ডুমুর খালার মেয়ে ফুলকে এইটুকু দেখেছিলাম। এতদিনে নিশ্চয়ই অনেক বড়ো হয়েছে। ফেসবুক অ্যাকাউন্টও খুলে থাকতে পারে। ‘ফুল’ নাম দিয়ে সার্চ করেও দেখেছি। যদিও ফেসবুকে বসার সময় আমার খুব একটা থাকে না। কোনোভাবেই তার ভালো নামটা মনে পড়ছিল না। আমি নাম দিতে বলেছিলাম, তৃপ্তিকণা সর্বেশ্বরী। খালা বলেছিল, এত কঠিন নাম! পরে যে কী নাম রেখেছিলেন- কোনোভাবেই মনে করতে পারছিলাম না। এবার দেশে ফেরার পর কেবলই ডুমুর খালার কথা মনে পড়ছে। ফুলকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।
ডুমুর খালা শেষ কোন ব্যাংকে ছিলেন তাও নিশ্চিত হতে পারি নি। আশ্চর্যেরই ব্যাপার!- ডুমুর খালা এত দিন আমাদের বাসায় ছিল অথচ তার ভালো নামটাও আমরা কেউই জানি না? বাবার কাছে, মায়ের কাছে কিছু চিঠি ছিল- তাতেও ইতির পর ‘ডুমুর’ দিয়ে শেষ। চিঠির ভেতরেও তেমন কোনো কিছু লেখা নেই। স্বামীর সঙ্গে তখনও ছাড়াছাড়ি হয় নি। সেই সময়ের কষ্টের কথা আছে কিছু। তাও একেবারে আভাসে ইঙ্গিতে। চিঠিগুলো ভালো করে খেয়াল করে বোঝা যায় এ বাড়িতে ঠাঁই নেওয়ার আগে আমার মা-বাবার মনে আগে থেকে ঠাঁই নিয়েছিলেন তিনি।
মা একটা স্কুলে পড়াতেন। ডুমুর খালা চাকরি নিলেন একটা ব্যাংকে। এর আগে একটা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের মাস্টারনি ছিলেন। বিএ পাস করেই স্কুলে ঢুকেছিলেন। স্কুলের চাকরি করতে করতে এমএ। আর এমএ-টা যতদিন হচ্ছিল না, ততদিন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন স্বামীর কীর্তিগুলো। তখন রাজশাহীর বর্ডার এলাকায় থাকতেন। স্বামীর নিজের বাড়ি ছিল। শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। ননদগুলোরও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মফস্বল শহরে দোতলা বাড়ি। একতলায় দুটো পরিবার থাকে। স্বামীটা একে চোরাইমালের ব্যবসা করত, তারওপর ছিল প্রতিদিন রাতে মদ খেয়ে বাসায় ফিরত। ডুমুর খালার বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিল না। প্রতিদিন রাতে ফিরে অদ্ভুত সব উছিলা ধরে গায়ে হাত তুলত। মদ খেয়ে মাঝরাতে রাতে বাসায় ফিরে ধাম ধাম করে দরজায় থাবা, ওই খোল। খুলতে দেরি হলে, কেন খুলতে দেরি হলো ? কেন?
-ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
– কার সঙ্গে?
– কার সঙ্গে মানে?
– আমি জানি না মনে করছ? তোমার যে ইয়ে আছে- রসিয়া বন্ধু, তার সঙ্গে ।
বলে কুৎসিতভাবে হাসতে থাকে।
– বাজে কথা বলতেছ কেন?
-অ্যাই চোপ, বাজে কথা- আমি বলছি? বাজে কথা বলছিস তুই!
– খবরদার একদম তুই তোকারি করবে না।
– কী আমার খেয়ে আমার পরে আমারে বলে খরবদার। শালি!
তারপরই গায়ে হাত তুলত।
দ্রুত খুললে এই এত তাড়াতাড়ি খুললি কেন বলে সেই একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মারত।
ডুমুর খালা মার খেতে খেতে বলত, আমি নিজের চাকরি করি। কটা টাকা দেও তুমি সংসারে। বাড়ি ভাড়ার টাকাগুলো ব্যবসায় নষ্ট করো। আর আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মদ খাও। এসব শুনে না শুনে মেরে যেত লোকটা। ডুমুর খালার বলেছিলেন, চাইলে আমিও পেটাতে পারতাম।
রোগা পটকা লোক তারওপর নেশা করে শরীরে তেমন জোর থাকত না। ডুমুর খালার গাট্টাগোট্টা শরীর। যাকে বলে কিনা পেটানো আর মাংসল। এমন চওড়া শরীরের লম্বা মহিলা আমি খুব একটা দেখি নি। আমাদের এখানে থাকার সময় প্রায়ই দেখাতাম ব্যায়াম করছেন। এমনিতে শাড়ি পরলেও ওই সময় সালোয়ার কামিজ পরতেন। গায়ের ওড়না থাকত না। ভেতরেও কিছু পরতেন না। ওঠবস করার সময় মনে হতো সামনে পেছনে একটি বিশাল ঢেউ বুক থেকে কোমর হয়ে পাছা পর্যন্ত বার বার ওঠানামা করছে। তারপর আরেকটা ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে বাসায় থাকতেন। আম্মার স্কুলে আর আব্বা অফিসে গেলেই একটা লোক আসত ডুমুর খালার ঘরে। লোকটাকে ঢুকিয়ে দরজ বন্ধ করে দিতেন।
আমার একটাই ভাই। বড়ো হওয়ার পর থেকেই শুনেছি আমেরিকা থাকে। একেবারে অল্প বয়সে বলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। তারপর কী সব আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ে। কদিন পর পর বাসায় কারা যেন এসে ভাইয়ার খোঁজ করত। বাবা-মাকে হুমকিধামকি দিত। আমি তখনও জন্মাই নি। আমার পরে কয়েকটা ভাইবোন হয়েই মারা যায়।
ভাইয়া পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার সময় যুদ্ধ লাগে। তারপর তো ওই চলতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও একই অবস্থা চলতে থাকে। তারপর ভাইয়া প্রথমে লন্ডন, পরে আমেরিকায় চলে যায়। সেখানে এক ইহুদি মহিলাকে বিয়ে করে। এতে নাকি বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। অথচ কষ্ট পাওয়ার কথা ছিল মায়ের। মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কালাম পড়েন। বাবা জুমার নামাজ ছাড়া মসজিদের যেতেন না। আর দেখেছি শবে কদর আর শবে বরাতে সারারাত নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন তিরিশটাই। শবে বরাতের সময় আমাকেও রোজা রাখতে হতো।
ডুমুর খালা নামাজ-রোজা কিছুই করতেন না। তারওপর ঘরে লোক আসত। রোজার সময়ও আসত। কোনো কোনো সময় রাতের বেলা লোকটা থেকেও যেত। আমি নাম দিয়েছিলাম পাতলা খান। লোকটা ইয়া লম্বা। প্রথমে নাম দিয়েছিলাম ঢ্যাঙ্গা মিয়া। পরে লোকটার নাম পাহলবি খান শুনে নাম দেই পাতলা খান।
আমি সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছি। ফ্রক তো ছেড়েছি সেই কবেই। তখন সালোয়ার, কামিজ ওড়না। আর সবচেয়ে যেটা খেয়াল আছে, ঘটনাটা ঘটেছিল ডুমুর খালার সামনেই, হঠাৎ একদিন দরদর করে রক্ত। আমি ভয় পাওয়ার আগেই ডুমুর খালা, ‘এই রে’ বলে এমন একটা খুশির আওয়াজ করলেন যেন মহাআনন্দের কোনো ঘটনা ঘটেছে। আমি তো প্রায় চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। ডুমুর খালা বলেন, না না, একদম ভয়ের কিছু নেই। এরপর ডুমুর খালা যা যা বলেছিলেন, এ ঘটনার পর ডুমুর খালার সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা কোনোদিন কারো সঙ্গে হতে পারে কল্পনাও করি নি। ডুমুর খালা এরপর থেকে ঘুরেফিরে আমাকে বলতেন, মেয়েরা কতটা শক্তিশালী, মেয়েরাই আসলে পৃথিবীটা চালাতে পারে, গোটা পুরুষজাতটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারে। কারণ তাদের কাছে এমন এক জিনিস রয়েছে যা পুরুষরা আর কোথাও পায় না। আর পুরুষরা মেয়েদের কাছে ওটাই চায়। (পাতলা খানের কাছ থেকে শোনা) ডুমুর খালা আমাকে একটা ধাঁধা ধরেছিল। আচ্ছা বলত, নারী আর পুরুষের মধ্যে তফাৎ কী?
আমি বলি, কী?
-একজন নারী একজন পুরুষের কাছেই সব কিছু বা অনেক কিছু চায়। আর একজন পুরুষ অনেকজন বা সব নারীর কাছে একটা জিনিসই চায়।
আমি তখনও পুরুষরা ওই চাওয়ার ব্যাপারটা ধরতে পারি নি।
খালাকে বলি, বুঝলাম না। কিন্তু এটা তো তোকে নিজে থেকে বুঝতে হবে সোনা।
নিজেকে খুব বোকা বোকাও লাগে। কিন্তু আমি তো বোকা ছিলাম না। তারওপর খালা আমকে বয়সের আগেই আরেকটু বড় করে দিয়েছিলেন। পর পর দুটো বোর্ড পরীক্ষায় আরেকটু হলে মেধাতালিকায় নাম উঠে যাচ্ছিল। ডুমুর খালা বলেছিল, মন খারাপ করিস না। তোর মাথাটা কত পরিষ্কার! তোকে কেউ ঠেকাতে পারবে না রে।
খালা আমাকে বলতেন, মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো আশ্রয় হল লেখাপড়া। এটা কখনো ছাড়বি না। মেয়েদের কেন, মানুষের সবচেয়ে বড়ো আশ্রয় লেখাপড়া। লেখাপড়ায় ভালো হলে আর কোনো চিন্তা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে নিয়েছিলাম। আব্বার ইচ্ছা ছিল ডাক্তারি পড়ি। চাচা আব্বাকে বোঝালেন, অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স কত ভালো সাবজেক্ট। আমি অনার্সে, মাস্টার্সে দুবারই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হই। তারপর স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় চলে আসি। লেখাপড়ার চাপে স্বার্থপরের মতো সবার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। উইলিয়াম বলেছিল, নিজের দিকে একবার তাকাও, বেইবি।
অনার্স পাস করার পরই আম্মা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কলেজ পাস করার পর থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। আমার একটা কথা, আগে মাস্টার্স শেষ হোক। ততদিনে আমার চোখের সামনে আগামীর পথটা একেবারে ঝকঝকে হয়ে দেখা হয়ে যায়। স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছিলাম আমাকে কোথা থেকে কোথায় যেতে হবে। এমনকি উইলিয়াম, মানে উইলিয়াম মরিসের মতো কারো সঙ্গে আমার দেখা হবে- সেই দৃশ্যটাও দেখতে পাচ্ছিলাম।
বরাবরই শরীরের যত্ন নিতাম। ব্যায়াম করতাম। ডুমুর খালা বলত, তুই তো দেখি একটা খাপখোলা তলোয়ার হয়ে যাচ্ছিস। ডুমুর খালার কাছেও কিছু অন্যরকম ব্যায়াম শিখেছিলাম। গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়তাম। সময় করে প্রায়ই সিনেমা নাটক দেখতাম। অনার্স পাস করার পর ঋদ্ধরূপম দত্ত নামে একটা ছেলে আমার প্রেমেই পড়ে যায়। প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশা শুরু করে। ওর সঙ্গে বেশ কয়েকবার মহিলা সমিতিতে নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। ভারতীয় হাইকমিশনে, অলিয়াসঁ ফ্রাসেসে, গ্যেটে ইন্সটিটিউটে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক-বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থেকে হিচকক-ফেলিনি-বার্গম্যান-গদার-থ্রুফো-কুরাশাওয়া আর কতজনের কত যে সিনেমা দেখেছি। ঋদ্ধ ফিজিক্সে পড়ত। বলত, মৃণাল সেনও ফিজিক্স পড়তেন।
– মৃণাল সেন হবে নাকি?
-চাইলেও কি হতে পারব!
– মৃণাল সেন হতে যাবে কেন? তুমি হবে তোমার মতো ।
ওর সঙ্গে এসব কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম। যাচ্ছিলাম শামসুন্নাহার হলের দিকে। মালিহার কাছ থেকে আমার একটা বই নেওয়ার কথা। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত সন্ধ্যার পর কোনো কারণ ছাড়া আমি বাইরে থাকতাম না। থাকলে আগে থেকে বাসায় জানিয়ে দিতাম। নাটক-সিনেমা দেখার দিনগুলোতে ঋদ্ধ নিজেই আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে চাইত। আমি কখনোই রাজি হই নি।
ও বলত, তোমার বাবা মা কি রাগ করবেন?
-আমি এটা পছন্দ করি না, ঋদ্ধ। তুমি যদি এমনি আমার বাসায় যেতে চাও তো চল। বাসায় যাবে, বসবে, রাতের খাবার খেয়ে তারপর ফিরবে, এতে যদি রাজি হও, তো চল। কিন্তু আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যই শুধু যাবে, এর কোনো দরকার নেই। কি, যাবে?
ঋদ্ধ প্রায়ই আসত। ও অন্য ধর্মের, তারওপর বয়সে আমার চেয়ে ছোটো, যদিও ও আমার ব্যাচমেট ছিল। বন্ধুরা বলত, আমি জাতে মাতাল, তালে ঠিক। তলে তলে প্রেমও করছি। আমি শুধু হাসতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঋদ্ধর সঙ্গে খুব ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। আর অপেক্ষা করছিলাম রেজাল্টের। এই সময় একদিন মহিলা সমিতিতে নাটক দেখে ঋদ্ধর সঙ্গে বের হয়েছি। রিকশা পাওয়ার পর মনে হল ঋদ্ধ কী যেন বলবে। আমি বলি, তুমি কি কিছু বলবে?
ও খুব ধীরে ধীরে বলে, আমার পুনের যাওয়ার ব্যাপারটা হয়ে গেছে।
এমন করে বলে যেন খুব মন খারাপ করা একটা খবর আমাকে বলছে। বলেই মাথাটা নিচু করে।
ওর কথা শুনে আমি লাফিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ি। একটা চিৎকার দিয়ে, বলতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। ঋদ্ধ একঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। এমন উচ্ছ্বাস আমি কোনোদিন কোনো ব্যাপারে দেখিয়েছিলাম কিনা মনে নেই। এমনকি আমেরিকায় আমার স্কলারশিপটা হওয়ার সময়ও এমন লাফিয়ে উঠি নি। উইলিয়াম যখন ডুমুর খালা পাতলা খানকে দেওয়া শর্তের মতো আমর কথা মেনে নিয়েছিল, তখনও এত আনন্দ বোধ করিনি। বাবা মা জানে বিয়ে হয়েছে, আসলে জীবনে কিছু গোপনীয় ব্যাপার থেকেই যায়। যা কাউকে বলা যায় না। বলার দরকারও নেই।
এয়ারপোর্টে ঋদ্ধকে বিদায় দিতেও গিয়েছিলাম। ওর বাবামা ছেলের সিনেমা নিয়ে পাগলামী খুব একটা পছন্দ করতেন না। তারপরও পুনে যাওয়ার সুযোগটাতে ওরা প্রথমবারে মতো স্বস্তি পেয়েছিলেন। তারাও এসেছিলেন। লাউঞ্জে ঢোকার ঠিক আগে, ঋদ্ধ পাও বাড়িয়েছে, তারপর হঠাৎ ফিরে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে এমন করে আমার দিকে তাকায় যেন শেষ বারের মতো আমাকে দেখে নিচ্ছে। সেটা সর্বস্ব হারাতে যাওয়া মানুষের দৃষ্টি, নাকি সম্পূর্ণ অজানার উদ্দেশে যাওয়া মানুষের দৃষ্টি- আমি ঠিক বুঝতে পারি নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা সিনেমা দেখেছিলাম। এক সৈনিকের তার প্রেমিকার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। মুখটাকে ক্লোজশটে এনে তার দুটো চোখ ফুটে উঠেছিল গোটা পর্দা জুড়ে। সেই চোখে ফুটে ওঠে এমন এক আকুতি। হয়ত সে বলতে চেয়েছিল, হয়ত ফিরে আসবো না, ভালো থেকো, বা বলতে চেয়েছিল, আমি যদি বেঁচে থাকি তো তোমার কাছেই ফিরে আসব, বা, তোমাকে না বলে আমি মরব না, বেঁচে থাকি কি মরে যাই, তুমি অন্তত জানবে। যদি মরে যাই তো নতুন করে জীবন শুরু করো। জীবন খুব বড়ো, যদি আমাকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসো তো বিয়ে করো, করে সুখী হয়ো, সুখী তোমাকে হতেই হবে, কারণ আমি জানি, তুমি কত ভালোবাসতে জানো, এই ভালোবাসা আমি না হয় না-ই পেলাম, কিন্তু কোনো পুরুষ যদি তোমার কাছ থেকে এই ভালোবাসা না পায় তো এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা জগতে আর কিছু হতে পারে না…এমন কত কথাই না বলতে চাইছিল সেই চোখ দুটো।
ঋদ্ধ আমার দুটো হাত নিজের দুহাতে নিয়ে বলছিল, দুলি একটা কথা বলা হয় নি। তুমি একদিন জানতে চেয়েছিলে, কেন পার্টি করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ আমি তোমাকে দেখেছিলাম। বিপ্ল¬ব যদি কোনো কিছু থেকে থাকে তো তুমিই সেই বিপ্লব। এছাড়া আর কোনো বিপ্লবের অস্তিত্ব নেই।… ভালো থেকো। বলেই একেবারে ঝট করে ঘুরে চলে গিয়েছিল সে। উইলিয়ামের বুকের ওপরে শুয়ে ঋদ্ধর এই কথাগুলি বলেছিলাম।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল। মাজে মাঝে মানুষের কী যে হয় এবার দেশে ফিরে ঘুরে ফিরে ডুমুর খালা, পাতলা খান আর ফুলের কথা মনে করে চলেছি। পাতলা খান অনেক আগে থেকেই এক ছেলে, এক মেয়ের বাপ। খালার প্রেমে তার একেবারে হাবু ডুবু অবস্থা। বিয়েও করতে চেয়েছিল। খালা রাজি হয়নি। বিয়েশাদিতে খালার কোনো বিশ্বাস নেই। বিয়েশাদি বাদ দিয়ে কিছু হলে হবে, নইলে নয়। এই শর্তে সম্পর্কটা হয়। ফুল পেটে আসার কথা আমাকে ভেতরের অনেক কথা বলেছিলেন।
আমি বলি, এখন?
খালা বলে, যা ছিলাম তাই থাকব।
আমি বলি, পারবে থাকতে?
-কেন পারব না।
– অন্যরা জানলে?
– জানবে না।
ফুলকে নিয়ে তিন বছরের মতো আমাদের বাসায় ছিলেন। খালাকে বহুবার বলেছি, তুমি একদম চিন্তা করবে না ফুলের জন্য আমি আছি। পাতলা খানও দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল, খালা রাজি হন নি। পাতলা খান আগের মতোই আসা-যাওয়া করত। এর ভেতরে আমার স্কলারশিপটা হয়ে যায়। আমেরিকায় বসে খবর পাই, খালা একদিন কাউকে কিছু না বলে উধাও! কেবল ছোট্ট একটা চিঠি লিখে গেছে। চিঠিটা পড়ে মা নাকি কেঁদেছেন।
আমেরিকা থেকে কয়েকদিনের জন্য ফিরেছিলাম। বাড়িটা ভাঙা হচ্ছিল। কদিন আগে মিলাদও হয়েছে। একটা ডেভলপার কোম্পানি ছয়তলা করবে। প্রায় দশকাঠা ছিল আমাদের জায়গাটা। অনেকগুলো ফ্ল্যাট হবে। আব্বা এক কোটি টাকা আর চারটা ফ্ল্যাট পাবেন। কাছেই একটা ভাড়া বাসায় উঠেছি আমরা।
যেদিন বাড়িটা ভাঙা শুরু হয়। দেখতে এসেছিলাম। চিলিকোঠার ছাদ ভাঙা শুরু হওয়া মাত্র আমার ফেলে আসা সমস্ত জীবনটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। আর টের পাচ্ছিলাম, তার পেছনে আবছা ছায়ার মতো ডুমুর খালার মুখটাই দেখছি। সেদিন প্রথম টের পাই, ডুমুর খালা না হলে আমি হয়ত আমিই হতাম না। পরম এক কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ভিজে ওঠে।
বাবার কথা শুনে চমতে উঠি, ‘কীরে? কাঁদছিস যে!’
মুখটা আড়ালে নিয়ে বলি, চোখে কী যেন পড়ল। ঠিক তখন মনে পড়ে, ফুলের ভালো নাম ছিল, ফারিয়া আইরিন ফুল। বাসায় গিয়ে ফেসবুক খুলে দেখতে হবে এবার ওকে পাওয়া যায় কিনা।
সূত্র: উত্তরাধিকার