আবদ্ধ রুমের গল্প

আবদ্ধ রুমের গল্প
রেস্টুরেন্টের সামনে এসে খানিকটা অবাকই হলাম। এই রেস্টুরেন্টটা শহরের বেশ নামীদামী রেস্টুরেন্টের মধ্যে একটি। সারাক্ষণ মানুষের ভীড় লেগে থাকে এখানে৷ কিন্তু আজ ভীড় নেই৷ ভীড় কেন মানুষ জনই দেখা যাচ্ছে না। অদ্ভুত ব্যাপার! আমি এর আগেও এখানে এসেছি মিহিনের সাথে৷ কিন্তু কখনই এমন দেখিনি৷ আমি দাঁড়িয়ে থাকতেই এক কাপল এলো৷ দারোয়ান তাদের ভেতর ঢুকতে দিলো না৷ কী জানি বলল৷ তারা চলে গেল৷ আমি কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম বাইরে৷ ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না এমন এক বিড়ম্বনায় আঁটকে ছিলাম৷ ঠিক সে সময়ই রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে স্যুট পর এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন৷ আমার সামনে এসেই কিছুটা সবিনয়ে বললেন,
-মিস্টার তাসফি, রাইট?
আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম৷ এই লোককে আমি চিনি বলে মনে হয় না৷ ইনি আমার নাম জানলেন কীভাবে? লোকটা আবারও কোমল স্বরে বলল,
-স্যার ভেতরে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন৷ প্লিজ ভেতরে আসুন৷
তখনই মনে পড়লো এই ব্যাটা ওই লোকের এসিস্ট্যান্ট। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছু না বলে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেলাম৷ এসিস্ট্যান্ট সাহেব আমার সামনে সামনে গেল৷ এমন ভাবে হাঁটছিল যেন আমি সম্মানিত কেউ৷ আমাকে সম্মানের সাথে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ তার এমন আচরণে আমি অত্যন্ত অবাক হলাম৷ আমার মতো নর্দমার এক মানুষকে এমন সম্মাননা দেয়াটা অযৌক্তিক। আমি এসবের প্রাপ্য নই৷ তবুও কেন দিচ্ছে কে জানে৷ আমার অবশ্য খারাপও লাগছিল না৷ হঠাৎ এমন সম্মান পেলে বেশ ভালোই লাগে৷ আমি ভেতরে গেলাম৷ ওখানে গিয়েই দেখতে পেলাম মানুষটাকে। পৃথিবীর সবচে জঘন্যতম মানুষটাকে৷ আমাকে দেখেই তিনি মুচকি হাসলেন৷ আমিও বিপরীতে হাসলাম৷ উনি আমায় বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। কোমল স্বরে বললেন,
-কেমন আছো? আমি মৃদু হেসে বললাম,
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?
ভদ্রলোক হাসলেন। জবাব দিলেন না৷ এই ভদ্রবেশী মানুষটার নাম অয়ন চৌধুরী। ইয়াং আইকন অয়ন চৌধুরী। বেশ স্মার্ট এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে৷ বাবার কোম্পানির দেখাশোনা করছেন৷ প্রথম প্রথম তাদের কোম্পানির তেমন নাম ডাক না থাকলেও উনার স্পর্শে তাদের কোম্পানি বেশ এগিয়ে গিয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছে অয়ন চৌধুরীর নাম৷ ক’দিন পত্রপত্রিকায় বেশ উত্তপ্ত অবস্থায় ছিলেন এই ভদ্রলোক। সে সময় আমিও ভাবলাম এই মানুষটার মাঝে আসলেই কিছু একটা আছে৷ বেশ উদ্যমী। কিন্তু এরপরের ঘটনাটা আমাকে এমন ভাবে আহত করলো যে এই মানুষটার জন্যে যতো শ্রদ্ধা ছিল সব ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়ে গেল৷ এতো ঘৃণা আমি আজ পর্যন্ত কাউকে করিনি৷ অয়ন চৌধুরী বললেন,
-তুমি এতো সহজে ব্যাপারটা মেনে নিবে আমি ভাবতেও পারিনি৷ আমি খানিকটা হেসে বললাম,
-আমরা সব সময় যা ভাবি তা কখনই হয় না৷ ভাবনার আড়ালের কিছু হয়৷ অয়ন চৌধুরী আর কিছু বললেন না৷ টাকার ব্যাগটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন৷ বললেন,
-দেখো টাকাটা ঠিক আছে কী না৷ আমি ব্যাগটা নিলাম৷ নিয়ে বললাম,
-গোনার প্রয়োজনবোধ করছি না৷
অয়ন চৌধুরী হাসলেন৷ ঠিক সেই সময়েই মিহিনে এসে উপস্থিত হলো৷ এসে একদম আমার সামনে দাঁড়ালো৷ আমি তার দিকে তাকালাম। মেয়েটা আজ চোখে কাজল দেয়নি৷ চোখ-মুখ ফ্যাকাসে৷ কেমন মলিন হয়ে আছে৷ আমার কেমন জানি মায়া হলো মেয়েটার জন্যে৷ আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ঠিক সে সময়েই মেয়েটা আমাকে কষিয়ে একটা চড় দিলো৷ তারপর হনহন করে চলে গেল৷ আমি নিজেকে সামলে চারপাশে তাকাতেই দেখলাম রেস্টুরেন্ট কর্মিরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অয়ন চৌধুরীও শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। যেন তেমন কিছুই হয়নি৷ এই চড়টা আমার প্রাপ্য ছিল। তিনি যেন জানতেন এমন কিছুই হবে৷ কথা অবশ্য সত্য৷ চড়টার উপযুক্ত আমি। ভদ্রলোক উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-হ্যাভ আ গুড ডে ডিয়ার৷ টেক কেয়ার। এই বলে চলে গেলেন৷ উনি চলে যাওয়ার পরেই ওয়েটার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-স্যার, কী খাবেন বলেন? আপনার জন্যে আজকের সব ফ্রি। যা ইচ্ছে অর্ডার করতে পারেন৷ আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়৷ এই রেস্টুরেন্টটা অয়ন চৌধুরীর। এই ব্যাপারটা আমি জানি৷ এই লোক খাওয়ায় কমতি করবেন না৷ সেটাও জানা আছে আমার৷ বললাম,
-এখানকার যে খাবারটা তোমার সবচে বেশি পছন্দ সেটা খাওয়াও আজ৷ ছেলেটা মৃদু হেসে প্রস্থান করলো৷ রুমে ঢুকতেই দেখলাম ইমন শুয়ে আছে। আমাকে দেখতেই বলল,
-কই ছিলি? আমি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললাম,
-কোথাও না। ইমন উঠে বসলো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তোর কী হয়েছে? ইদানীং কেমন অদ্ভুত বিহ্যাভ করছিস।
-কই? কিছু হয়নি তো!
-দেখ তাসফি আমার থেকে কিছু লুকাবি না৷ আমি তোর বন্ধু হই।
-আশ্চর্য! কী লুকাবো।
-এই যে যা লুকাতে চাচ্ছিস!
-কিছুই লুকাতে চাচ্ছি না৷ ইমন কিছু বলল না৷ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো৷ আমি বললাম,
-এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ইমন জবাব দেয়,
-মিহিন ফোন করছিল।
-অহ৷ এই বলে আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিছু বললাম না৷ শার্টটা খুলে বিছানার কাছে রাখলাম৷ ইমন বলে,
-মেয়েটা কাঁদছিল৷ তুই নাকি ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস? আমি চট করেই কথাটার জবাব দিলাম না। কিছু সময় চুপ করে থাকলাম৷ এরপর বললাম,
-আমি কিছু কথা বলছি৷ মনোযোগ দিয়ে শোন। ইমন কিছু বলল না৷ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কেবল৷ আমি বলতে শুরু করলাম, “ভার্সিটিতে মিহিনের সাথে আমার কীভাবে জানি বন্ধুত্ব হয়ে যায়৷ কীভাবে হয় তা আমি নিজেও জানি না৷ একদিন ক্লাস থেকে বের হতেই সে বলল,
-এই? আমার ব্যাগটা ধরো তো!
আমি আচমকা এমন প্রশ্নে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারছিলাম না৷ তার থেকে ব্যাগটা নিলাম কেবল। সে নিজের হাইহিল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। তার হাইহিলে কিছুটা ঝামেলা হচ্ছিল হয়তো৷ সেদিনই প্রথম কথা হয় ওর সাথে আমার৷ হাইহিল ঠিক করে আমার থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে,
-থ্যাংক্স। আমি বিপরীতে হেসে বলি,
-মাই প্লেজার। মেয়েটাও হাসে৷ আমরা দুজন একসাথে হাঁটা শুরু করি৷ কিছু পথ যেতেই সে বলে,
-মেয়েদের ভয় পাও নাকি? আমি হতভম্ব হয়ে যাই৷ এ কেমন প্রশ্ন? আশ্চর্য, মেয়েদের ভয় পাবো কেন? বলি,
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-আমার প্রশ্নের জবাব দাও আগে৷
-না, মেয়েদের ভয় পাবো কেন? মেয়েটা খানিকটা চুপ করে থাকে৷ বলে,
-কোনো মেয়েদের সাথে তোমাকে মিশতে দেখিনি।
-আমি একটু অন্য রকম। সহজে মিশতে জানি না৷ কেউ মিশতে না আসলে এগিয়ে গিয়ে মেশা হয় না।
-আমারও ঠিক তেমন হয়৷ সহজে সম্পর্ক গড়তে পারি না৷ এ জন্যে মানুষ অহংকারী ভাবে৷ এই যেমন তুমি ভাবছো!
-আমি আবার কখন ভাবলাম?
-ভাবোনি?
-না তো। তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে? মেয়েটা এবারেও খানিকটা চুপ হয়ে যায়৷ কিছু সময় পর বলে,
-ক্লাসের সব ছেলেই মোটামুটি আমার সাথে কথা বলতে চায়৷ এটেনশন পেতে চায়৷ কেবল তুমিই ছাড়া৷ আমার তো মনে হয় আমি যে তোমার সাথে পড়ি এই ব্যাপারটাও তুমি ঠিকভাবে জানো না৷ আমি হাসলাম। বললাম,
-আমি আগেও বলেছি তোমাকে, আমি সবার সাথে সহজ হতে জানি না৷
-সেটা বললে তো হবে না৷ দুজনের মধ্যে একজনকে তো সহজ হতে হবে।
-সহজ হয়ে কী হবে?
-কেন? তোমার কি আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে ইচ্ছে করছে না?
সেই থেকে শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্ব৷ আমি ভেবেছিলাম এই ব্যাপারটা তেমন গড়াবে না৷ আমার মতো ছেলের সাথে এই মেয়েটার বন্ধুত্ব বেশি দিন টিকবে না৷ কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে টানা দু’বছর আমাদের ফ্রেন্ডশিপ চলল৷ বেশ চমৎকার একটা ফ্রেন্ডশিপ। এই চমৎকার ব্যাপারটাই আমাকে আরো খেয়ে ফেললো৷ আবেগ জমে কী একটা অবস্থা। আবেগে আমি এমন ভাবে তলিয়েছিলাম যে নিজের প্রকৃত অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিলাম। মোহমায়ায় পড়ে গেলাম। যেটা অন্যায় হয়েছে।
বিশ্বাস করবি না মেয়েটা যেদিন একটা নীল শাড়ি পরে আমার সামনে এসেছিল আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। কেমন পাগল পাগল লাগছিল ভেতরে৷ বুকভরা এক অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি। এই মেয়েটাকে দেখলে যে কারোই ভোঁতা অনুভূতি তীব্র হবে৷ যেকারোই ইচ্ছে হবে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যেতে৷ আশ্চর্য ব্যাপার, একটা মানুষ এতো সুন্দর হয় কীভাবে? গাঢ় করে কাজল মাখতো মেয়েটা! ঠোঁট ভরা লিপস্টিক। মেয়েটাকে দেখলে ঘোর ধরতো আমার। প্রায়ই কপালে ছোট্ট করে একটা টিপ দিতো৷ আমি নিষেধ করতাম। সে আমার নিষেধাজ্ঞা শুনতো না৷ ঠিকই টিপ দিয়ে আমার সামনে চলে আসতো৷ আমি ঠিক ভাবে তাকাতে পারতাম না ওর দিকে। সে কড়া স্বরে বলতো,
-এই? তাকাও আমার দিকে? তাকাও বলছি? আমি তাকাই না৷ চোখ ফিরিয়ে নেই৷ সে রাগ আনে চেহারায়৷ দু’হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরায়। রাগি চোখে তাকিয়ে বলে,
-আমায় দেখো। তুমি শুধু আমাকে দেখবে। কেবল আমাকে৷ আমি এতো কষ্ট করে সেজে আসি কার জন্যে? অবশ্যই তোমার জন্যে। সেখানে তুমি আমাকেই দেখবে না সেটা কেমন করে হয়? তার চেহারার রাগ উড়ে যায়৷ কথার শেষটুকু কেমন জানি অভিমানী শোনায়।আমি না চাইতেও তার দিকে তাকাই৷ বলি,
-তোমাকে টিপ দিতে নিষেধ করেছি আমি।
-কেন করেছো শুনি? কেন টিপ দিবো না আমি?
আমি চোখ সরিয়ে নেই৷ অস্বস্তিকর একটা প্রশ্ন! আমি কীভাবে বলি যে টিপ দিলে তোমায় মারাত্মক সুন্দর লাগে। আমার ঘোর ধরে চোখে৷ আমি চোখ সরিয়ে নিতেই সে আবার কড়া স্বরে বলে,
-এই ছেলে? চোখ সরাবা না বলছি৷ তাকাও এদিকে। তাকাও? আমি আবার তার চোখের দিকে তাকাই৷ চোখে চোখ রাখতেই আমার গা’টা কেমন শিউরে উঠে৷ কী ভীষণ মায়া এই মেয়ের চেহারায়৷ মেয়েটা আমার দিকে আরেকটু সরে আসে৷ বলে,
-আজ তোমাকে বলতেই হবে, কেন টিপ দিবো না আমি? আজ না বলে পার পাবা না৷ আমি তাকিয়ে থাকি মেয়েটার দিকে৷ কথা খুঁজে পাই না৷ সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়৷ আমি বলি,
-মিহিন, আজ না বলি৷ প্লীজ৷ আমার অনুনয় উপেক্ষা করে সে৷ বলে,
-কোনো কথা শুনতে চাই না আমি৷ আমাকে আজ বলতেই হবে। না বললে খবর আছে তোমার৷
-খবর মানে? কিসের খবর?
-আছে৷ সেটা পরে বলব।
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিসের খবরের কথা বলছে মেয়েটা? আমার ভয় হয়৷ এই মেয়েটা যেহেতু বলেছে কিছু একটা খবর আছে তার মানে খবরই আছে৷ এই মেয়েটা যেকোনো কিছুই করতে পারে৷ আমি খানিকটা ভিতু স্বরে বললাম,
-কী সেই খবর? বলতো? সে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরবো৷
কথাটা বলেই লজ্জায় লাল হয় সে৷ আমি হতভম্ব হয়ে তাকাই তার দিকে৷ আমার চেহারায়, মনে, তখন অস্বস্তি আর অসহায়ত্ব ভাসে৷ আমি উপায়হীন হয়ে বলি,
-তার প্রয়োজন নেই৷ আমি বলছি৷
-তাই ভালো। চট করেই বলে ফেলো। তবে যা বলবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে৷
-চোখের দিকে তাকাতে হবে কেন?
-আমি বলেছি তাই৷ আমি মাথা নিচু করে বলি,
-তোমার চোখের দিকে তাকালে আমি শব্দ হারিয়ে ফেলি। ঠিকভাবে কথা বলতে পারি না। এসব এলোমেলো লাগে৷
মিহিন যেন বেশ মজা পায়৷ ফিক করেই হেসে উঠে। বলে,
-যা-ই হোক৷ তোমাকে বলতে হবে৷ আমি নিরুপায় হয়ে তার দিকে তাকাই৷ তার চোখে চোখ রাখি৷ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলি,
-মিহিন, এই যে তোমার চোখ, টানা টানা চোখ, চোখ ভরা কাজল, এই কাজল কালো চোখ দুটোয় কিছু একটা আছে৷ অদ্ভুত কাছে৷ যা মানুষকে টানে৷ আমায় টানে৷ তুমি টিপ দাও৷ কপালের মাঝখানে বিন্দুর মতো একটা টিপ৷ অথচ এই ছোট্ট কালো টিপটি তোমার সমস্ত চেহারায় কী অদ্ভুত সুন্দর দ্যুতি ছড়ায়৷ তোমাকে এতো দারুণ লাগে, এতো অনিন্দ্য লাগে সেটা হয়তো তুমি জানোও না৷ মিহিন, এই চোখ, এই চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না৷ আমার চোখে কেমন ঘোর ধরে৷ আমি যেন অন্য জগতে হারিয়ে যাই৷ অন্য এক প্রশান্তির ভুবনে হারিয়ে যাই আমি৷ আমার চারপাশটা যেন এক অদ্ভুত কোমলতায় ভরে যায়। পৃথিবীটাকে দারুণ সুন্দর মনে হয়৷ বাঁচতে ইচ্ছে করে। কথা গুলো বলে আমি মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকি৷ মিহিনও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা তখন, সেই সময়ে ঘোর ধরা এক জগতে হারয়ে গিয়েছি৷” এতটুকু বলে আমি থামি। চুপ করে থাকি৷ ইমন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তার চোখভরা প্রশ্ন। সে জানতে চায়,
-এরপর? এরপর কী এমন হলো যে তুই ওকে ছেড়ে দিলি? তারউপর তার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে? তুই এই কাজটা কীভাবে করলি? আমি ইমনের দিকে তাকাই। বলি,
-বাস্তবতা অনেক কঠিনরে ভাই৷ অনেক কঠিন। মিহিন মেয়েটাকে আমার দারুণ পছন্দ৷ এটা ভুল নয়৷ তবে তার কিছু ব্যাপার আমায় ভীষণ আঘাত করেছে। সে গরীবদের মানুষ মনে করে না৷ তার ভেতরে অহংকারের এক বিশাল পাহাড় রয়েছে৷
-মানে? কী বলছিস?
-হ্যাঁ৷ যা সত্যি তাই-ই বলছি৷ মেয়েটার একদিক দেখেই আমি আমার সমস্ত অনুভূতি তার দিকে গড়িয়েছিলাম৷ অথচ মুদ্রার অপর পিঠ বলে কিছু একটা আছে সেটা আমি ভুলেই গিয়েছি৷ মিহিন এ যাবত পাঁচজন ভিখারিকে চড় মেরেছে৷ বৃদ্ধ মানুষ, বেহায়ার মতো বারবার এসে মিহিনের কাছে হাত পাতে। মিহিন বিরক্ত হয়। তাকে যেতে বলে। ভিখারি যায় না। মিহিন রেগে যায়৷ যাচ্ছে তাই বলে। বাবার সমান মানুষ গুলোর গায়ে হাত তুলতে দ্বিধাবোধ করে না৷ এসব দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই৷ তাকে অনেক বুঝাই৷ সে বুঝে না৷ তার মাথায় এসব ঢুকে না৷ আমি তখন অন্য এক মিহিনকে আবিষ্কার করি৷ যে মিহিনকে আমি চিনি না৷ একদমই চিনি না৷ যাকে দেখে আমার ভয় হয়, অচেনা লাগে৷ অনুভূতিরা বিরূপ আচরণ করে। ইমন কিছু বলে না৷ চুপ করে থাকে৷ আমি আবার বলি,
-ইমন, আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তেমন প্রতিষ্ঠিত নয়৷ এই ব্যাপারটা মিহিন জানে না৷ জানলে সে আমার সঙ্গ ছাড়বে৷ এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত৷ ইমন অনেক্ষণ চুপ থাকে। ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়৷ আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। ছেলেটা বলে,
-ওর ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারটা কী? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি৷ বলি,
-মিহিনের ভাই আমাদের ব্যাপারটা জানতে পেরে যায়৷ আমরা তখনও বন্ধুই ছিলাম। তিনি জানতে পেরে আমাকে একবার ডেকে নিয়ে হুমকি দেন৷ নানান ভাবে ভয় দেখান৷ তার তখন থেকেই সন্দেহ হয়, আমাদের মাঝে কিছু চলছে। আর যাই হোক, কোনো ভাইই চাইবে না তার বোন নর্দমার কোনো মানুষের সাথে থাকুক৷ একটা বিভৎস জীবন যাপন করুক। যেখানে তার ভবিষ্যৎটা উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে সে কেন একটা মধ্যবিত্ত ঘরে যাবে? ঠিক এই কারণে মিহিনের ভাই আমাকে মিহিনের জীবন থেকে সরে আসতে বলেন। কিন্তু উনার হুমকি কিংবা ভয়ে কাজ না হওয়ায় অন্য পথ বেছে নেন। তিনি বুঝতে পারেন যে মিহিন নিজেই আমার প্রতি বেশি আশক্ত। এভাবে হুমকি দিয়ে কোনো কাজ হবে না৷ তিনি আমার সাথে একটা ডিল করতে আসেন৷ আমি যদি মিহিনের জীবন থেকে সরে যাই তবে আমাকে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হবে৷ অদ্ভুত না! একদম ফিল্মি। যাই হোক, আমি প্রথমে রাজি হইনি। উনি আমায় ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বলেন৷ আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবি৷ অনেক ভেবে কিছু একটা স্থির করি। আমার ধারণা ছিল মিহিনের সাথে আমার কখনই মিলবে না৷ খামখা আবেগ বাড়িয়ে কী লাভ৷
এরচে বিচ্ছেদটাই সই৷ যার যাই হোক, আবেগের বসে তো ওর জীবন চালানো যাবে না। আর আমিও ঠিক মিহিনের মতো এমন সম্ভাবনাময়ী কোনো মেয়ের জীবনটা এভাবে ধ্বংস করে দিতে পারি না৷ সে জীবনে অনেক উপরে উঠবে৷ অনেক। এর ঠিক ক’দিন পরেই মিহিন আমার সামনে এক বৃদ্ধ ভিখারিকে চড় মারে। ব্যস! আমি একটা কারণ পেয়ে যাই৷ আমাদের ঝগড়া হয়৷ মেয়েটা হাত জোড়া করে মাপ চায়৷ আমি মাপ করি না আর৷ সম্পর্কের ফাটল ধরে৷ এরপর দু’জন দু’দিকে। যেটা যেকোনো এক সময় হওয়ার কথা ছিল সেটা এখন হয়ে গেলে। উল্টো কিছু টাকাও পাওয়া গেল। সম্পর্ক ফাটলের মূল্য। বেশ কিছু চকচকে টাকা৷ এই তো! ইমন আমার দিকে তাকায়৷ তার চোখ ভরা বেদনা৷ কেমন নিরস হয়ে তাকিয়ে আছে৷ আমি ভাবলাম তার চোখে ঘৃণা দেখবো৷ কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি৷ তার দৃষ্টিতে ঘৃণা নয়৷ কেমন মায়া ভর করে আছে৷ সে বলে,
-টাকা নেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? তুই টাকা নিয়েছিস সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে৷ আমি মেকি হাসি৷ বলি,
-টাকার প্রয়োজন আমার নেই৷ যার আছে তাকে পৌঁছে দিয়েছি৷
-মানে? কাকে দিয়েছিস?
-মিহিন যে ভিখারিদের মেরেছিল না? ওই ভিখারিদের খুঁজে, দিয়ে এসেছে টাকা গুলো৷ চড়ের বিনিময়ে কিছু কচকচে টাকা পেয়ে গেল তারা৷ এও বা কম কী! আমি হাসি৷ আমার হাসি কেমন ফ্যাকাসে লাগে৷ আমার নিজের থেকেও কেমন জানি লাগে৷ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে৷ ক’দিন ধরেই হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে কেউ নেই? কোথাও কেউ একজন নেই৷ সেই জায়গাটা ভীষণ খালি। খালি জায়গাটা কষ্ট দিচ্ছে ভীষণ। সেই কষ্ট সয়ে নিয়ে ইমনের সামনে হাসছি৷ আমার নিজেকে কেমন অভিনেতা মনে হচ্ছে৷ দারুণ একজন অভিনেতা৷ ইমন আমার দিকে এগিয়ে এলো৷ কাছে এসে বলল,
-তাসফি? তুই ঠিক আছিস? আমি হাসি৷ আমি জানি না আমার হাসিটা কেমন। তবুও হাসি৷ বলি,
-আমি ভালো আছি ইমন। ভীষণ ভালো আছি৷ ইমন অবাক হয়ে তাকায়৷ বলে,
-তোর স্বরটা এমন শোনাচ্ছে কেন? কী হয়েছে তোর?
-কই? কি হবে?
ইমন আমার গায়ে হাত রাখে৷ তারপর চট করেই সেই হাত কপালে উঠে আসে। আশ্চর্য হয়ে তাকায় আমার দিকে৷ বলে,
-জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোর৷ তাসফি, তোকে অসুস্থ লাগছে। আমি হাসি। বলি,
-এই পোড়া যাওয়া আসল পুড়ে যাওয়া নয়। এই অসুখ আসল অসুখ নয়৷ এই অসুখ সারানো যাবে৷ কিন্তু আসল সারানো যাবে না৷ কারণ অসুখ সারানোর ঔষধটা আমি চিরদিনের জন্যে হারিয়ে ফেলেছি। একদম চিরদিনের জন্যে৷ আচ্ছা, ইমন? ইমন কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে৷ সে কথা বলতে পারে না৷ কেমন বাকরুদ্ধ। আমি বলি,
-দরজা জানালা বন্ধ করবি একটু?
-কেন?
-আহা কর না?
ইমন দরজা জানালা বন্ধ করে আমার কাছে এসে বসে৷ আমার তখন কেমন জানি দূর্বল লাগে৷ মানুষ হারানোটা মানুষকে এতোটা দূর্বল করে দেয় সেটা আমার জানা ছিল না৷ আমি ইমনকে বলি,
-ইমন? একটা কথা রাখবি আমার? ইমনের অসহায় স্বর,
-কী?
-এই রুমে এই মুহুর্তে যা ঘটবে তা যেন এই পৃথিবীর কেউ না জানে৷ কেউ না৷ ঠিকাছে?
-কী ঘটবে এই রুমে?
আমি অনেকটা সময় চুপ করে থাকি৷ তার প্রশ্নের জবাব দেই না। চুপ করে থাকি। তারপর চট করেই ইমনকে জড়িয়ে ধরি৷ আমার হঠাৎই কেন জানি কান্না পাচ্ছে৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত