নয়নতারা ঘুমিয়ে কাদা।
ঘরের ভেতরে আধো আলো-আঁধারি। বাইরে ফিক ফোটা ধবল জোছনা। সেই জোছনার একটা সরু ফালি কঞ্চির বেড়ার ফাঁক গলিয়ে এসে পড়েছে নয়নতারার মুখের ওপর। মাত্র ওইটুকু আলো এসে তার মুখে অপার্থিব সৌন্দর্যের সবক’টা ঘুমন্ত বাতি যেন-বা একযোগে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঝোড়ো বাতাস নেই, ফলে আলোকপ্রভা একেবারে নিস্কম্প স্থির। মন্টু ফকির নয়নতারার মুখের ওপর থেকে সরিয়ে আনে দৃষ্টি; তারপর সে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় নিরাবৃত শরীরের বাঁকে বাঁকে। দূরে নদীপাড়ের গ্রামের ছবি যেমন অস্পষ্ট মনে হয় এই আলো-আঁধারিতে নয়নতারার দেহনদীকে ঠিক সেই রকম কুয়াশাচ্ছন্ন মনে হয় না। নিকষ কালো অন্ধকারেই সে চিনেছে এই বাঁকা নদী, তার জোয়ার-ভাটা, চিনেছে সে নদীতে ভাসমান কুমির এবং ত্রিবেণী ঘাট। অমাবস্যা চন্দ্রসাধন প্রভৃতি গূঢ়তত্ত্বের ভেতর দিয়েই মন্টু ফকির এতদূর এসেছে, তার আবার ভয় কিসের, কিসের-বা উদ্বেগ? তবু তার ঘুম আসে না চোখে, এক পলকা ভাবনা হয় এই নয়নতারাকে নিয়ে- আগামীকাল তারা নির্ভয়ে নিঃসংকোচে সাঁইজির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে তো!
আগামীকাল, এই আকালি সাঁইজির ধামে যাবারই তো প্রস্তুতি চলছে সেই কবে থেকে। মেহেরপুর থেকে সোজা পশ্চিমে মাইল তিন-চারেক গেলে শুভরাজপুর, তারপর ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে সাধুর আশ্রম। একসময় ছিল নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ, এখন আর সেই নির্জনতা নেই। দূর-দূরান্তের শিষ্য-সামন্তের নিত্য আনাগোনা লেগেই আছে, এমনকি কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকফোকর গলিয়ে ওপার থেকেও অনেক সাধু-সাগরেদ চলে আসে। একদা এই আকালি সাঁইজির হাতে মন্টু ফকিরের বাপ মন্তাজ ফকিরেরও চাল-পানি হয়। চাল-পানি হওয়া মানে দীক্ষা গ্রহণের প্রাথমিক স্তর। প্রতিদিন পাঁচটি করে চাল খেতে হয় পানির সঙ্গে, সকাল-সন্ধ্যা। প্রথমে পঞ্চআত্মার শান্তি কামনা করে পাকপাঞ্জাতনের প্রতীক হিসেবে পাঁচটি চাল শিষ্যের হাতে তুলে দেন গুরু। এটাকে গুরুর প্রথম স্বীকৃতির স্বাক্ষর বলে গ্রহণ করে শিষ্য। মন্তাজ ফকির সেই স্বীকৃতি লাভের পর যেন-বা আকাশের চাঁদ হাতে পায়। অন্ধকার রাতে মেঠোপথে বাড়ি ফেরে, বুকের মধ্যে ভয়-তড়াশের লেশমাত্র খুঁজে পায় না। বরং আকাশভরা তারার মাঝে ডিগবাজি খেতে ইচ্ছে করে। একতারার তারে টুংটাং ধ্বনি তুলে গান ধরে : ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠার যার…।’ কিন্তু মন্তাজ ফকিরের এই দীক্ষা গ্রহণকে গ্রামের শরিয়তপন্থি মোল্লারা মোটেই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। বিচার-সালিশ বসিয়ে চুল-দাড়ি কেটে দেয় জবরদস্তি করে, তওবা করার জন্য চাপ দেয়, নতুবা একঘরে করার হুমকি দেয়।
এসব সেই কবেকার কথা! আজকের এই মন্টু ফকির তখন তের-চৌদ্দ বছরের কিশোর বৈ তো নয়! এতদিন পর রাতের দুই প্রহর গড়িয়ে যাবার পর বাবার মুখ কেন মনে পড়ছে! সকালের আলো ফুটলেই সূচনা হবে শুভদিনের। সাঁইজি নিজে থেকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন- বিষ্যুদবার তারা দুজনে আশ্রমে গিয়ে পৌঁছলে তবে হবে বাল্যসেবা। মানে সকালের নাস্তা, চিড়ে-দই-কলার ফলার। দুপুরবেলা পূর্ণসেবার আগেই হবে তাদের খিলকা প্রদান। এসবই পূর্বনির্ধারিত। নয়নতারার সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। দুজনের গুরুদীক্ষা হয়েছে অনেক আগেই, এবার আসছে ভেক বা খিলকা ধারণের অধ্যায়। চূড়ান্ত পর্ব। ধবধবে কাফন-সাদা কাপড়ে মোড়া অন্য একজীবন। এ জীবনে প্রবেশের দুয়ার হচ্ছে গুরু। এই দুয়ারে কড়া নাড়ার অধিকার দিনে দিনে নানান পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। তারপর গুরু সদয় হলেই মুক্তি।
এই আকালি সাঁইজিও তো তাদের বাজিয়ে দেখতে কম করেননি! এত চেনাজানা, এত যে মন্তাজ ফকিরের জন্য বুকের মধ্যে হাহাকার, সেই মন্তাজের ছেলে মন্টু যেদিন নয়নতারাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর শরণ নেয়, হাতজোড় করে আশ্রয় প্রার্থনা করে, সেদিন কি তিনি সহজে ছেড়ে দিয়েছেন! কতরকম তাঁর প্রশ্নবাণ, একটার পর একটা ছুড়ে মারেন! বিশেষত নয়নতারার দিকে তাকিয়ে জানতে চান,
-এ পাখি তুই কোথায় পেয়েছিস বাপ! পোষ মানিয়েছিস?
শুধু হাতজোড় নয়, মন্টু তখন চোখ ইশারায় নয়নতারাকে ইঙ্গিত দেয় এবং নিজেও আভূমি নত হয়ে সাঁইজির দুই পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ চায়। তারপর নয়নতারার পরিচয় দিতে গিয়ে জানায় বর্ডারের ওপারে তেহট্ট থানার নন্দীগ্রামের রতন স্যাঁকরার মেয়ে হলেও সে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তার হাত ধরে পথে নেমেছে। মন্টু আরো নিশ্চিত করে, শান্তিপুরের খুব কাছেই এক শ্রীপাট আশ্রমে গিয়ে তারা উভয়েই গুরুদীক্ষা নিয়েছে। আকালি সাঁইজি চোখ বড় বড় করে দু’জনেরই মুখে তাকান, তারপর মন্টুর কাঁধে হাত রেখে শুধান,
-তা আমার কাছে কেন এসেছিস?
মন্টু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়,
-আমার বাবাও তো এসেছিল আপনার কাছেই।
-হ্যাঁ, মুন্তাজকে আমি দীক্ষা দিয়েছি। সে কাপুরুষ। নিজেকে চিনতে পারেনি।
আপনাকে চেনা সহজ নয়, সে আমি জানি। কিন্তু কাপুরুষ বলছেন কেন?
ঘন গোঁফ-দাড়ির ফাঁকে একটুখানি হেসে ওঠেন সাঁইজি,
-নিজেকে নিয়ে এ রকম ইয়ার্কি মারার কোনো মানে হয়! নিজের মাঠ নিজের ফসল ফেলে এভাবে কেউ পালিয়ে যায়!
মন্টু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
-আপনি কি আত্মহত্যার কথা বলছেন?
-তবে আর কী বলছি! নিজেকে চেনাই হলো না যার, সে কেন হত্যা করবে নিজেকে? কোন অধিকারে?
মন্টু হঠাৎ যেন বোমা ফাটায়,
-আমার বাবা আত্মহত্যা করেনি। তাকে হত্যা করেছে গাঁয়ের লোক।
-বলিস কী বাপ!
-আমরা নতুন করে আবার দীক্ষা নেব আপনার কাছে।
-কেনরে বাপ! এ লাইনে আসবি কেন?
দু’জনেই মাথা নিচু করে থাকে। কথা বলে না। আকালি সাঁইজি প্রশ্ন করেন,
-বাপের হত্যার বদলা নিবি নাকি?
মন্টুর সারা শরীর শিউরে ওঠে। আকালি সাঁইজির চোখে চোখ রেখে বলে, বদলা আমি নিতে চাই, তবে কাউকে হত্যা করে নয়। খুন-খারাবির বদলা নয়।
-তাহলে?
-আমার বাবা যে কাজ শেষ করতে পারেনি আমরা সেটা করতে চাই সাঁইজি। -সেটাই হবে বদলা নেয়া। আপনি ফেরাবেন না।
সাঁইজি খুশি হন। দু’জনের মাথায় দুই হাত রেখে বলেন,
-বলিস কী বেটা! পারবি তোরা এ পথে দাঁড়াতে? এ বড় পিছল পথ।
নয়নতারা এতক্ষণে মুখ খোলে,
-আমরা তো জেনেশুনেই এসেছি বাবা। এখান থেকে আমরা ফিরে যাব না।
আকালি সাঁইজি যেন চমকে ওঠে,
-দাঁড়া দাঁড়া, নন্দীগ্রামের কার মেয়ে তুই?
আপনি চেনেন নন্দীগ্রাম?
-ওরে বাবা, আমি তো পাইকপাড়ার ছেলে। পাশাপাশি গ্রাম। শৈশবজোড়া কত স্মৃতি আছে, কত বন্ধুবান্ধব…
এবার মন্টু যোগ করে,
-নন্দীগ্রামের রতন স্যাঁকরার ছোট মেয়ে নয়নতারা।
-স্যাঁকরাকে দিয়ে কি গুরুগিরি হয়! একবেলা সে যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের কাছে তো আরেকবেলা সাহেব-ধনী সম্প্রদায়ের কাছে। দুই নৌকায় পা দিলে তার এই দশাই তো হয়। নয়নতারাকে জিজ্ঞেস করেন,
-কয় ভাইবোন তোমরা? শেকড়-বাকড় কদ্দুর নামিয়েছে তোমার বাবা?
মাথা নিচু করে নয়নতারা জানায়,
-পাঁচ বোন, এক ভাই।
-ওরেব্বাবা! এ যে লতায় লতায় লতিয়ে একাকার! শেকড়-বাকড় হলো শিষ্যভক্ত। লতা-পাতা শেকড়-বাকড়- এসব কী যে…
বাক্য শেষ হয় না নয়নতারার। হা হা করে হেসে ওঠেন আকালি সাঁইজি, হাসি থামলে আবার তত্ত্বকথা বলেন, ‘আগি শান্তিপুরে চলোরে মন তবে গুপ্তিপাড়ায় যাবি।’
এ হচ্ছে তত্ত্বগানের বাণী। এ গানের মর্ম হচ্ছে- দেহমনকে শান্ত করলে তবে গুপ্তিপাড়া অর্থাৎ গুপ্তকথা জানা যাবে। লতার কথা শেকড়ের কথা জানা যাবে। কিন্তু রতন স্যাঁকরা তো বাঁধা পড়ে রইল বোধিতনে। এয়োতনের থেকে কোথায় নিত্যনের সাধনা করবে, তা নয় বোধিতনের ফাঁদে আটকে গেল।
এয়োতন-নিত্যন-বোধিতন এসব গূঢ়ার্থ শব্দের অর্থ অনেক পরে জেনেছে মন্টু এবং নয়নতারা। এই মেহেরপুরের মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি লৌকিক যে ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন, তার মর্মমূলে বৈরাগ্য নয়, আছে গৃহীর সাধনা। এ সাধনার গোড়াতে আছে এয়োতন। বলা হাড়ির ‘মনের মানুষ’ যারা, তারা জন্মদ্বারে যাবে শুধু সৃষ্টির জন্য। অকারণ বীর্যক্ষয়কে তারা নরহত্যার তুল্য পাপ বলে মনে করে। নারীর ঋতুস্রাবের সাড়ে তিন দিন পরে অর্থাৎ চতুর্থ দিনে সুসন্তান কামনা করে স্ত্রী সহবাসে যাওয়া এয়োতনের বৈশিষ্ট্য। সংসারে অনাসক্তি আর জন্মদ্বারে বিতৃষ্ণা তৈরির মাধ্যমে এয়োতনের পরের স্তর নিত্যনের সাধনা করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। প্রতিদিন অকারণ বীর্যক্ষয়ের মাধ্যমে অধিকাংশ মানুষ বোধিতনের ফাঁদে আটকা পড়ে। আত্মসর্বস্ব ভোগী এই মানুষকে দিয়ে বড় সাধনা হবে কী করে!
এসব তত্ত্বকথার সাধারণ ব্যাখ্যা এবং দেহতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনেক পরে জেনেছে মন্টু শাহ্ এবং নয়নতারা। সেই ব্যাখ্যা ভক্তিভরে তারা গ্রহণও করেছে পরে। কিন্তু সেই প্রথম দিনেই আকালি সাঁইজি দীক্ষাদানের শর্ত হিসেবে কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। গুরুগৃহে তাদের একমাস কাটাতে হবে। শোবার সময় কিছুতেই মুখোমুখি নয়, পিঠের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে থাকতে হবে। মুখ ফেরালেই পতন, দুধ নষ্ট এক ফোঁটা গো-চোনায়।
কঠিন সে পরীক্ষায় মন্টু এবং নয়নতারা উতরে যাবার পর নতুন করে তাদের চাল-পানি হয়েছে, দীক্ষা পেয়েছে। আকালি সাঁইজির কাছে বিস্তারিত জেনেছে- শরীরকে তারা উপেক্ষা করে না, শাসন করে, পোষ মানায় এবং শরীরের কাছে যা পাবার তা ষোলো আনা বুঝে নেয়। অযথা শুক্রক্ষয় আর সন্তান জন্ম মানে বাউলধর্মে আপ্তমরণ, অন্য কথায় নিজেকে মারা। তবে হ্যাঁ, এ লাইনে পতনও আছে। যারা বারংবার ঘুরেফিরে জন্মদ্বারে যায়। সেই একমাসের স্মৃতি মনে হলে মন্টুর অন্তর তড়পায় এক প্রশ্ন- হাতের মুঠোয় অগ্নিপিণ্ড ধরে রাখা কি তার চেয়ে কঠিন? তরঙ্গসঙ্কুল বাঁকানদী যতই হাতছানি দিক, কুমিরের লেজ সাপ্টানোর মধ্যে হাত-পা ছুড়ে সাঁতরানো কি সোজা কথা! হায় বাঁকানদী, মীনরূপে সাঁই বিরাজ করে কোথায়! জল শুকালে আবার সেই মীন নাকি হাওয়ায় ভাসে, এ কী ভীষণ গোলকধাঁধা!
এই গোলকধাঁধার গেরো খুলতে হলে গুরুপদে নিজেকে নিঃশর্ত নিবেদন করা চাই। একদিন সাঁইজি কাচের দুটো টুকরো এনে সামনে ধরেন। প্রথমে স্বচ্ছ কাচের পাত সামনে ধরে জিজ্ঞেস করেন,
-কী দেখছিস?
মন্টু এবং নয়নতারা দু’জনেই বলে ওঠে,
-আপনাকে দেখছি। কাচের ওপারে তো আপনিই আছেন।
সাঁইজি এবার এক পৃষ্ঠায় পারা লাগানো আয়নার টুকরো সামনে ধরে বলে,
-কী দেখছিস এবার?
-খুব সোজা উত্তর- নিজেকে দেখছি।
এক গাল হেসে তিনি জানতে চান,
-কেন, আমাকে দেখা যাচ্ছে না?
-নাহ!
-আমি কি তাহলে নেই?
জিভ কাটে মন্টু, হাত কচলে বলে,
-আপনি আছেন কাচের গায়ে লাগানো পারার ওপারে।
-আহা, আছি তাহলে! আমি আছি পারার সাথে মিথে। পারা না থাকলে সব ফাঁকা ফকফকা। পারা আছে বলে, মানে তোদের গুরু আছে বলেই তোরা নিজেদের দেখতে পাচ্ছিস, ঠিক তো? এই যে গুরুর মধ্য দিয়ে নিজেকে দেখা, এটাই কিন্তু সারকথা।
গুরুভক্তির নানাবিধ কণ্টাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে শিষ্যকে পৌঁছতে হয় চূড়ান্ত গন্তব্যে। সেই পর্বতচূড়ায় আরোহণ যেমন কঠিন, অবতরণও তেমনই কঠিন; পতনের কথা আলাদা। পতন আর অবতরণ কিছুতেই এক নয়। পতনের আশঙ্কা থেকে মুক্ত হবার পর গুরু খিলকা প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। যে কোনো শিষ্যের জন্য সেই ঘোষণা হচ্ছে পরম পুরস্কার। এক জীবনের অন্ধকারে প্রবেশ করে আরেক জীবনের পরিশুদ্ধ আলো। এই আলোকপ্রাপ্তির জন্যই তো শিষ্যের যত সাধন-ভজন! মন্টু শাহ এবং নয়নতারার জীবনে বহু প্রতীক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যতই এগিয়ে আসে, দু’জনে ততই রোমাঞ্চিত হয়, পুলকিত হয়; আগের রাতে সন্ধ্যাবাতি জ্বালান হয়ে গেলে হাতে একতারা নিয়ে মন্টু শাহ গান ধরে :’বাড়ির কাছে আরশিনগর…।’ মুখে আহ্বান জানানোই লাগে না, নয়নতারা দুই হাতে প্রেমজুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসে। কান খাড়া করে একতারার তাল ধরতে চেষ্টা করে, তারপর সোমের ফাঁক ধরে টুংটাং করে ঠিকই ঢুকে পড়ে গানের মধ্যে। দু’হাতের আঙুলের বাঁধা খঞ্জনিকে স্থানীয়ভাবে প্রেমজুড়ি বলে। কী যে মিষ্টি ধ্বনি তার, সঠিক মাত্রায় গানের সঙ্গে মিশে গেলে কানে তখন সুধা বর্ষিত হয়।
মন্টু শাহর ভরাটকণ্ঠে আরশিনগরের পড়শির বিবরণ সুরের মূর্ছনায় ভেসে বেড়ায় : ‘কী বলব সে পড়শির কথা, ও তার হস্তপদ স্কন্ধ মাথা নাই রে…।’ ভাবনার কথা বটে, আরশিনগরের এই পড়শি তাহলে কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে! সেই জবাবও আছে লালনের গানে : ‘ক্ষণেক ভাসে শূন্যের উপর ক্ষণেক ভাসে নীরে।’ সাইকেলে হঠাৎ ব্রেক কষার মতো মন্টু শাহ দুম করে বন্ধ করে দেয় গান। সহসা নয়নতারার দু’হাত জড়িয়ে ধরে প্রেমজুড়ির বাজনা থামিয়ে দেয়। কী যে পাগলামিতে পেয়ে বসে, দু’হাতে নয়নতারার মুখমণ্ডল তুলে ধরে সে প্রশ্ন করে,
-তুমি আরশিনগর চেন?
নয়নতারার শরীর থেকে কী এক সৌরভ ভেসে আসে। সন্ধ্যাবেলায় কোনো সস্তা পাউডার মেখেছে কিনা কে জানে! তার শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে। কোনোমতে সে উচ্ছারণ করে,
-তুমি চেনালেই চিনি।
-তুমি তো নয়নতারা, তুমিই ভালো বুঝবে। দুই চোখের ভুরুর মাঝখানে যে সূক্ষ্ণ জায়গা, সেটাই হচ্ছে আরশিনগর। সেখানে বাস করে অচেনা পড়শি।
-তার মানে অচিন মানুষ!
-কেন মনের মানুষ বলা যায় না তাকে?
এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয় না নয়নতারা। দু’হাতে মন্টু শাহর গলা জড়িয়ে ধরে সে গেয়ে ওঠে : ‘পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত, দূরে।’ এই পর্যন্ত গাইবার পর তার কণ্ঠে মৃদু ফোঁপানি শোনা যায়। সে আর লালন একখানে থাকার পরও যে লক্ষ যোজন ফাঁক থেকে যায়, সেই হাহাকারই যেন মর্মরিত হয়ে ওঠে। মন্টু শাহ তখন বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নয়নতারাকে, বুঝিয়ে বলে- আরশিনগর পৌঁছতে হলে ভজতে হবে সোনার মানুষ। সে-ই পড়শি। ‘নড়েচড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভর মেলে না।’
নয়নতারার কণ্ঠে তখন সাগরতরঙ্গের আছড়েপড়া জলোচ্ছ্বাস। স্বামীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে সে দাবি করে,
-তুমিই আমার সোনার মানুষ। আমার আরশিনগর তুমি। তুমিই আমার দয়ালচাঁদ। অরূপে স্বরূপে তুমি। আমার আরশিও তুমি, পড়শিও তুমি।
মন্টু শাহ টের পায়- তার দেহভাণ্ডে তিনশ’ ষাট রসের নদীর কূল উপচিয়ে ঢেউ উঠছে। প্রবল এই ঢেউয়ের মুখে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে সে! অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, মনে পড়ে যায় আকালি সাঁইজির মুখের ছবি, আগামীকাল থেকে তিনি দেবে শুভ্র কাফনে মোড়া পরিশুদ্ধ অন্য এক জীবন। যাপিত সে জীবনে কেবল মৃত্যুর আরাধনা মাত্র। নয়নতারাকে সকৌতুকে মনে করিয়ে দেয়, সকালের আলো ফুটলেই আজকের এই রাত হারিয়ে যাবে।
নয়নতারা শুধু অস্টম্ফুটে বলে, সকাল হতে এখনো অনেক বাকি।
মন্টু শাহ উপলব্ধি করে, নয়নতারা আজকের এই রাতের প্রহরগুলো রাঙিয়ে তুলতে চায় মনের মাধুরী দিয়ে, দেহনদী তার কানায় কানায় পূর্ণ; সে নদীতে নেমে টের পায়- এ হচ্ছে কূল উপচানো দশা। ওপারে মেঘের ঘটা, কনক ও বিজলিছটা, মাঝে নদী বহে সাঁই সাঁইরে…। বিষম নদীর পানি ঢেউ করে হানাহানি, মন্টু শাহ সেই ঢেউয়ের দাপাদাপির মধ্যেই আরশিনগর পৌঁছে যায়। কিন্তু পড়শি কোথায়? কী খবর পড়শির?
রাতের প্রহর গড়িয়ে চলে, ঘুম আসে না মন্টু শাহর চোখে। দু’চোখের পাতায় যদিও আকাশভাঙা জোছনা এসে গড়িয়ে পড়ে ঘরের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে, তখন সে কী করে! এপাশ-ওপাশ করে। একি শয্যাকণ্টকি! নাহ, নয়নতারার ক্লান্ত পরিতৃপ্ত মুখের দিকে চোখ পড়তেই যম যাতনা হারিয়ে যায়। কণ্টকি কিসের! না না, যম যাতনাই-বা কিসের!
ঘুম নয়, ভোররাতের দিকে হালকা একটু তন্দ্রালু ভাব এসেছিল চোখে, ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নে তাও কেটে যায়। চোখ রগড়ে ধাঁ করে উঠে বসে মন্টু। ভাবতে চেষ্টা করে, তার গুরু এভাবে কেন দেখা দিলেন! কী বোঝাতে চাইলেন! ভোররাতের স্বপ্নের নিশ্চয় কোনো তাৎপর্য আছে। আলো-আঁধারির মধ্যে আবারও দৃষ্টি চলে যায় নয়নতারার দিকে। আহা, রমণক্লান্ত শরীর তার ঘুমিয়ে কাদা। কাদা হবে কেন? ওটা কথার কথা। কাদা নয়, ক্ষীর। সাঁইজি তো বুঝিয়েই বলেছেন- নারী আমাদের ত্যক্ত নয়। নারীকে নিয়েই তো সাধনা। বিন্দু-সাধনা। যাকে বলে রসের ভিয়ান। দুধ জ্বাল দিয়ে হয় ক্ষীর। জ্বাল দিলে তো দুধ উথলে উঠবেই, ক্ষীর হয়ে গেলে স্থির শান্ত; আর ওথলানো নেই। গুরু ওই কথাটাই বলেন উপমার আশ্রয়ে- কামকেও পাকে চড়িয়ে শান্ত করতে হয় বৎস! ক্ষীরের মতো শান্ত।
ভোররাতের স্বপ্ন বলে কথা! আকালি সাঁইজি নিজে হাতে তাকে সেলাইবিহীন শ্বেতশুভ্র খিলকা পরিয়ে দিচ্ছেন, সাদা কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দিচ্ছেন, হাত বেঁধে দিচ্ছেন; নয়নতারাকে সাজিয়ে দিচ্ছে গুরুমা। তারা দু’জনেই ভয়ে কাঁপছে। সাঁইজি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন- এখন থেকে তোমরা অন্ধ, হাত থাকতে নুলো, পা থাকতে খোঁড়া, জিভ থাকতেও স্বাদ গ্রহণে অক্ষম। আজ থেকে তোমরা জিন্দা-মরা, জাগতিক সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে তোমাদের অবস্থান। ব্যাখ্যা চলতেই থাকে, গুরুমা হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে : ‘ও মা, আমার এ কী হলো! ও নয়ন!’
গুরুমার হাতে সাদা ধবধবে খিলকা ধরাই আছে, খিলকার মধ্যে মানুষ নেই। এ কি জাদুমন্ত্র নাকি! জলজ্যান্ত নয়নতারা গেল কোথায়!
তন্দ্রাভাঙা চোখে স্বপ্নের অশ্রুকণা নিয়ে মন্টু শাহ আবারও তাকায় নয়নতারার দিকে। সে তখন পাশ ফিরে শোয়। উদোম বুকের স্তনজোড়া হেলে পড়ে বাম দিকে। তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় সোনার মানুষের বিছানার দিকে। কে বলবে- এই মেয়েটিই কিছুক্ষণ আগে স্বপ্নের ভেতর থেকে পালিয়ে এসেছে।