ঠমক

ঠমক

মি. করিম বিশ্বাস, সেগুন কাঠের কারুকাজ করা সাড়ে তিন ফুটের দরজার গায়ে ডোর ভিউয়ারের ঠিক দুই ইঞ্চি উপরে সাঁটানো নেমপ্লেট পড়ে লাজিনা শারমিন হেসে ফেলল। তার দম বন্ধ করা হাসি পেল। কথায় কথায় হাসি তার পেট উগড়ে বেরিয়ে আসে। কিছু একটা ছুঁতো পেলেই হলো। নিজেকে থামাতে পারে না। তার হাসি দেখে সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্তের মতো অন্যরাও অকারণে হাসতে থাকে। লাজিনা হাসতে জানে। অকাতরে। মুখে তার হাসি লেগেই থাকে। এমন হাসি ক’জনে হাসতে পারে!

মি. করিম বিশ্বাসÑ আচ্ছা নিজের নামের সাথে কেউ মিস্টার লাগায়?

লাজিনার হাসি পাবে নাই বা কেন! অন্য যে কেউ হলেও হাসত আর সে তো এমনিতেই হাসি-বিশারদ। সুনাম আছে বন্ধু মহলে। হাসলে পরে সোনা-রঙা দু’গালে ঈষৎ টোল পড়ে। বড় ভালোলাগে দেখতে। তার প্রেমী হতে ইচ্ছা করে, যে কারও। কিন্তু লাজিনা তার এই হাসির জন্য এখনও প্রেমে ডুবতে পারেনি। কারণ, সে একটা ছেলের সাথে প্রেম করবে, গায়ে গায়ে ঘষা দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি বলবেÑ এগুলো ভাবতেই তার হাসি পায়। তাই অহরহ ভালোবাসার প্রস্তাবকে সে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। কলেজ ইউনিভার্সিটি শেষ হয়ে গেল, লাজিনার প্রেম হলো না।

করিম বিশ্বাস লাজিনার বস হন। তিনি হাসেন না। তাঁর আবার হাসতে মানা। কেউ তাকে হাসতে দেখেনি। কিন্তু লাজিনা তাকে ঠিকই হাসতে দেখেছে। একদিন লাজিনা অফিসের একটা ফাইলে ভুল তথ্য পরিবেশন করে বসের কাছে বকা খাচ্ছিল। তিনি মাথা নিচু করে বক বক করে বকে যাচ্ছিলেন। লাজিনা তার বকা খাচ্ছিল আর নিঃশব্দে মুখের দুপাশে দুটা গজদন্ত বের করে কেলাচ্ছিল। বস সেটা লক্ষ্য করেননি। তিনি যখন লাজিনার দিকে মুখ তুলে চাইলেন, লাজিনা হাসছে। তাও আবার দন্ত বিকশিত করে। মি. বিশ্বাস অবাক হলেন। তার বকা খেয়ে কেউ হাসতে পারে এটা বিশ্বাস বিশ্বাসই করতে পারছেন না।

তিনি কপট রাগ করে বললেন, তোমার কি চাকরির মায়া একটুও নেই।

লাজিনা ঝকঝকে মুক্তার মতো দাঁত আগের থেকে আরও একটু ফুটিয়ে জানতে চাইল, কেন স্যার?
তুমি ভুল করেছ, তা জানো?

এই যে আপনার কাছে জানলাম। আগে জানতে পারলে তো সংশোধন করেই নিয়ে আসতাম। ভুলটা কি আর আনতাম। বলে উপর নিচ মিলিয়ে গজদন্তসহ ষোলো খানা ঝিলিকমারা দাঁত উন্মুক্ত করে মাসকারা আঁকা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকল।

লাজিনার নির্বিকার হাসি দেখে একসময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মি. বিশ্বাসও হেসে ফেললেন। পরক্ষণেই হেরে যাওয়া নিজেকে সামাল দিয়ে একটু জোরে বলে উঠলেন, অহ হেল! গেট ইউরসেল্ফ আউট অফ হেয়ার।
বসের হঠাৎ ইংরেজি ভাষা শুনে লাজিনা একটু অপ্রতিভ হয়ে গেল। সে ফাইলটা হাতে নিয়ে পেন্সিল হিলের খটখট শব্দ আর নিতম্বে দশআনা বিশআনা ছন্দ তুলে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলÑ দাঁড়াও সুযোগ পেয়ে নি, পিছন থেকে আমার পাছা দেখা আর তোমার বসগিরি ছুটাচ্ছি।

সেই থেকে লাজিনা তার বসের পিছনে হাত ধুয়ে শায়েস্তা করার জন্য পড়ে আছে।

মি. করিম বিশ্বাস গুরুগম্ভীর ভাব দেখান। বসগিরি আর কি! কিন্তু তিনি আসলে একজন নরম দিলের মানুষ। সবাই জানে। উপর থেকে চোটপাট দেখান কিন্তু ভিতরে তিনি পাখির ছানার মতো নরম তুলতুলে। বিয়ে করেননি। নারীর প্রতি আদৌ মোহ আছে কি না কেউ বলতে পারবে না। অফিসে প্রচুর নারী কর্মী আছে, সমস্তরের বা অধস্তন কেউ তার দিকে কিন্তু অঙুলি তুলে কথা বলতে পারবে না। ভালো মানুষ মি. করিম বিশ্বাস। সকলের সমীহের পাত্র।

মি. করিমের যৌবনকালের এক বন্ধু নবীন সরকার এই অফিসের একাউন্টসের প্রধান। তাঁর কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে কেউ একজন জেনে যায় যে, একদা যুবক বয়সে গ্রামের বাড়িতে মাতাল যৌবনের ঊষা লগ্নে একটি কিশোরীর প্রেমে পড়ে সামাজিকভাবে নাজেহাল হওয়ার পর নারীদের থেকে তিনি দূরে দূরে থাকেন। আসলে মি. করিম নারী বিদ্বেষী নন।

একথা সহকর্মীদের মুখে ঘুরতে ঘুরতে একদিন লাজিনা শারমিনের কানে এসে পৌঁছায়। লাজিনা ভীষণ মজা পায়। নিজে নিজে হাসে আর মনে মনে বলে, তাহলে আগেই সাহেব নাজেহাল হয়েছেন!

তার জানতে খুব ইচ্ছা করে, কী এমন ঘটেছিল সেদিন যে আজ বিশ বছর পরেও সেটা ভুলতে পারছে না। কোনো এক চড়া রোদের দুপুরে কিশোরীসহ ঢেউ খেলানো সরষে ক্ষেতে ধরা পড়েছিল নাকি! হি হি হি!

এমন সময় ক্রিং ক্রিং, ইনটারকম বেজে উঠল। সে হাসতে হাসতে মিন মিন করে নিজেকে শুনিয়ে বলল, তোমার কোনো সময় জ্ঞান নেই, যখন ইচ্ছা বেজে ওঠ।

লাজিনা, আর ইউ বিজি? মি. নবীন সরকারের কণ্ঠস্বর।
নট সো মাচ্, স্যার।
রুমে আসেন।

আদেশটা হেঁকে বস লাইন কেটে দিলেন। বসদের এই আচরণ খুব পীড়াদায়ক। লাজিনা বহুবার বহুজনকে এই আচরণ করতে দেখেছে। নিজের কথা শেষ হওয়া মাত্রই লাইনটা কেটে দেয়। এরা আবার নিজেদের শিক্ষিত তকমাও দেয়। সামনাসামনি মানুষ তার প্রয়োজন শেষ হলে যেমন বিদায় নেয় বা অনুমতি নেয় ঠিক তেমনি ফোনেও কথা শেষ করার পরে অপর প্রান্তের কোনো কথা রয়েছে কি না সেটা জেনে নিয়ে তবেই ফোনের লাইন বিচ্যুত করা উচিত। এটাই সভ্যতা, ইংরেজিতে যাকে বলে এটিকেট।

লাজিনা ইচ্ছার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াল। নবীন সাহেবের অফিস কক্ষের সামনে যাওয়া মাত্র তার স্মার্ট সেক্রেটারি টেবিলময় ছড়িয়ে থাকা কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে অর্থপূর্ণ চোখ ইশারায় ভিতরে চলে যেতে বলল। লাজিনাও দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। নবীন সরকার ফোনে কথা বলছেন না কারও সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে না। তিনি হাত দিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বসার জন্য ইশারা করলেন। লাজিনা বসে তাঁর কথা শুনতেছিলÑ না না আমাকে ঠিক করে বলো… তুমি কি তাহলে বিয়ে করবে না… সে দায়িত্ব তো আমার… না কোনো মানসম্মান যাবে না… ঠিক আছে পরে কথা বলছি… লাজিনা ইজ ইন ফ্রান্ট অফ মি। আবারও সেই একই আচরণ, ফোন ছেড়ে দিলেন।

লাজিনা বুঝতে পারল তিনি অফিসেরই কারও সাথে কথা বলছিলেন। লাজিনা সান্নিডেল থেকে এ লেভেল করে ইন্ডিয়া থেকে হিউম্যান বিহেভিয়ারের ওপর উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে। সে ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছে ঠিকই কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি তার অদ্ভুত মায়া রয়েছে। সে বলে, যতই ইংরেজি মারাও না কেন তুমি কিন্তু বাঙালি, তোমাকে বাংলাতেই চিন্তা করতে হবে আর বাংলাতেই স্বপ্ন দেখতে হবে।

মি. নবীন ফোন রেখে লাজিনার দিকে তাকালেন। লাজিনা স্বভাবজাত একটা সুন্দর মুচকি হাসি তাঁকে উপহার দিলো। তিনি একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, কনগ্রাচুলেশন।

লাজিনা প্রশ্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তিনি পুনরায় বললেন, খুলে দেখ।

লাজিনা তাঁর হাত থেকে খামটা নিয়ে খুলে আদ্যোপান্ত দুইবার পড়ল। মাত্র চার লাইন লেখা, ইংরেজিতে। ভাবতেই অবাক লাগছে। মাত্র তিন মাস হয়েছে তার চাকরির। কনফারমেশনের সাথে সাথে একটা প্রোমোশন পাওয়া নিশ্চয় আনন্দের। লাজিনারও খুব আনন্দ হচ্ছে। অপার তৃপ্তি তার চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠল। কখনও মনে মনে কখনও মুখে হাসিটা খলবল করছে। সে বলল, স্যার আই ফিল অনার্ড, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।
ওয়েলকাম। কিন্তু ধন্যবাদটা তোমার করিম সাহেবের পাওনা।

আমি বুঝতে পারছি স্যার।

এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন… বলে চুপ করে গেলেন মি. নবীন। তিনি বোধ হয় ভাবলেন, লাজিনাকে বলার এখনও সময় হয়নি। তিনি ত্বরিত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে গিয়ে লাজিনাকে একেবারে বিদায় জানিয়ে দিলেন। মুখ থেকে কেউ যেন শব্দগুলো টেনে বের করে দিলো, হ্যাভ এ গুড ডে, লাজিনা।

লাজিনা নবীনের কথা শেষ হতে হতেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে সে আনন্দ মনে বসের রুম থেকে বেরিয়ে আসল। তার কানে সব কিছু ছাপিয়ে, এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন… কথাটা বারবার বাজতে লাগল। সে নিজের আসনে না গিয়ে মি. করিমের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।

কক্ষের সামনে তাঁর সেক্রেটারি আসনে ছিল না। কি করবে এখন ফেরত যাবে কি না ভাবছে এমন সময় মি. করিমের রুম থেকে তাঁর সেক্রেটারি বের হয়ে এসে বলল, ভিতরে যান। স্যার ইস ওয়েটিং ফর ইউ।

বোঝা গেল সিসিটিভির গুরুত্ব।

লাজিনা ভিতরে পা রাখার সাথে সাথে মি. করিম উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন।

লাজিনা স্মিত হেসে ধন্যবাদ জানালো। বস উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়েছেন। লাজিনা করিম সাহেবের বডি লাংগুয়েজ বোঝার চেষ্টা করল। একথা সেকথা বলে সময় নিলো। তার কানে ‘এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন…’ বারবার বাজতে লাগল। করিম সাহেবকে আজ যথেষ্ট সপ্রতিভ মনে হলো। লাজিনার ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি মিলাচ্ছে না। সে মনে মনে বলল, প্রেম করতে চাও আর মুখ ফুটে বলতে পারো না। কেমন পুরুষ গো তুমি!

বসের কক্ষে বেশিক্ষণ অকারণ অবস্থান নেওয়াটা সমীচীন নয়। বেরিয়ে আসলো লাজিনা।

সিটে এসে বসার সাথে সাথে হ্যান্ডসাম সুবোধ চৌধুরী এসে কনগ্রাচুলেশন জানালো। আধা ঘণ্টার মধ্যে মোটামুটি পুরো অফিস জেনে গেল লাজিনার উন্নতির কথা। কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে খুশি না হলেও চেহারার মধ্যে একটা আনন্দভাব ফুটিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার নিষ্ফল চেষ্টা করল। লাজিনা বেশ ভালোই অনুমান করতে পারলো তাদের মনের পরিস্থিতি। তাতে তার কিছু যায় আসে না।

লাজিনার মাথার মধ্যে একটা কথাই শুধু ঘুরপাক করতে লাগল, ‘এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন…।’ সে ভালো করেই বুঝতে পারছে মি. নবীন কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছেন। একবার নবীন সাহেবের কাছে ফোন করে কনফার্ম হতে ইচ্ছা হলো। উন্মাদ! অবুঝ নাকি। ঊনত্রিশ বছর বয়সে এসে ছ্যাবলামো করাটা সাজে না!

মি. করিম যে তার প্রতি দুর্বল সে তো ভালো করেই বুঝতে পারছে। সে নিজের কথা আর কী বলবে। করিম সাহেবকে দেখতে দেখতে নিজেরও তো তাকে ভালো লেগেছে। এতো ভালো মানুষ! তার এক সময় মনে হলো করিম সাহেব বিড়ম্বনায় পড়েছিল বলেই আজও অবিবাহিত রয়ে গেছে। বোধ হয় তারই জন্যে। কথাটা মনে হতেই খুব হাসি পেল। সে মাথা নিচু করে একটু হেসে নিলো। হাসতে হাসতেই তার মাথার মধ্যে একটা বুদ্ধির উদয় হলো। সে তৎক্ষণাৎ করিম সাহেবের অফিস প্রোফাইলে ঢুকল। ১২ জুলাই তাঁর জন্ম তারিখ। ও মা! কর্কট রাশির জাতক! কিন্তু কর্কটের কামড় তো তিনি দেন না কখনও। নিপাট ভালো মানুষ। ১২ জুলাই অর্থাৎ আগামী পরশু। শুক্রবার। ছুটির দিন। ভালোই হয়েছে। সে একটা পরিকল্পনা মনে স্থির করে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করল।

শুক্রবার সকাল ১০টায় চমৎকার লাল রঙা একটা লিলেনের শাড়ি পরে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হৃদয় স্ফিত করে নিঃশ্বাস নিলো।

ঘর থেকে বেরিয়ে একটা রিকশায় উঠল। ধানমন্ডির শংকরে ফুলের দোকান থেকে একটা লাল তাজা গোলাপ কিনে আবার রিকশায় চড়ে বসল। তারপর মি. করিমের গাড়িচালক সবুজ মিয়ার দেওয়া ৯ নম্বর সড়কের ঠিকানায় নেমে রিকশা ছেড়ে দিলো।

বাড়ির ভিতরে প্রবেশের মুখে দারোয়ান তাকে আটকানোর চেষ্টা করলে সে তার ভুবন ভুলানো হাসি ছড়িয়ে ‘লাজিনা, ফোর-সি’ বলে পেন্সিল হিলের খটখট শব্দ তুলে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। তার রূপের ঠমকের কাছে মাঝবয়সী দারোয়ানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সে হ্যাঁ হয়ে লাজিনার চলে যাওয়া দেখতে গিয়ে নাম-ঠিকানা দুটোই ভুলে গেল।

লাজিনা মি. করিমের ৪-সি ফ্ল্যাটের সামনে এসে নেমপ্লেটে নাম পড়ে প্রথমে প্রাণ ভরে হেসে নিলো। হাসি তার ভিতরের অবশিষ্ট দ্বিধাকে হৃদয় থেকে একেবারে উচ্ছেদ করে দিলো।

সে কলিংবেলে চাপ দিয়ে ডোর ভিউয়ারের সামনে লাল গোলাপটা ধরে অপেক্ষায় থাকল।

করিম সাহেব ক্রয় করা ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। সে জানে তাঁর মা বাবা উভয়ে সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। তাঁরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। শহরমুখো খুব একটা হন না। চার দেয়ালের ভিতর থাকতে তাদের দম আটকে আসে।

তাদের নিদাঘ দুপুরে আমগাছের গোড়ায় শীতল পাটিতে গা এলিয়ে তালপাতার পাখার বাতাস ভালোলাগে, গভীর রাতে টিনের চালে বৃষ্টি পতনের ছন্দ ভালোলাগে, আকাশের নিচে পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনিল মেঘের দৌড়াদৌড়ি ভালোলাগে, হেমন্তের সকালে পাকা ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলানো দৃশ্য ভালোলাগে, শীতের ভোরে কুয়াশা ঢাকা পুকুরের পাড় ভালোলাগে, ফাল্গুন মাসের বাতাসে ভেসে থাকা আমের মুকুলের ঘ্রাণ ভালোলাগেÑ এগুলো শহরে কোথায়!

কলিংবেলের শব্দে করিম একটু বিরক্ত হলেন। এইমাত্র কাজের মেয়েকে বিদায় করে দরজা বন্ধ করে অ্যানড্রয়েড টিভিতে কৌশিকী চক্রবর্তীর ঠুমরি শুনতে বসেছেন। কৌশিকী যেমন সুন্দর রাগ পরিবেশন করে তেমন তার হাসিটাও ভারি সুন্দর! বড় ভালোলাগে তাকে।

করিম কোমরে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে দরজায় এসে ডোর ভিউয়ারে চোখ রাখলেন। দরজার ওপাশে লালচে একটা আভা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।

কে?

অপর পাশে নিশ্চুপ। তিনি ভিউয়ারে চোখটা আটকে রেখে আবার ডাকলেন, কে?

এবার লাল আভাটা একটু দূরে সরে গিয়ে লাল গোলাপের আদল নিলো। তিনি বুঝতে পারলেন তার জন্মদিনে কেউ শুভেচ্ছা জানাতে এসে রহস্য করছে। দরজাটা খোলা যায়।

তিনি দরজা খুলে কোনো অপ্সরাকে দেখার মতো চমকে উঠলেন। তার মুখ আপনাআপনি হাঁ হয়ে গেল, বিমোহিত দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।

শারমিন প্রাণমাতানো হাসির সাথে গোলাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, শুভ জন্মদিন।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব করিম হাত বাড়িয়ে ফুলটা নিয়ে নিঃসাড় দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখ থেকে রা উচ্চারণ করতে পারছেন না। তিনি কী কথা বলতে ভুলে গেছেন?

কী ব্যাপার এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভিতরে আসতে বলবেন না?
সম্বিত ফিরে এলো করিমের। ইয়েস ইয়েস প্লিজ কাম ইন।
কণ্ঠে এক অদ্ভুত জড়তা কোথায় থেকে এসে ভর করেছে।
না সরলে আসব কীভাবে?
ওহ হো! সরি।

করিম একটু সরতেই লাজিনা ঘরের ভিতর ঢুকে ভারী দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিলো। দরজা লক হওয়ার একটা মৃদু খটাস শব্দ হওয়ামাত্র লাজিনা করিমকে দু বাহুতে বেঁধে নিলো।

এই করছেন কী, ছাড়–ন! করিম নিজেকে বাহু পাশ থেকে মুক্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস করলেন।

লাজিনা আলতো করে করিমকে ধরেছিল। করিমের আতঙ্ক দেখে লাজিনা বন্ধনটা আরও দৃঢ় করল। বুকে রাখা মুখটা তুলে করিমের চোখে নিজের দৃষ্টি ধরে রেখে বলল, ছাড়ার জন্য তো তোমাকে ধরিনি।

মি. করিমের কান বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। হৃৎকম্প থেমে যেতে চাচ্ছে। অথচ নাড়িতে রক্ত দ্রুত লয়ে ধাবিত হচ্ছে। তার আবেশিত চোখ দেয়াল ঘুরে টেলিভিশনের পর্দায় গিয়ে পড়ল। সেখানে কৌশিকী গান গাইতে গাইতে চোখ পাকিয়ে হাসছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত