বন্ধুর মুখ

ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত এই অবস্থায় যাবে, সেটা আমরা কেউ–ই ভাবিনি। ভাবার সময়ও ছিল না। তখন কেবল শাহরিয়ারের বেঁচে থাকার বিষয়টি নিয়েই ভেবেছিলাম আমরা। ওকে জীবিত ফিরে পাওয়াই ছিল প্রথম চিন্তা। দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমাদের মধ্যে ছিল, তা হলো নিজেদের যার যার জন্য শঙ্কা। কেননা আমারা বিশ্বাস করি, শাহরিয়ারকে ফিরে না পেলে, আমাদের নিখোঁজ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই আমরা খুব মরিয়া হয়ে উঠি। আর বন্ধুকে উদ্ধারের মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চাই। শাহরিয়ারের বড় বোন শাফিনাজ আপাই প্রথম ফোন করে জানান, ‘ও বাড়ি ফেরেনি।’

তারপরই আমি, রুদ্র আর বশির ছুটে যাই ওদের কলাবাগানের বাসায়। যেতে যেতে ধারণামূলক নানা ধরনের কথাবার্তা চলে আমাদের। ঘরে ঢুকতেই খালাম্মা, মানে শাহরিয়ারে মা আমাদের জড়িয়ে ধরেন, ‘বাবা, শাহরিয়ারকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে।’

এটুকু বলেই তিনি জ্ঞান হারান। শাফিনাজ আপা রাতজাগা লাল চোখ মেলে আমাদের দেখে নিয়ে খালাম্মাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যান। আমাদের সামনে খালুজান, মানে শাহরিয়ারের বাবা গম্ভীর এবং শঙ্কাগ্রস্ত মুখে বলেন, ‘বসো।’

রুদ্রের তর সইছিল না। বসার আগেই সে জানতে চাইল, ‘শাহরিয়ারকে কারা ধরে নিয়ে গেছে?’

শাহরিয়ারের বাবা রুদ্রের দিকে যে চোখে তাকান, তা সন্দেহ ও বিরক্তির। হঠাৎ আমার মনে হয়, কয়েক বছর ধরে আমরা কেউ-ই আসলে কারও দিকে সরল চোখে তাকাতে পারিনি! শাহরিয়ারের বাবা একসময় আমাদের শিক্ষক ছিলেন। আমি, রুদ্র আর বশির যখন ঢাকা কলেজে এইচএসসি পড়ি, তখন তিনি ইংরেজি পড়াতেন। তিনি বললেন, ‘কারা ধরে নিয়ে গেছে? তুমি জানো?’

এমন প্রশ্নে আমি আর বশিরও কি সন্দেহের চোখে রুদ্রের দিকে তাকালাম! রুদ্র এবার সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। বলল, ‘না, মানে খালাম্মা বললেন…’

এবার পুরো হতাশ কণ্ঠে বললেন শাহরিয়ারের বাবা, ‘সে তো কত কিছুই বলছে…’

ঘরের মধ্যে নেমে এল খানিকক্ষণের নীরবতা। এই ফাঁকে ভেতরের ঘর থেকে পর্দা সরিয়ে শাহরিয়ারের পাঁচ বছরের ছেলে তূর্য বিহ্বল চোখে দেখল আমাদের। তার দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম আমরা।

সকালে শাহরিয়ার অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যায়। সারা দিন সে অফিসেই ছিল। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হওয়ার সময় তূর্যর মাকে ফোন করেছিল, কিছু আনতে হবে কি না জানতে। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই। মোবাইলের সুইচ অফ। সারা রাতে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সকালে থানায় জিডি করা হয়েছে। আমরা শাহরিয়ারদের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। রুদ্র যাবে উত্তরা, কিছু ছবি ডেলিভারি দিতে।

আমার পত্রিকা অফিস আর বশিরের ব্যাংকে আজ একবেলা ছুটি নিতে হলো। একসময় পারস্পরের দিকে শঙ্কা আর সন্দেহের চোখ রেখেই বিদায় নিলাম আমরা।

দুই.
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না। বরং একসময় ঐক্যদৃষ্টি স্থাপিত হয়েছিল। বন্ধুদের মধ্যে শাহরিয়ার সফর্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের তিনজনের কথা তো বললামই। এ ছাড়া আমাদের বন্ধু নিতু গান গাইত, মারুফ লেখক আর হিরা ছিল কবি। ‘আমরা’ নামে আমাদের একটা ওয়েবপেজ তৈরি করে দিয়েছিল শাহরিয়ার। সেখানে যে যার মতো খোলা গদ্য লিখতাম। মূলত মারুফই দেখত ওই পেজ। ওর আরও কিছু লেখকবন্ধুও ছিল, যারা আমাদেরও আড্ডার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের বন্ধুবৃত্ত ছড়িয়ে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে এক বসন্তে একবার আমরা সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে প্লাকার্ড হাতে শাহবাগে রাস্তায় গিয়ে বসেছিলাম। হাজার হাজার চোখের ঐক্য স্থাপিত হয়েছিল। তবে দিন ১৫ না যেতেই আমাদের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস দেখা দেয়। মূলত তখনই সবাই খেয়াল করলাম, আমরা কেউ কলম ধরতে জানি, কেউ গিটার হাতে পথে নামতে পারি; আর এভাবেই প্রতিবাদ করি এবং এসবই ভালোবাসার আবেগে মথিত হয়ে। অথচ আমরা রাজনীতিটাই বুঝি না! ফলে তখন আবার নিজেদের গুটিয়ে আনি আমরা, রাজপথ ছেড়ে দিই। কিন্তু মনের খটকা কিছুতেই দূর হয় না। আমরা কেন রাজনীতি করিনি? এসব প্রশ্ন জন্ম নিতে থাকে। মনে পড়ে আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ের কথা। কবে? কে শিখিয়েছিল রাজনীতি ভীষণ নোংরা? মনে করতে পারি না সে কথা । উচ্চারিত কোনো মুখ জেগে ওঠে না। তবে কানে কানে নানা কথা ভেসে বেড়াত তখন! আবার ভাবতে বসি আমরা, কেমন করে সামরিক শাসক অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিল? আর নব্বইয়ের উত্তাপে আমরা কেবল বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তিই শিখলাম! রাজনীতির বিকারগ্রস্ততা কি আমাদের রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে? না, বুঝে উঠতে পারি না। কেমন দিশেহারা বোধকরি।

আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ খুন হয়, লেখক খুন হয়। সহসা ঐক্যে ফেরা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিটাও যে রাজনীতি, তা আমরা দূর থেকে দেখি। মদদ দিতে দিতে বেপরোয়া রাজনীতির খেলায় প্রথম বিপন্ন বোধকরি আমরাই। হয়তো এটা আমাদের দীর্ঘদিন যাবৎ রাজনীতিহীন হওয়ার ফল? কে জানে! তর্ক থেমে যায়, আমাদের কিছু বন্ধু এসাইলাম নিয়ে হয় অভিবাসী। তবে সেখানেও ব্যাপক রাজনীতির খবর বেরিয়ে পড়ে। এ বিশ্বায়ন। দেশ থেকে আমেরিকায় অভিবাসী হওয়া নিতু জানায়, তাবৎ বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীলরাই নাকি ওখানে ওর প্রতিবেশী! নিজের দেশে প্রাণ খোয়ানোর শঙ্কায় তারাও নাকি পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে! এতকাল আমরা রাজনীতি করিনি, কেবল শান্তি শান্তি করতাম। ভালো থাকার আপেক্ষিক সূচক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতাম। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে কত দিন কত মৃত্যু, কত অনৈতিক হত্যা হলো! সেসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করিনি। বরং বলেছি, ও তো সন্ত্রাসী, কতগুলো কেস ঝুলছে? মরেছে তো আমার মতো পড়ুয়া ছেলের কি? আমার চাই ব্যাংক জব। দশটা-ছয়টা খাটব; বউ-বাচ্চা নিয়ে কেটে যাবে দিন। আমার চাই একটা চাকরি, একটা ভাড়া ঘর, একটা সুখের সংসার। ওসব মারামারি মানে রাজনীতি। আমি প্রেমিকার চোখে খুঁজি ধনুষ্টঙ্কার! বিকেলের আলোকে ‘বকুলের ফুল’ বলে কাব্য করি। এভাবে যখন চলছিল দিন, তখন এসবের মধ্যে হারানো বন্ধুদের কথা ভেবে আবার ঘরকুনো হয়ে পড়ি আমরা। ভয় পেতে হয় আমাদেরই! অথচ যেকোনো দিন হয়ে যায় হলি আর্টিজান! আমরা জেনে যাই, সন্ত্রাসের ভিন্ন নাম, রাজনীতিহীন পথে বেঘোরে জারি হয় মৃত্যুর জন্য হুলিয়া। আমরা জানি শোলাকিয়ায় ঈদ জামায়াতে খুনটা আসলে কী? তাই আমরা বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিই মূষিকের জীবন। কিন্তু আমাদের বড় ক্ষুধা, একটু শান্তি পেলেই রাস্তায় নেমে লাল-সবুজ পতাকা ওড়াই।

অফিসে এসে কাজে মন বসাতে পারিনি; তাই কী সব লিখে যাচ্ছিলাম আপন মনে। খুব গোপনে পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢেকে রাখি, যত ব্যক্তিগত ক্ষোভ। আমাদের কোনো দল নেই, আমরা কেবল ব্যক্তিগত শঙ্কার ভেতর বাস করি। দেশে নানা রকম অপারেশন চালু হলে আমরা শান্তি পাই। ভাবি, এবার তবে লেখালেখি শুরু করা যায়। তাই আবার চালু হয় ওয়েব। কেউ একজন ধার করা কাব্যে লেখে, আমি কুকুর হয়ে বসে থাকি, তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে। না, এসব আর আমাদের ভালো লাগে না। বনলতা সেনের বদলে নুসরাত ফারিয়ার চোখ নিয়ে কাব্য করি আমরা।

আবার সাহিত্য করতে বসি, মন থেকে আগের মতোই রাজনীতিকে নোংরা ঝুড়ি ভেবে ডিলিট দিয়ে সরিয়ে রাখি। কেননা, টবের ফুলগাছটি আমাদের ভীষণ প্রিয়!

কথাগুলো ধ্রুবকে কেবলই সেন্ড করেছিলাম। ব্যাটাও যেন মুখিয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এল, ‘গত মাসে তোর একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম, কত সুন্দর সুন্দর বাংলা নামের অপারেশন নিয়ে সবিস্তারে লিখেছিলি। মানুষ স্বস্তি পেয়েছিল রে। তোরও নিশ্চয়ই লিখতে ভীষণ ভালো লেগেছিল?’

আমি এ কথার কোনো উত্তর দিই না। সেই ছোটবেলাতেই জেনেছিলাম, পৃথিবীতে শান্তি রক্ষা বাহিনী আছে। হ্যাঁ, শাহরিয়ারের নিখোঁজ সংবাদ আমাকে আবার ভীত করে ফেলেছে।

তিন.
সাত দিন হলো কোনো সন্ধান মেলেনি শাহরিয়ারের। পুলিশ ওর বাবাকে থানায় নিয়ে জেরা করেছে, বউকে প্রশ্ন করেছে, ওর ল্যাপটপসহ সব ডিভাইজ এখন থানায়। আমাদের ওয়েবপেজ আবার বন্ধ। ওখানের সবকিছু বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিষয়গুলো জেনে সবার মধ্যে একধরনে নিশ্চয়তা জাগে। বশির বলে, ‘পুলিশের তৎপরতা ভালো।’

ধ্রুব বলে, ‘ও তো কোনো কিছু লিখতও না, ওর ব্যবসাও নেই…ওকে কার এত প্রয়োজন!’

আমার মনে যা হয়, তা আমি বলি না। অদ্ভুতভাবে সন্দেহ করতে শিখেছি এবং নিজের মনের মধ্যে উতলে ওঠা ভাবনায় আমি নিজেই অবাক হয়েছি। কেননা, আমার কেন মনে হলো, ও কোনো জঙ্গি বাহিনীতে যোগ দিয়ে থাকতে পারে! গত বছরগুলোতে তো দেখছি; নিখোঁজদের অনেকের পরিণতি, গোপন আস্তানায় ট্রেনিং নিয়ে ফিরছে। কিন্তু মুখে এসবের কিছুই বলতে পারি না। তাই একটু ঘুরিয়ে বলি, ‘ওকে দিয়ে কোনো সফর্টওয়্যার ডেভলপ করাতে চায় না তো?’

কে চায়? কী চায়? কোনো প্রশ্ন না করে বন্ধুরা চুপ করে ভাবতে থাকি।

চার.
শাহরিয়ারের পরিবারের সবাইকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলাম আজ। শাহরিয়ারের মা খুব কেঁদেছেন। ধ্রুবর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমি শাহরিয়ারের পাঁচ বছরের ছেলে তূর্যকে মাইক্রোফোনের সামনে নিয়েছিলাম। বাচ্চাটা সবাইকে বোকা বানিয়ে মাইক পেয়ে ছড়া বলা শুরু করল, ‘আয় রে আয় টিয়ে…নায়ে ভর দিয়ে…ওরে ভোঁদড় সরে দাঁড়া…খেপেছে আমার পাগলা ঘোড়া।’

মোটামুটি সব টিভি চ্যানেল আর নিউজ মিডিয়ায় সবিস্তারে খবরটা এসেছে। তূর্যর ছড়া শুনে শহরের মানুষ চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সে ছড়া ভাইরাল হয়ে গেছে। আমরা একটা গ্রুপ খুলে ভীষণভাবে লেখালেখি করছি। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে।

পাঁচ.
খবর শুনে প্রথম দিনই আমেরিকা থেকে ফোন করেছিল নিতু। প্রথমে ওর বিশ্বাসই হয়নি। শাহরিয়ারকে কেন তুলে নেবে? ও তো গোবেচারা এক সফটওয়্যার মিস্ত্রি। হাসতে হাসতে এ-ও বলল, ‘সেই রাখাল বালকের গল্প নয় তো? শুনেছিলাম বউয়ের সাথেও ভালো যাচ্ছে না শাহরিয়ারের।’

এখন সেই নিতুকেও দেখি জ্যাকসন হাইটে, বাঙালিদের নিয়ে মানববন্ধন করেছে। প্রথম প্রথম অনেকেই নানা রকম মন্তব্য করেছিল। আমাদের ডাক্তার বন্ধু কল্লোল বলেছিল, ‘মেয়েরা প্রেম করলে সিম নিয়ে নেবে, প্রেমিকাদের খুঁজতে এক্সপার্ট হিসেবে শাহরিয়ার!’

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও হাসি–ঠাট্টা করি আমরা। বাঙালিদের রসবোধের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বেঁচেবর্তে থাকি। কিন্তু কোনো মুক্তি মেলে না। ফোন রেকর্ডে কোনো তথ্য মেলে না। তখন ক্রমশ সন্দেহ হয় আমাদের। কিন্তু সে কথা আর মুখে আনা যায় না। দেয়ালেরও কান আছে, আমরা তা বিশ্বাস করতে শিখেছি।

ছয়.
জরুরি একটা কাজে আমি নরসিংদী গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় ফিরে জানতে পারলাম কে বা কারা শাহরিয়ারের ফোন থেকে কল দিয়েছিল। ৪০ লাখ টাকা চেয়েছে ওরা। নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিন পর এমন ফোন! আমাদের সবার সন্দেহের হিসাব-কিতাব এলোমেলো হয়ে যায় মুহূর্তেই। পুলিশ জানায়, বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছে। শাহরিয়ারের মা আলমারি খুলে বসে হিসাব কষেন, কোথায় কত টাকা আছে, গয়নার দাম বাজারে এখন কত? তূর্য ঘরের এক কোণায় বসে মোবাইলে গেম খেলছিল। আমাকে দেখে বলে, ‘আঙ্কেল ৪০ লাখ টাকা দিয়ে বাবাকে নিয়ে এসো না।’

সে কি তাহলে মোবাইল গেম খেলছিল না বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করছিল?

শাহরিয়ারের বাবা, আমাদের স্যারের মুখটা আরও গম্ভীর। এ ঘটনার পর থেকে কিছুক্ষণ বাদে বাদে শাহরিয়ারের মোবাইলে ফোন করি আমরা এবং যথারীতি বন্ধ পাই।

আমাদের পত্রিকা অফিসে সবাইকে বলা আছে, কোথাও কোনো অজ্ঞাত লাশের খবর পেলেই আমাকে যেন জানায়। অফিসে এসব কথা বলেছি বটে, কিন্তু আমরা যারা শাহরিয়ারের বন্ধুবান্ধব, আমরা ভেবে নিয়েছি শাহরিয়ারকে আর পাওয়া যাবে না। তবে ওর মা অবশ্য বলেন, ‘বাবা, টাকা যখন চেয়েছে, তখন বেঁচে আছে।’ টাকা দিয়ে তিনি ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা করেন। তিনি তাঁর সমস্ত আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা ধার করেন আর মোবাইল হাতে অপেক্ষায় থাকেন।

সাত.
এক মাস সাত দিন পেরিয়ে গেল। কোনো খোঁজ নেই। হঠাৎ পুলিশের কাছ থেকে ফোন এল, সায়েদাবাদে শাহরিয়ারকে পাওয়া গেছে। বেলা তিনটায় সংবাদ সম্মেলন।

সংবাদ সম্মেলনের জন্য নির্ধারিত কক্ষে পুলিশ বেষ্টিত শাহরিয়ার প্রবেশ করলে মায়ের কোল ছেড়ে ‘বাবা’ বলে দৌড়ে যায় তূর্য । কিন্তু তাকে আমাদের ফিরিয়ে আনতে হয়, নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য। শাহরিয়ারের মুখ এক মাসের দাড়িতে ঢাকা। তার মুখে হয়তো ক্লান্তির ছাপ ছিল। কিন্তু তবুও ওকে দেখে দারুণ ভালো লাগে আমাদের। বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আকুতিতে আমরা তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। শাহরিয়ার কার দিকে তাকিয়ে? ওর মা-বাবা, সন্তান নাকি স্ত্রীর দিকে? বুঝতে পারি না। শূন্য দৃষ্টি মনে হয়; গতকাল মাছবাজার থেকে কেনা রুই মাছের মৃত অথচ চকচকে চোখের মতো। ওর চোখে কোনো ভাষা নেই, যা থেকে অজ্ঞাতবাসের কষ্টকে আঁচ করা যায়। মনে হয়, ও হয়তো এখনো কেবলই শান্তি চায়। আমাদের চাওয়া তো ওই একটি শব্দের মধ্যেই আটকে আছে।

শাহরিয়ার যা বলে তা শুনে আমাদের গত এক মাসের উদ্বেগের কোনো হদিস মেলে না। কেমন একটা অচেনা কণ্ঠে ও বলে, ‘আমার কিছু ভালো লাগে না।’

এ কথায় নড়েচড়ে বসে উপস্থিত সবাই। শাহরিয়ারের কেসটা মিডিয়াতে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। তারা কেউ ক্যামেরা হাতে, কেউ নোটপ্যাড নিয়ে প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত। রহস্য উন্মোচনের জন্য উদ্‌গ্রীব। অথচ শাহরিয়ার নির্লিপ্ত স্বরে বলে যায়, ‘শহরের এত যানজট আমার ভালো লাগে না। তাই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, হাওয়া খেতে!’

হাওয়া খেতে! সবার মধ্যে একটা হাসির রোল পড়ে যায়। এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘হাওয়া খাওয়ার জন্য কি আপনার ৪০ লাখ টাকাও দরকার ছিল?’

আরেকজন বলেন, ‘নিজের জন্য মুক্তিপণ? সত্যি কথাটা বলুন। আপনার ভয় কিসের? বলুন। আমাদের সামনে, মিডিয়ার সামনে।’

এবার শাহরিয়ার খুব রেগে যায়, ‘কি যা-তা বলছেন? এই দেশে কি মানুষ একটু হাওয়া খেতে যেতে পারবে না?’

এরপর ঘরজুড়ে শুরু হয় ফিসফাস, বিভিন্ন গুঞ্জন ডালপালা মেলে। পুলিশ সবাইকে জানায়, সে বেশ ট্রমার মধ্যে আছে। কেন? তা খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।

আমরা আমাদের ভেতর থেকে বদ্ধ বাতাস বের করে, বলি, ‘যাক, কিছুটা হাওয়া খেয়ে ও ফিরে এসেছে। এই তো অনেক!’

সূত্র: প্রথম আলো

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত