ওর কথা দেবু অনেক শুনেছে। চোখে দেখেনি। তবে একবার চোখে দেখার বড় সাধ। মানে একটু পরীক্ষা করে দেখা। এবার পূজায় সেই সুযোগটা এসে গেল। অবশ্য সুযোগ না বলে একে ‘দুর্যোগ’ বলাই ভালো। বড়দের মুখে গুপীদার গুণের কথা এত শুনেছে যে কর গুনে শেষ করতে পারেনি। কান প্রায় ঝালাপালা। এখন ওই নাম শুনলেই গা জ্বলে। ওর জন্য দেবুকে বিভিন্ন সময় কম কথা শুনতে হয়নি। পরীক্ষায় একটু খারাপ করলেই মা খেপে ওঠেন, ‘গুপীনাথকে দ্যাখ! শুনেছি এবারও ফার্স্ট হয়েছে। আর তুই!’
গতবার স্কুলে স্পোর্টস কম্পিটিশনে অল্পের জন্য দৌড়ে হেরে গিয়েছিল। ছোট কাকা সবার সামনেই তিরস্কার করলেন, ‘এবার গুপীনাথ এলে ওর পায়ে ধোয়া জল খাস। তাতে যদি কিছু হয়।’
‘আরে হবে হবে, বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ বাবাই শুধু গুপীকে বুঝতে পারেন। অন্যরা সে কথা মানতেই চায় না। অবশ্য উপদেশ মেনে চলবে এমন ছেলে সে নয়। দাদুর একটা কথা দেবুর মনে ধরেছে। দাদু বলেছেন, ‘মানুষ হতে হলে আগে রাজহাঁসের মতো হতে হবে।’
মানুষ আবার হাঁস হয় কীভাবে? দেবু প্রথমে বুঝতে পারেনি। দাদু বুঝিয়ে বলেছেন, ‘তাহলে জীবনে চলার পথে নোংরা কাদাজল শরীরে লাগবে না।’
কথাটা দেবু মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছে। কাউকে বুঝতে দেয় না। সুযোগ পেলে সে–ও একদিন দেখিয়ে দেবে। কিন্তু সুযোগটা কীভাবে পেতে হয়, এটাই তার অজানা।
গুপীনাথ দেবুর কাকাতো ভাই, ঢাকায় থাকে। সে পড়াশোনায় ভালো, স্কুলের স্পোর্টসে মেডেল পায়, ডিবেটে নাকি হারেনি কখনো; তাই বলে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করে না। পড়ার কথা ওকে বলতেই হয় না। নিয়ম করে স্কুলে যায়। এককথায়—ভেরি ভেরি গুড বয়!
‘আর আমি?’
‘তুমিও গুড বয়।’ বাবা পেছন থেকে এসে দেবুর কাঁধে হাত রাখেন।
‘গুড না ছাই।’ মা রাগে গজগজ করেন, ‘ব্রহ্মার বড় পেয়ে মহিষাসুর মাথায় উঠেছিল। তোমার লাই পেয়ে ও মাথায় উঠছে এই আমি বলে দিলাম।’
বাবা হেসে বলেন, ‘মহিষাসুরকে শায়েস্তা করেছিল কে?’
‘দুর্গা।’ চট করে উত্তর দেয় দেবু।
‘এ সংসারেও ভগবতী যখন আছেন, তখন আর চিন্তা কী! তাঁর সন্তান তিনিই দেখবেন।’ বাবা এমনভাবে বলেন, যেন মাথা থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেল। তারপর দেবুর দিকে ফিরে তাড়া দেন, ‘চটপট তৈরি হয়ে নাও। ঢাকা থেকে গুপীনাথ আসছে। ওকে কিন্তু তোমাকেই পূজামণ্ডপ ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।’
‘তা তো দেখবই। কিন্তু আঙ্কেল, ভগবতী কে?’ প্রশ্ন করতে করতে ঘরে ঢোকে গুপীনাথ। তার চেহারাজুড়ে কৌতূহল।
এই তাহলে গুপীনাথ! দেবু সতর্ক হয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয় একবার। ঢাকের কাঠির মতো লম্বা, পাতলা গড়ন। কোঁকড়ানো চুল, টিকালো নাক। মা বলেছিলেন, কার্তিকের মতো দেখতে। কই, তেমন তো লাগছে না। তবে হ্যাঁ, চোখ দুটো বেশ; সাদা গোল বাতাসার মধ্যে একটা করে নারকেলের নাড়ু। আর দ্যাখো না, ঘরে ঢুকেই কেমন বড়দের মতো প্রশ্ন করছে। পাশেই যে দেবু দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তার নজরই নেই!
বাবা ওকে বুকে টেনে নিলেন। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আগে হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করো। ভগবতীর সংসারে যখন এসেছ, তখন নিজেই জানতে পারবে।’ তারপর দেবুকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে চিনতে পেরেছ? চিনবেই বা কী করে; ফোনে তোমাদের কথা হয়েছে, দেখা হয়নি। ও দেবাশীষ।’
‘ও তাই!’ বলেই গুপীনাথ দেবুর কাঁধ ধরে এমন ঝাঁকুনি দিল যে শরীরের হাড়গুলো নড়ে উঠল। তারপরই বলে কিনা, ‘আমি কিন্তু তোমাকে দেবু ডাকব।’
‘হ্যাঁ, তাই ডেকো।’ বাবা সায় দিলেন।
দেবুর কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগল না। সে চট করে বলল, ‘তাহলে আমি তোমাকে ডাকব গুপী বলে।’
‘উহু, গুপী নয়, গুপীদা।’ বাবা শুধরে দিলেন।
‘উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে যোগ দিতে দিতে গুপীনাথ বলল, ‘অলরাইট। এবার চলো, মায়ের মুখটা একবার দেখে আসি।’
মা না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। সুতরাং খাওয়ার পর দুজন বের হলো ঠাকুর দেখতে। প্রথম মণ্ডপে এসেই চোখ কপালে তুলে থমকে দাঁড়াল গুপীনাথ।
‘আরে! এখানে দুর্গার সঙ্গে বাঘ কেন?’
দেবু বিজ্ঞের মতো বলল, ‘বাঘ যেমন শক্তিশালী, সিংহও তা–ই। সমস্যা কী?’
‘সমস্যা ঠিক নয়, তবে…।’ গুপীনাথ দেবুর দিকে ফিরে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা, তুমিই বলো, দেবী দুর্গা সিংহের পিঠে চড়েন বলেই তিনি সিংহবাহিনী। তাহলে এই বাঘ এল কোত্থেকে?’
দেবু এভাবে কখনো ভাবেনি। দুর্গাপূজার প্রায় সব কাহিনি সে দাদুর মুখ থেকে শুনেছে। কিন্তু এর উত্তর কী হতে পারে, ভাবতে ভাবতেই ছোট কাকার সঙ্গে দেখা। তিনিই বললেন এর কারণ: ‘দুর্গাপূজার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বর্তমানে প্রচলিত প্রতিমা পূজায় নতুন অনেক কিছু যোগ হয়েছে। দিন বদলেছে। মানুষের ভাবনা বদলেছে। যেহেতু আমাদের জাতীয় পশু বেঙ্গল টাইগার। আমাদের শৌর্যবীর্যের প্রতীক বাঘ। তাই এখানে সেই প্রতীককেই মায়ের বাহিনীরূপে কল্পনা করা হয়েছে।’
গোপীনাথের মুখ মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে মুচকি হেসে দেবুকে বলল, ‘দেখলে তো, প্রশ্ন না করলে কখনো উত্তর পাওয়া যায় না। আর উত্তর না পেলে জানবে কীভাবে?’
‘ঠিক। আর এইটিই হচ্ছে আমাদের গোপীনাথের সবচেয়ে বড় গুণ।’ ছোট কাকা হেসে বললেন।
দেবুর গুণও যে একেবারে কম নেই, সম্ভবত এ কথার প্রমাণ দিতেই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আমি দেবী দুর্গার আট হাতের ছবিও দেখেছি।’
‘হ্যাঁ, তবে আমাদের মা দশভুজা। দশ হাতে তিনি দশ দিক সামলান। দশ হাতে তার নয় অস্ত্র।’
দেবু ব্যাপারটি আগে খেয়াল করেনি। সে বলল, ‘এক হাতে অস্ত্র নেই কেন?’
‘ওটা আশীর্বাদের হাত।’ ছোট কাকা বুঝিয়ে বললেন, ‘এক মায়ের যে কত রূপ, কত নাম, বলে শেষ করা যাবে না। চণ্ডী, কালী, পার্বতী, উমা, শঙ্করী, অম্বিকা, ভগবতী।’
‘ভগবতী!’ দেবু ও গুপী দুজনেই একসঙ্গে চমকে উঠল। কথা বলতে বলতে তারা কখন বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে বাবার গলা শোনা গেল—‘ভগবতী দ্যাখো তো কে এল?’
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। সামনে মা দাঁড়িয়ে।
সূত্র : প্রথম আলো