আবার হাসি

আবার হাসি
রাতের বিদঘুটে অন্ধকারে রাস্তার বুকে পা চিড়ে, সোড়িয়াম লাইটের আলো গায়ে মেখে হাটছি। হঠাৎ সামনে একটি কুকুর চোখে পড়লো। কুকুরটির গায়ের রং হলুদ, ঘাড়ের দিকটায় কালো মোটা লম্বা রেখার মতো, ঐ লম্বা কালো রেখাটা তাকে অনেক সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলছিলো। কিছু কিছু মানুষের মুখমন্ডলে কালো তিল থাকে যা তাকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলে। আমারও এই মূহুর্তে এই কুকুরটিকে দেখে অনেক আকর্ষণ জাগছে।
আচ্ছা একটা রাস্তায় পরে থাকা একটা অবুঝ প্রাণীর প্রতি আমার কেনো এত আকর্ষণ কাজ করছে? কুকুর না হয়ে যদি প্রাণীটি একজন মানুষ হতো তাহলে কি আমি ওর প্রেমে পড়ে যেতাম? হয়তো! কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম সামনে বসে থাকা কুকুরের পিছে পিছে একটা কালো কুকুর দৌঁড়ে এলো। এসেই দু’জনেই একসাথে দুষ্টুমি করতে লাগলো বোধহয় কালো কুকুরটি তার সাথে সঙ্গ পাততে এসেছে। বেশিক্ষণ থাকবো না তাদের মাঝে থাকলে তাদের ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের পূর্বেই আমার কাবাবে হাড্ডি হওয়া উচিত হবে না, তাই সরে এসে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আবার হাঁটছি। রাস্তা ফাঁকা প্রায়। মাঝ রাতে শহরের এই ব্রীজে কোনো মানুষ তো দূর কীটপতঙ্গের ও দেখা পাওয়া দুষ্কর, তবে মাঝেমাঝে কিছু যাযাবর মানে ঐ কুকুরগুলার মতো প্রাণী দেখা যায়। আমিও এই মুহুর্তে তাদের মতোই এক যাযাবর।
আচ্ছা এত রাতে ফাঁকা রাস্তায় আমি কেনো হাঁটছি? লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর হিমুও মাঝ রাতে হলুদ পাঞ্জাবী একটা ব্যাগ আর খালি পায়ে হাঁটে। কিন্তু ৪২ বছরের এক বুড়ো, সাদা পাঞ্জাবী আর স্যান্ডেল পরে হাঁটছে এইরকমটা কি হিমুর ধর্মের সাথে যায়? আচ্ছা আমারতো গাল ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, হিমুও কি এমন ছিলো? জানিনা। তবে কোনো হিমু ভক্ত নিশ্চয়ই আমার সাথে হিমুর মিল খুঁজে তার সময় নষ্ট করবেনা।
হাঁটছি কিন্তু কুকুর দু’টোর কান্ড দেখে আমার মনের গহীনে এক ঝড় বয়ে গেলো। যে ঝড়ের কারণ কেউ কখনো জানেনি আর জানবেও না। খুব করে ২০ বছর পেছন থেকে মায়া আর মোহ আমাকে এক অদৃশ্য দড়ি দিয়ে টানছে, টানটা খুব জোরালো তা উপলব্ধি করতে পারছি। কি আশ্চর্য! এই টান থেকে আমি পালাতে চাচ্ছি কিন্তু পারছিনা, কেনো? এরও উত্তর জানা নেই। আজও অতীতগুলো স্বচ্ছ কাঁচে ফলিত প্রতিবিম্বের ন্যায় আমার মস্তিষ্কে ফুটে উঠেছে। আমি তখন ১৯ বছরের নবীন যুবক। আমার স্বপ্নের ভার্সিটিতে স্বপ্নের বিভাগ গণিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আর সেখানেই হাসির সাথে দেখা। হাসি নামটা সত্যিই সার্থক কারণ ওর হাসিটা দেখেই আমি নিশ্চুপে ওকে আমার মনটা দিয়ে দিয়েছিলাম ওর অগোচরেই।
ওর বাম গালের টোলটা আমাকে সবসময়ই আকর্ষণ করতো। ওর সাথে বন্ধুত্ব করার জন্যই আমি আর কারও সাথে মিশতামনা। বন্ধুত্ব হবার পর ও বোধহয় শুরু থেকেই সব বুঝতো তাইতো আমার সকল দুষ্টুমি পাগলামি সহ্য করে যেতো কখনোই বিরক্ত হতোনা। তবে একটা ঝড় সব পালটে দিলো। তখন আমরাদের গ্রেজুয়েশন শেষ। আমি খুঁজছিলাম একটা ভালো চাকরি। মাস্টার্স করার ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের হাল ধরতে বাস্তবতার গন্ধ গায়ে মেখে চাকরির পিছনেই ছুটতে হয়। ততদিনে একটা বিষয় শিখে গিয়েছিলাম, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয় মামা-খালুর ভিত্তিতে যোগ্যতা পরিমাপ করতে হয়। খুব নাটকীয়ভাবে ওর পরিবারও বিয়ের জন্য ওকে চাপ দিচ্ছিলো, এখন যদি কেউ আমার এইসমস্ত কথা শুনে তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে উম্মাদ পাগল কিংবা, নিছক মিথ্যে বানানো গল্প বলে অট্টহাসিতে মেতে উঠবে কিন্তু আমি তো জানি জীবনযুদ্ধের সব গল্প, গল্প নয়।
শেষ দিনটা ছিলো অবিস্মরণীয়। বিকাল বেলা নদীর ধারে সবুজ ঘাসে পদচারণ চলছিলো আমাদের, হঠাৎ দাঁড়িয়ে আমার হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিয়েছিলো আর দিলো তিনটি সাদা গোলাপ। আমি ওর এমন কর্মকান্ডে প্রচুর অবাক হয়েছিলাম! মনে হচ্ছিলো এই বিকেল, এই নদীর পাড় আমি কোনো এক স্বপ্নপুরিতে কাটাচ্ছি আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নপুরি রাজ্যের রাজকন্যা, যার কাজকর্মগুলোও ছিলো স্বপ্নের মতো। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় নেত্রে জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ এইসব কেনো? আজ কি আমার জন্মদিন! কই নাতো!
ও মুখটাকে শান্ত শ্যামল সবুজ মাটির দিকে তাক করে বললো, কাউকে যখন বিদায় দেওয়া হয় তখন ঘটা করে বিদায় দেওয়া হয়। তোমাকে বিদায় দিচ্ছি, ঘটা করে বিদায় দেওয়ার সখ ছিলো ইন্তু পারিনি, বিদায়বেলায় আমি নিয়ে যাচ্ছি এক অকৃত্রিম সুখকর স্মৃতি তবে তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু ছিলোনা, না না কিছু দিয়ে যাচ্ছিনা বললে ভুল হবে, দিয়ে যাচ্ছি এক ফালি কালো মেঘের মতো বিষাদ আর বিষময় কষ্ট। কথার মাঝে দুই কি তিন ফোটা অশ্রু চিবুক বেয়ে সবুজের সাথে মিশে গেলো। আমি তাচ্ছিল্যের সুরে একটু হেঁসে বললাম, হা হা হা, নিশ্চয়ই নানু নাহলে দাদুর বাড়িতে যাচ্ছো? তাই বুঝি এত কষ্ট? আরে দু এক দিনেরই তো ব্যাপার তারপর তো আবার আমাদের দেখা হবে। আমার কথা শুনে এইবার হাউমাউ করে কাঁদা শুরু করে দিলো। ওর কান্নার প্রতিটি শব্দ আমার হৃদয়পটে এক একটা ছুরিকাঘাতের ন্যায় ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো, আমি ওর কাঁদা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, প্রশ্ন করেছিলাম, কি হয়েছে হাসি? ওর কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেয়েছিলো, সাথে বৃদ্ধি পেয়েছিলো আমার উতলা হওয়ার বেগ। কান্নার সাথে আকাশ কাঁপানো চিৎকার এর মাধ্যমে ও উত্তর দিলো, “আমার বিয়ে এই মাসে।”
মানুষ যখন অবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় তখন আর সে নিজের মধ্যে থাকেনা, আমিও তখন আর নিজের মাঝে ছিলাম না। ও বোধহয় নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছিলো আর আমি ভাবছিলাম, কিছুইনা কারণ এ হয়তো আমাদের নির্ধারিত নিয়তি। ও মুখ ফিরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছিলো তবে যাওয়ার আগে আমার দিকে না তাকিয়েই বললো, কি জানো তো, বাবা-মা এর বিরুদ্ধে গেলে তুলকালাম হয়ে যাবে। বাবা আমাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন এতদিন তোমার চাকরির আশায় বসে ছিলেন তাঁরা কিন্তু গতকাল একটা ভালো সম্বন্ধ আসায় বাবা সব পাকাপাকি করে ফেলেন। যাওয়ার আগে একটা অনুরোধ শুনো, পারলে হাতে সবসময় ঘড়িটা পরে থেকো। যখনই ঘড়িটা হাতে পরা থাকবে মনে করবে আমার হাত তোমাকে স্পর্শ করে আছে, যখন সময় দেখবে মনে করবে আমাকে দেখছো। ভালো থেকো। কি আশ্চর্য! ও এতগুলো কথা বলেছিলো কিন্তু একটাবারও ফিরেও তাকায়নি, বোধহয় অপরাধবোধের পোকাগুলো ওর হৃদয়টাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো তাই একটাবারও তাকায়নি।
এই যা! নিজের স্মৃতিপটের এতই পিছনে ডুবে গিয়েছিলাম যে আমি আমার বাড়ির এক্কেবারে সামনে এগিয়ে এসেছি। ঘরে ঢুকার সময় বুশ আমাকে দেখে চিৎকার করে দিলো, হয়তো আমাকে বকা দিচ্ছে এত রাতে ঘরে ঢুকছি বলে। বুশ আমার পোষা কুকুর ও যখন অনেক ছোট ছিলো, রাস্তায় আহত হয়ে পড়েছিলো, একদম একা ছিলো ঠিক আমার মতো। এখন আমি আর ও খুব ভালোই চলছে। আমার শোবার ঘরের পাশে বেলকনিতে রয়েছে প্রায় দশ প্রকারের ফুল যার সবগুলোর রং-ই সাদা। সাদা আমার প্রিয় রং না হলেও সময়ের সাথে সাথে আমার সত্তার সাথে মিশে যায় এই ফুলগুলো। হাসি নিয়ে গিয়েছিলো আমার সব রং নিয়ে, দিয়ে গিয়েছিল সাদা তিনটি ফুল। বোধহয় শোকের ফুল হিসেবে সাদা ফুলই শ্রেয় তাই হাঁসি আমাকে সাদা ফুলই দিয়ে গিয়েছিলো। আমার ডায়েরির ভাজে সেই ফুলগুলোর জায়গা হয়েছে তবে আমার হৃদয় আজও শুন্য।
বাবা-মা আজও গ্রামে পড়ে আছে, হাজারবার বলেও আমার কাছে আনতে পারলাম না, তাঁদের মতে বাব-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যাবেন না তাঁরা। আমিও আর কিছু বলিনি। ইদানিং বাবা একটা আবদার করে বসেছেন আমার কাছে, আর তা হলো আমার বিয়ে। প্রত্যেকবারই একইভাবে আমাকে কাবু করার চেষ্টা করে, “ বাবা বিয়েটা কবে করবে তুমি? আজকাল তো তুমি আর আমি পাশাপাশি দাঁড়ালে লোকে তোমাকে আমার বড়ভাই বলে মনে করে। তোমার ছোটভাইয়ের এক ছেলে ভার্সিটিতে পড়ছে আর মেয়েটা এইবার এইচ.এস.সি দিবে আর তোমার এখনো বিয়ে করারই নামগন্ধ নেই। বাবা আমরা কি মরার আগে নাতিপুতির মুখ দেখে মরতে পারবোনা?”
প্রত্যেকবার কল দিয়ে একই কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে আমার। হাসিকে আমি ভালোবাসি আর তাই বিয়ে করছিনা ব্যাপারটা তা নয়, ব্যাপারটা হলো, যার নাম আমার গোটা অন্তর জুড়ে লিখিত সেই অন্তরে অন্য কাউকে আমি কিভাবে জায়গা দিবো? বিয়ে করলেও যে মেয়েটার সাথে চরম অন্যায় হবে কিন্তু এইবার বাবা আর ছাড়লেন না, উনি সব কিছু ঠিকঠাক করে রেখেছেন এখন শুধু গিয়ে মেয়েটাকে কবুল বলে নিয়ে আসার পালা, উনি এতসব কিছু করে রেখেছেন অথচ আমিই কিছু জানিনা। আরে অদ্ভুত তো, বিয়ে আমার অথচ আমারই মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই! বাবা তো সোজা বলে দিয়েছেন বিয়ে না করলে ত্যাজ্য। আর যাই হোক নিজের জন্য নিজের বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়ার মতো দুঃসাহস আমার নেই। আজ আমার বিয়ে হয়ে গেলো। আমার শর্ত অনুযায়ী বিয়েটা শহরেই হয়েছে। আরেকটি শর্ত ছিলো বিয়ের পর যদি বাবা-মা আমার সাথে শহরে থাকতে রাজী হয় তবেই আমি বিয়েটা করছি, বাধ্য হয়েই তাঁরা রাজী হয়েছেন।
বাসর রাতে আমি আমার ঘরে না থেকে রাস্তায় ঘোর অন্ধকারে হাঁটছি কিন্তু কেনো হাঁটছি? আজও এর উত্তর আমার কাছে নেই। তবে হাঁটার মাঝে ঐদিনের সে কুকুর দু’টিকে আজও দেখতে পেলাম। আজ তারা পাশাপাশি একসাথে বসে আছে আর দুষ্টুমি করছে। ওদের দিকে হালকা দৃষ্টিপাত করেই আবার হাঁটা শুরু করলাম। আনমনে অনেকক্ষণ হেঁটে চলেছি, হাঁটছি তবে হাঁটায় মন নেই, কিছু ভাবছিও না। হাঁটার সময় হঠাৎ করে মনে এলো, আজতো আমি বিয়ে করেছি ঘরে আমার বউ বসে আছে। আচ্ছা সে কি ভয় পাচ্ছে এই মূহুর্তে আমাকে না দেখে? আচ্ছা আমার নতুন বউয়ের কথা আমার মনে না থাকা কি ওর প্রতি অবহেলার কোনো লক্ষণ? কিন্তু ওকে আমি কেনো অবহেলা করছি? ওর কি কোনো দোষ আছে? না, আমার অতীতের জেরে ও কেনো কষ্ট পাবে? ওর তো কোনো দোষ নেই। ওর সাথে ভালোভাবেই থাকতে হবে। আমার কষ্টের ভাগিদার ও কেনো হবে?
রাত দেড়টায় আমি আমার বাসায় প্রবেশ করলাম। সবাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি আমার ঘরে প্রবেশ করলাম যাতে কেউ না টের পায়। ঘরে ঢুকে বিশ্বাস-ই হচ্ছে না এটা যে আমার ঘর! একদম রাজকীয়ভাবে সাজিয়েছে ছেলেপেলেগুলো। কিন্তু কি আশ্চর্য মেয়েটা এখনো ঘোমটা দিয়ে রেখেছে! আচ্ছা মেয়েটা আমাকে তার মুখ লুকিয়ে রাখছে কেনো? হয়তো লজ্জায়। কিন্তু আমারতো খুব লজ্জা লাগছে! ইশ বুশ যদি পাশে থাকতো! না না লজ্জা কেনো পাবো আমি? আচ্ছা মেয়েটি কি আমার কারণেই এতক্ষণ এইভাবে বসে আছে? ওহো বড্ড খারাপ লাগছে নিজের প্রতি। আচ্ছা যাই গিয়ে কথা বলি কিন্তু বলবোটা কি?
কিছু না বলে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। আজ রাতটায় ওকে আমার অতীত জানিয়ে বর্তমান করে দেব কিন্তু ও কি তা ভালো মতে মেনে নিতে পারবে? না পারুক আমার দায়িত্ব ওকে জানানো আর আমি তা জানাবো। আচ্ছা ওর ও যদি এমন অতীত থাকে তাহলে কি আমি মেনে নিতে পারবো? না পারার তো কিছু নেই! আঁধার যতই কালো হোক না কেন, স্বর্ণালী রৌদ্রজ্জ্বল দিন আসবেই। এই যা এতক্ষণ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছি অথচ আমার খেয়ালই নেই? ওর পাশে গিয়ে বসলাম আর বললাম,“ আসসালামু আলাইকুম, ইয়ে মানে কিভাবে শুরু করবো তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। আসলে আপনি কি মনে করে যে আমার মতো একটা বুড়োকে বিয়ে করলেন কে জানে? আসলে আমার একটু লজ্জা লাগছে আপনি যদি আপনার ঘোমটাটা নিজেই খুলতেন তাহলে বড্ড উপকৃত হতাম।”
কি আশ্চর্য! মেয়েটা আমার কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে কেনো? ওর হাসিটার মধ্যে রয়েছে একধরনের মাদকতা, যে মাদকতার নেশাতে ডুবছি আমি। কোনো এক মোহে ডুবে পড়ছি আমি, মনে হচ্ছে এ যেনো আমার খুব কাছের মানুষের হাসির শব্দ। কাছের মানুষের হাঁসি খুব টানে কিন্তু ও কিভাবে আমার কাছের মানুষ হয়? ওর সাথে তো আমার আগে কখনো দেখা হয় নি। আমার এক ঝাঁক প্রশ্নের পোকাগুলো বারবার মস্তিষ্কে ঘূর্ণিপাক খাচ্ছিলো, ঠিক অমন সময়েই মেয়েটি ঘোমটার আড়াল থেকে বলে উঠলো, “আগে তো এমন লজ্জা পেতে না! এমন লজ্জা পাওয়া শিখলে কবে থেকে? “
আরে এ তো হাসির গলা! হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাসির-ই গলা। আমি কি করে ওর গলা ভুলবো? গত ২০ টি বছর ধরে যে ওর শ্বাস প্রশ্বাসের মতো সকল স্মৃতি-ই নিজের মধ্যে নিয়ে বেঁচে আছি এই আওয়াজ আমার কাছে কখনো অপরিচিত হতে পারেনা। না পারতেই কাঁপা হাতে আমি ওর ঘোমটা উঠিয়ে দিলাম। হ্যাঁ, ঘোমটার আড়ালে যে লুকিয়ে আছে সে আমার বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া সেই হাসি, যার হাসি দেখে আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম প্রতিটি মূহুর্ত। আমার মুখ ও চোখদুটো সমানতালে নিখুঁত শুন্যের মতো গোল হয়ে আছে। আমার এই অবস্থা দেখে ও নিজের সেই চিরাচরিত হাসি দিয়ে বললো, “কেমন আছো?” আমার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না কারণ কিছুটা অবাক হওয়ার বজ্রপাতে আর কিছুটা ওর রূপের ঝংকারে। চেহারায় বয়সের ছাপ কিছুটা ফুটে উঠেছে তবে আমার কাছে সেই আগের ঐ-ই রয়ে গেছে। হাতের তুড়ি মেরে ইশারায় “কি” জিজ্ঞেস করছে? আমি মূর্তির মতো বসে আছি শুধু, মুখ থেকে একটাই শব্দ বেরুলো, “তুমি?”
ও আমার কথা শুনে নিজের কোমল হাতটা দিয়ে আমার নাকটা টেনে দিয়ে বললো,“ কেনো, বাসর রাতে নিজের বউ থাকবে না তো কি অন্য কারও বউ থাকবে? আমি হা করে তাকিয়ে থেকে বললাম, কিন্তু তোমার তো ২০ বছর আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল!। ও আমার কথা শুনে বোধহয় একটু কষ্ট পেলো তাই বললো,“ দয়া করে ঐসব কথা আমাকে মনে করিয়ে দিও না। ” কথাটা বলেই ও মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। আমার কৌতূহলী মন জানতে চাইছে বারবার ওর অতীত তাই জিজ্ঞেস করেই বসলাম, “কি হয়েছিলো?” ও প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও পরে বলা শুরু করলো, “নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে শুধুমাত্র বাবা-মায়ের জন্য’ই যখন তোমার আর আমার পবিত্র ভালোবাসাকে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করে বিয়ে করি তখন পর্যন্ত এক কালো সত্য দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গিয়েছিলো।”
— কি সেই সত্য?
ও নিজেকে একটু শক্ত করে এক পাশে মুখ ফিরিয়ে হিংস্রাত্মকভাবে বললো, ”জানোয়ারটা আমাকে বিয়ের দিন-ই ঘরে ফেলে চলে যায়। ওর বাবা-মা ও খুব অবাক হয়েছিলো তাঁদের ছেলের এমন কর্মে তাঁরাও খুব অবাক হয়েছিলেন। আমি সারাটা রাত একাকী নিঃসঙ্গতায় ধুকরে মরছিলাম। একটা অচেনা-অপরিচিত নতুন পরিবেশ, আর এই মূহুর্তে ও ছিলোনা সত্যিই আমার খুব ভয় আর ওর প্রতি রাগ হচ্ছিলো।
সারাটা রাত ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ি। পরেরদিন সকাল বেলাও ঐ লোকটাকে আমার পাশে পেলাম না। ওর প্রতি রাগ আর ঘৃণা আরও বাড়তে শুরু করলো। অনেকক্ষণ পর যখন ঘর থেকে বের হলাম ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখি টিভির সামনে বসে আমার শাশুড়ি মা অঝোরে কাঁদছে। ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে আমি তাঁর সামনে গিয়ে টিভিতে হেডলাইন দেখি রাতে কোনো এক রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা হয়েছিলো। পরবর্তীতে ক্রসফায়ারে সব জঙ্গি নিহত হয়, জঙ্গিরা ছিলো ৮ জন তার মধ্যে একজন আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী। এইটা দেখার পর আমি ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। “
ও যখন আমাকে ওর কালো অতীত সম্পর্কে জানাচ্ছিল তখনও ওর চোখে দু-এক ফোটা মুক্তার মতো অশ্রুকণা গাল বয়ে পড়ে যেতে দেখলাম। আমি ওর হাতটা ধরে ফেললাম, কেনো ধরলাম জানিনা তবে ধরে ফেললাম। হাত ধরার পর ও বোধহয় একটু স্বাভাবিক হলো। আবার বলা শুরু করলো, “আমি পরে নিজেকে ঐ বাড়ির একটা ঘরে আবিষ্কার করি, ওটা আমার শ্বশুরের ঘর ছিলো। আমার মাথার পাশে শাশুড়ি কাঁদছিলো আর আমার জ্ঞ্যান ফিরতে দেখে বললো, “আমাদের মাফ করে দাও মা।
আমরা বুঝতে পারিনি যে আমাদের হীরার টুকরো ছেলেটা একটা কাঁচের টুকরো ছিলো। ছোট বেলা থেকেই ও সহজ-সরল ও ভদ্র ছিলো কিন্তু আমাদের দৃষ্টির অগোচরে ও যে এমন পশু হয়ে উঠবে তা কে জানতো? জানলে নিশ্চয়ই তোমার জীবনটা এইভাবে ধ্বংস করে দিতাম না আমরা।” আসলে কি জানো, উনারা খুবই ভালো মনের মানুষ ছিলেন, আর কোনো সন্তান ছিলো না উনাদের তাই পরবর্তীতে আমার প্রতি স্নেহ ও আদরটা একটু বেশি-ই ফুটে উঠেছিলো। আমার শ্বশুর তো ছেলের লাশের মুখও দেখবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। পরে আমি আমার বাড়িতে চলে আসি। বাবা-মা সকলেই আমার জন্য অনুতপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে আমি আমার মতো করেই থাকতে শুরু করে দিই। আমি নিচু সরে বললাম, “বিয়ের ব্যাপারে আর কখনো ভাবোনি? “
— না।
— কেনো?
— ইচ্ছা ছিলো না তাই। প্রথম প্রথম বাবা-মা একটু ঘ্যানঘ্যান করতো তবে পরে তারাও বুঝে গিয়েছিলেন আমি নড়বার পাত্রী নই, তাই পরে তারাও মেনে নিয়েছিলেন সব।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আমার কাছে আবার কেনো ফিরে আসোনি? ” ও মাথা নিচু করে বললো, “সাহস হয়নি আর। যে ভালোবাসা নিজের হাতে গলা টিপে হত্যা করেছিলাম, সেই ভালোবাসার নীড়ে কিভাবে আবার আশ্রয় নিই বলোতো? খুব অপরাধবোধ হচ্ছিলো। ” আমি বুঝতে পারলাম পরিবেশটা একটু বেশি-ই ভারী হয়ে উঠেছে, একটু হালকা করা লাগবে, তাই আমি হাসি কে বললাম, “গিটারটা পড়ে আছে, অনেকদিন গান ধরি না। পেশাদার গায়ক হলেও কি জানো অনেকদিন আমার সেই গিটার নিয়ে কোনো এক চাঁদনী রাতে সুরের ঝংকার তুলা হয়নি। আচ্ছা কেমন হয় বলোতো এমন চাঁদনী রাতে ছাদে বসে হাতে গিটার আর পাশে নিজের প্রিয়তমা আর মাঝে মাঝে চায়ের চুমুক। আহা আমারতো ভাবতেই শিহরণ বয়ে যাচ্ছে প্লিজ চলোনা, না করোনা।”
আমার কথা শুনেই ও নিজের সে বিখ্যাত হাঁসি দিয়ে বললো, “বয়স বেড়েছে ঠিকই কিন্তু রোমান্টিকতা কমেনি দেখছি? এখন যদি ঘর থেকে বেরিয়ে চা বানাতে আর ছাদে যেতে কেউ দেখে ফেলে তবে এক কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে, আমার স্বামী। ” হাসি আমাকে স্বামী বলে ডাকায় আমার ভিতরটা কেমন যেনো উথাল-পাথাল করতে লাগলো, ২০ বছরে এই প্রথম ওর মুখে এই শব্দটা শুনতে পেলাম। আমি একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে বললাম,“ আচ্ছা যাও চা আর ছাদ বাদ, বেলকনিতে গিয়ে বসতে তো আর কোনো সমস্যা নেই?” আমার কথা শুনে ও আমার মাথা ঠুকে দিয়ে বললো, “আরে পাগল, মাঝরাতে গিটার আর গানের শব্দ পেলে মানুষ কি বলবে বলোতো? বলবে দুই বুড়ো-বুড়ির আদিখ্যেতা দেখো, মাঝরাতে গিটারের সুরে গান গাইছে। “
আমি একটু গলার স্বর ভারী করে বললাম, ”কে বলেছে আমার বউ বুড়ি?” আবার নরম স্বরে ওর গালটা টেনে দিয়ে বললাম,“ আমার বউ তো একদম পরীর মতো।” ও একটু কঠিন গলায় প্রশ্ন করলো, ”ঐ তুমি কি মানুষ ছেড়ে পরী-টরীর সাথে প্রেম করছিলে নাকি?” আমি তো মূহুর্তেই ওর এমন পাল্টা প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “আরে না না, কি বলছো এইসব?” ও হেঁসে বললো, “হা হা হা, দুষ্টুমি করছিলাম। আচ্ছা চলো।” বেলকনিতে আমি আর আমার প্রেয়সী পাশাপাশি বসে আছি। আমাদের পরণে বিয়ের পোশাক, আর এই পোশাকগুলোতে চাঁদের জ্যোৎস্না পড়ছে, কেমন যেনো একটা ঘোর লাগানো মূহুর্ত সৃষ্টি হচ্ছে। আমি গিটারের টিউনিং করছি এমন সময়ে হাঁসি বললো,“ আচ্ছা ২০ টা বছর হয়ে গেলো এতদিন বিয়ে করোনি কেনো?”
আমি টিউনিং এ মনোযোগী ছিলাম কিন্তু ওর প্রশ্ন শুনে থমকে গেলাম, কি উত্তর দিবো এই প্রশ্নের? কোনো গুছানো উত্তর যে আমার ভান্ডারে নেই! তাও বললাম, “আমার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়পুরে অন্য কাউকে জায়গা দেওয়ার মতো জমি আমার কাছে ছিলোনা। যখনই বাবা-মা বিয়ের কথা বলতো আমি পাশ কেটে চলে যেতাম। আমার কাছে মনে হতো নতুন কেউ আমার জীবনে আসলে ওর সাথে খুব অন্যায় হবে কারণ যে হৃদয়ে সমস্ত তোমার নামে লিখা অন্য কাউকে আমি সেখানে কিভাবে জায়গা দিই বলোতো? “গিটার টিউনিং করতে করতে উত্তর দিচ্ছিলাম, টিউনিং শেষ করে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর গাল বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছিলো, চাঁদের জ্যোৎস্নায় তা ঝকঝকে মুক্তার ন্যায় রূপ ধারণ করেছিলো। আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম,“ ও বুড়ি, কাঁদো কেনো? কাঁদার দিন শেষ এখন আমি আমার হাঁসির মুখে শুধু হাঁসি দেখতে চাই।”
ও একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে বললো,“ ঐ,আমি বুড়ি? তুমি নিজেই না বুড়া। কি হালচাল করে রেখছো নিজের? গাল ভর্তি দাঁড়ি, লম্বা-লম্বা চুল! ইশ… আমার সব ছবিই বরবাদ চলে যাবে! ভেবেছিলাম বিয়ের দিন সারপ্রাইজ দিবো বলে ঘোমটা দিয়ে রাখবো আর পরে সুন্দর সুন্দর কাপল পিক তুলে দেওয়ালে টঙিয়ে রাখবো কিন্তু এমন উজবুক হয়ে যাবে তুমি তা কে জানতো? শিম্পাঞ্জি একটা! আমি ওর এমন বোকাবোকা গালাগাল শুনে হেসে দিলাম আর বললাম, “আরে দু’দিন আগে তো পাক্কা শিম্পাঞ্জি ছিলাম কিন্তু আমার ভাইবোনদের ছেলেমেয়ে গুলা এই কম সময়ে শিম্পাঞ্জির জায়গায় একটু মানুষের রূপে ফেরত আনলো। ছেলেমেয়ে গুলাও কত্ত বড় হয়ে গেছে! আর কয়েকদিন পরতো ওরাও বিয়ের লাইন লাগিয়ে দিবে। ” আমার কথা শেষে ও বললো, “সময় কারো জন্য থেমে থাকে না।”
— হুম, আচ্ছা যাও কাল-ই দাঁড়ি-গোফ কেটে চুল ছোট করে একদম আগের মতো হয়ে যাবো।
— না না থাক লাগবেনা, এমনিতেই বললাম। তুমি শিল্পী মানুষ হয়তো এটাই তোমাকে বাকিদের থেকে আলাদা করে তুলে?
— আরে না ঐসব কিছুইনা। কি জানোতো মাঝেমধ্যে নিজের মধ্যে একটু পরিবর্তন আনলে নিজেকে এক অন্য মানুষ বলে মনে হয়।
—আচ্ছা।
আমি “হুম” শব্দ করে গিটারে সুর দিতে লাগলাম আর গান গাইতে যাবো তখনই একটা প্রশ্ন মাথায় ধরা দিলো তাই গিটার বাজানো বন্ধ করে সাথে সাথে ওকে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা একটা প্রশ্ন না করে পারছিনা, আমার বাবা-মা তোমাকে কিভাবে পেলো?” ও হেঁসে বললো,“ তোমাকে নিয়ে তো বাবার চিন্তার কোনো শেষ ছিলোনা। একদিন মা তোমার ডায়েরিতে আমার সম্পর্কে জানতে পারেন আর পরে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেন আর আমার বাব-মা কে জানান সবাই হাসিখুশি সব মেনে নেন আমিও না করিনি সব জানতে পেরে।” আমি সব হা করে শুনছিলাম আর বললাম,“ সত্যি মা-বাবাদের কোনো তুলনা-ই হয় না।”
গিটারের তালে তালে গান গাইছি অনেকক্ষণ, আমার কাঁধে মাথা রেখে তাল মিলিয়ে গান গাইছিলো হাসিও কিন্তু কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ও নিশ্চুপ হয়ে গেছে পরে খেয়াল করলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে। গিটারটা একপাশে রেখে খুব সাবধানে ওকে আমার কোলে শুইয়ে দিলাম। চাঁদের জ্যোৎস্নায় ওর ঘুমন্ত মুখে এক মায়া খেলা করছে, ঘুমিয়ে থাকার কারণে বোধহয় মায়াটা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। আকাশে জ্বলজ্বল করা চাঁদ দেখবো নাকি আমার কাছে থাকা চাঁদ দেখবো দ্বিধায় পড়ে গেলাম। অনেকক্ষণ ওর মুখের পানে চেয়ে থেকে পরে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি দেখতে লাগলাম। চোখবুঁজে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলাম, কেনো ধন্যবাদ দিলাম জানিনা তবে মনে হলো এইটা উনার প্রাপ্য। ভালোবাসার মানুষগুলো হয়তো হারিয়ে যাবে কিন্তু পবিত্র ভালোবাসা কখনো হারাবেনা। দুটি মানুষ হেরে যায়, হেরে যায় দুটি প্রাণ। পবিত্র ভালোবাসা কখনো হারে না, যদি তাতে থাকে শক্ত, মজবুত টান।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত