চশমা

চশমা
বাসর রাতে এমন একটা কান্ড হবে জীবনেও কল্পনাও করিনি।আমার বর সৌরভ আমাদের বাসর ঘরে না ঢুকে ঢুকেছে তারই বড় ভাবির রুমে।সৌরভ আর ওর বড় ভায়ের রুমটা পাশাপাশি।আর তাদের দুইটা রুম একই ফার্নিচার দিয়ে সাজানো।বড় ভাবি আর ভাইয়া নিচে একটা রুমে ঘুমিয়েছেন।তারা ভেবেছিলেন আজ যেহেতু আমাদের বাসর রাত তাই আমরা যেনো কোনোভাবে বিরক্ত না হয় তার জন্য আমাদের পাশের রুমে আজ আর তারা ঘুমাননি।কিন্ত একি আমি ফুল দিয়ে সাজানো বাসর ঘরে বসে অপেক্ষা করেই আছি আর ও দিকে রাত ১২ টা গড়িয়ে ১ টা , ১টা গড়িয়ে ২ এভাবে প্রায় রাত ৪ টা পর্যন্ত আমি জেগে বসে ছিলাম তার জন্য। তার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা। সকালে উঠে দেখি সৌরভ নেই।তারমানে ও গতকাল রাতে এই রুমে আসেনি।আমি কিছুটা অবাক হলাম,তাহলে কী ওর এই বিয়েতে মত ছিলো না?
যাই হোক তার থেকে বেশি অবাক হলাম যখন দেখলাম সৌরভ বড় ভাবির রুম থেকে বের হচ্ছে।ওকে দেখে কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম, আমি গতকাল সারারাত আপনার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম, আপনি এলেন না যে? তবে কি আপনার এই বিয়েতে সম্মতি ছিলো না? সৌরভ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো’কই আমিও তো তোমার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম তুমিও তো এলেনা,তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। তাখন আমি মনে মনে ভাবলাম তবে কী ওরা আমাকে ভুল রুমে রেখে গেলো নাকি আমি ভুল করে অন্য রুমে ঢুকে পড়েছি? যাই হোক একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটাকে আর না বাড়ানোই ভালো। ৩দিনের দিন আমরা আমার বাবার বাড়িতে গেলাম। বাড়ি পৌছাতেই দরজা নক করলাম সাথে সাথে দরজা খুলে দিলো আমাদের বাসার কাজের মহিলা, জরিনা চাচি।
চাচি সৌরভকে দেখা মাত্র বললো, ‘আরে সৌরভ বাবা কেমন আছো,আসো বাবা ভেতরে আসো,সৌরভ সাথে সাথে জরিনা চাচির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললো, ‘ভালো আছি মা আপনি কেমন আছেন?বাবা কোথাই? আমি সাথে সাথে সৌরভের গায়ে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বললাম ওটা আমার মা না ওটা আমাদের জরিনা চাচি, আমাদের বাসায় কাজ করে। পরেরদিন আম্মা সকালে নাস্তা রেডি করে আমাদের খেতে ডাকলেন।আমরা ৩জন গেলাম।মানে আমি সৌরভ আর সৌরভের নানি। আমি আর সৌরভের নানি টেবিলে বসে গেলাম আর সৌরভ আসলো ১/২ মিনিট পরে আমার বোন ওকে নিয়ে আসছে।
আমার আম্মা সৌরভকে দেখে বললো বাবা তুমি আতিকার পাশের চেয়ারটাতে বসো। সৌরভ আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে ধপ করে ও নিজের নানির কোলে গিয়ে বসে পড়লো। আমি তো হা করে তাকিয়ে আছি আর বাসার সবাই হাসতে হাসতে শেষ।আমি লজ্জাই লাল হয়ে গেলাম একদম।আমার ছোট বোন হাসতে হাসতে বললো দুলাভাই এত জায়গা রেখে নানির কোলটাই পছন্দ হলো।সৌরভ কথাটা শোনা মাত্র এক লাফে উঠে দাড়ালো।তারপর আমার বোন ওর হাত ধোরে আমার পাশে বসিয়ে দিলো।সৌরভের নানি তখন তোতলাতে তোতলাতে বললো,এখনো তোর বদমাইশি করা বন্ধ হলো না।এখন তো বিয়ে করেছিস এখন তো এসব ছেলেমানুষি গুলো বাদ দে। সৌরভ কোনো কথা বললো না চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো।মনে হয় লজ্জা পেয়েছে।
তার ঠিক পরের দিন বাসায় সবাই ঠিক করলো বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবে।কিন্ত সৌরভ একেবারে যেতে নারাজ। ও কিছুতে যাবে না।আমার বোন কোনোমতে ওকে রাজি করলো।তবে ওর সর্ত নানিকেও নিয়ে যেতে হবে আমাদের সাথে। আমরা সবাই একসাথে ঘুরতে বের হলাম।সবাই ঘুরাঘুরি শেষে খাওয়াদাওয়া করলাম।তারপর সৌরভ খাবারের বিল দিতে গেলো তখন নানিও গেলো ওর সাথে।বিল দেওয়া শেষে নানি আর ও ফিরে এলো আমাদের কাছে।তারপর সৌরভ বললো চলো এবার ওঠা যাক। নানিশাশুড়ি আমার হাতটা সৌরভের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো নাও নানুভাই বৌকে সামলাও। আমরা আগে চলে যাচ্ছি তোমরা এসো। আমি আর সৌরভ লজ্জাই লাল হয়ে গেলাম। ওরা সবাই চলে গেলো আমি আর সৌরভ ধীরে ধীরে যাচ্ছি।হঠাৎ আমি সৌরভকে বললাম সৌরভ ঐ দেখো কত সুন্দর গোলাপ ফুল। আমাকে এনে দাও না প্লিজ।
-ঠিকআছে চলো। আমি আর সৌরভ ফুলের কাছে গেলাম সৌরভ তুমি ফুল কিনো আমি একটু আসছি। আমি গেলাম সৌরভের জন্য ওর একটা প্রিয় জিনিস কিনতে।ফিরে এসে দেখি ফুলের দোকানটার ওখানে অনেক ভিড়। আমি ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে সৌরভের শার্টের কলার ধরে টানাটানি করছে। আমি গিয়ে মেয়েটার হাত থেকে সৌরভকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম কী হয়েছেটা কী?আপনি আমার হাসবেন্ড এর কলার ধরে এভাবে টানাটানি করছেন কেনো?
-আপনার হাসবেন্ড একটা চরিত্রহীন। আমাকে ফুল দেই আবার আমার হাত ধরে টানাটানি করে। মেয়েটা কথাটা বলার সাথে সাথে সৌরভ হাওমাও করে কেঁদে দিয়ে বলে বিশ্বাস করো আতিকা আমি ভেবেছিলাম তুমি তাই হাত ধরেছিলাম।মেয়েটা তোমার মত শাড়ি পরে ছিলো সে জন্য। আমি মেয়েটাকে কোনোরকম বুঝিয়ে সৌরভকে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম।আর মনে মনে নিজেকে বোঝালাম এমনটা হতেই পারে।ভুল তো মানুষেরি হয় নাকি। আবার আমার আর এক মন বলছে সৌরভ কী সত্যি চরিত্রহীন? ধুর কি সব ভাবছি।
পরেরদিন আমার ছোট বোন নিলিমা বাইনা ধরলো আমার একটা শাড়ি পরবে।কি আর করবো ছোট বোন না করবো কী করে দিলাম আমার একটা শাড়ি।দুপুর ১ টার সময় আমি গোছল করছি হঠাৎ করে নিলিমার চিৎকার।আমি তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে দেখি নিলিমা কাঁদছে।পাশে সৌরভ দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। নিলিমা আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আপু তোর বরের চরিত্র ভালো না।আমি এই শাড়িটা পরে তোকে দেখাতে এসেছিলাম তখন দুলাভাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে পেছন থেকে। কথাটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।তবে কী সত্যি সৌরভের চরিত্র খারাপ। নিলিমাকে আমি অনুরোধ করলাম কথাটা যেনো এখুনি ও কাউকে না বলে।মান সম্মানের বেপার এটা। এবারো কিছু বললাম না ওকে আমি।রাতে সুয়ে আছি তখন সৌরভ আগে থেকে বিছানায় বসে ছিলো।আমি গিয়ে ওর দিকে পিঠ দিয়ে সুয়ে পড়লাম। ও ঠিক তখন আমার পিঠে হাত দিয়ে বললো,
-আতিকা আমি আসলে সত্যি ইচ্ছে করে করিনি।ভুল করে করেছি।আমি ভেবেছিলাম ওটা তুমি।
-কীভাবে সৌরভ?কীভাবে?একটা মানুষ একই ভুল বার বার কীভাবে করে?আমাকে কী তুমি পাগল পেয়েছো?তুমি বার বার একই ভূল করছো আর বার বারই বলছো ভুল করে করেছো ভুল করে করেছো।এটা কীভবে মেনে নেবো আমি বলোতো?
-বিশ্বাস করো আতিকা আমি সত্যি বলছি। সৌরভ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো কথাটা।আমি ওকে সরিয়ে দিলাম দিয়ে ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে রইলাম।
পরেরদিন আমারা চলে যাবো ঠিক করলো আমার নানিশাশুড়ি।চলে গেলাম শশুরবাড়ি। কিছুদিন পর আমার আর সৌরভের হানিমুনের ব্যাবস্থা করলো বাড়ির সবাই মিলে।কক্সবাজার। আমরা রেডি হয়ে বের হলাম।আমি আর সৌরভ ওয়েট করছি বাসের জন্য। বাস চলে এলে সৌরভ ওর লাকেজ টা নিলো আর আমি আমার লাকেজ নিতে পেছন ঘুরলাম,ঘুরে লাকেজ নিয়ে সৌরভের দিকে তাকিয়ে দেখি ও নেই।হঠাৎ খেয়াল করলাম সৌরভ অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বাসের দিকে। সেটা দেখে আমি হাওমাও করে কেঁদে ফেললাম। আর সৌরভ যে মেয়েটার হাত ধরে যাচ্ছিল সে মেয়েটা একটা জোরে চড় বসিয়ে দিলো ওর গালে।আমি সাথে সাথে সৌরভের কাছে এগিয়ে গিয়ে ঐ মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, দেন দেন আরো একটা চড় দেন কশিয়ে দেন আর একটা।
-দেখুন না আপা এই লোকটা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে এসেছে।এত বলছি ছাড়ুন ছাড়ছেই না।বলছে তাড়াতাড়ি চলো না হলে বাস মিস করে ফেলবো।ও ও দিকে আমার ৩ বছরের বাচ্চাটা একা একা বসে আছে।আমাকে না পেয়ে হয়তো এতক্ষনে কান্না শুরু করেছে। চরিত্রহীন বেটা কোথাকার।আবার বলে হানিমুনে যাবে আমাকে নিয়ে। ছিঃ। সরি আপা আসলে ওনার মাথাই সমস্যা আছে একটু।ছেড়ে দিন ওনাকে প্লিজ।আমি অনেক জোরাজোরি করার পর মহিলাটি ওকে ছেড়ে দিলো।আমি কোনো কথা না বলে সৌরভের কলার ধরে টানতে টানতে আবার সোজা চলে গেলাম শশুড় বাড়ি।নিকুজি করেছে হানিমুনের।হানিমুনের কাথাই আগুন। বাসায় ফিরলে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।শাশুড়ি আম্মা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,কি হয়েছে আতিকা মা?কিছু ভুলে রেখে গিয়েছো নাকি?এতটা রাস্তা আবার না এলেও পারতে একটা ফোন করে দিতে কি লাগবে বললে তোমার দেবর নিয়ে যেতো।
-না মা আমি কিছু ফেলে যাইনি।মা কিছু মনে করবেন না, আমার পক্ষে আর আপনার ছেলের সাথে থাকা সম্ভব নয়।আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনার ছেলের চরিত্র ভালো না।আমকে ক্ষমা করে দিবেন মা। আমি চলে যাচ্ছি।
কথাটা বলে আমি আর এক মিনিটও দাড়ালাম না লাকেজটা নিয়ে হনহন করে চলে এলাম বাবার বাড়িতে।বাড়িতে আসতেই বাবা মা হাজারটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আমার দিকে আমি ওদের সবটা খুলে বললাম।তারপর নিজের রুমে চলে গেলাম। আমি চলে আসার ঠিক ২দিন পর সৌরভ আর ওর বাবা মা আমাদের বাসায় হাজির।সৌরভ কে দেখে আমিতে অবাক। মোটা ফ্রেমের একটা চশমা পরে আছে ও।কেমন কেবলা কেবলা দেখতে লাগছে ওকে।আমি ওকে দেখা মাত্র কথা না বলে চলে গেলাম নিজের রুমে।কিছুক্ষন পর সৌরভ ও আমার রুমে এলো।এসে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলো ও।
-ছাড়ুন বলছি আমার হাত।আপনার মত একজন চরিত্রহীন লোকের কোনো অধীকার নেই আমার হাত ধরার। ছাড়ুন বলছি।
-আমার একটা কথা শুনো প্লিজ তারপর তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো।প্লিজ আতিকা প্লিজ প্লিজ।
-আচ্ছা ঠিক আছে বলুন কী বলবেন।
-আতিকা আসলে আমি চশমা ছাড়া চোখে একদমি ঝাপসা দেখি।বলতে গেলে চশমা ছাড়া দেখতে পাই না আমি।
আর এই কথাটা আমার বাবা মা বিয়ের আগে লুকিয়েছে তোমাদের কাছে।কারন এর আগে এই কারনে আমার অনেকগুলো বিয়ে ভেঙো গিয়েছে। বিশ্বাস করো আতিকা আমি একদমি জানতাম না বেপারটা।আমি ভেবেছিলাম তোমারা পুরো বেপারটা জেনে তারপর রাজি হয়েছো বিয়েতে। আমি এই বিষয়টা জানতে পারি তখন যখন আমি বিয়ে করার জন্য তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম।মা আমাকে যখন বললেন চশমা বাসায় রেখে যেতে তখন জানতে পারি আমি পুরোঘটনাটা।আর মা বাবার কথা রাখতে গিয়ে আজ এই অবস্থা।আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্লিজ। বাসার সবাই বিষয়টা প্রথমে না মেনে নিলেও পরে আমি সবাইকে বুঝিয়েছিলাম।কারন আমি সৌরভ কে ভালোবেসে ফেলে ছিলাম।আর বিয়ে ছেলেখেলা নয় যে বললাম আর ভেঙে দিলাম।
আমাদের বিয়ের ২ বছর পর আমার একটা বেবি হলো।নাম রাখলাম অয়ন। আয়নের যখন ৩ বছর বয়স তখন আমরা বাবার বাসায় বেড়াতে গেলাম।দেখলাম মা বাবা আমাদের জন্য বাসারর মেইন গেটে অপেক্ষা করছেন।আমি আর সৌরভ বাবা মা কে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।আমার ছেলে অয়ন বললো আমিও সালাম করবো আম্মু। আমি মুচকি হেসে বললাম করো। অয়ন সালাম করতে গিয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।ও বাবা মা কে খুজেই পাচ্ছে না। সেটা দেখে আমার বাবা মা মাথাই হাত দিয়ে বললেন আবার আর একটা চশমা লাগবে মনে হয় আতিকা।ছেলেটা একদম ওর বাবার মত হয়েছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত