সুলতান আহমদ দড়ির চৌপায়া ডিঙিয়ে ঘরে ঢোকে। সেই সাথে বৃদ্ধ দাদা রহমতুল্লাহকেও ডিঙিয়ে যায়। পুরা দুয়ারজুড়েই তো রহমতুল্লাহর শয্যা পাতা। তাঁর ছ ফুট দেহটা জোড়া-জাড়ি ছেড়ে আরও বিঘৎখানেক লম্বা হয়ে যাওয়ায়, চৌপায়া ছাপিয়ে বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা ইস্তক বেদখল হয়ে গেছে। জর্দা-রঙা আলোয়ানের তলায় তিনি যেন জিন্দা লাশ, শুধু বুকের কাছটা নদীকূলের দূর্বাঘাসের মতো দুলছে মৃদু মৃদু।
আহমদ ঘরের বেড়ায় লটকানো আরশিতে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়। পকেট হাতড়ে চিরুনি বের করে। হেয়ার জেল আর ধুলাবালিতে চুল সব আঠা আঠা। চিরুনি চালালে শজারুর কাঁটার মতো খাঁড়া হয়ে ওঠে। বিরক্তিতে পান খাওয়া দাঁতের পাটি যখন বেরিয়ে আসার জোগাড়, চিরুনি চালানো ক্ষান্তি দিয়ে পেছন ফেরে সে। তখন ওর নজর আটকে যায় রহমতুল্লাহর প্যাঁচানো ভুরুর নিচের আর্দ্র চোখ দুটিতে। দাদার দুপুরের নিদ্রা-ঘোর ভাঙল বুঝি আহমদের পদশব্দে।
‘কখন এলি, আহমদ?’
‘এলাম তো বিহানে। ফের যাওয়ার আনজাম করছি।’
বিহান থেকে আহমদের বাদামি ব্যাগটা মেঝেতে পড়ে আছে—তালা মারা। বাস কোম্পানির ট্যাগটাও খোলা হয় নাই। চোখের সামনে এসব নিশানা থাকতে দাদার শ্বাসেরও আওয়াজ নাই। নাতি হেঁয়ালি করছে ভেবে রহমতুল্লাহ কি ফের নিদ্রা গেলেন!
‘এক মিনিটও আমি আর এ জাহান্নামে থাকতে চাই না।’ এবার আয়নার বুকে চোখ রেখে জোরে জোরে বলে আহমদ। যদিও জানে ওর এ কথায় দাদার নিদেন বছরখানেক হায়াত কমবে। এটি ওর বাচপানকালের গৃহত্যাগের আধো আধো মিঠা বোল নয় যে, হেসে গড়াগড়ি খাবে ক্যাম্পচুক্তি লোকজন। ছোটবেলায় ভুখ লাগলে আহমদ বলত, ও মিরপুরের খালে ডুব দিয়ে সিলেট শাহজালালের দরগার পুকুরে ভুশ করে ভেসে উঠবে। পুকুরে মানতির খাবারের কমতি নাই। রাত-দিন শ্যাওলা ধরা শতায়ু শোল মাছের হাঁ বরাবর পাড় থেকে এটা-সেটা ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই খানায় ভাগ বসাবে আহমদ। তারপর মহানন্দে পানিতে দাপাদাপি, মাছের সঙ্গে বসবাস।
এই গল্পখানা হিট হয়। তা শোনাতে ক্যাম্পের গলিতে গলিতে হামেশাই ডাক পড়ত আহমদের। শোনানোর আগে-পরে মুঠো-মুঠো ভাজা কড়াই, তা ছাড়া চিনির বাতাসা ইনাম মিলত কদাচিৎ।
এখন বাতাসার বদলি জুতার বাড়ি। খোদার বিহানে ওর দেশত্যাগের কথাটা শুনে কাগজের পার্টিশানের ওপাশ থেকে বড় বোন কানিজ ফাতিমা তেড়ে আসে। সেলাইকলের ভনভনানি থামিয়ে তার সে কী হম্বিতম্বি! আহমদ নিজের তক্তপোশে বসে পা দোলাতে দোলাতে পান-রাঙা দাঁতে হাসে। এবারে পাতালপথে শতায়ু মাছের মাঝে উজিয়ে ওঠার মতো অলীক কিছু নয়। স্থলপথে ভারত সফর আহমদের চোখ খুলে দিয়েছে। জাহান্নাম থেকে বেরোবার ঠিকানা পেয়ে গেছে আহমদ। আর সেটা তার বাপ-দাদার ভিটা বিহারের ছাপড়া।
‘পুকুরপাড়ে বাপদাদার কবরস্থান। তার গায়ে তেঁতুলগাছ।’ রাত গভীর হলে কানিজ ফাতিমার কান বাঁচিয়ে রহমতুল্লাহ কিসসা জুড়ে দেন। আহমদের এ হাজারবার শোনা গল্প। তবে কিনা এ বয়ানের পরই আজ শুরু হবে সওয়াল, যার জওয়াব হতে হবে একদম সহি। আহমদ দাদার দিকে পাশ ফিরতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় এনার্জি সেভিং বাল্বের ধবধবা সাদা আলোয়, যা সম্প্রতি আজরাইলের ভয়ে সারা রাত জ্বেলে রাখেন রহমতুল্লাহ।
‘এ সনে তেঁতুলগাছে ফুল ফুটছে, আহমদ?’ দাদার বেতফলের মতো ঘোলা চোখ নাতির কটা নয়নে নিবদ্ধ। ‘আর গাঁয়ের মাঝখানের ঝুড়িনামা বটগাছটা আছে, না কাটা পড়ছে? তুই নিজের চক্ষে দেখে আইছিস, ভাইজান?’
এ ঝুড়িনামা বটের নিচে গ্রামের সালিস-দরবার বসত। ফুলেল শামিয়ানা টাঙিয়ে খিচুড়ি পাকানো হতো মহররমের ১০ তারিখে। ধর্মীয় আলোচনা, শাদির ঘটকালি—সব ধরনের সভা-জমায়েতই হতো বটের ছায়ায় ফরাস পেতে। আর সেসব দিনে খাজা-গজার বিক্রি বেড়ে যেত রহমতুল্লাহর আব্বাজানের।
বটগাছ তলায় একটা টং দোকান ছিল বটে আহমদের বড় আব্বার। সে দাদার মুখে আগেও শুনেছে। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় দোকানটা লুট হয়। বড় আব্বার লাশটা পড়ে পড়ে পচে খালি খাজা-গজার বস্তার মাঝখানে। সেই বস্তায় পুরেই বিনা গোসলে তাঁকে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে।
‘আরে ও আহমদ, তুমি নিদ গেলা নাকি, ভাইয়্যা?’ সারা দিন পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে রাতে রহমতুল্লাহর গলার জোর বেড়েছে খুব। আজকাল কাশির গমকও নাই বিশেষ। ওদিকে আহমদ খামোশ। যেহেতু ভারত সফরকালে সে বিহারের ছাপড়ার ছায়াও মাড়ায় নাই, খানিক বাদে বানিয়ে বানিয়ে এটা-সেটা বলে দাদার সওয়ালের জবাব দেওয়ার কোশিশ করে। এখন কি তেঁতুল ফুল ফোটার মৌসুম? নাকি ফুটে ফুটে ঝরে গেছে? গাছপালার বেড়ে ওঠা, ফুল ফোটানো, ফল ফলানোর মাস-ঋতুর হিসাব জানে না আহমদ। সে জন্মেছে, বড় হয়েছে বৃক্ষশূন্য, পুকুরপাড়হীন জনাকীর্ণ ক্যাম্পের উদলা ড্রেনের ধারের ঘুপচি ঘরে। ক্যাম্পের চৌহদ্দির বাইরেও গিয়েছে কদাচিৎ। আর দেশের বাইরে তো সবুজ পাসপোর্ট মেলার পর এই প্রথম। সেটা ভারত হলেও বাপদাদার ভিটা ছাপড়ায় নয়।
কলকাতা থেকে সোজা কালকা মেলের টিকিট কেটে দিল্লি। রাতে ঘুম ভেঙে আহমদ শুনেছে ট্রেনটা ঝমঝমিয়ে বিহার রাজ্যের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। চটজলদি জানালায় মুখ বাড়াতে গরম হাওয়ার ঝাপটা লাগে। চোখের সামনে কয়লা-কালো জমাট আঁধার। তার মাঝে দূরে দূরে আলোর ফুটকি। এ নিরাকার দৃশ্যে কী যেন এক অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া ছিল, আহমদের ঘুম-ভাঙা চোখ ছলছল করে ওঠে।
ট্রেন থামলে রাতের ঠাঁই নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগা। দিনের আলো ফুটতে দিল্লির জামে মসজিদ, চাঁদনি চক। সকালের নাশতায় এমন স্বাদের লাচ্ছি কখনো খায় নাই আহমদ। আর রাবড়ি তো জিন্দেগিতেই এই প্রথম। কী যে স্বাদ! ঢেকুরটাও মিঠা মিঠা। আহমদ মিঠা ঢেকুর তুলে মিঠা সুরের হিন্দিগান শিস দিয়ে গাইতে গাইতে পুরান দিল্লির পাথুরে গলিতে হাঁটে।
‘আমি ইন্ডিয়ায় মনের সাধ মিটাইয়া নিজের জবানে কথা কইছি, দাদা।’ রহমতুল্লাহর পুরানা দিনের কাহিনি পাশ কাটিয়ে হালের দিল্লির গল্প ফাঁদে আহমদ, তা পুরান দিল্লি যদিও। ‘গানও গাইছি চিল্লাইয়া ফাল্লাইয়া। আমার উর্দু বোল শুনে কেউ বিহাইর্যা বলে গালি দেয় নাই। শহরের চিপা চিপা গলিতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হইছে নিজের বাড়ির উঠান দিয়া রাজার হালে যাইতেছি। আমি নিজ মকানের তালাশ পাইছি, দাদা। কসম খাও, কানিজ ফাতিমার মতো বাধা দিবা না!’
পুরান দিল্লি, ১৯৪৭ সাল। মানুষের লাশ কুকুরেও খায় নাই। তা অবশ্য রহমতুল্লাহ নিজের চোখে দেখেন নাই। কিন্তু ছাপড়ায় যা দেখেছেন তা-ই যথেষ্ট—মরা নখে পিঁচুটি খুঁটতে খুঁটতে ভাবেন রহমতুল্লাহ। আর তা ‘বিহারে অন্ধকার দিওয়ালি পালন করা হয়; মসজিদে মসজিদে বলা হয়, ওদের শোক আমাদের উৎসব’—এ দস্তুরের কাগুজে আলাপের মতো নয়। সেদিন বটের ঝুরি ধরে রহমতুল্লাহর সমবয়সীরা দোল খায় নাই। উত্তুরে হাওয়ার শীত শীত আমেজে শামিয়ানা টাঙিয়ে উৎসব-অনুষ্ঠানের দিনের মতো গোলাপ-পানি, জাফরান ছড়ানো সুগন্ধি খানাও পাকানো হয় নাই। যদিও বিস্তর লোক সমাগম হয়েছিল। ওরা এসেছিল ভোজালি, ছুরি, লোহার রড হাতে। দিনভর দূরে দূরে বন্দেমাতরম স্লোগান। এ পাশ থেকেও নাড়া দেয় আল্লাহু আকবর। রহমতুল্লাহর বয়সী কিশোর-কিশোরীরা দিনমান তামাশা দেখেছে। রাত হলে যে যার ঘরে ফেরে। মা মাটির বাসনে খানা বেড়ে রহমতুল্লাহর আব্বার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারপরই গুলির শব্দ। চিৎকার-চেঁচামেচি। আগুন-ধোঁয়া। ফটফট বাঁশ ফাটার মতো আওয়াজ। যন্ত্রণার কাতরানি। দুদিন বাদে শুষ্ক কুয়া থেকে রহমতুল্লাহকে উদ্ধার করে ফেরেশতার মতো সাদা পোশাকধারী ভলান্টিয়াররা।
‘লায়েক নাতি এক পাক ঘুরেই হিন্দুস্থান খুব চিনে ফেলছে!’ ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলে অন্ধকারে গজগজ করেন রহমতুল্লাহ। ‘দেশটার মসৃণ চামড়ার নিচেই তো দগদগে ঘা, পুঁজ, রক্ত, কান্না।’ রহমতুল্লাহ ছাপড়া নিয়ে স্মৃতিকাতর হলেও কায়মনে ‘স্ট্যান্ডেট’ পাকিস্তানি। তা ছিলেন বহুদিন। আর এখন তো মওতের অপেক্ষায়। তাঁর স্ট্রোক করে বেনজির সরকারের ‘বিহারিদের পাকিস্তান নেবে না’ ঘোষণার রাতে। সেই রাতে তিনি নিজেকে দেখেন একটা নোংরা ইজের পরে ছাপড়ার বাড়ির উঠানে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বাটকে রাহেগা হিন্দুস্থান।’ বাড়ির পাশে পুদিনাখেত। বাতাস গন্ধে ম-ম। খেত থেকে পুদিনাপাতা তুলতে গিয়ে ঘুমের মধ্যে প্রথম টের পান তাঁর বাম হাত অবশ।
কত অনশন, অবরোধ বিফলে গেল! তারপর বাম হাত, ক্রমে বাম পা-ও খোয়ালেন। তবু রহমতুল্লাহ এ দেশের নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার, সবুজ পাসপোর্টের জন্য লালায়িত নন মোটেও; বরং মনে করেন তাঁর ঘরে সবুজ পাসপোর্ট ঢোকার পর থেকেই রাজ্যের অশান্তি। একমাত্র নাতি তল্পিতল্পা নিয়ে দেশছাড়া হতে চাইছে।
কার দেশ? তাঁর কোন দেশ?
’৪৬-এর দাঙ্গায় রহমতুল্লাহ বাপ হারিয়েছেন। ’৭১ সালে নওজোয়ান ছেলে, বেঁচে থাকলে যে আহমদের জ্যাঠা হতো। ‘খোদা তাকে জান্নাতবাসী করুক। আমার পেয়ারের লাড়কা শহীদ হইছে।’ ফজরের নামাজের অক্তে শোয়াবস্থায় জোরে জোরে দোয়া পড়েন রহমতুল্লাহ।
‘তোমার ছেলে শহীদ হইছে? জান্নাতবাসী হবে? আমিও দোয়া করি হউক।’ রহমতুল্লাহর মোনাজাত শেষ হতে কাগজের পার্টিশানের ওপাশ থেকে বাহাস জুড়ে দেয় কানিজ ফাতিমা। ‘ছেলের হাতে তক্তাকাটা ডামি রাইফেল ধরাই দিছিল কে, ট্রেনিং দেয়ালো কে, আল-শামস বানাল কে? তারও হিসাব হবে পরকালে।’ বলে দম নেয় রহমতুল্লাহর এক কালের পেয়ারের নাতনি কানিজ ফাতিমা। এখন হয়তো ও কাঁথা নেড়েচেড়ে দেখছে পরিবারের এ গান্দা ইতিহাস ওর বাচ্চারা ঘুমের ভান করে শুনছে কি না।
‘কার মতো এ লাড়কি?’ রহমতুল্লাহ রাতজাগা ভারী চোখে তাজিয়ার মতো রঙিন কাপড়ে মোড়া চাঁদোয়ার দিকে তাকিয়ে স্মরণে আনার কোশিশ করেন। তাঁর খান্দানের কোনো জেনানাই তো এ স্বভাবের নয়। রহমতুল্লাহর বিবি কোমরে দোপাট্টা বেঁধে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গায় ছুরি-ভোজালি-হাতবোমা পেছন থেকে এগিয়ে এগিয়ে দিয়েছে। আর কানিজ ফাতিমার মায়ের মুখে ছিল একটাই জবান, ‘বাঙ্গাইল্যা যদি ঘরের দুয়ারে মুখে ফেনা তুলেও মরে, আল্লার দোহাই তোমরা এক ফোঁটা পানি দিবা না, এক মুঠ ভিক্ষা দিবা না।’ খোদার কী কুদরত, ছেলে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলে রহমতুল্লাহর এই পুত্রবধূকে বাঙালির দুয়ারে ভিক্ষা মেঙে খেতে হয়েছে। তারপর বাঙালির ঘরে ঝিগিরি। আহমদ তখন গুঁড়িয়া বাচ্চা। ও তালা মারা ঘরে থাকত দিনমান। আর কানিজ ফাতিমা যুবতী মাকে পাহারা দিতে পেছন পেছন যেত সেই বাঙালি বাড়ি। সেই থেকে লাড়কি ঘেউ ঘেউ করা প্রাণীর স্বভাবের হয়ে গেছে কথাটা সজোরে জানান দিয়ে ঘরের বেড়ায় নাকের শিকনি ঝাড়েন রহমতুল্লাহ। তুলনায় সুলতান আহমদ পানির মতো ঠান্ডা। এখন গোলমাল যা করছে—সবুজ পাসপোর্ট। এই অলক্ষুণে জিনিসটা বালিশের নিচে রেখে ঘুমায় সে।
আহমদ ততক্ষণে দাদা-নাতনির তুমুল ঝগড়ায় বিছানায় উঠে বসেছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে খুব। রাতভর দাদার বকবকানি। ফজরের আজানের পর চোখ লেগে আসতেই অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখে সে। ছোটবেলায় দাদার কাছে হজরত মুসা (আ.)-এর মিসর ত্যাগের কিসসা শুনেছে আহমদ। তাই হয়তো সুবেহ-সাদিকে এমন স্বপ্ন। আহমদ স্বপ্নে দেখে বাপ-দাদার ভিটায় ফিরছে। তার কাঁধের টিনের বাক্সে ইউসুফ নবির অস্থি। কদমে কদমে এ থেকে আওয়াজ ওঠে ঠকঠক, ঠকাঠক। সে এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে বাক্সটা বদল করতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। এ অবস্থায় কানিজ ফাতিমার বাকানিতে ঘুম ভেঙে যায়। সকালে কাজে গিয়েও আহমদ দেখে কাঁধে ব্যথা। সেলুনের কাজ। চুল কাটা, শরীর দলাই-মলাই। তখন কাঁধটা টনটন করে যন্ত্রণায়। তা দাঁত চেপে সহ্য করে এই ভেবে যে, এই গাধার খাটুনি আর কদিন! কাঁধে কফিন নিয়ে যেতে হলেও সে ছাপড়ায় ফিরে যাবে।
কিন্তু কার অস্থি কফিনে বইবে আহমদ—বাবার, জ্যাঠার, মায়ের না দাদির? রাতে রহমতুল্লাহকে সুবেহ-সাদিকের স্বপ্নের কথা বলে এর উত্তর জানতে চায় সে।
‘শহীদের মর্যাদা যার, তার’—আওয়াজটা তার নিজের কল্ব থেকে উঠে আসে, না দাদার মুখ থেকে? তবে বিষয়টা তফসির করেন একা রহমতুল্লাহ। তিনি ’৪৭-এ ভারত হারিয়েছেন, বাবাকে হারানোর এক সন বাদ—আঙুলের কড়ে গুনে হিসাব করে বলেন রহমতুল্লাহ। তারপর ’৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর, পূর্ব পাকিস্তান খোয়ানোর দুদিন পর হারিয়েছেন নওজোয়ান ছেলেকে। আফসোস, পরিবারের দুই শহীদ শয্যা নিয়েছে দুই মুলুকে।
‘দু-দুটি কোরবানিই ব্যর্থ হইল, দাদাজান!’ বিছানায় উঠে বসে দুঃখী গলায় বলে আহমদ।
‘হু, আমাদের নসিবে হারানোই লেখা আছে, প্রাপ্তি নাই। কিন্তু দুই শহীদ পাশাপাশি নিদ যাবে—সেই ব্যবস্থাই তো করা উচিত।’
‘সেই ব্যবস্থাই তো করা উচিত, এখন আমরা বিহারিরা সবুজ পাসপোর্ট বানাইতে পারছি যখন!’
সবুজ পাসপোর্টের নামে রহমতুল্লাহর উৎসাহে ভাটা পড়ে। তিনি কথা ঘুরিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলেন, ‘আমরা অভিশপ্ত, আল্লার আদেশ লঙ্ঘনকারী।’
কিন্তু আল্লার কী আদেশ লঙ্ঘন করেছেন দাদা বা তাঁর কৌমের লোকেরা? আহমদ তা জিজ্ঞাস করে না। মনে মনে সে গোমরায়—জন্মভূমি ছাড়ার অভিশাপ। জন্মভূমির অভিশাপ।
‘সাধে কি কেউ মাটির মায়া ছাড়ে! তখন এমন এক পরিস্থিতি ছিল, আমরা জন্মভিটা ছাড়তে বাধ্য হইছি।’ দাদা যেন নাতির মনের কথা বুঝে জওয়াব সাজান। ‘বাবাজানের শাহাদতবরণের দিন পয়লা মালুম হয়, আমরা মাইনরিটি। এ মুলুকে থাকা যাবে না। পাকিস্তানে তো মেজরিটি মুসলমান। চাচা রাস্তা বাতান—চলো পাকিস্তান।’
‘এখন তো আর এ দেশটা পাকিস্তান না। তুমি ভারতত্যাগী মুহাজির। কেন তওবা কেটে ভারত ফিরতে পারবা না?’
রহমতুল্লাহ নিরুত্তর।
‘আমরা যদি ভারতে থাকতাম, বিহারি বলে আমাদের মারত না কেউ।’
‘মুসলমান বলে মারত ভারতে। মুহাজির বলে মারত পাকিস্তানের সিন্ধিতে, পাঞ্জাবে।’
‘ইন্ডিয়াতে আমি ইচ্ছামতো উর্দুতে কথা বলছি, ট্রেনে, দোকানে, বাজারে রাবড়ি খেতে খেতে, লাচ্ছি খেতে খেতে। এখানে তা পারতাম? ওই দেশে কেউ একবারও ভাবে নাই আমি বাংলাদেশি। ভাবছে তাদের নিজের দেশের লোক। নিজের লোক।’
দাদার নফ্স দুলে ওঠে। যখন দেশ ছাড়েন, তখন ছিল শুধু জানের মায়া। মাটির টান কী, জানা ছিল না। নাতির চোখ দিয়ে যদি জিন্দেগিটা ফের দেখতে পেতেন! তার আর সময় কই। এখন একটাই আফসোস—তেঁতুলতলার গোরস্থানে শয্যা পাতা হবে না, যেখানে কমসে কম তাঁর চৌদ্দ পুরুষ ঘুমিয়ে আছে।
‘তখন আমরা হেলালি ঝাণ্ডার মোহে পড়ছিলাম, ভাইজান। হিলির লোকজনও আমাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করল। কী আপ্যায়ন! কী আন্তরিকতা! কত অল্প সময়ে আমরা একে-অপরের দুশমন বনে গেলাম!’
‘এ তোমাদেরই গলতি। এইটা চৌদ্দপুরুষের মুলুক কার—তোমার না বাঙ্গাইল্যার?’ কাগজের পার্টিশনের ওপাশ থেকে কানিজ ফাতিমা গলা বাড়ায়। বাচ্চারা জেগে থাকলে সে একদম রা কাড়ে না। তখন এদিকের বাতচিত রুখতে কাগজের পার্টিশনের ওপর আরেকপ্রস্থ পর্দা টাঙিয়ে দেয়। এখন সবুজসাথী, আদর্শলিপি পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্চারা। এখনই সময় জুতমতো ঝগড়া করার। ‘তোমরা রেলগাড়ির সিট থেকে বাঙ্গাইল্যাদের ঠেলে সরাই দিছ। ল্যাং মারছ হাটে-বাজারে, কলে-কারখানায়। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মির দোস্ত সাইজ্যা কল্লা কাটছ।’ কানিজ ফাতিমার এ বাখান চলতেই থাকবে, যতক্ষণ না তার কোনো এক সন্তান ধুসমুসিয়ে উঠে দুয়ারে পেসাব করতে ছোটে। সে এ জাহান্নামে বসে খোয়াব দেখে, তার বাচ্চারা লেখাপড়া শিখে একেকজন বাঙালি লাটসাহেব। শুধুই বাঙালি, না ‘স্ট্যান্ডেড’ পাকিস্তানি, না বিহারি, না ভারতত্যাগী মুহাজির।
অথচ নিজের পরিচয় ভাঁড়িয়ে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেছে বলে আহমদের দুঃখের শেষ নাই।
‘যখন দেখলাম পাকিস্তান দুই টুকরা হইয়া যাচ্ছে’, কানিজ ফাতিমার দম নেওয়ার ফাঁকে রহমতুল্লাহ আগের কথার খেই ধরে নাতিকে বলেন, ‘তখন ভাবলাম, ঠিক চাল দিতে না পারলে আমরা ঝাড়ে-বংশে খতম হয়ে যাব।’
‘বুড়া কি আজ সারা রাতই বকব!’ বাচ্চাদের ঘুমন্ত অবস্থায়ই দুসরা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে কানিজ ফাতিমা খোদার দরবারে হাত তোলে, ‘হে গফুরুর রহিম, আমি চাই না আমার বাচ্চারা দেশভাগ, দাঙ্গা, পাকিস্তান, বাঙালি-বিহারি রায়ট—এসব কিসসা-কাহিনি শুনে বড় হোক। আমি ওদের বলি, এ দেশে তোমার জন্ম। জন্মস্থানের সেবা করো। এ মাটির সেবা করো। খেদমত করো। আখেরাতে ফল পাইবা।’
আজ বাচ্চাদের ঘুমন্ত অবস্থায় কাগজের পার্টিশনের গায়ে দুসরা বেড়া তুলে দিয়ে কানিজ ফাতিমা যেন তাদের মাঝে চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে। রহমতুল্লাহ দুঃখের ভারে নুইয়ে পড়েন। মিইয়ে যায় সুলতান আহমদ। দুজনে কথা বলার আর আগ্রহ পায় না। আহমদ ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার, আলি দা প্যায়লা নাম্বার’ গানটা গুনগুনিয়ে গায় খানিক। তারপর কান পেতে রাতের পাখির ডানা ঝাপটানি শোনে। টিনের চালে শিশিরের টুপটাপ পতনের শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে দুজন।
‘দাদা, রাত শেষ হয়ে আসছে, আমারে বিদায় দিবা না?’
‘বিদায়!’ ঘুমচোখে আচমকা কথাটা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন রহমতুল্লাহ। ধীরে ধীরে মালুম হয় আহমদের আজ চলে যাবার দিন। নিজ মকানে ফিরে যাচ্ছে সে। রহমতুল্লাহ আলবিদা জানাবেন একটা শর্তে—তাঁর শহীদ পুত্রের অস্থি বহন করে ছাপড়ায় নিয়ে যাবে সুলতান আহমদ। দেখা গেল, নাতি দাদার ফরমাইশ ভোলে নাই। সে খুরপি আর নাইলনের ব্যাগ হাতে ঘরের দুয়ার টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। একবার গোরস্থানের ঠিকানাও জানতে চায় না। ফিরেও আসে রাত থাকতে।
পিঠে নাইলনের বস্তা, হাতে ব্যাগ। দরজার মুখপাতে পৌঁছে ঘুরে তাকায় আহমদ। বেড়ায় ঝোলা আয়নার সাদা বুকটা ভোরের আবছা আলোয় ঝিকমিক করছে, চৌপায়ায় শোয়া দাদার আর্দ্র চোখ দুটির মতো। আহমদ হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে মাথায় আঙুল চালায়। চুলে আজ আঠা আঠা ভাব নাই, শিশিরে ভিজে সিক্ত নরম হয়ে আছে। বেড়া থেকে আয়নাটা নামিয়ে ব্যাগে ভরতে ভরতে আহমদ ভাবে, দাদাকে সঙ্গে নিলে আর কোনো পিছুটানই থাকত না। কিন্তু কী করে তা সম্ভব, যে লোকের সবুজ পাসপোর্টই নাই! অচল মানুষ চোরাই পথে নেওয়াও মুশকিল। আহমদ দৌড়ে বর্ডার পার হতে পারলেও দাদা গুলি খাবে। তখন আরেকটা বোঝা বাড়বে আহমদের। আরেকজন শহীদের অস্থিভর্তি নাইলনের ব্যাগের বোঝা।