চিঠি

চিঠি
এই নিয়ে উনিশ বার কলিং বেল টা বাজালাম।আয়েশা দরজা খুলছে না। নতুন নতুন চাকরিতে জয়েন।এক আধদিন ফিরতে একটু দেরি হতেই পারে।কিছুতেই সেটা এই মেয়ে কে বোঝানো যায় না। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় এক বছর হতে চলল।ধানমন্ডির তিন তিনটা বাড়ির মালিক জলিল সাহেবের একমাত্র মেয়ে আয়েশা।আর আমি!অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত। এক বছর আগে এই মেয়ে তার এনগেজমেন্ট এর দিন সকালে বিষ খেয়ে ফেলেছিল। ফলাফলস্বরুপ জলিল সাহেবের অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও সেদিন রাতে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।
-দরজা টা খুললে কেন? রাত্রি টা বাইরেই কাটিয়ে দিতাম।
-আরে কানের দুল পড়তে পড়তে দেরী হয়ে গেল।একি! আবার তুমি লাল গোলাপের তোড়া এনেছো? আমার যে লাল গোলাপ অপছন্দ সেটা ভুলে গেলে!
-হ্যা? না মানে শাড়ি পড়েছ কেন এখন? কোথাও যাবে নাকি?
-আরে নাহ। আজকের দিন টা শুধু তুমি আর আমি সেলিব্রেট করবো।আচ্ছা কেক আনো নি? আমি আমার জন্মদিনে কেক কাটবো না?
-আসলে আসার সময় দেখলাম পাড়ার বেকারি টা বন্ধ হয়ে গেছে।আচ্ছা আয়েশা রানী আমাকে ১০ মিনিট সময় দাও।আমি এখনি ওভেনে তোমার কেক বানিয়ে আনছি।
– আচ্ছা যাও। ১০ মিনিট না।২০ মিনিট দিলাম।আগে ফ্রেশ হয়ে আসো।তারপর কেক বানাবে।আগের বারের মতো হাত পা পুড়িয়ে ফেলো না আবার।
দুই রুমের এই ছোট্ট ফ্ল্যাট টার মধ্যে এই খোলা বারান্দা টাই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর। এখানে ই আমার বেশি সময় কাটানো হয়।আয়েশার ও।বারান্দার একপাশে আয়শার সাড়ি সাড়ি ফুল গাছের টব।অন্য পাশে আমার লেখালেখির টেবিল।রাতের বেলা যখন চারিদিক সুনসান হয়ে যায়, একা একা বসে আমি এখানে আধ্মাতিক চিন্তা ভাবনা করি।
আমি ফরহাদ।ঠিক কি আছে আমার মধ্যে? গতানুগতিক মধ্যবিত্ত দের যে লোক দেখানো সততা টা থাকে,সেটা ছাড়া বলতে গেলে আমার কিছুই নেই।তবুও কেন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয় আমার? আয়শাকে পাশে পেয়েছি বলে? আয়েশা ছাড়া অন্য কেউ স্ত্রী রুপে আমার জীবনে আসলে হয়তো এত সুখও থাকতো না জীবনে।
-এই একটু সরো তো।আমিও বসবো।
-এই ঠাণ্ডার মধ্যে ফ্লোরে বসো না।ঠাণ্ডায় ধরে যাবে ।
-উফফ ,তুমি বসেছো না? কিছুই হবে না। সরো।
-ঘুম আসছে না?
-না।আচ্ছা কাল তো শুক্রবার।চলো না কোথাও থেকে ঘুরে আসি!
-আয়েশা,আমার কালকেও অফিসে যেতে হবে একটু। বুঝোই তো। নতুন চাকরি।বসকে না করাটা ঠিক মানায় না এখন।
-অ আচ্ছা।
-মন খারাপ করলে?
-না তো।
-প্লিজ মন খারাপ করো না।কথা দিলাম।
একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবো। যেখানে তুমি চাও।আর তোমার জন্মদিনের উপহার টা তো পাওনাই রইল। হাটুতে মুখ রেখে একমনে দুরের রাস্তার সোডিয়াম বাতিটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে আয়েশা।আর আমি আয়শার দিকে তাকিয়ে বসে আছি।শাড়ি পড়লে নাকি মেয়েদের অনেক বড় বড় দেখায়।অযৌক্তিক কথা একদম।শাড়ি পড়া আয়েশাকে দেখায় একদম কিশোরীর মতো।কলেজের প্রথম দিন দেখা সেই আয়শার মতো।
-আচ্ছা ফরহাদ।একটা সত্যি কথা বলবে?
-আমি কি কখনো মিথ্যা বলি?
-তাও ঠিক।আজকে যে আমার জন্মদিন সেটা তুমি ভুলে গিয়েছিলে তাইনা?
-হুম।আমার আসলে এটা আগেই বলা উচিত ছিল তোমায়।কষ্ট পাবে তাই বলিনি।অফিসে আজকে ১০ বছরপূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠান ছিল।সেজন্য সবাইকে ফুলেরতোড়া দিয়েছে।সরি আয়েশা।
-হুম বুঝেছি।সরি বলতে হবে না।
-দেখেছো আমি শুধু তোমাকে কষ্টই দিয়ে যাই। না চাইতেও।
-আমি কোনো কষ্ট পাইনি ফরহাদ।জন্মদিনে মনে করে উপহার দিলেই কি শুধু ভালোবাসার প্রকাশ পায়!তুমি যে সত্য বলেছ সেজন্য আমি অনেক খুশি হয়েছি।
-হয়েছে আর আমার দোষ ঢাকতে হবে না তোমায়।ঘরে যাও। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে অনেক।
-আচ্ছা। তুমি বসে বসে সিগারেট টানো ইচ্ছেমত।আমি চলি।
-হুম।
-আমি এখন শুয়ে কিছুক্ষণ বই পড়বো।
তুমি এসে যদি দেখো আমি ঘুমিয়ে গেছি,তাহলে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো।ও আরেকটা কথা।তোমার শার্ট টার পকেটে একটা চিঠি আছে।আমি চলে যাবার পর বের করে পড়বে। এটা ওর অনেক পুরোনো ছেলেমানুষি। প্রায়ই আমার শার্ট এর পকেটে,বইয়ের ভাজে চিঠি লিখে রেখে দেয়।মাঝেমাঝে বলেও না।এমন ও হয়েছে বই খুলে তিনমাস পর ওর চিঠি পেয়েছি।জিজ্ঞেস করলে তখন হাসে শুধু।আয়েশা প্রথম আমায় চিঠি দিয়েছিল অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার আগের দিন।এমনি এক চিঠি সেটা ছিল।যার কারণে এর পরদিন আমি ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছিলাম।
প্রিয় ফরহাদ,
আচ্ছা তুমি এত সহজ সরল আর এত বোকা কেন? এই জন্য মাঝেমাঝে ই আমার দুশ্চিন্তা হয় জানো।তোমার মত মানুষ কে যে কেউ খুব সহজে কষ্ট দিয়ে ফেলতে পারবে।তখন আমি কি সেটা হজম করতে পারবো বলো! মায়ের অসুধের খরচ,বোনের লেখাপড়া আর আমাদের সংসার এইসবের চিন্তায় তুমি নিজেকে ইদানীং একদমই দাম দাও না।দাম দিলে তোমার মনে থাকতো যে,আজ আমার নয় তোমার ২৮ তম জন্মদিন ছিল।উফফ,তুমি কি বলো তো? নিজের জন্মদিনে নিজেই কেক বানালে আবার সেই কেক আমাকে দিয়েই কাটালে!!পাগল একটা।শুভ জন্মদিন।আর জন্মদিনের উপহারটা কিন্তু পাওনা রইল তোমার।ভালোবাসি খুব বেশি।
-তোমার আয়েশা
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত