এলাকার ব্যানার লাগাইসি, হালার পুতের গা জ্বলতাসে। এহানে–ওহানে এইডা–সেইডা কয়া বেড়াইতাসে। সে বলে বেকারমুক্ত ব্যানার লাগাইব। ওই এলাকার কেউ অবশ্যই আমগো মিছিলে ঢুইক্যা এই কাম করসে। কমিশনার শুদ্ধা সাবগুলার নামে মামলা দিমু। এইবার শ্যাষ। তয় গুড নিউজ হইল, তোমার মানিব্যাগের ছবি কিন্তু স্যারের মার্কা। নিজের মানিব্যাগে নিজেই সিল মাইরো।’
‘নওশের ভাই, এলাকার মধ্যেই একটু খোঁজ লাগান না, আমরা তো এলাকার বাইরে যাই নাই। আর ওই এলাকার কেউ আইলে তো আপনেগো কর্মীরা চিন্যালাইত। নাকি?’
‘কও কী মিয়া তুমি! দুর্নীতিমুক্ত ব্যানার দিয়া আমাগো এলাকা বান্ধা। এহন এলাকাবাসীরে সন্দেহ করলে কমিশনারের ইজ্জত কই যাইব? তয় কামের কতা হইতাসে, পাশের এলাকার কমিশনার আর সহজে বেকারমুক্ত ব্যানার লাগাইতে পারব না, এমুন ব্যবস্থাই করুম। চোরের এলাকা বেকারমুক্তই কি আর বেকারযুক্তই কি!’