মনোস্রোত ক্রমশ ক্ষীণ

বসুন্ধরা শপিং কমপেল্গক্সের লিফটটি তখন দ্রুত উঠে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। কাচের ভেতর দিয়ে দূরে চলে যাওয়া ঘুরানো সিঁড়ি আর সাজানো দোকানগুলো দেখতে দেখতে রত্না ঘুরে দাঁড়িয়েছিল লিফটের দরজার দিকে। আর ঠিক তখনই লিফটের দরজা খুলে গিয়ে যে মানুষটি অপ্রত্যাশিতভাবে ঢুকে পড়েছিল, আর অপ্রস্তুতভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছিল রত্নার সামনে, তার নাম ফেরদৌস। ঝুলে থাকা সময়টা হঠাৎ করেই রত্নার সামনে একটা গল্পকে মেলে ধরল। যার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়েছিল রত্না নিজেই। অনেক দিন পার হওয়ার পরও সেই মুহূর্তে অনেক দিনের অল্প চেনা মানুষটি তাকে আপাদমস্তক চমকে দিয়েছিল। তবু ভীষণ সহজ ভঙ্গিতে রত্না কথা বলেছিল, দ্রুত কণ্ঠে হেসেছিল ফেরদৌসের পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে। রত্না অনুভব করছিল তার কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া জীবন যেন হঠাৎ রূপকথার পরীর মতো ডানা ফুলিয়ে উড়তে চাইছিল হাওয়ায় হাওয়ায়।

ফেরদৌসের যথেষ্ট তাড়া থাকায় রত্না ফুডকোর্টের দিকে আর গেল না। বরং পাঁচতলায় এসে বারান্দার এক কোনের ছোট্ট স্টলের কাছে দাঁড়িয়ে কফি নিতেই পছন্দ করল। রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে পাশাপাশি কফির কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। অনেক দিন আগের একটা স্মৃতির ঢেউ যেন নাড়া দিয়ে গেল রত্নার শরীর ও প্রাণে। সেদিন চারপাশে এমন নীরবতা আর এয়ারকন্ডিশনের ঠাণ্ডা হাওয়া ছিল না। আজিজ মার্কেটে অনেক কোলাহল, ভিড় আর গরমের ভেতর ফেরদৌসের ধবধবে সাদা শার্টের ভাঁজে ভাঁজে লেপ্টে ছিল এমনি শরীরী গন্ধ। সেই ঘোরের মধ্যে সেদিনও তেমন কোনো কথা ওরা কেউ বলতে পারেনি। তখন চোখের ভেতর দুলছিল এক মায়াবী বাগান আর এক সর্বগ্রাসী অদৃশ্য চোরাটান, যা দু’জনকেই অন্য কোনো ঠিকানায় নিয়ে যেতে পারত। না, শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো ঠিকানায় যাওয়া হয়নি তাদের। অন্য কোনো ঠিকানায় যাবে কী করে? যে কথাগুলো বলতে চেয়েছিল দু’জনে, তাই তো বলা হলো না! নিজেদের ভেতরের এক অন্তহীন নীরবতা ছিল পুরো সময়টুকু জুড়ে। তবু দীর্ঘদিন পর সেই একইভাবে রত্না তার বুকের ভেতর ভরে নিল হাওয়ায় ভেসে আসা সেই পুরনো গন্ধকে নতুন করে। আপাত স্থিরভাবে সে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু ভেতরে ভেতরে টের পাচ্ছিল আর চমকে উঠেছিল নিজের মধ্যে এক দ্বন্দ্বমুখরতাকে টের পেয়ে। হায়, ফেরদৌস কি টের পাচ্ছে এসব ভাবনা? এসব সম্মোহন! বিবাহিত জীবন আজ দু’জনকেই দিয়েছে স্থিতি। রত্না নিজের ভেতরে ঝুঁকে আবার নিজেকে দেখতে চাইল আর একবার। নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা এই কাঁপন কি সত্যি? হ্যাঁ, সত্যিই তো! সেই যে প্রথম ভালোলাগার স্পন্দন! আজও সেরকমভাবেই এতদিন পর তার রক্তপ্রবাহে তোলপাড় ঘটিয়ে দিচ্ছে!

কফির মগে ঠোঁট রেখে ওরা দাঁড়িয়েছিল পরস্পরের কাছাকাছি, বাইরের দিকে মুখ করে। আর ওপর থেকে দেখছিল যাবতীয় জটিল আঁকাবাঁকা পথ, কানাগলি, ফুটপাত। যে পথে সবাই যাওয়ার দিকে যাচ্ছে। কফি খাওয়া শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পরেই ফেরদৌস যাওয়ার তাড়া দেখাল, খুব চমৎকার আর আয়েশী ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরাল রেলিংয়ের দিকে পিঠ ঠেসেই। সিগারেটটা অর্ধেক শেষ করেই সে দ্রুত চলে যাচ্ছিল এমনভাবে, যেন এতদিন পরের এই চোখে চোখ রাখা, পাশাপাশি হেঁটে চলা, কফি খাওয়া সবকিছু মিলিয়ে এই গভীর অনুভবকে উপেক্ষা করার শক্তি সে রাখে। রত্না এই অনুভবের তাড়না নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আরও কিছুক্ষণ, যতক্ষণ না ফেরদৌসকে সে লোকের ভিড়ে আড়াল হতে দেখছিল। তারপর তার মনে হতে লাগল সংসারের জটের ভেতর, পরিত্যক্ত দালানের ভেতর সে একটা পুরনো পচা কাঠের মতোই কী ছিল এতদিন? নাকি এ এক দারুণ বিভ্রান্তি!

২.

তারপরের কয়েকটি দিন রত্না নিজেকে নিয়ে ভাববার অবকাশটুকুও পায় না। সংসারের জটিল আর কঠিন দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ব্যস্ততায় আর একঘেয়েমিতে, সবসময় যেমন কাটে। চারপাশটা সারাক্ষণই জটপাকানো। ছেলেকে স্কুলে পাঠানো, টিফিন দেওয়া, বেয়াদপি সামলানো, কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা, শাশুড়িকে নিয়ে ডাক্তার দেখানো, তিনবেলা খাবারের বন্দোবস্ত করা। রাতে ঘুমোবার আগে চুল ঠিক করতে করতে আয়নায় সে নিজেকে দেখে, একজন মাকে দেখে, একজন স্ত্রীকে দেখে। নিজেকে দেখে না। এক অন্তহীন আড়ালের মধ্যে একটা দমবন্ধ পরিস্থিতিতে সময়টা সবসময়ের মতো পার হতে থাকে। তবু মাঝে মাঝে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার, নিজেকে খুঁজতে গিয়ে মনে হয় যেন রত্না নামে কেউ নেই। তার নিজের সাজানো ফ্ল্যাট, হাজব্যান্ডের যথেষ্ট টাকা, আত্মীয়স্বজন, কিছুই যেন তাকে স্বস্তি দিতে পারছে না। রাতে ঘুমোবার আগে সে তার স্বামীর কাছ থেকে মনোযোগ আশা করে। কিন্তু ভদ্রলোকটিকে এ ব্যাপারে খুব বেশি উৎসাহী মনে হয় না। বেডরুমের নীল আলোটা অদ্ভুত ক্লান্তিকর মনে হয় তার। ভেতরে ভেতরে একটি তীক্ষষ্ট আর্তনাদ তার আত্মার ভেতর থেকে জেগে উঠতে চায়। নিজ অস্তিত্বের সংকটের ভেতর থেকে। নিজের ভেতরের সেই স্বরটি গভীর অন্ধকারে তার দ্বিধাগ্রস্ত শরীর আর মনের ওপর নিঃশব্দে পড়ে থাকে।

আজকাল একটু সময় পেলেই আনমনা হতে ইচ্ছে করে তার। অথচ ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েকদিন আগেও রোদ, বৃষ্টি বা মেঘলা দিনে নিজের মধ্যে কোনো উদাসভাব টের পায়নি সে। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই একটা অদ্ভুত তাড়নার তীব্রতা ফাঁক পেলেই নিজের মনের গভীরে তাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যদিও নিজের ভেতর খুঁড়ে একরাশ অবসাদ আর ক্লান্তি ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এতদিনের জীবনের স্রোতে ভেসে চলা রত্না হঠাৎ করেই যেন চারপাশে চরম নৈঃশব্দ টের পেতে থাকে। গোপন কান্নার মতো সে সব নৈঃশব্দের বিষণ্ণতার মধ্যে ডুবে থাকার ইচ্ছে হয় যখন তখন। বিষণ্ণতায় বুঁদ হয়ে থাকা রত্নাকে তার পরিবারের কেউ তেমন খেয়াল করে না।

একদিন চাঁদনি রাতে রত্নার মনে হলো, ফেরদৌসের মোবাইল থেকে এখুনি একটি রিং বেজে উঠবে তার জন্য। ওর দিক থেকে ফোনটি সে নিবিড়ভাবে আশা করেছিল, আর এও অনুভব করছিল যে, ফেরদৌসের জন্য তার মন পুড়ছে। মনে হলো একি স্বপ্ন না সত্যি? ফেরদৌসকে তো সে কোনো ফোন নম্বর দেয়নি। বরং ফেরদৌসই তার কার্ডটি তাকে দিয়েছিল। আর সে পরম যত্নে রেখে দিয়েছিল তার ব্যাগের ভেতর। চাইলেই কি সে ফোন করতে পারত না! তবে সে করেনি কেন? এখনি করতে পারে! কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সে কি ফেরদৌসকে কখনও দেখেছিল দেখার মতো করে? সে আসলে কিছুই দেখেনি, খোঁজেনি, বুঝতেও চায়নি। ছিপছিপে রিজু নির্মেদ দীর্ঘ শরীরের স্থির ও শান্ত যুবকটিকে সে বুঝতে পারেনি। আর তখনি ভুলে যাওয়া দিনগুলোর ভেতর থেকে সে অন্য এক ফেরদৌসকে পেতে চাইল। ভেতরে জেগে উঠল অন্য এক অনুভব। কোনো এক বিগত দিনের অন্ধকারের ভেতর, ফেরদৌসের সিগারেটে জ্বলে থাকা গোল আগুনটার ভেতর, সিগারেটের ধোঁয়ায় এঁকে যাওয়া নকশার ভেতর। তখন লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়ার দিন ছিল, ফেরদৌসের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার দিন ছিল, হাসতে হাসতে সময় পার করার দিন ছিল। এতদিন এই অনুভবগুলো কোথায় ছিল? তবে কী কালো মুখোশের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল নিজেকে?

রাতে ঘুমুতে এসে সে আর একবার টের পায় এক বিশাল শূন্যতা। আলো-আঁধারিতে ঘুমের ঘোরে স্বামীর হাতটি অভ্যাস মতো তখন গায়ের পোশাকগুলো খুলে নেওয়ার তাড়া দিতে থাকে। সেও তাড়াহুড়ো করে। সবসময়ের মতো তাড়াহুড়ো করে সঙ্গমে পৌঁছে যায়। প্রক্রিয়াটিতে না থাকে আনন্দ, না উপভোগ। মাঝে মাঝে সে উপভোগের ভান করে। স্বামীকে খুশি রাখার এটি একটি দাওয়াই, যাতে সে অন্য মেয়েতে ঝুলে না পড়ে। কখনও কখনও এই যান্ত্রিক সঙ্গম তাকে গভীর হতাশায় নিয়ে যায়। নিজের জ্বলে ওঠা শরীরের প্রত্যেকটি কোণকে সে স্পর্শ করে পরম মমতায়। সঙ্গমক্লান্ত স্বামীটি তখন গভীর ঘুমে। এক গভীর হতাশায় সে নিজের শরীরের প্রতিটি কোণে হাত বোলায়। এপাশ-ওপাশ করে। অদ্ভুত তাড়নায় ছটফট করতে করতে তার মনে হতে থাকে কেউ তাকে ভালবাসেনি। ঘুমন্ত স্বামীর দিকে তাকিয়ে অন্য একটি শরীরকে সে মনে মনে কামনা করে। চোখ বন্ধ করে নিজের শরীরে নিজের আঙুলের পরিচালনে আবেশিত হতে হতে ফেরদৌসকে ভাবে। উথলে ওঠে তার শরীরী ভালোবাসা। ফেরদৌসকে সে শরীরে নিয়ে আসে গভীর অনুভবে ধীরে ধীরে। যেন সে ধীরে চুম্বন করছে তার গালে, কপালে, নাভিতে, গভীরতায় আর ভালোবাসার অধিকারে পৌঁছে যাচ্ছে গভীর অতলে। সেই অন্তহীন রহস্যময় গভীর অতলকে কোনোদিন জেনেছে কি তার স্বামী? অথচ কত দীর্ঘদিন মিলিত হয়েছে এই অভ্যস্ত দাম্পত্য! আর সেই সব মিলনে উচ্ছলতা ছিল, বিষণ্নতা ছিল, আঁচড়-কামড়ও ছিল। কিন্তু ভালোবাসা কি ছিল? ছিল না। কখনও ছিল না। নিজের চারপাশে জ্বলতে থাকা তৃষ্ণাগুলো রত্নাকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। ঘুম আসে না। রাত্রির গভীরতায় চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকতে থাকতে ঘুমন্ত চারপাশের ভেতর থেকে, টুকরো টুকরো আলো অন্ধকারের ভেতর থেকে, আর তার নিজের ভেতর থেকে সে এক অন্য মেয়েকে জেগে উঠতে দেখে। খুব বিষণ্ণ এক মেয়ে নিজেকে আবিস্কারের আকাঙ্ক্ষায়, নিজেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় সময় ও বাস্তবতা পেরিয়ে তাকে এক গোপন সংকেতের দিকে ঠেলে দিতে থাকে।

৩.

বৈবাহিক সম্পর্ক মানেই এক গভীর বিশ্বাস আর দীর্ঘস্থায়ী ন্যায়পরায়ণতা বলেই রত্না নিজের মধ্যে জেনে নিয়েছে। তবু নিজের মধ্যে তার চারপাশের শিকল ভাঙার এক দুর্নিবার চোরাটান সে অনুভব করে। নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের বাইরের স্বাদ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে থাকে। ছেলের বন্ধুদের মায়েরা রাতদিন ফেসবুকের নতুন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যায়। কেউ কেউ এসব সম্পর্ককে মনে করে বিশ টাকার ফুচকা খাওয়ার মতো। কেউ কেউ আবার শারীরিক আনন্দ উপভোগের জন্য বিউটি পার্লারের স্পা ও ম্যাসেজ কর্নারগুলোতে নিয়মিত শরীর ম্যাসেজ করিয়ে থাকে। স্বামীর কাছ থেকে যে মনোযোগ তারা পায় না, তা তারা আদায় করে নেয় এভাবে অনেক টাকা খরচ করে আনন্দ কেনার মধ্য দিয়ে। রত্নার এসবের কোনোটিই ভালো লাগে না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোতে সে নারাজ। বরং সে খুঁজতে থাকে তার শূন্যতার ভেতরের তরঙ্গ, সে খুঁজতে থাকে সেই অতলের খোঁজ, নিজের ভেতরের এক অজানা রহস্যময় জগৎ। সে বুঝতে পারে না, একি তার নিজের জন্য নিজের প্রেম, নাকি ফেরদৌসের প্রতি তার প্রেমের আকাঙ্ক্ষা? তবে সে ধাবিত হয়। নিজেকে ধ্বংস করে নিজেকেই আবার নতুন করে ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষায় সে ধাবিত হতে থাকে। ফেরদৌসের কার্ডে থাকা ফোন নম্বরে সে যোগাযোগ করে। আর পরবর্তী সময়ে অতি সাহসিকতায় লিপ্ত হতে থাকে ফেরদৌসের সঙ্গে রহস্যনির্ভর সম্পর্কে। প্রায়ই সে নীরব অবসরে ফোনে কথা বলে আর সেই সব ভালো লাগার বার্তা মুহূর্তে পৌঁছে যায় শরীরের কোণে কোণে। জীবনে আবার যেন বসন্ত আসে। তার সুগন্ধে ভরে ওঠে চারদিক। সে হয়ে ওঠে লাবণ্যময়ী। আচরণে, ব্যবহারে তা ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের সবদিকে। ফুটে ওঠা ফুলের সৌন্দর্যকে জোর করে ভোগ করতে চায় তার স্বামী। কিন্তু রত্না জানে এই শরীরী সম্পর্কে সম্পূর্ণ সরে দাঁড়িয়েছে তার মন। আর এই উদাস ভঙ্গিটি স্বামীটি টের পেতে ভুল করে না। কাম আর ক্রোধকে একত্র করে সে দখল করে নেয় রত্নার শরীর। তৎক্ষণাৎ লোকটিকে তার অচেনা মনে হয়, মনে হয় ফেরদৌসের সঙ্গে সম্পর্কের বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত তাকে এমনভাবেই নিয়মিত ধর্ষণের শিকার হতে হবে। তার মনে হতে থাকে… বিয়ে! কী জটিল! কী ঠুনকো! কী সাংঘাতিক! কী অস্বাভাবিক অবস্থা যে, চাইলেও এর বাইরে সে যেতে পারবে না। সবকিছু মিলিয়ে নিজের মনে নিজের জন্যই ক্ষোভ, ঘৃণা, বিরক্তি জমা হতে থাকে পাশাপাশি।

তবু সময়ে অসময়ে ফেরদৌসের ঋজু, সুগঠিত সুন্দর শরীরটি তার মনের মাঝে হানা দেয়। আর সেই মানুষটির পাশে নিজেকে দাঁড় করানোর জন্য সে রাতদিন নানা যুক্তি খুঁজে বেড়ায়। তার বুক দুরু দুরু করে, দম আটকে আসে। এর মধ্যেই ফেরদৌসের এসএমএসটি আসে: ‘ফোনে আর কত কথা বলব! আমরা কবে দেখা করব!’ লাইনটি যেন তাকে জাপটে ধরে চুমু খেল, তার শরীর কাঁপল থরথরিয়ে। এখনও যৌবন আছে! আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে সে। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই কবেকার সাদা, সুন্দর, ক্ষীণ, নরম, সুগঠিত শরীর! স্টম্ফীত পেটের ওপর বিপুল স্তনভার, বিশাল নিতম্ব, মেদ আর মাংস মিলিয়ে নিজেকেই বিবমিষা লাগতে থাকে। এসব বাস্তবতা তাকে দিশেহারা করে দেয়। এসব মেদমাংস পেরিয়ে ফেরদৌস কী খুঁজে পাবে তার অতল মনের ঠিকানা! আর নিজেকেও সে আচমকা ভয় পেতে থাকে। তার ভয় হয় প্রেমের স্পর্শে সে নদী হয়ে উঠবে। আর কখনও ফিরতে পারবে না উৎসস্থলের দিকে। সে ভয়ে ভয়ে ফিরে তাকায় সংসারের বৃত্তে। ফেরদৌসের এসএমএস-এর উত্তরে সে আর কিছু বলতে পারে না। তার নিজের মধ্যে ক্লান্তি অনুভব করতে করতেই কখন যেন দোদুল্যমানতার ভেতর প্রতিশ্রুতিহীন এই রহস্যময় সম্পর্ক অতি দ্রুত হারিয়েও যেতে থাকে।

৪.

পরিবারের সবার অস্তিত্বের মধ্যে সহজভাবে সে মিশে থাকে রাত্রিদিন। তবু সে টের পায়, তারই অন্য একটি প্রতিচ্ছায়া একা একা নিঃশব্দে ঘোরে সমস্ত ব্যর্থতাকে বুকে নিয়ে। সেই হাহাকার এসে মিশে যায় তার স্বপ্নের ভেতর, স্মৃতির ভেতর।

শরীর ও সংকেত গল্পটির সূত্র মাথার ভেতর রয়ে গিয়েছিল অনেক আগে থেকেই। চারপাশে দেখা নারীদের মধ্যে এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা টের পেতাম। এরা নিজেরাও হাতড়ে বেড়াত তাদের সমস্যাটিকে। এদের অধিকাংশই অতি সচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত গৃহবধূ। ওদের জীবনও খুব সাজানো গোছানো। তবু অদ্ভুত এক একাকীত্ব এরা বয়ে বেড়ায়। আর এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নিজেকে মাঝে মাঝে ভেঙে আবার নতুনভাবে গড়ার স্বপ্ন দেখে। আমার গল্পের রত্না চরিত্রটি নিজের স্বরটিকে চিনবার চেষ্টা করে। এবং একসময় সে চিহ্নিতও করতে পারে তার শরীর ও সংকেতকে। নীরস ব্যস্ততা আর একঘেয়েমিভরা জীবনের মধ্যে নিজেকে খোঁজার এক অদম্য জাদুটান সে অনুভব করে নিজের ভেতর। নিজের ভেতর নিরন্তর শুনতে পায় দূরের ডাক। আর এই অসীম জাদুটানের মধ্যে উন্মুখ ও অধীরভাবে আবিস্কার করে তার ভালোবাসাকে। সে ভাঙতে চেয়েছিল তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বিয়ে নামক খাঁচার ভেতরে বন্দি জীবনের আনুগত্য পালন আর নিরন্তর ঘুরপাককে সে অতিক্রম করতে পারে না। নিজেকে আবিস্কারের পর বিয়ের অনিবার্য শরীরনির্ভর সম্পর্ক তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তার অন্তর্গত চেতনায় সঞ্চিত হতে থাকে সমূহ বিষণ্নতা। তবুও সে অ্যাক্যুরিয়ামের মাছের মতোই চাকচিক্যময় নিশ্চিত অর্থহীনতার মধ্যেই পড়ে থাকে। চারপাশের দেয়ালকে অতিক্রম করে নিজের জীবনে অন্য যোগসূত্র ঘটাতে পারে না।

এই গল্পটি লেখার সময় আমি প্রথমে ডায়ালগ ব্যবহারের চিন্তা করেছিলাম। পরে মনে হলো বর্ণনামূলক হলেই ভালো হয়। বাস্তবের সীমাবদ্ধতা আর স্বপ্নের বিস্তৃতির এক দ্বান্দ্বিক পটভূমি নির্মাণে আমি বর্ণনাকেই আশ্রয় করেছি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত