পাশের ফার্মেসির দোকান থেকে একটা প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপ কিনে আনলাম। স্ত্রী কে বললাম চেক করে দেখো।
ধুর.. এসব চেক করে কিছু হবে না.. কবে আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের প্রথম সন্তান ছেলে। বয়স ছয় বছর। ছেলে হবার পর থেকে গত পাঁচ বছর যেহেতু কোনকিছু হয়নি তাই আশা ছেড়ে দেওয়াটাই স্বাভাবিক। বললাম উপরওয়ালা চাইলে কত কিছুই তো হয়। যাও চেক করে দেখো। আল্লাহ ভরসা। একরকম নিরাশা নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকলো। বেরিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল, এই দ্যাখো দুই দাগ! আমি অবাক হয়ে স্ত্রীর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মুহূর্তের মধ্যে অন্যরকম এক আনন্দ ও ভালোলাগা সারাটা শরীর ছুঁয়ে গেল। দ্বিতীয়বার বাবা হবার স্বপ্ন মনটাকে বিভোর করে তুলল। দুই রাকাআত নামাজ পড়ে আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। পরেরদিন কনফার্ম করার জন্য রক্ত পরীক্ষা দিতে গেলাম। রিপোর্টে আসলো প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ। আলহামদুলিল্লাহ। এবার আর কোন কিন্তু না রেখে মন খুলে আনন্দ প্রকাশ করলাম।
সন্ধ্যার পর গাল্ফ রোড ধরে ঘন্টাখানেক শুধুশুধু ড্রাইভ করলাম। গাল্ফ রোডটা কেন জানি একটু বেশি সুন্দর। পুরো রোডটা সমুদ্রের কোল ঘেঁষে। আজকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। নতুন অতিথির আগমন বার্তা টের পেয়ে আমরা তিনজন আরও দুই ঘন্টা সমুদ্রের পাড়ে বসে কাটালাম। আজকে ভরা পূর্ণিমা। জোছনার আলো সমুদ্রের জলে ঠিকরে পড়ছে। দুর থেকে চিকচিক করছে। আমরা দু’জন মুগ্ধ হয়ে সেই অপার্থিব সুন্দর ঠিকরে পড়া আলো দেখছি।
আমাদের দুজনের ভীষণ ইচ্ছে যে এবার একটা মেয়ে হোক। অবশ্য এই ইচ্ছেটা ওর চেয়ে আমার বেশি। নামাজ পড়ে আল্লার কাছে একটা মেয়ের জন্য খুব করে চাইতাম। আমরা দু’জনেই খুব কল্পনাপ্রিয় মানুষ। দুজনেই শিশুদের ডাক্তার। বাচ্চাদের সাথেই বেশিরভাগ সময়গুলো কাটে। হরেকরকমের বাচ্চা দেখে অভ্যস্ত। বেশিরভাগ শিশুরাই কিউট। সেটা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেরই হোক না কেন। তবে মেয়ে বাচ্চারা একটু বেশিমাত্রায় কিউট। আঠারো সপ্তাহের দিকে আলট্রাসাউন্ড করা হলো। ডাক্তার বললো মেয়ে। খুশিতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলাম। চিৎকার শুনে সনোলজিস্ট কলিগ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম সরি। কল্পনাপ্রিয় মানুষ, তাই কল্পনা জুড়ে একটা ছোট্ট তিন-চার বছরের মেয়ে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। সাধারণত মস্তিস্ক যে বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে সেটারই প্রতিফলন ঘটে স্বপ্নে।
আমিও মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে একটা তিন থেকে চার বছরের ফ্রগ পরা মেয়ে আমাকে দেখে ছুটে আসছে। মাথার দুপাশে চুল বেনী করে বাঁধা। স্বপ্নের সেই ছোট্ট মেয়েটি ঠিক পরীর মত দেখতে।
এরমধ্যে ছয়মাস কেটে গেছে। মেয়েটি তার ছোট্ট অন্ধকার পৃথিবীতে নিজস্ব গতিতে একা একা বড় হচ্ছে। এখন ওর মা খুব ভালোমতোই নড়াচড়া টের পায়। আমি পাশে থাকলে নড়ার সাথে সাথে আমাকে ইনফর্ম করে, এই দ্যাখো একটা লাথি মারলো। পেটের উপর হাত রেখে মাঝেমধ্যে মেয়ের লাথির গতিবেগ স্পর্শ করি। আমাদের দুজনের ধারনা এই মেয়ে একটু বেশিই নড়াচড়া করে। যেসব বাচ্চারা পেটে থাকতে বেশি নড়ে এরা নাকি দুষ্টু হয় বেশি। বুঝতে পারছি আমার এই মেয়ে নির্ঘাৎ দুষ্টু হবে! মনে মনে একটা নাম ঠিক করলাম। আয়েশা। আমার খুব পছন্দের একটা নাম।
আমাদের ছেলেটাও খুব এক্সাইটেড। তার ইচ্ছে এই সংসারে তার একটা সিস্টার আসুক। ব্রাদারের চেয়ে সিস্টার তার খুব পছন্দ। সে সিস্টারকে দেখেশুনে রাখবে। তার কিছু খেলনা সে সিস্টারের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছে।
আর মাত্র তিনমাস বাকি। একদিন সন্ধ্যার পর তলপেটে হঠাৎ অল্পঅল্প ব্যথার কথা বললো। বললাম, ওসব কিছু না.. প্রেগন্যান্সির সময় তো কত সমস্যাই হয়.. শুয়ে থাকো ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। কিন্তু ঘন্টাখানিক পেরিয়ে গেলেও সেই চাপা ব্যথাটা ঠিক কমছে না। মনে হচ্ছে আগের চেয়ে একটু একটু করে বাড়ছে। অপেক্ষা না করে হাসপাতালে গেলাম। আলট্রাসাউন্ড করে দেখলো বাচ্চা ভালো আছে। ডাক্তার সবকিছু দেখে পূর্ণ রেস্ট নিতে বললেন, সাথে কিছু মেডিসিন দিলেন।
বাসায় ফিরে আসলাম। ঘন্টা দুয়েক ব্যথা কম থাকার পর আবার শুরু হলো। রাত যত গভীর হয় ব্যথা ততই বাড়ে। আল্লাহকে খুব করে ডাকছি। ব্যথা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ব্যথার জন্য ঠিকমত শুতে পারছে না, বসতে পারছে না। পেট ধরে পায়চারি করছে। বুঝতে পারছি ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! রাত তখন প্রায় তিনটা। পাশের ফ্লাটে আমার কলিগকে ডাকলাম। বললাম আমার ছেলেটার পাশে গিয়ে শুয়ে থাকতে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ওইরাতে আবার হাসপাতালের পথে রওনা হলাম। এবার সরাসরি স্ত্রীকে ভর্তি করে নিল। আমি একা বাসায় ফিরে আসলাম। সকাল সাতটার দিকে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন আসলো। বললো, সরি! বাচ্চাটা রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আপনার স্ত্রীকে আমরা ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাচ্ছি। তাড়াহুড়ো করে আবার হাসপাতালের পথে রওনা হলাম।
ডেলিভারির পর মেয়েটি নাকি বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল! নার্স আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমি আমার মেয়ে আয়েশাকে দেখলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার সেই রাজকন্যাকে মন ভরে দেখে নিলাম। ঠিক আমার সেই স্বপ্নে দেখা মেয়েটি! এখনও রাতের অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে মাঝেমাঝে মেয়েটির জন্য হাত বাড়িয়ে রাখি। সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে গুটিগুটি পায়ে চুল বেনী করা অবস্থায় আমার দিকে ছুটে আসছে! আল্লাহ চাইলে নিশ্চয় ওপারে আমাদের দেখা হবে!
গল্পের বিষয়:
গল্প