রিলেশনের পাঁচ বছরের মাথায় রাফি যেদিন আমায় বলেছিলো, “রিলেশনটা আমার পক্ষে কন্টিনিউ করা সম্ভব না,আরশি” মুহূর্তের জন্য আমার দুনিয়াটা থমকে দাড়িয়েছিলো সেদিন। কান্নাভেজা চোখে জানতে চেয়েছিলাম- “কী আমার দোষ? কোন ভুলের শাস্তি দিচ্ছো আমায়?” দীর্ঘশ্বাসের ব্যপ্তি বাড়িয়ে নির্লিপ্ত সে বলেছিলো “ভুল তো আমরা দু’জনেই করেছি আরশী। এবার সে ভুলটা শুধরাতে যাচ্ছি। আমাদের ভালোবাসাটা যে ‘ভালোবাসার মালিকের’ বড়ই অপছন্দ। হারাম সম্পর্ক আর রাব্বের মধ্য থেকে আমি রাব্বকেই বেছে নিয়েছি। তুমিও বদলে নিও নিজেকে”
আর কোন প্রশ্নের সু্যোগ সে দেয়নি আমায়! “রাফি, রাফি” বলে শান্ত আমিটার অার্তচিৎকার গুলো প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছেই ফিরে এসেছে ফের! অথচ সে নির্বিকার। ভালোবাসার পিছুটানে ফিরে সে তাকায়নি আর! চেনা মানুষের অচেনা আচরণে দিন শেষে আমি ফিরেছি রিক্ত হস্তে। দিনের পর দিন কেটেছে, জগতের প্রতি চরম বিতৃষ্ণায়। নির্ঘুম রাতগুলোকে মনে হতো, জীবনের একেকটা অসহ্যকর অধ্যায়। চোখের নোনা জলে, বালিশের উপর অত্যাচার। শত অবহেলায়ও, রাফিকে খুঁজেছি হন্যে হয়ে। কিন্তু ওর টিকিটিরও খুঁজ পাইনি আর! প্রথমদিকে ভার্সিটিতে আসলেও, পরে শুনতে পেলাম ভার্সিটি বদলেছে। শুনে বিস্ময়ের সীমানা পাড়ি দিয়ে, মহাবিস্মিত হয়েছি আমি। যে ছেলেটা একটা দিন আমায় না দেখে থাকতে পারতোনা, তার কিনা আমার মুখোমুখি না হওয়ার জন্য এতো আয়োজন!
মাঝেমাঝে রাফির কথাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতাম। কিছুই বোধগম্য হতোনা। মাথার ভেতর হাজারটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফণী মেলো ধরতো; কিন্তু কোনো সদুত্তর পেতাম না। রাফির পরিবর্তন আমার কাছে ছিলো জটিল মানসাঙ্কের মতো। মাঝে মাঝে এর সমাধানে আমি বান্ধবীদের শরণাপন্ন হতাম! মুখে তাচ্ছিল্যের ভেংচি কেটে একেকজন বলতো, “এক নম্বরের ফটকাবাজ! তোরে বোকা পাইয়া ইউনিক আইডিয়ায় ঘাড় থেকে নামাইছে। কয়টারে লইয়া ঘুরাঘুরি করে,আল্লাহ’ই জানে”
এদের কারো উত্তরই আমার মনঃপুত হতো না। রাফির নাড়িনক্ষত্র আমার আত্মস্থ! মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, আমার সাথে বিট্রে করার ছেলে সে নয় মোটে। আমার অকারণ অনুযোগ আর উগড়ে দেওয়া রাগকে, ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা ঐ একজনই রাখতো। রাফি! তবু বান্ধবীদের কথাগুলো বিষিয়ে দিতো মন। উত্তর না পাওয়া কতশত প্রশ্নের সাথে লড়ে, দিনগুলো কেটে যেতো এভাবে-সেভাবে। বাবা একসময় ট্রান্সফার হলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে। বছর দু’য়েক পর আমরাও শিফট করলাম সেখানে।
আর, এই শিফটিং’টাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ ছিলো। সেখানে কিছু সিনিয়র আপুদের সাহচর্যে এসে জীবনের মানে খুঁজে পাই, নতুন করে। রাফির কথা তাদের খুলে বলি অকপটে। এরপর প্রেরণা পেয়েছি, তাদের প্রতিটি কথামালায়। রাফির বদলে যাওয়ার সমাধানটা তখন, বাল্যকালের সরল অংকের মতো ধরা দিলো আমার কাছে। জগৎবাছা যেসব স্কলারদের ইলম অর্জন থেকে বঞ্চিত ছিলাম বিগত বাইশটা বছর, তাদের সাথেই পরিচিত হয়েছি, আপুদের হাত ধরেই।
ইসলামকে জেনেছি আগাগোড়া। ফেলে আসা দিনগুলোতে জীবনের আশ্চর্য অপচয় বৈ কিছুই খুঁজে পেলাম না, উদ্দেশ্যহীন যাযাবর পথচলায়। সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ভালো সাথীদের সঙ্গ কতটা ফলদায়ক, আর অসৎসঙ্গ কতটা বিধ্বংসী! নিজেকে পরিবর্তনে তখন পুরোদস্তুর প্র্যাক্টিসিং হওয়ার কাজে লেগেগেলাম। কিন্তু, তখনও মন থেকে রাফির অস্তিত্ব বিলীন করতে পারিনি। হঠাৎ কোনো রাতে রাফিকে দেখতে পেতাম, স্বপ্নের ঘোরে। হুড়মুড়িয়ে উঠে শয়তানের চক্রান্ত থেকে পানাহ চাইতাম, রাব্বের নিকট। কিন্তু নফসের নিকট ধরাশায়ী হতাম বারংবার। এর চিরস্থায়ী উত্তরণের উপায় হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, বিয়ে করবো। লজ্জার মাথা খেয়ে, একদিন বাবাকে বিয়ের কথা বললাম।
লজ্জা যখন চরিত্ররক্ষায় অন্তরায় হয়,তখন লজ্জাকে জয় ছাড়া উপায়ান্তর থাকে কি? আমার কোনোই চাহিদা ছিলো না। বিয়ে নিয়ে অতীতের মতো ফ্যান্টাসি কাজ করেনা। চাহিদা শুধুমাত্র দ্বীনদারিতা’টুকুই। বহু খোঁজাখুঁজির পর মিলে, পাত্রের সন্ধান। বন্দোবস্ত হয় বিয়ের দিনকাল। অতঃপর এক অনাড়ম্বর আয়োজনে বিয়ে হয়, বাড়ির একমাত্র মেয়েটার! মা-বাবার চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে, আমি চলে এলাম নতুন পরিবেশে। আমাকে নিয়ে বসানো হলো বরের রুমে। একলা আমি পর্যবেক্ষণ করছিলাম, ঘরের প্রতিটা কোণ। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে বইয়ের রাজত্ব। বুঝে গিয়েছিলাম বেশ ভালোই ‘বইপোকা’র ঘরণী হতে চলেছি।
হঠাৎ সালামের আওয়াজে,ফিরে তাকালাম। দৃষ্টি ফেরানো মাত্রই জমে গেলাম, নিজের জায়গায়। দ্বিতীয় বারের মতো থমকে দাঁড়ালো আমার পৃথিবী। সফেদ সাদা পাঞ্জাবিতে একমুষ্টি দাড়ি; টোল পড়া হাসিতে, আমার চিরচেনা স্বপ্নপুরুষ। মুক্তোর মতো আনন্দের ঝিলিক টিকরে পড়ছে মুখাবয়বে। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হৃদয়ের ভেতর নাম ‘না জানা অভিমান’গুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, একের পর এক। আর সেই উত্তরগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে আমার গলায়। আনন্দঅশ্রুতে মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না কোনো কথা।
সে কপালে হাত রেখে বিড়বিড় করে দুআ পড়ছে, আর আমি অনুভব করছি, কাঙ্ক্ষিত মানবের প্রথম স্পর্শ। শান্ত গলায় রাফি বললো “চলো,নামাজ পড়বো” নিরুত্তরে চাবি দেওয়া যান্ত্রিক পুতুলের মতো, ওযু করে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম জায়নামাজে। নামাজে দাঁড়িয়ে তার সুমধুর তেলাওয়াতের লহমায় মনে হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতীটাই হয়তো আমি! নামাজ শেষে রাফি তাকালো আমার দিকে। আমি তখনো বিস্ময়ের ঘোরে। কোমল কন্ঠে সে বললো “অর্ধজীবন পাড়ি দিয়েছি অপাত্রে অনুভূতি বিলিয়ে। এখন তা সুদে-আসলে পুনরুদ্ধার করবো” কপটরাগে আমি বললাম, “অপাত্র ছিলাম বুঝি?”
-“মোটেও না,বরং ভালোবাসার মাধ্যমটা ‘অপাত্র’ ছিলো। রব্বের জন্য একটা স্যাক্রিফাইজে, কতটা পুরস্কার পেয়েছি ভেবে দেখেছো? রব্ব কতই মহান আরু।” বুকের ভেতর উথাল-পাথাল শুরু। আকৈশোর লালনপালন করা স্বপ্ন গুলো, ডালপালা মেলে প্রসারিত হচ্ছে পুনঃবার। আহ! কতদিন পর সেই মধুমাখা ডাক। “আরু” হাতের বাঁধন শক্ত করে সে বললো “ভালোবাসি” উদগত কান্না চেপে, লজ্জামুখে আমিও বললাম, “ভালোবাসি”
গল্পের বিষয়:
গল্প