বছরপাঁচেক হলো দর্শনে এমএ করেছি। টিউশনি করে হাতখরচ চালাই। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসএসসিতে বসি। একবার কোয়ালিফাই করেও ভাইভাতে বাদ হয়েছি। আসলে বিষয় নির্বাচনে ভুল। দর্শনে ভ্যাকান্সি কম। চাকরির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু সুযোগ এলো। ফুল ডিপার্টমেন্টে। লিখিত পরীক্ষায় বসতে হবে না, কেবল ইন্টারভিউ। বাবা ব্যবস্থা করেছেন। পেছনে অন্য কোনো গল্প আছে কি না জানি না। জানতে পারলে ইন্টারভিউতে যাব না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তরে গম্ভীর হয়েছেন তিনি, তোমাকে যা বলা হচ্ছে করো।
ভাইভার দিন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিতে হবে। সঙ্গে দুকপি করে জেরক্স উইথ অ্যাটাস্টেশন, যার মধ্যে কাস্ট সার্টিফিকেটও আছে। পদটি ওবিসি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত। আমরা ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত। যদিও আমার কাস্ট সার্টিফিকেট নেই। বাবাকে সে-কথা জানালাম। বিশেষ আমল দিলেন না। বললেন, সময় আছে বের করে নাও। এতদিন করোনি কেন?
জাতপাতের সুবিধা নেব না বলে।
– লাভ হলো?
আমি উত্তর দিই না। বাবার লাভ-লোকসানের হিসাবের সঙ্গে আমার দর্শন মেলে না। অহেতুক অশান্তি।
– ভবিষ্যতে খাবে কী করে ভেবেছ?
– আরো কয়েক বছর চেষ্টা করব। না হলে ব্যবসা করব।
– টাকা?– জমাচ্ছি।
– যা মন চায় করো।
বাবা ক্ষেপে গেলেন। মা কথা বন্ধ করল। সবচেয়ে অখুশি হলো ভাস্বতী। বিষয়টা জানার পর থেকেই মুখ গোমরা করে আছে। ভালো কথা বললেও বাঁকা অর্থ করছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিণতি কোনদিকে গড়াবে কে জানে! আমি শঙ্কিত হই। একদিন সরাসরি জিজ্ঞাসা করি, স্পষ্ট করে বলো তো কী চাইছ?
ভাস্বতী হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। উত্তরে আমাকেই জিজ্ঞাসা করল, তুমি তাহলে কাস্ট সার্টিফিকেট বের করবে না। এতবড় একটা সুযোগ এভাবে হারাবে?
– তুমি কী বলছ?
– দেশের আইনে আছে, অন্যায় সুবিধা তো নিচ্ছ না। সরকার তোমাকে অধিকার দিয়েছে, তুমি নেবে, এর মধ্যে আপত্তির কী আছে! আমার তো অহেতুক সেন্টিমেন্ট ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। বুঝতাম অসৎ পথ অবলম্বন করতে হচ্ছে …
ভাস্বতীর কথা অযৌক্তিক নয়। কিন্তু বড় সাধারণ যুক্তি। আইন-কানুনের বাইরেও নীতি-আদর্শ বলে একটা জিনিস থাকে, যুক্তি দিয়ে সবসময় তার ব্যাখ্যা হয় না। এটা আমার স্বপ্ন। ভাস্বতীকে সে-কথা কী করে বোঝাব? সবকিছু ও যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায়। বড় বেশি বাস্তববাদী। তাছাড়া এসব কথা বলতে গেলে হয়তো আমাকে পাগল ঠাওরাবে। ইদানীং বাড়ি থেকে দেখাশোনা শুরু হয়েছে। ভালো পাত্র পেলে হয়তো … ভাস্বতীর বাস্তববোধ আমাকে শঙ্কিত করে। বাড়িতে ভাস্বতীর কথা বলেছি। মায়ের আপত্তি নেই। শেষ পর্যন্ত বাবাও রাজি হয়ে যাবেন জানি। কেবল আমার ছোট্ট একটি ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হবে। কী আর করা যাবে, মূল্য ছাড়া দুনিয়ায় কিছুই মেলে না। ভালোবাসারও মূল্য দিতে হবে। ভাস্বতীকে প্রতিশ্রুতি দিই, কালই বিডিও অফিসে যাব।
ভাস্বতী খুশি হলো। তার মুখে যুদ্ধজয়ের আলো। আবেগ সামলাতে না পেরে আমাকে একটা চুমুও খেল, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কথা ভুলে।
বাবা শুনে বললেন, সুবুদ্ধি হয়েছে।
মা বলল, ওই মেয়েকেই আমি বউ করে আনব।
আমার চারপাশটা বদলে গেল আচমকা। সবাই খুশি। স্বপ্ন হারানোর যন্ত্রণা চেপে অন্যের খুশিতে খুশি আমিও। পরদিন সকালেই ছুটলাম বিডিও অফিসে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে। ক্লার্কবাবু হাতে একটা ফরম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ফিলআপ করে আনুন। প্রতিবেশী দশজনের সই লাগবে, তাদের পরিচয়সহ। আর হ্যাঁ, রেসিডেনসিয়াল সার্টিফিকেট আনবেন।
– সে-বস্তুটি কোথায় পাব?
– পৌরসভা হলে কাউন্সিলর দেবেন, পঞ্চায়েত হলে মেম্বার।
মেম্বার মানে রাখহরি মণ্ডল, থুরি সরকার! বুঝলাম, চাকরি ভোগে। সেইসঙ্গে হয়তো ভাস্বতীও।রাখহরির কাছে আমি কোনো অবস্থাতেই যাব না। আজীবন চাকরি না পেলেও।
এটা আমার এথিক্স। ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ সরকারি চাকরি করে না, তাতে তাদের জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়নি, আমারও হবে না।বাড়ি ফিরে আমার সিদ্ধান্তের কথা সবাইকে জানিয়ে দিলাম।
বাবা রেগে গেলেন। বললেন, যা ইচ্ছা করো, তোমার কোনো ব্যাপারে আমি আর নেই। ভুল হয়েছিল তোমাকে দর্শন পড়ানো।
মা বলল, তুই না হয় চাকরি না করলি, তোর ছেলেমেয়ে? তোর ওবিসি না থাকলে ওদের কী হবে? আজ বাদে কাল বিয়ে করবি, ছেলেমেয়ে হবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?
ভাস্বতীকে ফোন করলাম। আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে বলল, এক জায়গায় কথাবার্তা অনেকটাই এগিয়েছে। ওদের খুব পছন্দ। ছেলের বড় ব্যবসা। তেমন হলে বাড়িতে কী বলব?
– কিছু না, এক বস্ত্রে বেরিয়ে আসবে।
– ওসব সিনেমায় হয়। বাস্তবটা অন্যরকম –
– অর্থনৈতিক বাস্তবতা?
– কথায় প্যাঁচ মেরো না। ভাল্লাগে না সবসময়।
ভাস্বতী ফোন কেটে দিলো।
পাঠক বন্ধু, এখন আপনিই আমার ভরসা। আপনিই বলুন, একজন মানুষ কত নিচে নামতে পারে, যদি তার আত্মসম্মানবোধ থাকে! আপনি হলে পারবেন, রাখহরির মতো মানুষের কাছে যেতে? রাখহরির বেত্তান্ত জানেন তো? বলছি শুনুন –
আমরা এ-গাঁয়ের বর্ধিষ্ণু পরিবার। একসময় বিস্তর জমি-জায়গা ছিল। ভাগবাটোয়ারা হওয়ার পর এখনো যা অবশিষ্ট আছে, বছরের খোরাকি চলে যায়। বছরসাতেক আগের ঘটনা, সকালের দিকে নিমাইকাকা এলো বাবার সঙ্গে দেখা করতে, সঙ্গে বছর তিরিশের একটি ছেলে। পরিচয় করিয়ে দিলো, দেশ সম্পর্কে ভাতিজা। জাতের ছেলে, নাম রাখহরি। আতান্তরে পড়ে এদেশে এসেছে, মাইন্দার রাখেন দাদা। নিমাই মণ্ডল আমাদের জমিতে মুনিশ খাটে। আমরা ডাকি নিমাইকাকা। নিমাইকাকার বাবাও মুনিশ খাটত। শুনেছি একাত্তরের সময় পরিবারটি এদেশে আসে।
বাবা রসিকতা করলেন, জগতের যিনি রক্ষাকর্তা তাকে রাখব মাইন্দার। তোমার কি মাথা খারাপ হলো নিমাই?
– কেন বাবু, দোষ কোথায়! নিমাই রসিকতা না বুঝে বলে, নামে কী এসে যায়! তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণও নন্দরাজের আশ্রয়ে ছিলেন। রাখহরি ভালো ছেলে, আপনিও ওকে আশ্রয় দেন। দেখবেন, ঠকবেন না।
– সেজন্য নয়, নিমাইকাকার সরলতায় বাবা হেসে ফেলেন, কথা কি জানো, আজকাল আর মাইন্দার রাখার যুগ নেই। তেমন সামর্থ্যও নেই আমার। চাষবাসের অবস্থা তো দেখছ, তেল-সারের দাম আকাশছোঁয়া। জমিতে ক-পয়সা আয় হয়? ওকে তুমি অন্য কাজে লাগাও, দুটো পয়সার মুখ দেখবে।
কথাগুলো ওদের মনে ধরল হয়তো, আরো কিছুক্ষণ বসে, চা-মুড়ি খেয়ে, দেশ-গাঁয়ের দুরবস্থার গল্প শুনিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিল। পরে দেখেছি, নিমাইকাকার সঙ্গে রাখহরিও মুনিশ খাটছে। আমাদের জমিতেও কাজ করেছে। লোকটার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, চোখদুটো বড় বড়, দেখে সাহসী আর বুদ্ধিমান মনে হয়। সবচেয়ে বড় গুণ, সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে। প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে জানে। আনুগত্য প্রকাশের ভাষাটা যেন ওর সহজাত। কিছুদিনের মধ্যে পাড়ার দাদাদেরও বন্ধু হয়ে গেল। সন্ধ্যায় ক্লাবে ক্যারম খেলে, কাজ না থাকলে বিকেলে মাঠে যায় ফুটবল খেলতে, পুজোর সময় চাঁদা তুলতে বেরোয় দলবেঁধে। দুবার পাশের ক্লাবের সঙ্গে ক্লাবের হয়ে মারামারি করেছে। সেখানেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
শেষবার অবশ্য এফআইআর হয়েছিল। এমন মার মেরেছিল, বেশ কয়েকজনকে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়। অন্তত দুজনের সেলাই পড়েছিল মাথায়, মুখে। রাতে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল। সকালে পঞ্চায়েতপ্রধান লিয়াকত হোসেন ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়িয়ে এনেছিল। তারপর থেকে প্রধানের পেছনে সেঁটে গেল। কিছুদিনের মধ্যে বদলে গেল পোশাক-আশাক, কথাবার্তা, চালচলন। আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল তড়তড়িয়ে। রাজনীতির বুলিগুলোও একটু একটু করে রপ্ত করছিল।
মাসছয়েক না যেতেই মুনিশ খাটা ছেড়ে দিলো রাখহরি। মোটরসাইকেল কিনল। সারাদিন সেটা নিয়ে চক্কর মারে। রাখহরির দ্রুত পরিবর্তন গ্রামের সবার চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এক একজন এক এক রকম কথা বলে। তার কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে কে জানে!
রাস্তায় দেখা হতে একদিন নিমাইকাকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রাখহরি কি লটারি পেয়েছে?
– কী বলব ছোটকা, ওকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতাম
– নিমাইকাকা দুঃখ করে বলল, এত যে খিদে ওর কে জানত!
– কেন কী হয়েছে?– লটারি পেয়েছে। ঠিকই বলেছ, লটারির নাম ইন্ডিয়া।
তা বটে, বাতাসে টাকা উড়ছে এখানে। বিশেষ করে আমাদের মতো সীমান্ত এলাকায়। কেবল লজ্জা-ঘৃণা-ভয় ত্যাগ করলেই হলো।
– ওই তিন বস্তুর কোনোটাই ওর নেই। এখন শুনছি রাখালি করে।
– শুনছি মানে, তোমার কাছে থাকে না?
– সে তো অনেককাল হলো।
নিমাইকাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাখালি শব্দটা এ-অঞ্চলের নিজস্ব। আভিধানিক অর্থে এর হদিস মিলবে না। চোরাচালানে অন্যের মাল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার সাংকেতিক পরিচয়। আর এসব কাজে ওপার থেকে সদ্য আসা মানুষের কদর বেশি। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে যে-কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে তারা প্রস্তুত। বিনিময়ে পায়ের তলায় একটু মাটি, দুবেলা পেটপুরে খাওয়া আর সামাজিক স্বীকৃতি চাই। আর এসবের জন্য চাই টাকা। আর অল্পসময়ে অনেক অর্থ রোজগারের সহজ পথ এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে!
– সরকার কেন যে এদের তাড়ায় না?
আমার গলায় আক্ষেপ। কথাগুলো সচেতনভাবে বলিনি, মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বুঝতে পারি ঠিক করলাম না। নিমাইকাকা অসন্তুষ্ট হবে, দুঃখ পাবে। এখনো ওপারে তার শেকড় আছে। মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন আসে। কখনো ডাক্তার দেখাতে, কখনো কালীঘাটে মানত দিতে, কখনো চিরদিনের জন্য। নিমাইকাকার হাতধরে অনেকেই দেশ ছেড়ে দেশ পেয়েছে। এটা তার কাছে একরকম জ্ঞাতিসেবা।
নিমাইকাকা হয়তো খেয়াল করেনি। রাখহরির আঘাতটা এত তীব্র যে, ক্ষোভ চাপতে পারছে না। বলল, তাড়াবে কী! ওরা তোমার থেকেও বেশি ভারতীয়। রেশনকার্ড, ভোটারকার্ড, আধারকার্ড, জন্ম সার্টিফিকেট … কী নেই!
– ডুপ্লিকেট?
– সব আসল। আমাদের নেতাদের দয়ার শরীর না!
– ডকুমেন্ট লাগেনি?
– তুমি দেখছি দেশের কোনো খবর রাখো না। পয়সা হলে সব পাওয়া যায়। বাবা ভাড়া পাওয়া যায় মাত্র পাঁচ হাজার টাকায়। খোঁজ নিয়ে দেখ, অনেক ধৃতরাষ্ট্রের সন্ধান পাবে। আর বাবা ভারতীয় হলে ছেলের ভারতীয় হওয়া আটকায় কে!
পদবি, জাত-ধর্ম?
– আত্মসুখের থেকে বড় না। দরকারে বদলে নেওয়া যায়। রাখহরি মণ্ডল এখন রাখহরি সরকার। ছিল কাপালি, হয়েছে নমশূদ্র। ওবিসি থেকে এসসি। সবদিক থেকেই লাভ। কে দেখতে যাচ্ছে ওপারে কী ছিল! আর জানলেই কী এসে যায়!
– ভয়ংকর সব কথা শোনাচ্ছ!
– দুঃখের কথা কি জানো? নিমাইকাকা আফসোস করে, না খেতে পেয়ে মরতে বসেছিল। হাতধরে এপারে নিয়ে এলাম, এখন আমাকেও চেনে না। রাস্তায় দেখা হলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে যায়। এতবড় বেইমান আমি জন্মে দেখিনি।
– বিয়ে-থা করেছে?
– করেছে শুনেছি। বাড়িঘরও করেছে। ওপার থেকে ছোট ভাইটাকে নিয়ে এসেছে। শুনেছি কীসব ব্যবসা করবে ভাইকে সামনে রেখে। ব্ল্যাক করে টাকা হয়, ভদ্দরলোক হওয়া যায় না। সমাজে কলকে পেতে হলে দেখানোর মতো কিছু একটা তো চাই! কী আর বলব, ঘেন্না হয় ওর কথা ভাবলে …
রাস্তার মাঝখানে এক খাবলা থুতু ফেলে হনহন করে হাঁটা লাগায় নিমাইকাকা। আমিও আর পিছু ডাকি না। মানুষটার অভিমান সংগত মনে হয় আমার কাছে।
এ ঘটনার পর বছরও ঘুরল না, বমাল ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। একটু-আধটু নয়, দুই কেজি হেরোইনসহ। নিজেদের মধ্যে থেকে কেউ নাকি ধরিয়ে দিয়েছিল। বিচারে দুবছরের জেল হলো।
ছাড়া পাওয়ার দিন লিয়াকত হোসেন নিজে গিয়ে তাকে গ্রামে নিয়ে এসেছিল।
রাখহরিকে গ্রামের মানুষ এখন বিশেষ চোখে দেখে। পকেটে নাইন এমএম পিস্তল, দু-পাঁচজন সাগরেদ থাকে সবসময় সঙ্গে। জেলে থাকতে মস্তবড় সব মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাদের সৌজন্যে এই উন্নতি। এখন আর সে রাখালি করে না, নিজেই মালিক।
পাঁচ গাঁয়ের লোক এখন একডাকে চেনে রাখহরিকে। নাম শুনে ডরায়। আর হ্যাঁ, রাজনীতিটা মন দিয়ে করে।
লিয়াকতের বিশ্বস্ত। পার্টির সম্পদ। শেষ পঞ্চায়েত ভোটে টিকিটও পেয়ে গেল। আসনটি সংরক্ষিত হওয়ায় লিয়াকত টিকিট পায়নি। শিষ্য রাখহরির নাম প্রস্তাব করেছিল। রাখহরি এখন সংখ্যালঘু শ্রেণির মানুষ। দুয়ে দুয়ে চার হতে সময় লাগেনি। সাঙ্গোপাঙ্গরা নেমে পড়ল গুরুকে জেতানোর জন্য। বলল, রাখহরি সরকার মানুষের বন্ধু, সে জিতলে মানুষের বিপদ কমবে, হারলে …।
রাখহরি জিতে গেল।
পঞ্চায়েতপ্রধানের আসনটিও সংরক্ষিত। আসন হারালেও ক্ষমতা হারাতে চাইল না লিয়াকত, প্রধান হিসেবে নবাগত হলেও অনুগত রাখহরির নাম প্রস্তাব করল। লিয়াকতের লবি দলে ভারি, রাখহরিকেই সমর্থন করল তারা।
রাখহরি এখন কেবল মেম্বার নয়, প্রধানও। রেসিডেনসিয়াল সার্টিফিকেট আনতে হলে যেতে হবে তার কাছে। একজন ক্রিমিনাল, এখনো যার শরীর থেকে বাংলাদেশের গন্ধ কাটেনি, কথাবার্তায় ওপারের টান, ভারতকে বলে ইন্ডিয়া – প্রিয় পাঠকবন্ধু, আপনি হলে পারবেন এমন একজন মানুষের কাছে নাগরিকত্বের প্রশংসাপত্র আনতে? কী বলছেন, প্রয়োজনে অনেক কিছু করতে হয়। সব জায়গায় সেন্টিমেন্ট দেখাতে নেই? ভালো করে ভেবে সিদ্ধান্ত নেব? এতকিছুর পরও ভাবার অবকাশ আছে বলছেন তাহলে? বেশ, আপনাদের কথাই শিরোধার্য। আপনারা আমার সম্মানীয়, কথা দিচ্ছি, ভাবব …
সারারাত ঘুম হলো না। ভাবলাম। একবার ভাবা শেষ হলে দ্বিতীয়বার ভাবলাম, দ্বিতীয়বার শেষ হলে … ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হলো। সকাল হলো। প্রতিদিনের মতো সকাল ছটার মধ্যে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। না, আজ আর টিউশনিতে যাব না। রাখহরির কাছেও না। যাচ্ছি ভাস্বতীদের বাড়ি। ওর মতামতটা জানা উচিত। আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সিদ্ধান্ত তারপর …
সাতসকালে আমাকে দেখে বিস্মিত হলো ভাস্বতী, তুমি?
– বিশেষ প্রয়োজনে।
– আবার কী হলো?
– তোমার কাছে কয়েকটা কথা জানার আছে।
– বলো।
– আমার সেন্টিমেন্টের কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?ভাস্বতী ঘুরিয়ে উত্তর দিলো, আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
– একটা বাংলাদেশির দয়ায় সারাজীবন গ্রাসাচ্ছাদন করব, ভাবলে ঘেন্না হয় না?
– বিয়ের কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে। ইমিডিয়েট কিছু না করলে বাড়িতে আটকানো সম্ভব নয়।
– তবে আর কী, এখানেই সমস্ত সম্পর্কের ইতি হোক।
– যা ভালো বোঝ। ভাস্বতীর সাফ জবাব।আমি সাইকেলে চাপি।
– দাঁড়াও। ভাস্বতী পিছু ডাকে।
– আমাদের মধ্যে আর কোনো কথা থাকতে পারে না।
– তোমার না থাকতে পারে, আমার আছে। তোমার জানা উচিত, বিয়েটা কিন্তু এ-গ্রামেই ঠিক হচ্ছে।
– নো প্রোবলেম।
– ছেলের বড় ব্যবসা।
– শুভেচ্ছা রইল।
আমি প্যাডেলে চাপ দিই।ভাস্বতী পেছন থেকে চিৎকার করে, পাত্র সম্পর্কে রাখহরির ছোট ভাই।