শ্বাশুড়ি মা

শ্বাশুড়ি মা
রুটি বানাচ্ছি বসে বসে, শ্বাশুড়ি মা চুলায় রুটি গুলো আগুনে ছ্যাঁক দিচ্ছে। রুটি বানিয়ে দিতে দেরি হলো বলে, রুটি উল্টানো গরম চামচ আমার গালে লাগিয়ে দিলো। আমি গালে হাত দিয়ে রাখছি, চোঁখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে। শ্বাশুড়ি মা বলে, “তোর মা কোনদিন কাজ শেখায়নি? রুটি বানাতে পারস না ঠিক মতো! কেমন মেয়ে জন্ম দিলো ” আমি গালে হাত দিয়েই কান্না কন্ঠে বললাম, “এক মা না হয় জন্ম দিলো, আরেক মা তাই মেরে কাজ শিখাচ্ছে। আপনি শিখিয়ে দেন , শিখছিতো মাইর খেয়ে। “
শ্বাশুড়ি মা আমার হাত থেকে রুটি বানানো জিনিস গুলো কেড়ে নিয়ে। টেবিলের উপর রাখলো। আমি দেখছি কি করে ওনি। প্রতিদিনই রুটি ও সবজি সকালে আমি ও ননদ মিলে বানাই। বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা করে যার যার মতো যায়। দুদিন হলো ননদ মামা শ্বশুরের বাড়ি গেছে। তাইতো বউ, শ্বাশুড়ি মিলে নাস্তা বানাচ্ছি।
শ্বাশুড়ি গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দিলো,আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেলো পাশের রুমে। গরম চামচ লাগানো জায়গায় এখনো হাত দিয়ে ধরে আছি। ওনি মলম নিয়ে আমার গালে লাগিয়ে দিচ্ছে। কোন শব্দ করছে না। আমাকে বসতে বলে ওনি চলে গেলো রান্না ঘরে। আমিও তার পিছনে গিয়ে দেখি ওনি রুটি বানাতে বসলো। আমি যখনই বানাতে চাইলাম বলে,”বউ তোমার করা লাগবে না। আজ না হয় আমিই বানাই তুমি যাও বসে আরাম করো। গালটা লাল হয়ে গেছে। কাউকে বলার দরকার নাই। ” আমিও কিছু না বলে চুপচাপ চুলার সবজি বসালাম। সব কিছু ভালো করে দিয়ে বসিয়ে চুলায় । শ্বাশুড়ির পাশে বসলাম। আমি ছোট ছোট ময়দার আঁটি করে দিচ্ছি। ওনি বানাচ্ছে।
“জানো বউ মা, গত ৩০ বছর রোজ করে এভাবেই নাস্তা বানিয়ে খাওয়াই সবাইকে। ভেবে ছিলাম বড় ছেলের বউ আসবে আমার একটু ছুটি হবে। বিয়ে করিয়ে যখন বড় ছেলের বউ আনলাম, বউকে মেয়ের মতোই আদর করতাম। সব কিছুতে মিলেমিশে থাকতাম। কয়েকমাস পরই ছেলে ও তার বউ চলে যায় নতুন বাসা নিয়ে। ” আমি,”তাই, আমিও এমন করবো ভাবতেছেন? ” শ্বাশুড়ি বলে,”আগের জন নিয়ে স্বপ্ন ছিলো, আশা ছিলো থাকে নাই। আর তুমি চলে গেলে কি হবে আর! ভাইয়ের মেয়ে বিয়ে করলাম আর কি হলো?’ “আমি সবসময়ই মায়ের মতোই ভালবাসবো। কে কি করলো জেনে লাভ নাই “(আমি)
-“তোমাকে আমার ছেলে নিজে বিয়ে করে আনছে। তাই তোমার যা খুশী করো ” দুজনে নানান কথা বলতে বলতে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলাম। আজই প্রথম শ্বাশুড়ি এত ভালো করে কথা বলছে। আমি সুরাইয়া, রানাকে বিয়ে করে আসছি বউ হয়ে। তাও সবার অমতে। বিয়ের পরই শ্বশুর আমাদের কিছু না বললেও শ্বাশুড়ি আমায় পছন্দ করে না। বিয়ে হলো ২মাস হলো। এই দু-মাসে আমাকে প্রতিদিনই এটা ওটা নিয়ে গালাগালি করে। মাঝে মাঝে গায়ে হাত দিতো শ্বাশুড়ি। এইতো সেই দিনের কথা, তরকারিতে লবণ কম হওয়ায়, বাটি ছুড়ে মারছে আমায়। রানাকে কিছু বললে বলে, বাড়ির ভিতরে মহিলারা কি করে তা জানার ইচ্ছে নাই। মিলেমিশে তোমরা থাকো। আমরা সারাদিন কাজ করি। বাসায় এসে এইসব শুনতে চাই না। আসলে রানা সব কিছুই বুঝে।
সবাই ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করতে বসলো। শ্বশুর রুটি একটু খেয়েই বলে, বউ মা আজ দেখি লবণ কম নিয়ে কেউ কিছু বলে না। আমার শ্বাশুড়িও খেয়ে বলে, লবণ কম দিছে তাতে কি? সবাই এমনই খেয়ে নাও। বউ এর চেয়ে আর ভালো দিতে পারবে না। চুপচাপ খাও সবাই। আমি ও রানা শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছি অবাক হয়ে। আজ অন্য দিন সামন্য কিছু নিয়ে চিল্লাচিল্লি করতো। আজ চুপচাপ। সবাই নাস্তা করে খেয়ে চলে গেলো। আমি টেবিলের সব খাবার গুছাতে গেলে , শ্বাশুড়ি বলে বউ মা তুমি ঘরে যাও আমি এইসব করে আসতেছি। শ্বাশুড়ির আজ কি হলো বুঝতে পারছি না। রানী খানের মতো ভেবেছিলাম গত ২মাস। আজ দেখি পুরাই সাবানার মতো আচরণ। রুমে বসে বসে টিভি দেখছি কিছুক্ষণ পরই আসলো শ্বাশুড়ি।
-চলো বউ, মাথায় একটু তেল দিয়ে দাও। মাথাটা কেমন করছে। আমি তেলের বোতল নিয়ে বসলাম, তেল দিয়ে দিতে। আমি তেল দিচ্ছি আর শ্বাশুড়ি শুনাচ্ছে প্রথম বউকে আদর করার কথা। আমার এইসব শুনে হিংসে হচ্ছে। আমার সাথে এমন করে কেনো? তেল দেওয়া শেষ হলে, ওনিও আমার চুল গুলো আচঁরে দেয়। ননদও চলে আসলো ১১টা নাগাত। এসেই আড্ডায় মেতে উঠলাম। অন্য দিন আড্ডা দিলে শ্বাশুড়ির বাংলা ওয়াজ শুরু হয়ে যেতো। আজ কিছু বলে না। ননদও আমার কাছে বলে আজ এমন কেনো মা।
সবাই মিলে দুপুরে রান্না করে নামাজ পড়ে নিলাম। রানা ও শ্বশুর বাড়ির বাহিরে রাতে আসবে। আমরা তিনজন খেয়ে নিলাম। শ্বাশুড়ি বলছে, বউ মা চলো মার্কেটে যাই। বিয়ের পর তোমায় কিছুই কিনে দেইনি। আজ মন চাইছে কিছু দেই। ননদ ও আমি জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। তারপরও সবাই চললাম মার্কেটে। শ্বাশুড়ি আমাদের নিয়ে স্বর্নের দোকানে গেলো। ওনি কিছু গহনা বের করলো ব্যাগ থেকে। মেপে দেখে ৬০গ্রাম। প্রায় ২লাখ টাকা বিক্রি করে দিলো। তারপর আমাকে ও ননদকে কানের দুল কিনে দিলো একই রকম। কাপড়, জুতা, শাড়ি সব কিছু একই রকম কিনে দিলো আমাকেও ননদকে। যদিও ও শাড়ি নেয় নি। বাসায় ফিরে হিসাব করে দেখলাম দেড় লাখ শেষ টাকা। আমিও ননদ শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে গেলাম।
_মা, এত টাকা খরচ করলেন কেনো?(আমি)
_আমার মেয়েদের জন্য আমি করবো না কে করবে?(শ্বাশুড়ি)
_এত গহনা! (ননদ)
_তোর দাদী আমাকে দিয়ে ছিলো। ২০বড়ি হবে। ওখান থেকে ৫বড়িই বিক্রি করছি। ৫বড়ি বড় বউকে দিছি। বাকি ১০থেকে সুরাইয়ার ৫ আর তোর ৫। আজকের গুলো আমার মেয়েদের দিছি। বউকে না। (শ্বাশুড়ি)
_মা,যদি শ্বশুর শুনে!(আমি)
_এই গুলো কেউ জানে না।
আমার শ্বাশুড়ি চুপিচুপি দিয়ে ছিলো। আর তোমাদের জন্য তোমার শ্বশুর রাখছে সব কিছু আলাদা। (শ্বাশুড়ি) এইসব শুনে মাথা চক্কর দেওয়ার মতো অবস্থা। আমার শ্বাশুড়ি তাহলে এত দিন ইচ্ছে করে এমন অত্যাচার করতো। আজ মেয়ের মতো ভালবাসা। সবাই মিলে আমাদের চললো সুন্দর জীবন। আর কখনো কোন কিছু নিয়ে বকে নি। বিয়ের প্রথম ২মাস যা করছে সব সহ্য করে নিয়েছি। তাই আল্লাহ এত সুখ দিলো। বিয়ের ১বছর কেটে গেলো। একদিন আমার শরীর খারাপ।
-বউ মা চলো হাসপাতালে যাই।
-লাগবে না। এমনিই কেমন লাগছে জানি।
আমাকে জোর করেই নিয়ে গেলো হাসপতাল। ডাক্তার ভালো করে দেখে বলে মা হতে চলছি। আমার শ্বাশুড়ি শুনে অনেক খুশী। বাড়িতে এসে সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো। দাদি হওয়ার আনন্দের শেষ নাই তার ভিতর। আমাকে সেই দিনের পর গত ১বছরে কিছুই বলে নি। একজন মেয়ের মতোই আমাকে আদর করতো। শ্বাশুড়ি যে মায়ের চেয়ে বেশি হয়। তা আমার জানা ছিলো না। আমিও মায়ের মতো ভালবাসি। পরিবারের সবাইকে ভালবাসি।
শ্বাশুড়িকে মায়ের মত দেখলে জীবনে সুখ ছাড়া কিছু আসে না। দেখতে দেখতে আমার বাচ্চা হওয়ার সময় হয়ে গেলো। বাবু পেটে থাকার সময় কোন কিছু করতে দেয় নি। মেয়ে হয়েছে আমার। বাসার সবাই খুশী। আমার শ্বাশুড়ি সারাক্ষণই নাতীনকে নিয়ে খেলা করে, আদর করে। আমি আমার শ্বাশুড়ি জন্য সবসময়ই এটাই দোয়া করি যেনো সারাজীবন মা ও মেয়ের মতোই থাকতে পারি। রানা আমাকে বলে, “যদি তখন তোমার কথা শুনে মায়ের সাথে কিছু বলতাম। যে কোন একজনকে পেয়ে অন্যজনকে হারাতাম। তোমাদের সব কিছু তোমরাই সমাধান করে থাকলে। তাই আজ এত সুখ আমাদের” আমি বলি,”তোমার মত স্বামী ও পরিবার পেয়ে আমি ভাগ্যবতী। আমার মেয়েটাও অনেক সুন্দর শিক্ষা দিয়ে বড় করবো। একদম মায়ের মতো ” রানা,”তোমরা যা খুশী করো। আমার এবার ছেলে হলেই হয়। “
_”আমার কথা ভাবো না। সবসময় বাচ্চা এটা সেটা নিয়ে ভাবো। মা ছাড়া কেউ ভাবে না আমাকে নিয়ে। শ্বাশুড়ি আছে বলেই আমি ভালো আছি “
-“তুমি যাও তোমার মায়ের কাছে। আমার ছোট মা’কে আমার কাছে দিয়ে যাও। ” প্রত্যেক মেয়ে যদি আমার মতো শ্বাশুড়িকে মায়ের মতোই ভাবে, তাহলে মেয়ে হয়ে থাকতে পারে। আসলে শ্বাশুড়ি মা আর জন্মদাতা মা, মায়েরা মা’ই হয় আমার শ্বাশুড়ি মায়ের জন্য দোয়া করবেন। সবাই যেনো একসাথেই থাকতে পারি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত