বাঁশবন, শটিবন, আসশেওড়ার ঝোপের বনজ আগ্রাসন আর অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে মাটির দলামোচড়া খণ্ডগুলো পায়ে মাড়িয়ে জঙ্গল ছেড়ে বেরোল রতন।
এই পথে রতনের স্কুলে যাওয়া তাড়াতাড়ি হয়।
রতন ক্লাস ফাইভে এবার বৃত্তি পেয়েছে। সে তার গ্রামের স্কুলের বর্তমান গৌরব। রতনদের স্কুলটি বেসরকারি। মানুষের অনুদানে চলে। একজনের পোড়ো জমির ওপরে তৈরি হয়েছে এই স্কুল। ক্লাসঘর এখানে বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি। এই গ্রামে বাঁশ হয় প্রচুর।
এ-স্কুল সরকারি হওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু রতনের মতো ছেলেরা ভরসা। এ রকম দু’চারটে ছেলে পরপর কয়েক বছর বৃত্তি পেলে এবং এসএসসির ফল ভালো করলে স্কুলটি সরকারের সুনজরে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে ভবিষ্যতে। সেই আশায় বুক বেঁধে এই তরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কাজ করে যাচ্ছেন।
রতন তার বিধবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন; যে অবলম্বনের ভেতরে বর্তমানে জরিবুটি কেটে যাচ্ছে আশা আর স্বপ্ন। মানুষের বাড়িতে ধান-চাল-গম, তিল-তিসি ঝাড়াই-বাছাই করে তারাবিবির সংসার চলে। ছোট থাকতেই রতনের বাবা মারা গেছে। সেই কতদিন আগে একদিন সন্ধেয় খেজুর গাছে ঝোলানো দোকাটা রসের ঠিলে নামাতে গিয়ে ঠিলেসুদ্ধ গাছ থেকে পড়ে রতনের বাবা মারা যায়। খেজুরগাছটা এমন কিছু বড় ছিল না। সেখান থেকে পড়লে মানুষের মৃত্যু হওয়ার কোনো কথা নয়। কিন্তু মানুষের ধারণা, গাছটার দোষ ছিল। মরা মানুষের হাড়ের ওপর জন্মেছিল গাছটা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু মানুষের গণকবর হয়েছিল নাকি সেখানে। আর আল্লাহ্র কী মহিমা! সেই গণকবর ঘিরে আপন মনে বেড়ে উঠেছিল কয়েকটা খেজুরগাছ। গ্রামবাসী ভাগাভাগি করে খেজুরের রস খেত। গুড়-পাটালি তৈরি করে বাজারে বেচত কেউ কেউ।
কিন্তু রতনের বাবা গাছ থেকে রস পাড়তে গিয়ে মরে গেলে রব উঠল- মরা মানুষের হাড়ের ওপর জন্মানো গাছের রস খাওয়া হারাম। এর পর কেটে ফেলা হলো সব গাছ। তারাবিবি অবশ্য স্বামীর এ রকম আচমকা মৃত্যুকে তার কপালের দোষ বলে ধরে নিয়েছিল। বুক থাবড়ে কেঁদেছিল কয়েক মাস। তারপর শোক আঁচলে বেঁধে উঠেপড়ে লেগেছিল রতনকে মানুষ করে তুলতে।
রতন লেখাপড়ায় ভালো। এত ভালো যে, সে বৃত্তি পেয়েছে। রতনের ক্লাসের শিক্ষকরা স্কুল শেষ হয়ে গেলেও রতনকে আলাদা বসিয়ে পড়ান। এ জন্যে তারাবিবির কোনো পয়সা খরচ হয় না।
রতন লেখাপড়ায় ভালো বলে তারাবিবির মনের ভেতরে ইদানীং এক ধরনের গর্বের তেরছা জাল বোনা শুরু হয়েছে। মানুষের বাড়িতে ধান-চাল ঝেড়ে-বেছে তোলার সময় সে কখনো কখনো গুনগুন করে ওঠে আজকাল। শরীরে একটা ছন্দ তুলে গুনগুন করে। অবস্থা দেখে সবুর মণ্ডলের স্ত্রী একদিন তো বলেই ফেলল, কী রে তারা? তোর গলায় দেখি গান শুনা যাতিছে আজকাল! ব্যাপারডা হতিছে কী বল্ দিনি?
উত্তরে হেসে উঠেছিল তারাবিবি। তারপর আপন মনে যে কাজ করছিল করতে লাগল। চক্ষুলজ্জায় বলতে পারল না- আর মাত্তর কডা দিন গো বুজি। এর পর চাল ঝাড়ার জন্যি তুমাগের বাড়ি তারাবিবি আর পাও দেবে না নে! আমারেই বলে তখুন সাহায্য করে কিডা!
এখন রতন স্কুলে যাচ্ছে। সে জঙ্গল ছেড়ে বেরোল। সকাল সাড়ে ৭টায় স্কুল বসে। এখন ৭টা। এখনই চারপাশে ঝলমল করে উঠেছে রোদ। দেবদারু গাছগুলো রাস্তার দু’পাশে খাড়া-মাথা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকে ফাঁকে শিরীষ গাছের ছড়ানো মাথায় পাখি এসে বসেছে একটা-দুটো। সময়টা ফাল্কগ্দুনের শেষ।
জঙ্গলের এদিকটা পুবদিকে পড়ে। জঙ্গল ছেড়ে বেরোতেই রতনের মুখের ওপর রোদের ঝাপটা এসে পড়ল। হাতের বারান্দা করে রোদ ঠেকাতে গেল রতন, ঠিক সেই মুহূর্তে যেন রতনের জীবনে অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল।
রতন তাকিয়ে দেখল তার সামনে দশাসই চেহারার কে একজন এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে তার ধবধবে শাদা ফুল প্যান্ট ও গায়ে শাদা হাতাকাটা শার্ট। রতন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেল। লোকটার মাথার চুল পানিতে ধুয়ে তোলা কোষ্টার মতো সোনালি। রঙ অতিরিক্ত ফর্সা। তার চোখে পাতলা ডাঁটির সরু চশমা। চশমার ভেতর দিয়ে যেন ঝকমক করে জ্বলছে দুটো চোখ।
রতন কী করে? সে প্রথমে হতভম্ব, পরে বিহ্বল হয়ে যেন তাকিয়ে থাকল লোকটার দিকে।
একটু পরে তার দৃষ্টি পড়ল লোকটার বুকের ওপর আড়াআড়ি করে পেতে রাখা হাত দুটোর দিকে। বাঁ হাতের কব্জিতে তার বাঁধা বিশাল একটা ঘড়ি। ঘড়ির কালো ঘেরের ভেতরে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শাদা রঙের লম্বা একটা কাঁটা।
রতনের মুখে আলোর তীব্র ছটা এসে পড়েছিল। সে হাত কপালে তুলে রোদ ঠেকিয়ে লোকটাকে দেখতে লাগল। তার ভেতরটা একটা অজানা শঙ্কায় যেন থিরথির করে কাঁপতে লাগল।এ রকম আচেনা অনুভূতি এর আগে আর কোনোদিন রতনের হয়নি। নির্জন বনভূমি-অধ্যুষিত এই রোদ্দুরি প্রত্যুষ হঠাৎ কী যেন এক রহস্যময় বার্তা নিয়ে এলো রতনের কাছে!
ইউ লিভ হিয়ার, বয়? লোকটা প্রশ্ন করে এবার এগিয়ে এলো রতনের কাছে। তার শরীর থেকে অপূর্ব এক ঘ্রাণ বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। সুখী মানুষের ঘ্রাণ। সুখী ও সচ্ছল মানুষের গায়ের ঘ্রাণ। সুখী, সচ্ছল ও সমৃদ্ধশালী মানুষের ঘ্রাণ। বিহ্বল রতন এই ঘ্রাণ বুকে টেনে নিতেই তার ভেতরে যেন আলোড়ন শুরু হলো। আর তখুনি রতন দেখল লোকটার চোখের মণি নীল। মানুষের চোখে এ রকম ঠাণ্ডা নীল রঙের মণি রতন জীবনে দেখেনি। বস্তুত মানুষের চোখের মণি যে নীল হয়- এই ধারণাই রতনের ছিল না।
তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল ঝাউ পাতার মতো। শিরশির শব্দটা যেন আরও বিস্তারিত হলো শরীরে। সেটা ভয়ের, কী উত্তেজনার- বোঝার আগেই সে মাথা নাড়ল।
ধবল জ্যোৎস্নার মতো শরীরী উপস্থিতি নিয়ে লোকটা যেন এবার আন্তরিকতায় নত হয়ে বলল, ইউ লিভ হিয়ার, ইয়েস?
তার কথা শুনে রতন আবারও মাথা নাড়ল। সে যেন বুঝে গেল প্রশ্নটা কী হতে পারে।
লোকটা এবার রতনের মুখের দিকে স্মিত চোখে তাকাল। তারা দু’জন এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একজন কৌতূহলী, একজন অভিভূত। যেন এই জঙ্গল পাগাড়ের ভেতরে আবির্ভাব হয়েছে অচেনা এক দেবদূতের! বনজ ফুলের ঘ্রাণ আর লোকটার শরীরের ঘ্রাণ দুয়ে মিলে একটা মাখামাখি বাতাস যেন দু’জনের ভেতর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল।
লোকটা এবার জিজ্ঞেস করল, হোয়াটস ইয়োর নেম, বয়?
রতন এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। বদলে কী যেন ভাবতে লাগল।
নেম? লোকটা এবার তার বুক থেকে হাত সরিয়ে হাতের একটা ভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করল।
রতন তাকিয়ে দেখল লোকটার হাতভর্তি লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলোর রঙ সোনালি। যেন সোনালি বেত দিয়ে মাদুর কে বুনে রেখেছে হাতজুড়ে। তার মাথার চুলের চেয়েও হাতের চুল বেশি সুন্দর, এমনি মনে হলো রতনের।
প্লিজ, টেল মি ইয়োর নেম, বয়। লোকটি এবার যেন জোর গলায় অনুরোধ করল।
লোকটির গলার স্বরের জোরাল ভাব শুনে পড়ূয়া রতনের যেন চৈতন্য হলো। মৃদু ও অস্বচ্ছ কণ্ঠে সে এবার বলল, রতন।
রাটান? নাম শুনে লোকটি যেন একটু বিস্মিত হলো। এত সোজা নাম হয়তো সে আশা করেনি।
ইয়েস স্যার, বলল এবার রতন। এখন যেন সে তার হতবুদ্ধি ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারছে।
গুড, ভেরি গুড। বলল লোকটা। এর পর গড় গড় করে আরও কিছু বলল সে। ভাষাটা যে ইংরেজি, তা ভালো করেই জানে রতন। কিন্তু এ ভাষার মর্ম উদ্ধার করতে সে এখনও শেখেনি। রতন লোকটার কথার বিন্দু-বিসর্গও বুঝল না।
লোকটা এবার কী ভেবে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল, হাউ ফার ইজ ইয়োর কালিগঞ্জ ফ্রম হিয়ার?
রতন কথাটার মানে বুঝল। বগলদাবা করে রাখা বই এক বগল থেকে আরেক বগলে চালান করে দিয়ে সে আঙুল তুলে নাক বরাবর রাস্তা দেখিয়ে দিল।
হাউ মেনি মাইল্স? উত্তরে রতন তার ডান হাতের তিনটে আঙুল তুলে দেখাল।
থ্রি মাইল্স? লোকটা যেন খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ইয়েস স্যার। এতক্ষণে রতনের গলায় স্বর ফুটল। আর কথাটা বলার পর খুব গর্ব হলো তার মনে। ভাবল, এই তো সেই মানুষ, যারা পরীর দেশ থেকে মাঝে মাঝে উড়ে বাংলার বন-জঙ্গলে এসে নামে।
লোকটা রতনের মনের ভাব না বুঝে ‘থ্যাংক ইউ, গুড বয়’ বলে রতনের কাঁধে তার হাতটা রাখল। সোনালি চুল দিয়ে পাটি বোনা একটি হাত। কয়েক সেকেন্ড মাত্র হাতটা রাখল লোকটা। কিন্তু রতনের মনে হলো, তা অনন্তকাল। যেন অনন্তকাল ধরে লোকটা রতনের বাম কাঁধে হাত রেখেছে; এ রকম মনে হলো তার। আর এই মনে হওয়া-হওয়ির ভেতরে রোদ্দুরি সকাল যেন দোল খেতে লাগল হলুদ ল্যাজঝোলা একটা পাখির মতো। বনজ সুঘ্রাণে, লতা-পাতায়, ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলে, আগাছায়, বাদা-হাওড়ে, শটিবনে, আসশেওড়ার অন্ধকার খোঁড়লে যেন একটা পরিবেশের সৃষ্টি হলো। রতন সে পরিবেশের ভেতরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকল।
রতনের কাছে যা ছিল অনন্তকাল, তা আসলেই কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা বলে লোকটি আপন মনে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল কালিগঞ্জের দিকে।
রতন লোকটার চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকল হাঁ করে। যতদূর লোকটাকে হেঁটে যেতে দেখা গেল, ততদূর সে তাকিয়ে দেখল তার চলে যাওয়া। যে কাঁধে লোকটা তার হাত রেখেছিল, সে কাঁধটা সে কিছুক্ষণ পরে টিপে দেখল। কেমন যেন অচেনা আর অবশ মনে হলো জায়গাটা! যেন কী একটা সেখানে ছিল; একটু আগেই ছি, কিন্তু এখন আর নেই। যাওয়ার আগে সেটা যেন রতনের অনুভূতিটুকু শুষে নিয়ে চলে গেছে। আর কী আশ্চর্য, সে অবশতাও যেন একটা ধীরগতি কচ্ছপের মতো ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে রতনের সারা শরীরে। এবং রতনের আনন্দ হচ্ছে!
রতন এখন দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে। চোখ ঘুরিয়ে চারদিক দেখল। সুন্দর, স্বচ্ছ, নিষ্পাপ একটি সকাল। নির্বিবাদী একটি গ্রামের এক গ্রাম্য সড়কে একটি ১৩ বছরের ছেলেকে কেন্দ্র করে সকালটা যেন আনন্দমণ্ডিত এক উৎসবের মতো বার্তা পাঠাতে লাগল চারদিকে।
এই গ্রাম এতটাই নির্বিবাদী যে, এখানে এখন পর্যন্ত কেউ বিদ্যুতের জন্য, গ্যাসের জন্য, টেলিভিশন অ্যান্টেনার জন্য, মোটরগাড়ির জন্য বা চেঁচিয়ে কথা বলা মাইকের জন্যও কোনো প্রকার আন্দোলন করেনি! কোনো এক বিশেষ সমৃদ্ধির সময়ে গ্রামে ইলেকট্রিক খাম্বা বা থাম বসালেও তারপর আর বিদ্যুতের সংযোগ দেবার জন্য কেউ তদ্বির বা দেনদরবার করেনি। এমনকি এনজিও নামধারী কোনো প্রতিষ্ঠানও এ গ্রামকে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আদর্শ স্থান বলে শনাক্ত করেনি এখন পর্যন্ত। যেন অকাট দারিদ্র্যই গ্রামটির ভূষণ। এতটি গ্রামের মানুষকে পাকিস্তানিরা এসে মেরে ফেললেও এ গ্রাম কোনো প্রতিবাদ করেনি। ভাগ্যের কাছে নতজানু হয়ে থেকেছে। যেন ধৈর্যই মানবজন্মের মূল উদ্দেশ্য- এ রকমই এ গ্রামটির মনোভাব। সেই পরিস্থিতির ভেতরে, আল্লাহ্র কী কুদরত, এই গ্রামেরই ছেলে রতনের কপালে আজ সকালে এমন একজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটল, যে মানুষটি রতনের মনের ভেতরে গড়ে ওঠা ধ্যান-ধারণাকে একটা যেন মোচড় দিয়ে চলে গেল। রতনের মনের ভেতরে গড়ে ধ্যান-ধারণাকে যেন ওলট-পালট করে দিয়ে গেল। তার গ্রামের বাইরে যে বিশাল এক পৃথিবীর অজানা একটি সৌরভ প্রতি মুহূর্তে আকাশ-বাতাস আমোদিত করে বয়ে যাচ্ছে; গ্রহ থেকে গ্রহে, নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, তারই একটি অণুপরিমাণ সৌরভ রতনের চোখের সামনে যেন স্ম্ফুলিঙ্গের মতো উদ্ভাসিত হয়ে রতনকে বিমূঢ় করে দিয়ে গেল। যেন কোনো অচিন দেশের এক পরী এসে রতনের শরীরে ডানা ছুঁইয়ে দিয়ে আবার উড়ে চলে গেল।
গরিব রতন; অনাদিকাল ধরে এক গভীর অন্ধকারের শিকড়ে বাস করা রতন; তার মানসিক পরিমণ্ডলের ভেতরে নিরাপদে আশ্রিত রতন; এখন কী করে? কে কোত্থেকে এসে তার শিকড় ধরে টান দিয়ে চলে গেল? কে তাকে ইশারায় বলে গেল- এই গ্রামই পৃথিবী নয়; এই জীবন নয় আসল জীবন?
১৩ বছরের রতনের আর স্কুল যাওয়া হলো না। বই বুকে জড়িয়ে সে ফিরে এলো বাড়িতে। বাড়িতে তখন কেউ নেই। তার মা প্রতিবেশীদের বাড়িতে কাজ করতে চলে গেছে। সমস্ত বাড়ি সুনসান। এককানি জমির ওপর হোগলার ছাউনি দেয়া দুটো ঘর তাদের। দুটো ছাগল পুষেছে তার মা। সে দুটো গলায় দড়িবাঁধা অবস্থায় বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে কী সব নিঃশব্দে চিবোচ্ছে! রতন ঘরের দাওয়ায় উঠে বসে দু’পাশে হাত রেখে ভাবতে বসল। ভাবনাগুলো এলোমেলো, ছেঁড়া ছেঁড়া; পিছেরটা আগে, আগেরটা পিছে। এই খণ্ড-বিখণ্ড ভাবনা বা স্মৃতির ভেতরে রতন ক্রমশ নিবিষ্ট হয়ে যেতে লাগল। কী রকম এক ভালো লাগায় তার চারপাশ এখন ভরে যেতে লাগল! বাবাকে স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাঁই দিতে না পারলেও তার যেন মনে হতে লাগল, মৃত সেই পিতা পরম সন্তোষের সাথে তাকিয়ে আছে রতনের দিকে।
একটু পরে রতন দাওয়া থেকে নেমে এলো। দাওয়ার পৈঠা থেকে বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আবার সে স্কুলে যাওয়ার মতো একটা ভঙ্গি করে রওনা হলো। আবার সেই বাদাবন, বাঁশবন, শটিবন, আসশেওড়ার ঝোপ এবং কাদার দলামোচড়া খণ্ডগুলো, সেই সাথে প্রচুর আগাছা যেমন আগড়া, বন পালং, বড় বিষকাটালী, ধুতুরা, বন তামাকের ঝোপ- সব পেরিয়ে-মাড়িয়ে, ডিঙি মেরে পার হয়ে সে বড় রাস্তায় এসে উঠল। আবার সে কপালে হাত দিয়ে রোদের বারান্দা তৈরি করে তাকিয়ে দেখতে লাগল দূরে। যতদূর চোখ গেল দেখল একটা ঘুমন্ত বাছুরের মতো রাস্তাটা গা এলিয়ে পড়ে আছে। আরও দেখল প্রকৃতির ভেতরে এক ধরনের নিষ্পাপ ভাব আপন মনে যেন খেলা করছে। এখন দেবদারু আর শিরীষগুলো পাতা না দুলিয়ে স্থির হয়ে আছে। গাছে কোথাও কোনো পাখি নেই। তারা সব কোথায় খাবার খুঁজতে যেন ব্যস্ত!
এখন রোদ উঠেছে চড়া হয়ে।
রতন চোখ ফেলে আশায় আশায় তাকিয়ে থাকল। এবার সে তাকিয়ে থাকল কালিগঞ্জে যাওয়ার রাস্তাটার দিকে। কিছুদূর হেঁটে হেঁটে সে গেলও বটে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। অবশ্য সে কথাও ঠিক না। কারণ রতনের চোখের সামনে একটা-দুটো রিকশা-ভ্যান ধীরে ধীরে কালিগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। তার ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল সেই খালি ভ্যানের একটাতে সে চড়ে বসে। চলে যায় কালিগঞ্জ। জায়গাটা আদতেই একটা গঞ্জ। চাল-ডাল ও ভোজ্যতেলের বড় বড় গুদাম আছে সেখানে। কাঁচা চামড়ার আড়ত আছে দুটো।
রতনের মনে পড়, সে অনেক দিন আগে একদিন তার মায়ের সাথে কালিগঞ্জে গিয়েছিল। সেটা ছিল ঈদের আগের দিন। নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দিয়েছিল তাকে মা। নীল রঙের হাফ প্যান্টের ওপর হালকা লাল রঙের জামা। বড় সুখের একটা সময় ছিল সেটা রতনের। তারপর আর কোনোদিন সেখানে যায়নি রতন। তার মায়ের নিষেধ আছে একা একা গঞ্জে যাওয়া।
কিছুক্ষণ বাদে বই-খাতা বগলে ধরে আবার বাড়ি ফিরে এলো রতন। স্কুলে যাওয়া আর হলো না। স্কুলের পথে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এলো। সারাদিন খুব গভীর একটা চিন্তায় যেন কেটে গেল তার দিন। রাতের বেলা উদাস হয়ে রতন শুয়ে থাকল অন্ধকারে চোখ মেলে। সন্ধেবেলা একবার মা তাকে গায়ে ঠেলা দিয়ে বলেছিল, কী হয়েছে রে বাজান? অ্যামুন আউলা-বাউলা লাগে ক্যান তোরে আজ! উত্তরে রতন মুখ ঘুরিয়ে বলে উঠেছিল, ও কিছু না।
এখন নিশুতি রাতে বাঁশের মাচার ওপর পাতা মাদুরের ওপর শুয়ে হোগলা পাতায় ছাওয়া ঘরের চালের দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টির তীর ফেলে সে শুয়ে থাকল।
ঘরের অন্যদিকে শুয়ে থাকল তার মা।
তারাবিরির চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে সন্ধে নামতে না নামতেই। সাধারণত অন্যসব দিনে মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাতে রতন বাঁশের আলনায় কাপড় ঝুলিয়ে বাতি আড়াল করে পড়তে বসে। অনেক রাত অব্দি সে পড়ে। প্রতিদিনের পড়া তো আছেই, আগামী দিনের পড়াও সে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে আগের রাতেই।
আজ প্রথম তার সে রুটিনে ছেদ পড়ল।
মা ঘুমিয়ে গেলে রতনও বাতি নিভিয়ে বাঁশের মাচায় উঠল।
মাচায় উঠে সে দেখতে লাগল আকাশ। হোগলার চালের ছাউনি জায়গায় জায়গায় সরে গেছে অনেক দিন আগে। বর্ষার আগে আগে ছাড়া এ ছাউনি আবার নতুন করে পাতা হবে না। এখন সে ছাউনির গোল, চৌকো, তেরছা ফুটো দিয়ে দেখা যেতে লাগল আকাশ। রতন তাকিয়ে দেখল আকাশে আজ অনেক তারা ফুটেছে। তারাগুলো যেন রতনের দিকে তাকিয়ে আছে আজ। বিশেষ এক রতনকে তারাগুলো যেন দেখে নিচ্ছে ভালো করে। রতনের তখন মনে হলো, আর একটু পরেই আকাশ থেকে নেমে আসবে স্বর্গীয় এক আলো। সেই আলোয় স্নান করে জ্যোৎস্নার রঙ গায়ে মেখে তার সামনে এসে দাঁড়াবে সেই লোকটি। যার ঘড়ির কালো ঘেরের মধ্যে নৃত্য করে যাচ্ছে শাদা ও লম্বা একটা কাঁটা। লোকটি রতনের দিকে তাকিয়ে তার বাম কাঁধে হাত রেখে বলে উঠবে, হোয়াটস ্ ইয়োর নেম, বয়? রাটান? গুড, ভেরি গুড।
তারপর লোকটি তার সোনালি ডাঁটির চশমার ভেতর দিয়ে রতনের দিকে তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো ফেলে বলে উঠবে, এ কোথায় তুমি পড়ে আছ, রতন? এই অন্ধকার বাদাবন, শটিবন, আসশেওড়ার ঝোপ, কাদা খাঁচড়ে? এই ছাতিধরা, নরদুলা, চাপড়া, খাগড়া, মুথা, ছাগলাগাছা, হাজারদানা, টুনাকি, শিয়ালমুত্রা আগাছার ভেতরে কেন তুমি অযথা দিন কাটাচ্ছ? গ্রামের আদিম পশ্চাৎপদ গহ্বরে তুমি পড়ে আছ এভাবে একা! অথচ তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলের এখানে পড়ে থাকার কথা নয়! এই আদিম অন্ধকার তোমাকে খেয়ে ফেলবে রতন। তুমি পালাও। তোমার শরীরের খাঁজের ভেতরেই লুকানো আছে ডানা; রতন। অনেক বড় দুটো ডানা। ডানা দুটো তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। ওড়ার জন্য খুঁজে বের করতে হবে। এ পৃথিবী ক-ত-তো যে বড় রতন! আর তুমি এখানে এভাবে মলিন ও জীর্ণ কাপড়ে খালি পায়ে কাদা মাড়িয়ে, আগাছা মাড়িয়ে, ঝড়-জল-বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্কুলে যাচ্ছ রোজ!
বাঁশের মাচার ওপর শুয়ে থাকতে থাকতে রতনের এখন মনে হলো, তার শরীর যেন ভারী হয়ে আসছে। কারণ তার শরীরের খাঁজেই লুকানো আছে ডানা দুটো। উড়ে যাবার ডানা। আর সে কারণে তার শরীরের ওজন ক্রমশ যেন হয়ে উঠছে ভারী।
গ্রীষ্ফ্ম পেরিয়ে বর্ষা এলো, বর্ষা পেরিয়ে আবার এলো গ্রীষ্ফ্ম। তারপর আবার বর্ষা এবং আবারও গ্রীষ্ফ্ম।
রতনের এখন আর লেখাপড়া ভালো লাগে না। সে উদাস হয়ে একদিকে চেয়ে বসে থাকে। ইতিমধ্যে তার গরিব মা তারাবিবি অনেক বকাঝকা, তেলপড়া, পানিপড়া, দোয়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, মানত করেছে। রতনের মাথাও ন্যাড়া করে দিয়েছে ওর মা। কান্নাকাটিও করেছে অনেক। কোন্ শয়তানের আছর তার ভালো ছেলের ওপর পড়েছে বুঝতে না পেরে ফকির ডেকে তিন-তিনবার ঘরের চারপাশে মন্ত্র পড়ে ঘর বন্ধ করেছে। জানে সে, গরিব মানুষ। শক্তিশালী অশুভ শক্তির সাথে যুদ্ধ করার মতো জোর তার নেই। তাই পীরের দরগায় গিয়ে মাথাকুটে পীরের কাছে তার ছেলের জন্য প্রার্থনা করেছে, শিন্নি চড়িয়েছে বটগাছের নিচে গর্ত খুঁড়ে চুলো বসিয়ে। কিন্তু রতনের ভেতরে কোনো পরিবর্তন নেই।
রতন ন্যাড়া মাথায় খালি গায়ে একগাদা মাদুলি-তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে দাওয়ায় বসে থাকে। হাঁটতে গেলে তাবিজগুলো মটমট করে শব্দ করে; এ-ওর গায়ে ঠোকাঠুকি খায়। আর সে শব্দ শুনে রতন হাসে। আজকাল কথায় কথায় রতন হাসে। আগে সে এ রকম হাসত না। এমনকি কেউ কোনো কথা না বললেও রতন আপন মনে মুচকি মুচকি হাসে আজকাল। ভাবটা, রহস্যের চাবিকাঠি তার হাতের ভেতরেই আছে ধরা। তার মা তাকে ঘরে আটকে রাখতে চায়। আরও বেশি যেন তার ক্ষতি না হয়- এই ভয়ে তারাবিবি ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু রতন ঘরে থাকতে চায় না। মাঝে মাঝে ঘরেই থাকতে চায় না। ফাঁক পেলেই সে আদাবন, বাদাবন, শটিবন, বাঁশবন, আসশেওড়ার ঝোপ পার হয়ে; শিয়ালমুত্রা, কান্দুলি, কানাইনালা, ভাতশোলা, কাঁটাবেগুনের আগাছা দুপায়ে মাড়িয়ে, প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে বড় রাস্তায় উঠে তীক্ষষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে দূরে। কালিগঞ্জের দিকে ফেলে রাখে তার দৃষ্টি। যে সুদূরতার ইঙ্গিত সে পেয়েছে অজানা-অচেনা একজনের কাছ থেকে, তার অন্বেষণে সে দাঁড়িয়ে থাকে।
রতন ভাবে, শুধু একবার যদি সে সেই সোনালি মানুষটির দেখা পেত! আর মাত্র একবার। তাহলে মানুষটির হাত আঁকড়ে ধরে সে একটা ঠিকানার কথা জিজ্ঞেস করত; সোনার দেশের ঠিকানা। খাদ্যশস্যের সম্ভার, সুখ-সমৃদ্ধির সম্ভার, হাসি-আনন্দের সম্ভারে পরিপূর্ণ সেই দেশটির ঠিকানা; যেখানে রতনের মতো ছেলেরা গিয়ে বাস করতে পারে! কোটি কোটি ছেলে এ দেশে এই অন্ধকারে পচে-গলে খসে যাচ্ছে প্রতিদিন। রতন তাদের হয়ে সেই ঠিকানাটা চায়। ঠিকানাটা রতনের বড় দরকার। কোন্ সুদূরের ডাক একদিন একটি হাত হয়ে রতনের কাঁধ স্পর্শ করেছিল; এবার দেখা হলে রতন সে হাত আর ছাড়বে না। ঠিকানা না পেয়ে ছাড়বে না!
রতন অপেক্ষা করে। স্পর্শের আশায় প্রহর গোনে। এদিকে দিন পার হয়ে যায়। দিনের পর দিন।