ডুমুরের ফুল এবং সাপের পাঁচ পা

ডুমুরের ফুল আর সাপের পাঁচ পা দেখা নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। তবে ওই দুই জিনিসই কখনো চোখে দেখা যায় না। কেউ কখনো দেখেনি। আমি অন্তত এতদিন সেটাই জানতাম। কিন্তু হঠাৎ করে আন্দু আমাকে বলল, ডুমুরের ফুল দেখবি?

আন্দু আমাদের বন্ধু। তার কথায় আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তুই একটা পাগল নাকি! ডুমুরের ফুল হয় নাকি যে তুই আমায় দেখাবি?

আন্দু বলল, হয় রে হয়! দেখার চোখ থাকলে দেখাও যায়। আমি আজকাল রোজ দেখি।

ছোঁড়া বলে কী? ডুমুরের ফুল হয়, সেই ফুল আবার সে দেখতে পায়! ছোঁড়া কি তবে সত্যিই পাগল হয়ে গেল?

আন্দুর কথা আমার বিশ্বাস হয় না। তাকে আমি বলি, চল – কোথায় ডুমুরের ফুল আছে আমি দেখব।

আন্দু বলল, আজ নয়, কাল দেখাব তোকে। ঠিক দশটার সময় রেডি থাকিস।

– ঠিক আছে রেডি থাকব। কথার খেলাপ করবি না কিন্তু।

– কথা খেলাপের কী আছে? আমি রোজ দেখি। তুই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। না হয় তুইও একদিন দেখলি। তাছাড়া একা দেখে সুখ হয় না, সঙ্গে কেউ থাকলে বেশি সুখ পাওয়া যায়।

আন্দুর এমন কথায় আমার গর্ব হয়। সে যে আমাকে এত পাত্তা দেয়, বন্ধু ভাবে – এর আগে কখনো বুঝতে পারিনি। তাই হয়তো আন্দুর ডুমুরের ফুল দেখার গল্পটা আমি বিশ্বাস করে বসি।

আন্দু আমাদের গ্রামের ছেলে। আমার বয়সী। বলতে গেলে আমরা একসঙ্গে জন্মেছি – একসঙ্গেই বেড়ে উঠছি। তাই ওকে আমি যতটা জানি, আর কেউ জানে না। এমনকি ওর মা সখী বেওয়া পর্যন্ত জানে না। সখী বেওয়া জানবে কী করে, সে তো স্বামী-মরা, চাকরি করে বেড়ায়, শহরে যায় চাকরি করতে। সেই ফজরের নামাজের আজান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে মাগরিবের নামাজের আজানের পর।

আন্দু যখন খুব ছোট ছিল সেও মায়ের সঙ্গে যেত। শহরের ইংলিশ মিডিয়াম ইশকুলে পড়ত। কিন্তু যেই সে বিড়ি-সিগারেট টানতে শিখল, মায়ের সঙ্গ ছেড়ে দিলো। আজকাল সে আর স্কুলে যায় না। আমরা যখন গ্রামের ইশ্কুলে পড়তে যাই, সে তখন ডোমকুল-মাঠে তার রাখালবন্ধুদের সঙ্গে খেলে বেড়ায়। পাখপাখালি শিকার করে। কিংবা বিল-ডোমকুলের নহরে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। সেইসব মাছ আবার ওই মাঠেই রাখালবন্ধুদের সঙ্গে পুড়িয়ে খায়। আরো অনেক ব্যাপারস্যাপার আছে তার।

শুধু বিকেলবেলা সে আমাদের সঙ্গী হয়, দরগার মাঠে যখন আমরা একসঙ্গে ফুটবল খেলি কিংবা গুলিডাণ্ডা। আমাদের সঙ্গে আরো অনেকেই খেলে। কিন্তু আন্দুর সঙ্গে আমরা কেউ কোনো খেলাতেই কখনো পেরে উঠি না। সবকিছুতে সে একাই একশ। সত্যি কথা বলতে আমরা প্রত্যেকেই তাকে রীতিমতো সমীহ করে চলি। সমীহ না করে আমাদের কোনো উপায় থাকে না। আমরা জানি, এই বয়সে সে যা যা করে বেড়ায় তার জন্য যে সাহস লাগে তা আমাদের কারোর নেই।

যেমন দরগার মাঠের সেই জঙ্গলে গোদানা আছে। এটা আমরা সকলেই জানি। তাই সন্ধ্যার আগে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসি। আন্দু কিন্তু ফিরে আসে না। একা একা বসে থাকে। বিড়ি টানে। স্বভাবতই এই বয়সে আমাদের চোখে আন্দু রীতিমতো হিরো সালমান খান। না হলে পরদিন আমি হঠাৎ করে তার সঙ্গী হয়ে ডুমুরের ফুল দেখতে যেতে রাজি হবো কেন?

দুই

আমার স্কুল ছিল। বাড়ি থেকে স্কুলে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে আমি দরগাতলায় এসে বসে আছি। আন্দু আমাকে এখানেই আসতে বলেছে; কিন্তু কোথায় সে? এখনো তার পাত্তা নেই কেন? আমার যে ভয় করছে! ঘুরেফিরে মনে পড়ছে আমি যেখানে বসে আন্দুর অপেক্ষা করছি, জায়গাটার নাম দরগাতলা। এখানে জিনের একরাত্রে তৈরি একটা ইঁদারা আর একটা মসজিদ আছে। যদিও এখন দুটোই পরিত্যক্ত। একটা বিশাল বটগাছ ঝুরি নামিয়ে দুটোকেই ঢেকে রেখেছে। আর এসবের দখল নিয়ে রেখেছে একটা শয়তান গোদানা। ভেতরে প্রবেশের কোনো পথ নেই। কেউ প্রবেশ করতে চাইলেও পারে না, ওই গোদানার ভয়ে। গোদানাটা নাকি পাহারা দেয় জায়গাটা। কেউ প্রবেশ করলে তার আর রক্ষে থাকে না। মুরব্বিরা গল্প করে, বহুদিন আগে ডিহিপাড়ার বাশেদ সেখ নামে একজনকে ঘাড় মটকে মেরে ফেলেছিল ওই গোদানাতেই।

আন্দুর অপেক্ষা করতে করতে গোদানার ভয় আমাকে ঘিরে ধরছে। আমাদের স্কুলটা এখন থেকে খুব বেশি দূরে নয়, শেষ পর্যন্ত স্কুলেই চলে যাব কি না ভাবছি। হঠাৎ দেখি আন্দুকে। কী একটা গান গুনগুন করতে করতে চামাবেড়ার ডিহির ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে।

বুঝতে পারি যেখানে আতঙ্ক, সেখানেই আন্দু। সাধারণত আমরা কেউ চামাবেড়ার ডিহি মাড়াই না। আমরা জানি, যত অপদেবতার আশ্রয় নাকি ওই ডিহিতেই। আমাদের গ্রাম, এমনকি আশপাশের গ্রামে যদি কারো ওপর অপদেবতা ভর করে, দুলহাবুড়ি কিংবা সায়েদ ওঝার তাড়া খেয়ে তারা আশ্রয় নেয় ওই ডিহিতেই। তাই নাকি সেখানে কোনো আবাদ হয় না, ফসল ফলে না। সারাবছর অনাবাদি পড়ে থাকে। বাড়ির গরু-ছাগল-কুকুর-হাঁস-মুরগি মরলে ফেলে আসা হয় সেখানে। অথচ আন্দু বলে, ওরকম ডিহি নাকি দুনিয়ায় আর একটিও নেই।

একদিন আন্দুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুনিয়ায় কেন নেই ওরকম আর একটি ডিহি?

কোনো জবাব দেয়নি সে। বদলে একদিন সে আমাকে নিয়ে গেছিল ওই ডিহিতে। আমি দেখেছিলাম সেই ডিহি। অদ্ভুত জায়গা বটে। মাটি যা আছে তার চেয়ে বেশি আছে খোলামকুচি। সবুজের চিহ্ন নেই। গাছ বলতে যা আছে কাঁটাঝোপ আর দু-চারটে বাবলা গাছ। যেগুলোর ডালে সর্বক্ষণ কাক-শকুন বসে থাকে লোলুপদৃষ্টি মেলে। অথচ বৃষ্টি হলে নাকি ওই ডিহি ফুঁড়ে চাঁদির মোহর উঠে আসে। সেই গল্পও করছিল আন্দু। শুধু গল্পই করেনি, পকেট থেকে একটা চাঁদির মোহর বের করে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল, জানিস – কালিপালের ডিহিতে পাওয়া এরকম মোহর আমার কাছে প্রচুর আছে।

শেষ পর্যন্ত আন্দু যখন আমার কাছে এলো, দেখলাম তার দুই হাতে আলতো করে ধরা একটা ফুটফুটে ফড়িং। আমি কিছু বলার আগেই সে বলতে শুরু করল, জানিস বন্ধু – এটা আমার একটা নতুন খেলা। এই খেলার নাম ফড়িংধরা খেলা। এর একটা একটা করে পাখনা ছিঁড়ে এর মৃত্যু দেখতে আজকাল আমার খুব ভালো লাগে। হয়তো জিজ্ঞেস করবি, এমন নিষ্ঠুর খেলার শখ আবার আমার হলো কী করে? তার উত্তরে বলি, খেলাটা নিষ্ঠুর বটে। তবে খুব মজার। আর এ-খেলার শখটা আমার এমনি এমনি হয়নি। তুই জানিস – একসময় আমার প্রিয় শখ ছিল পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা। সেটাও একটা নিষ্ঠুর খেলা। যদিও মানুষ তা স্বীকার করবে না। মাছেভাতে বাঙালি একটা কথা আছে না! সেটা অন্য প্রসঙ্গ। যাই হোক, আমি ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে চেয়ে থাকতাম আর অপেক্ষা করতাম, কখন মাছ বড়শির টোপে মুখ দেবে আর আমি আমার হাতে ধরা ছিপে মারব খাঁচ আর উঠে আসবে মাছ! কিন্তু তার আগেই কোথা থেকে ফড়িং উড়ে এসে বসল জলে ভাসা আমার ছিপের ফাতনার ওপর। ফাতনা নড়ে যেত। আমি ভাবতাম মাছ বড়শির টোপে মুখ দিয়েছে। ছিপে খাঁচ মারতাম। অথচ শূন্য বড়শি উঠে আসত আমার হাতে, আমার ভীষণ খারাপ লাগত। খুব রাগ হতো।

সেই রাগ থেকেই আমার ছিপে মাছ ধরার শখ কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন আমি ফড়িংয়ের পেছনে পড়ে থাকি। যেখানেই ফড়িং দেখি, খুব ধৈর্য ধরে আগে সেটাকে ধরি। তারপর তার একটা একটা করে পাখনা ছিঁড়ি। সে ছটফট করতে থাকে, কিন্তু আমি তারিয়ে তারিয়ে তার মৃত্যু দেখি। আজ অবশ্য ধৈর্য ধরে শুধু ফড়িংটাকে ধরেছি মাত্র। তারপর ডুমুরের ফুল দেখাব বলে তোকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি ব্যাপারটা মনে পড়তেই একে সঙ্গে করে নিয়ে সরাসরি তোর কাছে চলে এলাম। এই বিরান মাঠে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে যদি তুই ভয় পাস! কে জানে, ওই জঙ্গলের গোদানা যদি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে তোর ঘাড় মটকে দেয়।

আন্দু বলল, আর একটু দাঁড়া। আগে এটাকে সাপের পাঁচ পা দেখিয়ে নিয়ে আসি। তারপর তোকে ডুমুরের ফুল দেখাব। বলেই আন্দু ফড়িংটাকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ংকর জঙ্গলটার ভেতর ঢুকে গেল।

তিন

আন্দুকে আমার কেমন লাগে! তার কথা যেন আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি না। তার কথায় ডুমুরের ফুল দেখতে এসে আমি কোনো ভুল করিনি তো? আমার পিঠে স্কুলব্যাগ। অথচ আমি স্কুলের বদলে ডুমুরের ফুল দেখব বলে বিরান মাঠের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছি। যার একদিকে দরগাতলার সেই ভয়ংকর জঙ্গল। আর একদিকে যতসব অপদেবতার আশ্রয় ওই চামাবেড়ার ডিহি।

নিজের অবস্থান টের পেতেই আমি ডুমুরের ফুল দেখার কথা ভুলে যাই। আর আমার মনে পড়ে সেই গোদানাটাকে, যে ওই জঙ্গলটা পাহারা দেয়। যার বিনা অনুমতিতে ওই জঙ্গলে কেউ প্রবেশ করতে পারে না, করলেই ঘাড় মটকে মেরে ফেলে। যেমন বহুদিন আগে বাশেদ সেখকে মেরে ফেলেছিল। তাহলে যে আন্দু ফড়িংকে সঙ্গে করে ওই জঙ্গলে গিয়েই প্রবেশ করল! যদি তার কিছু হয়ে যায়! যদি ছোঁড়া মরে যায়!

আন্দুর ভাবনা ভাবতে গিয়ে আমার ভীষণ ভয় করতে শুরু করল। দুপাশে দুই বিপদ নিয়ে আমি আর দরগার বিরান মাঠে একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, প্রাণভয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করলাম।

চার

যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো, দেখলাম আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। আমাকে ঘিরে আছে আমার আত্মীয়স্বজন। তাদের সবার চোখেমুখে আতঙ্ক! আমার কী হয়েছে বুঝতে পারি না। সময়টা ভোর হতে পারে, আবার সন্ধ্যাও। তা বলে ফজরের কিংবা মাগরিবের নামাজের আজান শুনতে পাই না, তার বদলে আমার কানে আমাদের প্রতিবেশী কাদুখালার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। খুব করুণ স্বরে কাদুখালা কাঁদছে। কাদুখালা কাঁদছে কেন? আমি জিজ্ঞেস করি, কাদুখালার কী হলো যে এভাবে কাঁদছে?

আমার মা বসেছিলেন আমার মাথার কাছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, অর বিটি ফড়িংকে জি দরগার জঙ্গলে গোদানায় মেরে ফেলেছে বেটা।

এতক্ষণে বুঝতে পারি, আন্দু আমাকে শুধু ডুমুরের ফুল দেখায়নি, সাপের পাঁচ পা-ও দেখিয়েছে। কিন্তু সে-কথা আমি কাউকে বলতে পারি না।

সূত্র: কালিও কলাম

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত