অনেক দিন পর মিথিলা এই দীঘির পাড়ে এসেছে। পুরনো তালগাছগুলো এখনও আছে। কোনোকালে বেড়ে ওঠা এসব গাছ এখন যেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। গোল গোল পাতা আগের মতো এখন আর আকাশ ছুঁতে চায় না। হাতপাখার মতো মেলে থাকা এসব পাতা আর নেই। তবুও গাছগুলো কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আধমরা কয়েকটি পাতা নিয়ে। দীঘির জল এখনও স্বচ্ছ রয়ে গেছে। ওপাড়ের কৃষ্ণচূড়ার ছায়া আকাশটিকে মাথায় নিয়ে যেন পুকুরের তলায় নেমেছে। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেরা যেন পুকুরের তলা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে এপার থেকে ওপারে। বড় বড় পদ্মপাতা কখনও কখনও উড়ো মেঘকে আড়াল করলেও দীঘির তলাকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। পাতার ফাঁকে ফাঁকে জলের ওপর বেড়ে ওঠা পদ্ম আর শাপলা ফুল যেন রোদ ও বাতাসের দোলেও থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদের এই নিথর নিস্তব্ধতা মিথিলাকে তখনও বেশ বিভোর করত। সে একমনে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকত। চোখের পাতা পড়ত না। সামাং কোচড়ভর্তি কালোজাম, আমলকী, তেঁতুল, কামরাঙার মতো ফল নিয়ে এসে তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। এমনভাবে দাঁড়াত যেন তার নিঃশ্বাসের শব্দও মিথিলার কানে না পৌঁছে। সে টের পেয়েও চোখের পাতা ফেলত না। সামাং কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পিছু হেঁটে দূরে সরে যেত। আবার খানিক পর এসে দাঁড়াত। এভাবে যতক্ষণ না মিথিলা নিজে থেকে ধ্যান ভাংত ততক্ষণ সামাং অপেক্ষা করত।
মিথিলা প্রশ্ন করত, আচ্ছা তুই প্রতিদিন এসব আমার জন্য নিয়ে আসিস কেন?
সামাং কিছুটা অভিমানের স্বরে বলে, তুমি যে এগুলো পছন্দ কর।
আমি যে পছন্দ করি, তোকে কে বলল?
আমি কি বুঝতে পারি না, এগুলো তোমার খুব পছন্দ? তুমি খুব মজা করে খাও এসব।
তোর মজা লাগে না?
কী যে বল, ছেলেরা কি এসব খেতে চায়?
ছেলেদের কি এসব পছন্দ করতে নেই?
না। এই যে তুমি শাপলা ুলের দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকো, এটাতে নিশ্চয় তুমি আনন্দ পাও?
মিথিলা মাথা নেড়ে বলে, হুঁ। তোরা পাস না?
আমরা তো সারাক্ষণ এদের সাথে থাকি।
আচ্ছা,ফুল তোর কেমন লাগে?
ভালো লাগে। তুমি বললে আমি রোজ নিয়ে আসতে পারি।
এই যে শাপলা। একটা ফুটেছে আর একটা এখনও ফোটেনি। কোনটা তোর বেশি ভালো লাগে?
দুটোই আমার ভালো লাগে। আর যেটা এখনও ফোটেনি সেটা দুপুর হতে হতে মেলে যাবে।
আমার কাছে কিন্তু যেটা এখনও ফোটেনি সেটা খুব ভালো লাগে।
লাগতে পারে, তোমার মন তো আর সবার কাছে নেই।
যে ফুল এখনও ফোটেনি তার ভেতর অনেক কিছু লুকিয়ে আছে।
সামাং তখন মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কি তোমার জন্য কাল থেকে ফুল নিয়ে আসব?
কী ফুল আনবি তুই?
তুমি যে ফুল বেশি পছন্দ কর।
কোথায় পাবি তুই সেই ফুল?
বনে অনেক রকম ফুল আছে। একেক দিন একেক রকম ফুল নিয়ে আসব। দেখবে একটা না একটা ফুল তোমার পছন্দ হয়ে যাবে।
তার পর থেকে সে প্রতিদিন সকালে ফুল নিয়ে আসে। ফুলগুলো পেয়ে মিথিলা খুশি হয় কিন্তু পছন্দ-অপছন্দের কোনো কিছু জানায় না। সামাং প্রতিদিন ভোরে মিথিলাদের ঘরের বারান্দায় ফুল রেখে চলে যায়। এ সময় কোনো কথা হয় না এদের। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুই থামাতে পারে না ওকে। সে ভোর হতে না-হতে ফুল তুলতে বেরিয়ে যায়। নানান রকমের ফুল নিয়ে ফিরে আসে। পুকুরপাড়ে বসলে জাম-তেঁতুল দেওয়ার সময় সামাং একবার জানতে চেয়ে কোনো উত্তর পায়নি। একদিন অনেক দূরে পাহাড়ের কিনার দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ধারে ফোটা ফুল নিয়ে আসে। তাতেও মিথিলার পছন্দের ফুল কোনটা, সে বুঝতে পারেনি। দিন যত যায় সে তত দূর থেকে ফুল তুলে আনে। তার পরও মিথিলা কিছু বলে না তাকে।
একদিন দুপুরে পুকুরপাড়ে মিথিলাকে সে মনের কষ্টের কথা বলে- তোমার পছন্দের ফুল আমি এখনও আনতে পারিনি।
তুমি তো জানো না, আমার পছন্দের ফুল কোনটি?
বলো না- কোন ফুলটি তোমার বেশি পছন্দ?
সেটি তুমি আনতে পারবে না।
কেন পারব না? সামাং-এর প্রশ্ন।
‘সেটা আনতে হলে কালাপাহাড় আর সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে।’
সামাং ওর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন সাগর পাড়ি দেওয়া কোনো ব্যাপারই না।
মিথিলা বলে, ওই যে দূরে, অনেক দূরে, যেখানে আকাশটা এসে মাটির সাথে মিশে গেছে, সেখানে আছে অনেক উঁচু এক কালাপাহাড়। সেই পাহাড়ে আছে সরীসৃপ জগতের সব কালো কালো সাপ। পাহাড়ের পর বিশাল এক সমুদ্র। সেই সমুদ্রের ঢেউগুলো পাহাড়ের সমান। সেই উঁচু উঁচু ঢেউ সুতীব্র গর্জন করতে করতে প্রতিদিন আঘাত করে যায় কালাপাহাড়কে। কালাপাহাড় কিন্তু চিরকাল স্থির, অবিচল দাঁড়িয়ে আছে ওই আকাশ ছুঁয়ে।
গল্পের এতটুকু শোনার পর সামাং-এর চেহারাটা কালাপাহাড়ের মতো শক্ত হয়ে যায়। মিথিলা গল্পের শেষটুকু বলতে থাকে।
ওই পাহাড় আর সমুদ্র পাড়ি দিতে পারলে দেখবে অপূর্ব সুন্দর এক ফুলের বাগান। সে বাগানের শেষ নেই, নেই কোনো সীমানা। ওই বাগানের ফুল কখনও রোদে শুকায় না, ঝরেও পড়ে না। অথচ সব সময় টকটকে তাজা। মনে হয়, এইমাত্র ফুটেছে। ফুলের সৌরভ চারদিকে বাতাসকে মাতাল করে রাখে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানো, বাগানের আশপাশে কোনো মানুষ নেই। আছে শুধু পাখি আর প্রজাপতি। তাই ওই বাগানের ফুল কেউ ছেঁড়ে না।
সামাং পুকুরের স্থির জলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে, আমি ছিঁড়ে নেব।
মিথিলা অবাক ণ্ঠে বলে, কী করে নেবে? ওখানে তুমি যাবে কী করে?
সামাং-এর কণ্ঠে দৃঢ়তা- আমি যেতে পারব। কেউ না পারলেও আমাকে পারতে হবে। দেখবে একদিন ওই আশ্চর্য বাগান থেকে তোমার পছন্দের ফুলটি নিয়ে এসেছি।
আরে পাগল, ওটা সত্য না; একটা গল্প। ফুল না ছেঁড়ার জন্য বাচ্চাদের একটা গল্প।
কথাগুলো যেন সামাং-এর কানে ঢোকে না। সে দূরে তাকিয়ে কী যেন ভাবে। মিথিলার কাছে এলে সে এত মনোযোগী থাকে, অন্য কিছু ভাবতে পারে না। এখন তার চেহারার একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে সে। তার মনের দৃঢ়তা যেন তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ মুহূর্তে তাকে থামানোর শক্তি কারও নেই। তারপরও মিথিলা ভাবতে পারেনি, সে এমন একটি কল্পকাহিনীর টানে ওখানে যেতে পারে।
পরদিন বারান্দায় ফুল না দেখে মিথিলা অবাক হয়। সামাং যে ফুল নিয়ে আসবে না, সে ভাবতে পারেনি। ঝড়-ঝঞ্ঝা, অসুখ-বিসুখ কিছুই তাকে থামাতে পারে না। আজ হঠাৎ সে কেন ফুল নিয়ে এলো না- তার কোনো কূল-কিনারা মিথিলা পায় না। কালাপাহাড়ের গল্পটির কথা মনে পড়লেও ও রকম কিছু এখনও চিন্তা করতে পারছে না। তবু মাথাটা একটু ধরে যায়। কেন যেন ঝিমঝিম করে ওঠে। কিছুই ভাবতে পারে না এ মুহূর্তে। এ-রকম একটা গল্প সামাংকে টানতে পারে তা-ও সে এখন নিজের ভেতর আনতে চাচ্ছে না। কথাটা কিন্তু বারবার তার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সে কোনোমতে কথাটাকে নিজের মাঝে ভর করতে দিচ্ছে না। সে বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে হাঁটে এ সময়ে। এখন তার পা-যুগল যেন স্থির হয়ে আছে বারান্দার সাথে।
শরতের সকাল। একটু পরে আলো ঝলমল করে সূর্য উঠবে। শান্ত-স্নিগ্ধ ভাবটা সকালের রোদ মেখে হাসতে হাসতে যেন চারদিকে মুখরিত করে তুলবে। তখন মিথিলার ভেতরটা এক অপূর্ব আনন্দে মেতে ওঠে। সকালের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে প্রতিদিন নিজেকে একবার টেনে নেয়। পাখিরাও এ সময় তার সাথে মিতালি গড়ে তোলে। উঠোনের গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে উড়ে গান শোনায়। এখন যেন পাখিরাও নিঃশব্দে গাছের পাতার আড়ালে বসে আছে। তাদের কোনো শব্দ তার কানে আসছে না। শিশিরভেজা সকালটা যেন শরতের সূর্যের ছোঁয়ায় আর মূর্ত হয়ে উঠছে না। তারপরও মিথিলা ভাবতে পারছে না সামাং কালাপাহাড় পাড়ি দিয়ে তার পছন্দের ফুল আনতে যেতে পারে। এ ভাবনার মাঝে যে কষ্ট আর গ্লানি, তা সে কোনোমতে নিজের ভেতর আনতে চাচ্ছে না। তার পরও এমন একটি অচেনা ভাবনা যেন মুহূর্তের মধ্যে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই ভাবনার ভেতরেই সে ঘুরপাক খেতে থাকে।
এর পর আর কোনোদিন কেউ মিথিলাদের বারান্দায় ফুল রেখে যায়নি। সামাং আর কোনোদিন তেঁতুল আর কালোজাম নিয়ে পুকুরপাড়ে আসেনি। সামাংকে কেউ আর কখনও এলাকায় দেখেনি। কয়েক দিন লোকজন বলাবলি করলেও ধীরে ধীরে সবাই থেমে যায়। ওই কালাপাহাড়ে যারা যায় তাদের অনেকে আর ফিরে আসে না। হয় হিংস্র্র জীবজন্তুুর থাবায় নতুবা সরীসৃপের ছোবলে প্রাণ হারায়। কেউ কেউ আবার বর্মি সর্দারের সীমানায় ধরা পড়লে আর ফিরে আসতে পারে না। এসব কথা তো লোকমুখে ফেরে। সামাং কি জানে না? সে কি বাইরে থেকে এসেছে? সে সহজ-সরল একটি ছেলে। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। তার আপন বলতে কেউ নেই। দু’বছর বয়সে বাবা যে একদিন কোথায় চলে গেল আর ফিরে আসেনি। বাবা ছিল ভীষণ খেয়ালি। সারাদিন বাঁশি নিয়ে থাকত। এদিক সেদিক বাঁশি বাজিয়ে দিন কাটাত। মা রাজবাড়িতে কাজ করত। একদিন বেশি রাত করে ফেরায় বাবার সাথে খটমট লেগে যায়। পরদিন ভোরে বাবা বাঁশিতে সুর তুলে গভীর জঙ্গলের পথ ধরে চলে গেল, আর ফিরে এলো না। কেউ কেউ বলল, শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, আবার কেউ বলল, সে তো সারাক্ষণ বাঁশি নিয়ে থাকে। অস্ত্র চালাবে কী করে? একজন মন্তব্য করে, ও বাঁশি বাজাতে বাজাতে পথ ভুলে শান্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে গেছে। আরেকজন কথাটা সমর্থন করে- ঠিক তাই। ওরা তো আবার কাউকে ফিরে আসতে দেয় না। ফিরে এসে যদি ওদের আস্তানার ঠিকানা লোকালয়ে কাউকে জানিয়ে দেয়। অন্যরাও এসব কথায় সায় দেয়। তার পর থেকে মা-ও কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। কাজ করতে করতে থেমে যায়। বসে বসে কী যেন ভাবে? হয়তো চুলায় ভাত চড়িয়েছে, ভাবতে ভাবতে যেন কোন জগতে চলে গেছে। এদিকে ভাত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল নেই। তখন গৃহকর্ত্রী পোড়া ভাতের গন্ধে ভীষণ ক্ষেপে যায়। পিঠের ওপর কিল-লাথি পড়তে থাকে। এসব গা-সওয়া গেছে অনেক আগে। একদিন কাপড় ধুতে পুকুরঘাটে এসে এক কাণ্ড করে বসে। তখন বিকেল গড়িয়ে পড়ে। কাপড় ধুতে ধুতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। হঠাৎ পাখির সুরেলা ডাক বাঁশির সুরের মতো কানে বাজে। মা কান পেতে থাকে। ঠিক যেন সামাং-এর বাবার বাঁশির সুর। মনটা উত্তাল হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বিভোর হয়ে পড়ে মন পাগল বাঁশির টানে। সে সুর তাকে পুকুরের শান্ত কালো জলে টেনে নিয়ে যায়। সে কোমর জলে নেমে চারদিকে তাকায়। কোথাও কেউ নেই। মাতাল সুরটা যেন পুকুরের শান্ত জলে ঘুরপাক খাচ্ছে। জলের ভেতর পুকুরের তলায় পুরো আকাশটা যেন নেমে এসেছে। সে আকাশের খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ সুরের ভেতর দিয়ে যেন থির গতিতে ভাসছে। মা দৃষ্টি স্থির করে অপলক চেয়ে থাকে। বাঁশির মাতাল সুর আর রূপালি মেঘ তাকে পুকুরের তলায় আকাশের কাছে নিয়ে যেতে চায়। ততক্ষণে বিকেল শেষ, সাঁঝের আকাশের রঙ বদলায়। সে পানিতে দাঁড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টি মেলে আছে। আশপাশের অনেকে তাকে নিয়ে তামাশা শুরু করে দেয়। কেউ বলে, জিনের বাতাস লেগেছে, আবার কেউ বলে জলপরীর আছর ভর করেছে। নইলে এতক্ষণ কেউ পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে? তাকে পানি থেকে উঠতে বললে সে পানি থেকে ওঠে না কিছুতেই। শেষে গৃহকর্ত্রীর কাজের ছেলেটি পানিতে নেমে ওকে টেনে নিয়ে আসে। তার পর থেকে সামাং-এর মা প্রতিদিন বিকেলে পুকুরের কোমরজলে দাঁড়িয়ে পুকুরের তলায় আকাশ দেখে। তখন পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ‘পাগলি পাগলি’ বলে ঢিল ছুড়তে থাকে তার দিকে। এভাবে দিনের পর দিন, মাস গড়িয়ে বছর ঘুরে যায়। সামাং-এর বাপ আর ফিরে আসে না। মাকেও সবাই ‘জলপাগলি’ বলে ক্ষেপায়।
রাজবাড়ির আঙিনায় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করত। তখন সামাংও দৌড়ে যায়। কিন্তু ওরা ধাক্কা মেরে ওকে একপাশে ফেলে দিত। সে কান্না করতে করতে মিথিলার কাছে এসে নালিশ দিত। তখন মিথিলা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে মাত্র। তবু এ শিশুটির জন্য তার কেমন যেন মায়া হতো! সে ছেলেদের বলত, তোমরা ওকে ধাক্কা দিলে কেন? এসো, তুমি আমার সাথে খেলবে। বলে সামাংকে নিয়ে সিঁড়ির ওপর বসত।
সবাই মেনে নিলেও সামাং-এর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা সহজে মেনে নিতে পারে না মিথিলা। সে কিছুদিন স্কুলে যেতে পারে না। তার ভীষণ জ্বর হয়। ডাক্তার দেখানো হয়। ওষুধপথ্য খাওয়ানো হয়। কিন্তু সপ্তাহ ধরে জ্বর সারে না। এক সময় প্রলাপ বকতে শুরু করে। কিছুতেই ডাক্তার জ্বর নামাতে পারে না। পরে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়। রক্ত পরীক্ষা করা হয়। স্যালাইন দেওয়া হয়। ১০ দিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে জ্বর নেমে আসে। কিন্তু মাথার ভেতর ঘুরপাক খাওয়াটা বন্ধ হয় না। পরে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়। সেখানে ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠে। অনেক দিন শহরে থেকে যায়। ওখানকার স্কুলে ভর্তি হয়। লেখাপড়া শুরু করে আবার। আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। কিন্তু সামাংকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না।
মিথিলার দৃষ্টি এখনও পুকুরের জলে। বাতাসের ছোট ছোট ঢেউ মাঝে মাঝে দু-একটা পদ্মপাতা ওলট-পালট করে দিয়ে যায়। থির থাকা স্বচ্ছ জল কেঁপে কেঁপে ওঠে। তখন মিথিলা ভেতরটায় কাঁপানো শব্দ শুনতে পায়। সে হৃদয়-কাঁপনের শব্দে সামাং-এর অশরীরী উপস্থিতি টের পায়। হঠাৎ জায়গাটা কাঁচা ফুলের সুবাসে ভরে ওঠে। কী ফুলের সৌরভ ঠিক বুঝি উঠতে পারে না সে। মনে হয় হাজারো ফুলের গন্ধ বাতাসের সাথে মিশে আছে। সে পানি থেকে দৃষ্টি ফেরায়। সে কথা রঙের কাপড় জড়িয়ে ধন ভাণ্ডের মতো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে দূরে। তার মুখে শুভ্র মেঘের কারুকাজ। হাতে অপূর্ব সুন্দর একটি ফুল। মিথিলা অবাক নয়নে তাকায় কিছুক্ষণ। সে সময় নৈঃশব্দ্যের ভেতর কে যেন বলছে- আমাকে চিনতে পারছ না? আমি সামাং।
মিথিলার দৃষ্টি নির্বাক হয়। সে বলে ওঠে, এ তো সামাং-এর কণ্ঠ! তখন গেরুয়া কাপড়ের ভেতর থেকে সামাং সোনালি হাতটা বাড়িয়ে বলে, ‘এই দেখ না তোমার পছন্দের ফুল নিয়ে এসেছি।’