ব্লাড ভ্যাসেলস

ব্লাড ভ্যাসেলস
চোখ খুলেই নিজেকে ফ্রিজের ভিতর আবিস্কার করলো রেফিন। কি করে আসলো এই বদ্ধ ফ্রিজে? নাহ কিছুই মনে করতে পারছে না সে! ঠিক কতোক্ষণব্যাপী এভাবে আছে নিজেরই আন্দাজ নেই তার! ডিপ ফ্রিজ, চারিদিকে বরফ জমে আছে, কুজো হয়ে বসে আছে রেফিন, এখনো সে অপ্রস্তুত, বুঝতে পারছে না কিছু! হাত আর পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, মাথা থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, এটা কিসের পানি! ঘাম? নাকি বরফগলা পানি? মাথায় হাত দিলো রেফিন, মাথাটা গরম, ঝিম ধরে আছে, চুলের গোড়া ব্যথা করছে। ফ্রিজ খোলার জন্যে ধাক্কা দিলো সে, জোরে! আরো শক্ত হাতে। নাহ! লক করা! খোলা যাচ্ছে না। মনে অনেকগুলো প্রশ্ন তার! সেগুলো পরের ব্যপার, আগে এখান থেকে বের হতে হবে তার! নিজেকে স্থির করলো সে, এসব পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশী জরুরি হচ্ছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা! এবার হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই ফ্রীজ খুলে গেলো! আগেরবার কেনো খুললো না আশ্চর্য! হয়তো হাত বরফ হয়ে যাওয়াতে জোর পায়নি!
ফ্রিজের বাইরে বের হতেই রেফিন নিজের অবস্থান শনাক্ত করলো একটা ডাইনিং রুমে। রুমটা আবছা অন্ধকার, অন্য রুমের লাইটের আলো কিছুটা পড়েছে এই রুমে! জানালার ওপাশে সন্ধে নেমেছে, লাইট জ্বালাতে হবে রেফিনের, সুইচ কোথায়! ফ্রিজের ঠিক পাশে! লাইট জ্বালিয়ে নিচে তাকাতেই দেখতে পায় ফ্রিজের ঠিক সামনে রক্তাক্ত একটা ছুরি, আৎকে উঠে রেফিন, শরীরটা ছিটকে গিয়ে পড়ে রুমের কোনায়, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার, শরীর থরথর করে কাঁপছে, মাথাটা ভোঁভোঁ করে উঠছে। আর গরমে চুলের গোড়া দিয়ে যেনো আগুন বের হচ্ছে। চোখে অন্ধকার নেমে এসেছে! শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে তার, যেনো নিজের মৃত্যটা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে রেফিন, বাঁচার জন্যে ছটফট করছে সে।
সে নিজের ভিতর কারো আওয়াজ শুনতে পেলো, কেউ বলছে- “শান্ত হও রেফিন! চোখ বন্ধ করে স্থির হও! শুয়ে পড়ো টানটান হয়ে! [রেফিন শুয়ে পড়লো] রিল্যাক্স! শক্তি অর্জন করো! রক্ত কোনো ভয়ঙ্কর জিনিস নয়। শান্ত হও” দীর্ঘ ১৫মিনিট পর রেফিন স্বাভাবিক হয়, তারপরেও চোখ খুলতে ভয় হচ্ছিলো তার, উঠে বসে সে, কর্ণারে হেলান দিয়ে দু হাঁটু জড়িয়ে ধরে মুখটা হাঁটুর সাথে লেপ্টে ধরে আছে, আস্তে আস্তে নজর বুলায় পুরো রুমে! কর্ণারে চেয়ারের নিচে ছোপছোপ রক্তের চিহ্ন, রুমের এক কোনায় আগুন দিয়ে পোড়ানো কিছু দেখা যাচ্ছে, প্লাস্টিকের কিছু হয়তো, তার পাশে পঁচা খাবারের গলিত অংশ, মনে হচ্ছে কেউ বমি করেছে, এসব খেয়াল করতে করতে পেট পাকিয়ে রেফিন বমি করে দেয়।
মেঝের এই অংশ থেকে তিনটা রুমের তিনটা দরজা দেখা যাচ্ছে, দুটো দরজাই খোলা, কিন্তু একটা দরজা লকড, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সেই দরজার হাতলেও রক্ত লেগে আছে। কিছু একটা ঘটেছে এখানে, কিন্তু কি ঘটেছে? সে নিজেই বা কিভাবে এসেছে এখানে! কি করবে এখন রেফিন? চিৎকার করবে? হেল্প চাইবে? নাহ! উঠে দাঁড়ালো রেফিন। কাঁপা পায়ে বদ্ধ দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, যে দরজায় রক্তের ছড়াছড়ি। চোখ বন্ধ করে টিশার্ট দিয়ে দরজার হাতল ধরে দরজা খোলে রেফিন! খড়খড় করে শব্দ তুলে দরজা, খাটের উপর তাকাতেই অস্ফুটস্বরে চিৎকার বের হয়ে আসলো তার গলা থেকে, এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না রেফিন, দু হাত কানের উপর রেখে, চোখ দুটো বন্ধ করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসে গলা বেয়ে। লাশ! লাশ!! রক্তাক্ত লাশ! পুরো বিছানায় রক্তের হলি উৎসব!
লাশের সিনার খুপরি ছিন্নভিন্ন, যেনো নির্দয়ভাবে কোনো পাষণ্ড হৃদপিণ্ড বের করে ফেলেছে। রেফিনের শ্বাস নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে আবার, কে এটা! কে? কিভাবে! চেহারার দিকে তাকিয়ে রেফিন স্তব্ধ হয়ে গেলো, যেনো মুহুর্তেই পুরো পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে রেফিনের মুখ থেকে কয়েকটা প্রশ্ন বের হচ্ছে, না! এটা কি করে সম্ভব! কে এটা কে? আ..আআ..আমি? আমি বিছানায় কেনো! কিভাবে! খাটের ওপাশে পড়ে থাকা হৃদপিণ্ডটা কি আমার? না….ন..না এ হতে পারেনা। নিঃশব্দে অজ্ঞান হয়ে যায় রেফিন! আমি এখানে কতোক্ষণ ধরে আছি? নার্সকে অস্ফুটস্বরে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো। যতোটুকু জানলো তা হচ্ছে, সে এখানে আছে ১দিন হয়ে গেছে, অজ্ঞান অবস্থায় ছিলো ৮ ঘন্টা। একটু পরে ডক্টর আসলো, একটা খাতা কলম নিয়ে বেডের পাশের টুলে বসা সে। রেফিন তাকে পর্যবেক্ষণ করলো, মাঝ বয়সী একটা লোক, চোখে বড় ফ্রেমে চশমা, খোঁচা খোঁচা আঁধপাকা দাড়ি, চেহারা নিচু করে চশমার উপর দিয়ে তাকানের চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। প্রশ্ন করছে আর কি যেনো টুকে নিচ্ছে।
:- এখন কেমন লাগছে?
:- জি ভালো!
:- আপনার নাম কি?
:- রেফিন।
:- পিতার নাম?
:- আরাফাত হোসেন চৌধুরী।
:- আপনার বাসা?
:- রামপুরা, বউ বাজার, ১/১৩৩
:- আজ কতো তারিখ?
:- সঠিক মনে নেই।
:- লাস্ট আপনার অবস্থান কোথায় ছিলো কিছু মনে পড়ে?
:- একটা বাড়িতে ছিলাম, সেখানে……(রুদ্ধস্বর)
:- বাড়িটা কোথায় ছিলো?
:- জানিনা!
:- কার ছিলো?
:- জানা নেই।
:- কিভাবে গেলেন?
:- আমার কিচ্ছু মনে নেই, আমি জানিনা ওখানে কিভাবে গেলাম। কিছু বুঝতেছেন না কথা? (রেফিন বিরক্ত)
:- ওকে ওকে শান্ত হোন, রেস্ট নিন, আবার কথা হবে।
রেফিন বিরক্ত, কি করবে হসপিটালের এই বেডে শুয়ে! পাশ থেকে রিমোট টা নিয়ে টিভি অন করলো। চলছে ‘Time24’ চ্যানেল। রেফিনের এসব নিউজ চ্যানেল ভালোলাগে না, তবুও চোখ আটকে গেলো টিভির দিকে, সংবাদ পাঠিকার কণ্ঠে- গতকাল প্রখ্যাত জজ “ব্যারিস্টার রফীকুল আলম” তার নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন যুবক পুলিশ হেফাজতে আছে! শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সে হসপিটালে আছে এবং সুস্থ হলেই তার জবানবন্দি নিবে পুলিশ। এই সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ আরো অনেকে! এবং আশ্বাস দিয়েছেন অপরাধীকে খুঁজে বের করবেই পুলিশ।
পুরো সংবাদ দেখে রেফিন অনেকটা হকচকিয়ে গেলো। কপালে চিন্তা ও বিরক্তের ছাপ, কারণ তার কিছুই মনে নেই, সে কিছুই জানেনা, পুলিশ তার কাছে তদন্তের কাজে আসলে কি বলবে সে? বাথরুমে গেলো রেফিন, মুখে পানি দিয়ে মুখটা ভেজালো, মুখটা উঁচু করে আয়নার দিকে তাকাতেই আরেক দফা চমকে উঠলো রেফিন। এটা কে? আয়নায় যাকে দেখা যাচ্ছে সে তো আমি না! রেফিন হতভম্ব হয়ে নিজের চেহারার উপর হাত বুলাচ্ছে আর চেহারা ডানে বামে ঘুরিয়ে দেখছে! এই চেহারার মানুষটা তো রেফিন না, এটা তো আমি না। এটা কে? এই প্রতিবিম্ব তো আমার না! কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? কোনো ষড়যন্ত্র? কোনোদিন কি আমার চেহারার প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে? চেহারা কিভাবে পাল্টে যেতে পারে মানুষের! রেফিন চিন্তার সাগরে ডুব দেয়, এ হতে পারেনা, আমি কোনো ষড়যন্ত্রে আঁটকে যাচ্ছি! কেউ ফাঁসাচ্ছে আমাকে?
কে ভাসাবে? কেনো ফাঁসাবে? আমার শক্ত হতে হবে, মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু আমি কি করবো? আমি তো অসহায়! রেফিনের মনে পড়লো রুমে থাকা লাশের কথা, হ্যাঁ ওটাই তো আমি ছিলাম, কিন্তু সে নাকি উকিল, কিন্তু কিভাবে। এই চেহার আমি কে তাহলে? আমার চেহারা এমন কেনো? কি হচ্ছে এসব? মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো রেফিন। পুলিশ হেড কোয়ার্টার। উচ্চ পদস্থ সব অফিসাররা বসা, সাথে আছে ঢাকা জেলের প্রধান নিয়ন্ত্রক মি. রোকনুজ্জামান। তার বর্তমান রেকর্ড খুবই ভালো, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সবাই’ই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকি আসামিরাও তাকে ভালোবাসে কারণ তিনি জেলটাকে পরিচালনা করছেন নিজের ফ্যামেলির মতো করে। তিনিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন এখানে এই টেবিলে এবং এই কেসে, রেগে যাচ্ছেন!
হুকুম দিচ্ছেন, বড় বড় অফিসারদের তুই তোকারি করে এটা সেটা বলছেন, ঐ রেফিন ছোকড়াটাই খুন করেছে, ওকে আগে এরেস্ট কর তোরা, আই সেড এরেস্ট হিম। যদিও অফিসারদের হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। পুলিশ সুপার মি. গোলাম মাওলা রনিও কিছু বলছেন না, কিইবা বলবে! সে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর শালাবাবু, আর উকিল রফীকুল আলম তার ভাই। তাই তিনি খুবই ব্যথিত এবং এই ব্যথায়ই তার বিহেভিয়ারকে রুঢ় করে ফেলেছে। নয়তো রোকনুজ্জামান তিনি এমন নয়। শান্ত স্বভাবের মানুষ তিনি। একটু আগে সে হাসপাতালে গিয়ে রেফিনের কলার ধরে ধমকি দিয়ে আসছে, তোর এতো বড় সাহস তুই আমাকে বলিস আমার মাথায় প্রব হয়েছে! তুইইই খুন করেছিস আমার ভাইকে!
তোকে আমি জেলে পুরেই ছাড়বো। তোকে জেলে না ঢুকাতে পারলে আমার নাম রোকন নয় মনে রাখিস! গত এক সপ্তাহ ধরে ইনভেস্টিগেশন চলছে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না পুলিশ, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শুরু করে ফিঙ্গার প্রিন্ট সব উধাও! একমাত্র বমির অংশটা রেফিনের এটা নিশ্চিত করেছে ফরেনসিক বিভাগ। এছাড়া রেফিনের ঐ রুমে থাকারই কোনো অস্তিত্ব নেই ফ্রিজের ভিতরে ছাড়া। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চাপ একদিকে, অপর দিকে উপরমহলের চাপ, ওদিকে জেলার রোকনুজ্জামানের হুমকি ধমকি, ওদিকে সাংবাদিকরা মিডিয়া জগৎ পুরো সরগরম করে তুলেছে!
:- কি করা যায়? (গোলাম মাওলার গম্ভীর প্রশ্ন)
:- স্যার আমার মনে হয় রেফিনের দিকে নজরটা গভীর করা যেতে পারে। (বললো এক অফিসার)
:- রফীক সাহেবের সাথে কোনো যোগসূত্র আছে রেফিনের?
:- যোগসূত্র বলতে, পুরোনো নথিপত্র ঘেটে যতোটুকুু জানতে পেরেছি! ২০০৭ সনে রেফিনের এক মামা ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার হয়। এবং সমস্ত প্রমাণ সব তার মামার বিরুদ্ধেই ছিলো। সেই মামলায় জজ ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল আলম, এবং তিনি রায় দেন এবং সাজা শুনানি দেন।
:- স্যার কিছু মনে করবেন না, একটা কথা বলি, এই কেসে যদি আমরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে না পারি আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে।
:- হ্যাঁ মামুন সাহেব! উপরমহলে এখনই আমাদের ইস্তফা নিয়ে কথা চলছে, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। যাইহোক রেফিনের কোনো মেডিকেল ইস্যু?
:- হ্যাঁ স্যার! ছোটোবেলা থেকে ওর হিমোফোবিয়া রয়েছে, তাও মাত্রাতিরিক্ত, রক্ত দেখলে প্রচণ্ড ভয় পায় সে। এমনকি তার হার্টের কার্যক্ষমতা অফ হতে থাকে, কয়েকবার সে এর জন্যে ডক্টর দেখিয়েছে।
:- কি? তাহলে রেফিনকে কিভাবে আমরা আসামি কল্পনা করতে পারি? একদম বিপরীতমূখী চরিত্র রেফিনের, রক্ত দেখলেই যার হার্ট অফ হয়ে যায় সে করবে এমন নৃশংস খুন? হাউ পসিবল? নিশ্চয়ই রেফিন ষড়যন্ত্রের স্বীকার, কেসটা এতোটাও সহজ না যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম। ইটস আ ওয়েল প্ল্যানেড মার্ডার। ঠিক এই সময়ে অফিসে তড়িঘড়ি করে ঢুকলেন জেল নিয়ন্ত্রক রোকনুজ্জামান। এসেই টেবিলে আঘাত করে বলছেন, কি পেয়েছেন আপনারা? এখনো ঐ ছেলেকে গ্রেফতার করেননি? আশ্চর্য! সেইই খুনি, ওর মামার মামলার রায় দেওয়ার সময় আমিও কোর্টে ছিলাম, তখনকার তার হিংস্র চেহারা এখনো মনে আছে আমার। এই মুহুর্তে তাকে আগে গ্রেফতার করুন, এরপর কিভাবে ওর মুখ থেকে সত্যিটা বের করতে হয় সেটা ভালো করেই জানা আছে আমার।
:- কিন্তু স্যার রেফিনের তো হিমোফোবিয়া আছে, সে কিভাবে খুন করতে পারে? (গোলাম মাওলা)
:- সব প্ল্যান ওর, মেডিকেল সার্টিফিকেট হাইড রাখেন, সত্যটা সেইই বলবে, আর মোটিভ হচ্ছে তার মামার কেসের রায়। বাকি উপর মহলকে শান্ত করার দায়িত্ব আমার আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, ডু ইট! রোকনুজ্জামানের এই সিদ্ধান্তে সব অফিসাররাও মোটামুটি চিন্তামুক্ত হয়! উপরমহলের চাপে তারাও খুব টেনশনে ছিলো। চাকরি চলে যাওয়ার ভয়টাও থাকলোনা। গোলাম মাওলা সেও কিছু বললো না যেহেতু এতে পুলিশ ফোর্সদেরই লাভ বেশী।
গত ৫টা বছর রেফিন কারাগারে, তার উপর এমন কোনো নির্যাতন নেই যেটা করেনি জেলার রোকনুজ্জামান। ভাই হত্যার মামলা সে পার্সোনালি নিয়েছে। রেফিনকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে সে। রেফিন খুন করেনি, এটা যতোবার রেফিন বলেছে, ততোবার আরো তীব্র হয়েছে তার নির্যাতন। রেফিন কাঁদে একা একা। সে জ্বলে, জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুনে। রেফিনের অনেক হিসেব মিলে না, সে রুমে গেলো কিভাবে, আমার চেহারা কিভাবে ব্যারিস্টার রফিকুল আলমের হলো! আর আমার চেহারাই বা কিভাবে চেইঞ্জ হলো। আমি খুন না করেও কেনো জেলে? কোনো কারণ তো আছে। নিশ্চয়ই এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের পিছনে জেলার রোকনুজ্জামানের হাত আছে। রেফিন সিদ্ধান্ত নেয় রোকনুজ্জামানকে খুন করবে। যেভাবেই হোক। ছাড়বেনা সে তাকে। এভাবেই রেফিনের জীবন থেকে কেটে যাচ্ছে ৫টা বছর।
৭ বছরের মাথায় পর্যাপ্ত প্রমাণাদি না থাকায় আদালত রেফিনকে সাধারণ জামিন দেয়। চুড়ান্ত শুনানির আগ পর্যন্ত তাকে প্রতি মাসে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে। রেফিন বের হয়ে কারো সাথে কথা বলে না। ওর মাথায় একটাই চিন্তা, প্রতিশোধ নিতে হবে। সে অনেক চেইঞ্জ হয়ে গেছে ওর বন্ধুরা বলে। রেফিন ওর বন্ধুদের চিনেনা, কিন্তু রেফিন মানিয়ে নিচ্ছে। সেদিন রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে এক লোক, রক্তের বণ্যা, সেই রক্তের উপর দিয়েই হেটে আসলো রেফিন, কোনো পরিবর্তন হলোনা রেফিনের, ওর বন্ধু অবাক হয়, কারণ তারা তো জানে রেফিনের হিমোফোবিয়া আছে, রক্ত দেখলেই আৎকে উঠার কথা। বন্ধুদের সাথে আড্ডাও দেয়না সে। শুধু সকাল বিকেল সন্ধে দোকানে গিয়ে বলে “সিগারেট! তাও কয়েকদিন যাওয়ার পর আর বলা লাগেনা। রেফিন গেলেই দোকানি বুঝে নেয়। রেফিন এরই মধ্যে জেলারের বাসার ঠিকানা নিয়ে নিয়েছে। একটা ধাঁরালো ছুঁরি নিয়েছে। চাপাতি নিয়েছে। একটা হ্যান্ড গ্লাভস নিয়েছে। মাস্ক নিয়েছে।
ঈদের সময়টা সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও জেলার রোকনুজ্জামান নিজে আসামিদের সাথে ঈদ করে, তাই আজ তার স্ত্রী সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজে বাসায় একা। এখন রাত হলেও রেফিন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে রুমে ঢুকে বসে আছে বিকাল থেকে। রোকনুজ্জামান জরুরি কিছু কথা ফোনে বলে বিয়ারের বোতল নিয়ে সোফায় বসে। রেফিন বের হয় খাটের নিচ থেকে, চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে থাকা রোকনুজ্জামানের বুকে হামলে পড়ে রেফিন। ধড়ফড় করতে থাকে সে, রোকনুজ্জামান হাত দিয়ে রেফিনের গলা ধরে। রেফিন হিংস্রতায় মেতে উঠে, বুকটা ফেড়ে হৃদপিণ্ডটা বের করে ফেলে। নিস্তব্ধ হয়ে যায় রোকনুজ্জামান। রেফিন চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রেফিনের শ্বাস নিশ্বাস বড় হতে থাকে, মাথাটা ভোঁভোঁ করতে থাকে, গরমে মাথা পুড়ে যাচ্ছে হঠাৎ। মাথা থেকে টপটপ করে ঘাম বেরোচ্ছে, হঠাৎ রুমের তাপমাত্রা বেশী হয়ে গেছে মনে হয়। রেফিন পাগলের মতো হয়ে যায়, হাতের গ্লাভসটা আর পরনে থাকা প্লাস্টিকের রেইনকোট টা খুলে রুমের কর্ণারে একসাথে করে ম্যাচ বের করে পুড়িয়ে ফেলে, ছুড়িটা পড়ে আছে সোফার পাশে। রেফিন মাথার চাপ আর নিতে পারছেনা, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে রেফিন কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা। পেট ঘুরতে থাকে, বমি করে দেয় রেফিন। হঠাৎ রেফিনের চোখ পড়ে ফ্রীজের দিকে, তড়িঘড়ি করে রেফিন ফ্রীজের ভিতর ঢুকে পড়ে নিজেকে ঠান্ডা করতে।
চোখ খুলেই নিজেকে ফ্রিজের ভিতর আবিস্কার করলো রেফিন। কি করে আসলো এই বদ্ধ ফ্রিজে? নাহ কিছুই মনে করতে পারছেনা সে! ঠিক কতোক্ষণব্যাপী এভাবে আছে নিজেরই আন্দাজ নেই তার! ডিপ ফ্রিজ, চারিদিকে বরফ জমে আছে, কুজো হয়ে বসে আছে রেফিন, এখনো সে অপ্রস্তুত, বুঝতে পারছেনা কিছু! হাত আর পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, মাথা থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, এটা কিসের পানি! ঘাম? নাকি বরফগলা পানি? মাথায় হাত দিলো রেফিন, মাথাটা গরম, ঝিম ধরে আছে, চুলের গোড়া ব্যথা করছে। রেফিনের বের হতে হবে এখান থেকে এটা ভাবতেই ফ্রীজ খুলে গেলো, কয়েকজন পুলিশ রেফিনকে টেনে বের করে আনলো, রেফিন কিছুই বুঝতে পারছেনা। সোফায় একটা বিভৎস লাশ চোখে পড়লো রেফিনের। রেফিন আৎকে উঠলো, কিভাবে সম্ভব? আমি সোফায় কিভাবে! রেফিন অজ্ঞান হয়ে যায়!
-পরদিন পত্রিকাসহ নিউজ চ্যানেলগুলো সরগরম জেলার রোকনুজ্জামান হত্যার নিউজ দিয়ে।
-৩য় দিনের টিভি বক্তব্যে উঠে আসে যে, ব্যারিস্টার রফীকুল আলম যেভাবে খুন হয়েছে ঠিক সেভাবে রোকনুজ্জামান খুন হয়েছে।
-৪র্থ দিন মিডিয়ার সরগরম রেফিনকে নিয়ে, প্রকাশ পায় এই খুনেও রেফিনকে ঘটনাস্থলে পেয়েছে পুলিশ।
-৫ম দিন রেফিনকে হসপিটাল থেকে বের করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়, কারণ রেফিনের গলায় রোকনুজ্জামানের খামচি কাঁটার দাগ রয়েছে। রোকন সাহেবের নখে রেফিনের চামড়ার অংশ ছিলো।
-৮ম দিন রেফিনের চুড়ান্ত মেডিকেল রিপোর্ট প্রকাশ করে পুলিশ। রেফিন একজন হিমোফোবিয়া রুগী, একই সাথে তার ভিতর “মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার” রোগটা আছে। অর্থাৎ দ্বিমুখী দুটি চরিত্র বহন করে সে। একটি চরিত্রতে সে রক্ত দেখলেই ভয় পায়, আরেকটাতে সে রক্তখেকো থাকে এবং হ্যালুসিনেশন রয়েছে তার ভিতর, একজনের ভিতর অন্যজনকে দেখতে পায় সে।
-১০ম দিন একই সাথে রোকনুজ্জামান ও রফিকুল আলম দুজনের খুনের আসামি হিসেবে আদালতে পেশ করে পুলিশ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত