সুরে পিছনের ডাক

সুরে পিছনের ডাক
বোঝেনি অবুঝ মন নীলাঞ্জনা তখন গানের লাইনটা হঠাৎ ধক করে গিয়ে লাগলো নাসিমা পারভীন এর বুকে। তার ষোল বছরের কিশোরী মেয়েটা চেয়ারে হাঁটু তুলে কম্পিউটারে গানটা শুনছে। চোখ মুখ‌ গম্ভীর। বোঝাই যাচ্ছে তার মেয়েটা গানটার ভেতর ডুবে আছে।
মেয়েটাকে খেতে ডাকতে এসেছিলেন তিনি। মেয়েটার উদাসিনী রুপ দেখে ডাকতে ইচ্ছে করলো না আর।নীরবে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। আজ সারাদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। এক রত্তি থামবার অবকাশ নেই। ধীর পায়ে নিজের ঘরে জানালার পাশে বসলেন তিনি। আনমনে বাহিরের বৃষ্টি দেখছেন। মন তার অতীতের ডিঙিতে পাল তুলেছে। অবাক লাগছে নাসিমার। মনের ভেতর যেনো জমেছে জলাশয়। এত বছর পার হলো তবুও স্মৃতিগুলো জ্বলজ্বল করছে। তিনি বাংলা গানের বড় ভক্ত ছিলেন। বিটিভির সঙ্গীতানুষ্ঠান গুলো দেখতেন। কখনো বা ক্যাসেটের ফিতায় মন বেঁধে রাখতেন।
-যখন থামবে কোলাহল ঘুমে নিঝুম চারিদিক আকাশের উজ্জল তারাটা মিটমিট করে শুধু জ্বলছে বুঝে নিও তোমাকে আমি ভাবছি। রুনা লায়লার এ গানটা শুনে কত কেঁদেছিলেন তিনি তার হিসেব কে‌ কবে রেখেছে।
– শুধু গান গেয়ে পরিচয়। চলার পথে ক্ষণিক যে দেখা। একি শুধু অভিনয়।
মুগ্ধ ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনেও ।কখনো নচিকেতা, কখনো মান্না দে, কখনো খুরশিদ আলম। নাসিমা পারভীন আবেগী প্রকৃতির মানুষ। গান শুনে চোখ ভিজিয়ে ফেলার অভ্যাস তার শৈশব থেকে। এই যে এত বয়স হলো আজ‌ও তিনি চোখ বুজে গান শোনেন। ঐ সময়টাতে, হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন ঘটনা তার চোখের কোনায় ধীরলয়ে ভেসে আসে। তিনি টের পান তার চোখ ভিজে উঠছে। প্রত্যেকটা গানের কথা তার জন্য যেনো গীতিকার রচিত করেছেন। সুরকার যেনো কেবল তাকে ভেবেই সুর করেছেন। তার সর্বাঙ্গে আবেগী প্রকৃতির অনুভবে একটা চেহারা ভেসে উঠে। এত বছর পার হলো আজ‌ও চেহারাটা তিনি স্পষ্ট দেখতে পান। উস্কোখুস্কো অগোছালো একটা মুখ। এই মুখটির জন্য তার কিশোরী হতে ইচ্ছে করতো। বর্ষার ভারী সন্ধ্যায় ফানুস উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করতো অচেনা ঠিকানায়। কেবলমাত্র অনুভবের মৌনব্রত ধারণের জন্য খোলা চুলে তিনি বসে থাকতেন। অপেক্ষায় থাকতেন কোন হাতে লেখা চিঠির। আজ‌ও এ আবেগ টুকু একবিন্দুও কমেনি।
প্রেমে পড়ার অনুভূতি তাকে আজ‌ও অদৃশ্য এক অনুরাগ জন্ম দেয়। বয়স কালের প্রেম। আনমনে হেসে উঠলেন তিনি। হঠাৎ তার মনে হলো তার ভেতরের কেউ যেনো তার সাথে তাল মেলাচ্ছে। বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে সাধারণ কিছু তাকে অতীতের উদাসীন পথে নিয়ে গেছে। এ ব্যাপারটুকু তিনি উপভোগ করেন। দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো ভেসে বেড়ায়। যেনো সাদাটে কবুতর। সুখের অমোঘ আকর্ষণে দলবেঁধে ডানা মেলে উড়ে যায়। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। তার ভেতরে যেনো ডাকছে; তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা। এ আমার স্বপ্ন সুখের ভাবনা। চেয়েছি পেতে যাকে চাইনা হারাতে তাকে। বৃষ্টি তোমাকে তাই ফিরে চাইলাম। আমার সারাটি দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম। শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।
মানুষের জীবন হলো আনমনা হয়ে থাকার জীবন। কেবলমাত্র সুযোগ খুঁজে আনমনা হবার। কখনো গানে। কখনো বা কথায়। সে আনমনা হয়। মনের ভেতর হাজারো ছবি ভেসে উঠে। অবোধ শিশুর মতো কাতর হয়ে ছবি গুলো সে কুড়িয়ে নেয়। আমরা কেউ এর বাহিরে ন‌ই । নাসিমা পারভীনের আজ আনমনা হবার মৌসুম। তিনি বারবার আনমনা হবেন। তিনি জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখবেন। তিনি গানে গানে নিজেকে হারাবেন। তিনি আবারো পুরনো অভিব্যক্তি ভেবে ছন্নছাড়া মনের হবেন। আজ তিনি এবং তার মন একসাথে সঙ্গী হবেন। কোথাও যাত্রাপথে বিরতি হবে না। মনের অজান্তেই এক ছটাক কিছু যেনো তার ভেতর উথালপাথাল করছে। এটা আজ থাকুক বিড়বিড় উচ্চারণে বললেন তিনি।
পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে; তুমি কি সেই আগের মতই আছো, নাকি অনেকখানি বদলে গেছো.. খুব জানতে ইচ্ছে করে। ভিন্ন বয়সের দুইজন মানুষ অভিন্ন গানে আনমনা হয়ে চলেছে । দুইজনের কেউ জানে না আলাদা কক্ষপথে থাকা দু“টো মানুষের ভেতর কি চলছে । আসলে জানা উচিত ও নয়। সব অনুভূতি কাছের মানুষের জানতে নেই। কিছু অনুভব একান্ত ভারাক্রান্ত জীবন্ত হয়ে ফুটন্ত ফুল হয়ে থাকুক। ভিজুক সিক্ত হয়ে সতেজ হোক।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত