মধ্যবিত্ত হলে যা হয় আর কি! আজ সাতদিন হলো এশাদের বাসার টিভিটা নষ্ট। শাহেদকে কম করে দশবার বলেছে টিভিটা সারানোর জন্য।
“উনি ব্যস্ত!” রাগে গজগজ করে বলে ওঠে এশা। গতকাল পর্যন্ত দু’একটা টাক দিলে তবু চলেছে। আর আজ তো কোনোক্রমেই চালানো যাচ্ছে না। হাত দিয়ে টাক দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে চিরুনি দিয়েও দু-চার ঘা দিয়েছে।
টিভি তার অবস্থানে অনড়। আজ মনে হয় পণ করেছে না চলার।
এবার হাল ছেড়ে দিল এশা।
“এইজন্যই টিভিকে বোকাবাক্স বলে। আর আমাদের টিভিটা তো সেই অর্থে গর্দভ বাক্স”
আমি হাসলাম। কিছু বললাম না।
রাগে গজগজ করতে করতে বারান্দায় গেল এশা।
“সময় কাটানোটা আজ খুবই কঠিন। টিভিটা থাকলে অন্ততঃ সিরিয়াল দেখা যেত। এদিকে শাহেদও ফিরবে রাত দশটায়। তিন ঘন্টা কাটবে টা কিভাবে?”
কফির মগের ধোঁয়াটা এসে লাগে এশার ঠোঁটে। ঢাকায় ঠিকমতো আকাশটাও দেখা যায় না। শুধু দালান আর দালান। বলতে বলতেই সামনের বিল্ডিংটাতে নজর আটকায় এশার।
কেমন যেন বর্গাকারের মনে হচ্ছে পুরো দালানটাকেই। আধুনিক বসতবাড়ি বলতে যা বোঝায় তাই। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঘরবসতি।
বিল্ডিং এর একদম নীচতলাতে কে জানি মারা গেছে। সবাই কাঁদছে। দু’জন শুধু দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। দূরত্বের কারণে কোনো শব্দই আসছে না।
ঠিক উপরের তলাতেও মোবাইলে কথা বলছে একজন। একটা ১৭-১৮ বছরের মেয়ে। একটু আগেই তো মেয়েটা কাঁদছিল। এখন হাসছে। দূর যতই হোক, হাসি-কান্না বুঝতে কষ্ট হয় না এশার। মেয়েটা বারবার বাসার ভিতরে নজর রাখছে। কেউ এসে পড়তে পারে এই ভয়ে হয়তো। এশার মনে পড়ে যায় শাহেদের সাথে প্রণয়ের সময়টার কথা। এমনি করেই তো…
চোখ যায় ৩ তলার জানালায়। একটা ছেলে পড়ার টেবিলে বসা। ১০ মিনিটের মধ্যে কতবার যে টেবিল ছেড়ে উঠলো আর ফিরলো… ওর আবার ডায়াবেটিস নাকি? চিন্তা করে আনমনেই হাসে এশা।
চতুর্থ তলাটা রহস্য ঘেরা বলে মনে হয় এশার। ভারী পর্দার আড়ালে দেখা যায় না কিছুই। কেমন জানি একটা গা ছমছমে অনুভূতি। মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নেয় সে।
বাড়ীর ছাদে কার জানি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। অতটা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে ঠিকই।
ছাদসহ ডানপাশের ফ্ল্যাটগুলো দেখা শেষ। এবার এশা চোখ ডোবায় বামদিকে।
কী অদ্ভুত। কী অদ্ভুত। বামপাশের নিচতলায় রিকশা সারানোর দোকান! বিশ্বে এমন উদ্ভট কাণ্ড কী আর দ্বিতীয়টা আছে। গাড়ী সারানোর দোকান হলেও বুঝতাম। হিসেব এলোমেলো।
দোতলায় এক দম্পতির তুমুল ঝগড়া চলছে। শব্দ না শোনা গেলেও উত্তাপটা টের পাওয়া যায়। ইস্। স্বামীটা কী ইতর। বউটার গালে এক চড় বসিয়ে দিল। আঘাতটা নিজের গালেই যেন টের পেল এশা। বুকটার মধ্যে বড় কষ্ট হচ্ছে।
কষ্ট থেকেই চোখ গেল তিন তলায়। অন্ধকার। এ বাসাটা ভাড়া হয় না এক বছরেরও বেশি। কারণ জানতে ইচ্ছে করে এশার। উপায় আছে কি?
চার তলার বৃদ্ধ মহিলাকে এর আগেও বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছে সে। সঙ্গীহীন। একদম একা। একমনে তাকিয়ে থাকে আকাশের পানে। এ কেমন জীবন? এ ও কি জীবন?
ছাদের গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম চলছে। গানের শব্দ দ্বিগুণ হয়েছে। ছেলেপেলেদের উন্মাতাল নাচানাচিও বেড়েছে।
হঠাৎ ঘোর কাটে কলিংবেলের শব্দে। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খোলে এশা।
“এত তাড়াতাড়ি এলে যে!” এশা জিজ্ঞেস করে।
শাহেদ ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে, “তাড়াতাড়ি! ঘড়ি দেখেছ ক’টা বাজে? আমি আরও ভাবলাম আধা ঘন্টা দেরী করে এসে তোমার মুখ ভার দেখতে হবে।”
অবাক বিস্ময়ে ঘড়ির দিকে তাকায় এশা। রাত সাড়ে দশটা। কখন যে তিন ঘন্টা পেরিয়েছে তার হিসেব মেলে না।
“তা তুমি করছিলে টা কি শুনি? আমাকে একটা ফোনও তো দিলে না!”
এশা অজান্তেই বলে ওঠে, “টিভি দেখছিলাম”
শাহেদ বলে, “মানে কি? টিভি তো নষ্ট। আর নিচ থেকে তোমাকে যে দেখলাম বারান্দায়…”
কথা শেষ না করতেই শাহেদকে হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। সামনের ওই বিল্ডিংটি দেখিয়ে বলে,
“ওই যে আমার টিভি। গত তিন ঘন্টা ধরে দেখলাম জীবনের খণ্ডিত সব গল্প। মিউট করা টিভির মতো। যেমন করে তুমি টিভির অনুষ্ঠান দেখো”
এশা আর একা নয়। শাহেদও যোগ দিয়েছে জীবনের বোকাবাক্সের দর্শক সারিতে। রাত কটা বাজে খেয়াল নেই কারও।
বিড়বিড় করে শাহেদ শুধু বলে,
“এশা, আমরাও কি কারো বোকাবাক্সের অনুষ্ঠানের চরিত্র?”
এশা মাথা নাড়ে। সেটা হ্যাঁ সূচক নাকি না সূচক তা বুঝতে কষ্ট হয়।
রাত বাড়ছে। হলুদের অনুষ্ঠানে হাই বিটে বেজেই চলেছে গান:
“এতকিছু বোঝ আর…মন বোঝো না!”