বনের ধারে ছোট্ট গ্রাম। কয়েকটি চাষি পরিবার বাস করে। সব মিলিয়ে সত্তর–আশিজন মানুষ হবে। তারা মাঠে চাষ করে। ফসল ফলায়। সুখে–শান্তিতে জীবন কাটায়।
মানুষ যেখানে থাকে, সেখানে কিছু পশুপাখিও থাকে। এই গ্রামেও আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরু–ছাগল আছে, ভেড়া আছে, হাঁস–মুরগি আছে। কবুতরও আছে কোনো কোনো বাড়িতে। আর কুকুর–বিড়াল তো আছেই।
বিড়ালগুলো বাড়ির ভেতরই থাকে। বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাত আছে। ইঁদুরের যম হচ্ছে বিড়াল। তারা ইঁদুর তাড়ায়, ধরে ধরে খায়। কুকুরগুলো থাকে দল বেঁধে। সব মিলিয়ে তেরোটা কুকুর। তারা গ্রাম পাহারা দেওয়ার কাজ করে।
বনে আছে চিতা, হরিণ, শিয়াল, খাটাশ, মেছোবাঘ, বাগডাশ, গুঁই। ছোট ছোট প্রাণীও আছে অনেক। খরগোশ আছে, ইঁদুর আর কাঠবিড়াল আছে, বনমোরগ আর সাপ আছে, ব্যাঙ আছে অনেক। গাছে গাছে নানা রকমের পাখি। বড় আকৃতির হিংস্র প্রাণী নেই। যেমন হাতি-সিংহ নেই, বাঘ-অজগর নেই। বন্য মোষ নেই।
শিয়াল খুবই চতুর প্রাণী। প্রায়ই গ্রামে হানা দেয়। হাঁস–মুরগি, ছাগলছানা ধরে নিয়ে যায়। খাটাশ আর বাগডাশও করে একই কাজ। খোপে ঢুকে কবুতর পর্যন্ত ধরে নেয় খাটাশে।
সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে চিতার। বনে হরিণ শিকার করতে না পারলে গ্রামের দিকে আসে চিতারা। মাঠে চড়তে থাকা গৃহস্থের গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া আক্রমণ করে। ধরেও নিয়ে যায় কোনো কোনো সময়।
গ্রামের কুকুরগুলো দল বেঁধে শিয়াল-খাটাশ তাড়ায়, বাগডাশ তাড়ায়। বন থেকে চিতা বেরোতে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যায়। তেরোটা কুকুরের একসঙ্গে ওরকম ঘেউ ঘেউ শুনে গ্রামের লোকে বুঝে যায় চিতা বেরিয়েছে। তখন তারাও লাঠিসোঁটা নিয়ে হইহই শব্দে ছুটে যায়। মানুষ আর কুকুরের ভয়ে বনের গভীরে পালিয়ে যায় চিতা।
কুকুরও চিতাবাঘের খাবার। বাগে পেলে কুকুরও ধরে খায় তারা। কুকুরেরা এ কথা জানে। অতীতে গ্রামের দু–চারটা কুকুর চিতার পেটে গেছে। এ জন্য কুকুরগুলোর কোনোটাই কখনো একা থাকে না। একা চলাফেরা করে না। থাকে দল বেঁধে। তেরোটা কুকুর একত্রে শত্রুর দিকে তেড়ে গেলে শত্রু ভয়ে আতঙ্কে লেজ গুটিয়ে পালায়। কুকুরদের ভয়ে গ্রামের দিকে শিয়াল, বাগডাশ আর খাটাশগুলো তো আসেই না, চিতারাও এমুখো হয় না। দিনের আলোয় গ্রামের দিকে আসা তো দূরের কথা, রাতের অন্ধকারেও তারা গ্রামের দিকে আসে না।
সব মিলিয়ে গ্রামের মানুষজন ভালো আছে। সুখে–শান্তিতে আছে। তাদের পোষা প্রাণীগুলোও নিরাপদে আছে।
তেরোটা কুকুরের মধ্যে একটা একটু অলস, একটু আরামপ্রিয়। নড়ে তো নড়ে না, হাঁটে তো হাঁটে না, এ রকম। দলের সরদার এই নিয়ে রাগও করে তার সঙ্গে। ধমকটমক দেয়। তবু অন্য কুকুরগুলোর মতো চটপটে হতে পারেনি সে।
এই কুকুরটার নাম বল্টু।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও বল্টু একটু ঘুমাবে। দলের মধ্যে থেকেই এক ফাঁকে কোথাও একটু শোবে।
এই ঘুমের জন্য সরদার একদিন বেদম বকা বকল তাকে। বকা খেয়ে বল্টুর মন খুবই খারাপ হলো। সে দল থেকে বেরিয়ে, একা একা বনের ধারে গিয়ে বসে রইল। লজ্জায় অপমানে কান্না পাচ্ছিল বল্টুর।
বনের ভেতর থেকে বল্টুকে দেখতে পেল এক চিতা। দুদিন ধরে অনাহারে আছে চিতা। শিকার ধরতে পারেনি বলে খাওয়া জোটেনি। হরিণ শিকার তো দূরের কথা, একটা খরগোশ বা বনমোরগও ধরতে পারেনি। ক্ষুধায় কাতর হয়ে আছে সে। গ্রামের দিকে গিয়ে যে কিছু শিকার করবে, কুকুরদের ভয়ে সেদিকে যেতে পারছে না।
এই অবস্থায় বল্টুকে দেখতে পেল বনের ধারে একা বসে আছে। দেখে চোখ দুটো চকচক করে উঠল তার। আরে, এই তো হাতের কাছে শিকার। কুকুরটা ধরতে পারলেই তো কাজ হয়ে যাবে। একা একটা কুকুর। ওটাকে ধরা মোটেই কঠিন কাজ না।
প্রাণীদের মধ্যে চিতা হচ্ছে দৌড়ের ওস্তাদ। চিতার সঙ্গে দৌড়ে কেউ পারে না। দৌড়ে গিয়ে কুকুরটার ঘাড় কামড়ে ধরলেই হবে। কুকুর কি আর চিতার সঙ্গে পারবে? দৌড়েও পারবে না, শক্তিতেও পারবে না।
বন থেকে বেরিয়ে বল্টুর দিকে ছুটে এল চিতা।
বল্টু বুঝে গেল মহা বিপদে পড়েছে সে। এখনই চিতা তাকে ঘাড় মটকে খাবে। হায় হায়, একা একা সে বনের ধারে চলে এসেছে কেন? সরদার না হয় একটু বকেইছিল। তাতে কী? এখন যে প্রাণটা যাবে!
কিন্তু বাঁচতে হবে। চিতার হাত থেকে তাকে বাঁচতে হবে।
বল্টু জানে, যদি সে দৌড় দেয় তাহলে বাঁচতে পারবে না। পেছন থেকে তার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে চিতা।
কী করা যায়?
চিতার দিকে মুখ করে দাঁড়াল বল্টু। চিতা ছুটে আসছে, ছুটে আসছে। বল্টু তার গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। এত জোরে চিত্কার! এমন গলা ফাটানো চিত্কার! চিতা ভড়কে গেল। আরে এ কী! কুকুরটা এমন চিত্কার করছে কেন?
চিতা থমকে দাঁড়াল।
ওদিকে বল্টুর এ রকম প্রাণ ফাটানো চিত্কার শুনে গ্রামে ঢোকার মুখে বসে থাকা বারোটা কুকুর লাফিয়ে উঠল। সরদার বলল, নিশ্চয় বল্টু কোনো বিপদে পড়েছে। চলো তো দেখি।
বারোটা কুকুর একসঙ্গে ছুটে এল। এসে দেখে একটা চিতার মুখোমুখি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বল্টু আর বেদম জোরে চিত্কার করছে। চিতা তার দিকে এগোতে সাহস পাচ্ছে না।
সঙ্গীদের পেয়ে বল্টুর সাহস আরও বেড়ে গেল। তেরোটা কুকুর একত্র হয়ে তেড়ে গেল চিতার দিকে। দুদিনের অনাহারী চিতা ক্ষুধার কথা ভুলে লেজ গুটিয়ে বনের দিকে ছুটে পালাল। ক্ষুধা পরে, আগে জীবনটা তো বাঁচাই।
চিতা পালিয়ে যাওয়ার পর বল্টুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো কুকুরেরা। সরদার বলল, অলস হলে কী হবে, তুইই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী। সবচেয়ে বুদ্ধিমান। সাহস আর বুদ্ধির জোরেই তুই আজ চিতার হাত থেকে বেঁচেছিস। সাহস আর বুদ্ধিই সবাইকে বাঁচায়।