রোবট স্বামী

রোবট স্বামী
ঠিক এই মুহুর্তে নিহা নামের মেয়েটা বাসর ঘরে বসে আছে। আরশ নামের ছেলেটার সাথে এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। নিলয় নামের কোনো এক বখাটে ছেলেকে নিহা ভালোবাসে, এটা শুনার পর নিহার বাবা মা কয়েকদিনের ভিতরেই সব ঠিক করে নিহার বিয়ে দিয়ে দেন। নিহা অবশ্য বিয়েটা করতোনা, কিন্তু যখন কোনো বাবা-মা বলেন “হয়তো এই বিয়ে করবি, না’হয় আমাদের মরা মুখ দেখবি”, এই কথাটা শুনার পর যেকোনো মেয়েই বিয়ে করতে বাধ্য। নিহাও তাই করেছে। আরশ সম্পর্কে সে তেমন কিছুই জানেনা, শুধু এটা জানে যে ‘আরশ সিলেটের কোনো একটা কলেজের শিক্ষক’। এখন অবধী সে আরশকে দেখেওনি। কাকে বিয়ে করলো? সে দেখতে কেমন? এটা দেখার জন্যই নিহা অনেক্ষন যাবথ দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আরশ রুমে ডুকার অপেক্ষায় !!
একটু পরেই একটা ছেলে রুমে ডুকলো। মাথায় একটা পাগড়ি, গায়ে বরের পোশাক। দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনিই আরশ। চোখে একটা বড় গ্লাসের চশমাও আছে। ছেলেটা রুমে ডুকেই মাথা থেকে পাগড়িটা খুললো। তারপর চোখ থেকে চশমাটা খুলে বিছানার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। নিহা বসে বসে অবাক হয়ে আরশের দিকে তাকিয়ে আছে। মানে কি এটার?? এটা কি বাসর রাত?? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে। কথা না বলুক, একবার নতুন বউয়ের মুখটা তো দেখা যায়। পাশে নতুন বউকে রেখে, কোনো কথা না বলে কেউ এভাবে শুয়ে পড়ে? নিহা আরশের এরকম অবাক করা আচরণ দেখে চিন্তায় পড়ে যায়। আচ্ছা ছেলেটা কি বোবা? ধুরো… বোবা হলে কলেজের শিক্ষক হবে কিভাবে?আচ্ছা ছেলেটা কি নেশা করে এসেছে না’কি? নেশা না করলে কেউ বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথে এরকম মরার মতো ঘুমিয়ে যায় কিভাবে? কিন্তু ছেলেটার মুখ দেখে তো নেশা করেছে বলে মনে হচ্ছেনা। তাহলে ছেলেটা এরকম কেনো করলো? নিহা চিন্তা করতে থাকে। গভীর চিন্তা !!
“”‘১মাস পর”””
বিয়ের ১মাস হয়ে গেলো। এই ১মাসে নিহা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে আরশ কি’রকম মানুষ। আসলে মানুষ বললে ভুল হবে। বলা যায় একটা রোবট। রোবট বললেও আসলে ভুল হবে, আরশকে বলা যায় একটা আদর্শ রোবট। প্রতিদিন সকালে চুপচাপ নাস্তা করে কলেজে যায় আরশ। বিকালে ফিরে কিছুক্ষন বই পড়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। রাতে টিভি দেখে দেশের খবর নেওয়া, তারপর ডিনার করে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া।
আরশ যে কি’রকম মানুষ, সেটা বিয়ের ২য় দিনেই বুঝে গেছিলো নিহা। যখন নিহাকে বলা আরশের প্রথম কথাটা ছিলো “হাসিনা-খালেদা যুদ্ধ এবার মনে হয় শুরু হয়েই যাবে”। কথাটা শুনার পর ফ্যালফ্যাল করে আরশের দিকে অনেক সময় তাকিয়ে থাকে নিহা। বউকে বলা স্বামীর প্রথম কথা- “হাসিনা-খালেদা যুদ্ধ এবার মনে হয় শুরু হয়ে যাবে”। বাহহহ, এরকম মানুষের সাথে ১মাস অনেক কষ্টে সংসার করেছে নিহা। কিন্তু আর না। নিহা এর থেকে মুক্তি চায়। একটা রোবটের সাথে আর যাইহোক, সংসার করা যায়না। পরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করছে আরশ। নিহা পাশের চেয়ারে বসে আছে। হুট করেই নিহা বলে উঠলো-
– তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিলো”।
– হুম বলো”। (নিহার দিকে না তাকিয়ে, আপেল খাওয়ার দিকে মন দিয়ে কথাটা বললো আরশ)
– আমার বাবার রিকুয়েস্টের জন্যই তুমি আমাকে বিয়ে করেছো তাইনা”? প্রশ্নটা শুনে নিহার দিকে তাকায় আরশ।
– না, এরকম কেনো হবে”?
– তাহলে একটা কাজের মেয়ে পাবে এটা ভেবেই বিয়ে করেছো”?
– এসব প্রশ্নের মানে কি নিহা”?
– মানে আমি আর তোমার সাথে থাকতে চাচ্ছিনা। আমি মরে যাচ্ছি এখানে৷
আমি মুক্তি চাই। প্লিজ আমাকে আমার বাসায় দিয়ে আসো। আমার আর সহ্য হচ্ছেনা তোমার এই বাসা সাথে তোমাকেও”। (কথাগুলো চিল্লায়ে বলে নিহা) কথাগুলো শুনার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলোনা আরশ। হাত থেকে আপেলটা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আরশ বললো-
– ঠিক আছে”।
– ঠিক আছে কি? আমি আজকেই আমার বাসায় ফিরে যেতে চাই”।
– হুম, আমি বিকালে ফেরার সময় ট্রেনের টিকেট নিয়ে আসবো। আজকে রাতের ট্রেনেই তুমি ঢাকায় ফিরে যেও।
এখন ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই”। নিহাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আরশ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। নিহা অবাক হয়ে রোবটের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। তার বউ তাকে ছেড়ে বাসা থেকে চলে যাচ্ছে, কিন্তু তার তাতে কিছুই যায় আসেনা ?? একটা প্রশ্নও করলোনা? কেনো চলে যেতে চাই? কেনো অসহ্য লাগছে?
কম করে হলেও ১টা প্রশ্ন তো জিজ্ঞাস করা উচিত ছিলো। না, ছেলেটা আসলেই একটা রোবট। নিহা রাগ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। এখন তার ব্যাগ গুছাতে হবে। এই রোবটের হাত থেকে তার মুক্তি পেতেই হবে !! নিহা আলমারি খুলে ব্যাগ গুছাতে শুরু করে। কি মনে করে যেনো সে আরশের আলমারিটা খুলে। ড্রয়ারটা খুলতেই বড় রকমের ধাক্কা খায় নিহা। ড্রয়ারে একটা প্লেট, একটা চায়ের কাপ, একটা গ্লাস, নিহার হাতের লিখা একটা খাতা, নিহার পছন্দের কবিতার বই, এই টাইপের আরো কিছু জিনিস রাখা। নিহা ভালো করে আরো একবার ওগুলোর দিকে তাকায়। হ্যা… এটা সেই প্লেট, যেটাতে সে এই বাসায় প্রথম খাবার খেয়েছিলো। এটা সেই গ্লাস, যেটাতে সে প্রথম পানি খেয়েছিলো।
এটা সেই চায়ের কাপ, যেটাতে সে বিয়ের পরের দিন প্রথম চা খেয়েছিলো। নিহা মনে মনে বলে- “যাক রোবটের ভিতরে মন বলে কিছু একটা আছে তাহলে”। কিন্তু তারপরেও নিহার মনে আরশের জন্য কোনো টান আছে বলে নিহার মনে হচ্ছেনা। নিহা আবার ব্যাগ গুছাতে শুরু করলো। তাকে বাসায় ফিরে যেতে হবে। আজকে রাতেই ফিরে যেতে হবে !! ঠিক এই মুহুর্তে ট্রেনের মধ্যে জানালার পাশের সিটে বসে আছে নিহা। অনেকদিন পর রোবট মানুষটার হাত থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে সে। অনেকদিন পর তার সেই প্রিয় আপন বাসাটায় যাচ্ছে। ট্রেনের হুইসেলটা বেঁজে উঠলো। মাত্রই ট্রেনটা ছেড়ে দিবে। হুট করে আরশের কথা মনে পড়লো নিহার। মানুষটাকে সকালে নাস্তা বানিয়ে কে দিবে? চশমাটা হয়তো সকালে খুঁজেই পাবেনা। শার্টটা আয়রন করেই বা কে দিবে?
কেনো জানিনা আরশের জন্য নিহার ভিতরটা কেঁদে উঠলো। মুহুর্তেই মুখটা কেমন যেনো কালো হয়ে গেলো। একটা মুহুর্তের জন্য যে মানুষটার জন্য বুকের ভিতর কোনো টান ছিলোনা, আজকে সেই মানুষটার জন্য কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে? কেনো মানুষটাকে ছেড়ে যেতে তার কান্না পাচ্ছে?? নিহা তাড়াতাড়ি জানালার পাশ দিয়ে বাইরে তাকালো। আরশ হাত নাড়িয়ে মুখে মিথ্যা একটা হাসি নিয়ে নিহাকে বিদায় জানাচ্ছে। আরশের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতর কষ্টটা যেনো আরো বেড়ে যাচ্ছে নিহার। মনের অজান্তেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়া শুরু করেছে”। ট্রেনটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলো। চোখ থেকে পানি পড়েই যাচ্ছে নিহার। খুব বেশি ইচ্ছা করছে আরশকে জড়িয়ে ধরতে। “কি করবো এখন? ট্রেন থেকে কি নেমে যাবো? ট্রেনের গতি বেড়ে গেছে… এখন কি করে ট্রেন থেকে নামবো”?
এসব চিন্তা করতে করতে নিহা খেয়াল করলো, আরশ দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনের কামরায় ঢুকলো। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে নিহার কাছে এসে বললো- “ট্রেনটা অনেক জোরে চলে তাইনা?? এতো রাতে একা একটা মেয়ে মানুষ ট্রেনে যাওয়া ঠিক হবেনা। তাই চলে আসলাম। অবশ্য আগামিকাল ক্লাসটা মিস আরশকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আরশকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে নিহা। নিহা খেয়াল করলো আরশ ও চশমাটা খুলে চোখটা মুছার চেষ্টা করছে। আরশের বুকে মাথা রেখে নিহা চিন্তা করে, যে তার ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ করা জিনিসগুলো যত্ন করে আগলে রাখে, তাকেই তো ভালোবাসা উচিত। হোক সে অন্যদের মতো বুকে জড়িয়ে “ভালোবাসি” বলতে পারেনা। কিন্তু আমি’তো পারি। আমিই না’হয় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে “ভালোবাসি” বলবো। নিহা আরশকে জোরে জড়িয়ে ধরে বললো-
– এই বোকা ছেলে শুনো, “ভালোবাসি তোমায়”।
– ভালোবাসো? তাহলে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলে কেনো”?
আরশের প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়না নিহা। শুধু চোখটা বন্ধ করে আরশকে আরো জোরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এই রোবট স্বামীটাকে সে কখনোই হারাতে পারবেনা। কখনোই না…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত