ভোরের বৃষ্টি

ভোরের বৃষ্টি
রেলস্টেশনের বড় ঘড়িতে রাত ১টা বাজতে আর ১০ মিনিট বাকি আছে । আমি স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিক্সাওয়ালাকে বললাম , ” ফজরের আজান দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আপনার রিক্সায় করে এই শহরে ঘুরতে চাই , কত টাকা লাগবে ? “
রিক্সাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিলেন । কিন্তু মুখ ফুটে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না কারণ এত রাতে একটা মেয়ে সমস্ত শহর ঘুরতে চাইবে কেন ? মনে হয় আমি তাকে গভীর চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছি কারণ এত রাতে কেউ হয়তো তার কাছে কখনো কোনদিন এমন আবদার করেনি । অথবা রাত ১টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি হতে ফজরের আজান দেওয়া পর্যন্ত কত টাকা ভাড়া হতে পারে সেটা হিসাব করছেন । রিক্সাওয়ালার বয়স বেশি হবে না মনে হয় ২৫/২৬ বছর হতে পারে ।
স্টেশনের চারিদিকে দু’একজন মানুষ নিদ্রাহীন কেউ অর্ধনিদ্রিত আবার কেউবা সুষুপ্ত । রাস্তায় আরো দু একটা রিক্সার মধ্যে রিক্সাওয়ালা বসে বসে ঝিমাচ্ছে । আমি এত রাতে আসার তেমন কারণ নেই তবে ট্রেনের মধ্যে সবার মুখে শুনলাম আজকে নাকি ট্রেন লেটে এসেছে । রুপসা এক্সপ্রেস অন্যান্য দিনে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে পৌঁছে আবার রাত নয়টা বাজে ফিরে যায় । আমি এই প্রথম খুলনা শহরে এসেছি কিন্তু ইচ্ছে করে আসিনি কারণ যাবার ইচ্ছে ছিল ঢাকা শহর । কিন্তু আমাদের দিনাজপুর পার্বতীপুর রেলস্টেশন থেকে কোন ট্রেনের মধ্যে উঠছি তখন জানিনা । অবশ্য আমার নিজের গন্তব্য কিছু নেই ।
– আমি আবারও প্রশ্ন করলাম, পারবেন না সারারাত আমাকে ঘোরাতে ? আমার কাছে টাকা আছে , যা আছে সবকিছু আপনাকে দিয়ে দেবো । কিন্তু শর্ত আছে একটা । (আমি)
– কি শর্ত ? (রিক্সা ওয়ালা )
– এই শহরে বড় নদী আছে ?
– হ্যাঁ রূপসা আর ভৈরব ।
– ব্রীজ আছে একটাও ?
– হ্যাঁ রূপসা সেতু ।
– খুবই ভালো , এবার আমার শর্ত হচ্ছে সারারাত ঘোরাঘুরি করার পরে ঠিক আজান দেবার সময় আমাকে সেই ব্রীজের উপর নিয়ে যেতে হবে । কারণ আজান দেবার সময় আমি ব্রীজ থেকে নদীতে লাফ দিয়ে আমার অভিশপ্ত জীবনের সমাপ্তি করবো ।
– মানে কি ? কে আপনি ? আর আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হলো কেন ?
– আমি নাজমা আক্তার বৃষ্টি , জীবনের মাঝে এত পরিমাণ কষ্ট জমা হয়ে গেছে যেগুলো থেকে মুক্তি পেতে হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই । এই পৃথিবীতে মানুষ সকল দুঃখ কষ্ট থেকে মানসিক মুক্তির আশায় আত্মহত্যা করেছে । মরার জন্য কেউ আত্মহত্যা করে না বরং কষ্টের গ্লানি থেকে মুক্তির জন্য আত্মহত্যা করে । আচ্ছা আপনার নাম কি ?
– সজীব , মোঃ কাব্য সজীব । আপনার বাসা কোথায় ? বাসার ঠিকানা বলেন আমি গিয়ে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো ।
– আমার বাসা দিনাজপুর জেলা চিরিরবন্দর থানা পারবেন আমাকে নিয়ে যেতে ?
– এত দুরে কেন ? খুলনা শহরে কেউ নাই ?
– না আমি এই প্রথম খুলনা শহরে এসেছি । বেশি কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না , আপনি যদি না যান তাহলে আমি অন্য রিক্সা ডাকবো ।
– আচ্ছা ঠিক আছে আমি রাজি আছি কিন্তু আপনি রিক্সায় বসে আপনার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগার কারণ টা বলবেন । রাজি ?
– আচ্ছা ঠিক আছে , কিন্তু আমার কাহিনি কিন্তু খুব কষ্টের তাই যতই খারাপ লাগুগ তবুও চোখের কোনে পানি জমাতে পারবেন না ।
– হাহাহা আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে ।
– তাহলে চলুন , রিক্সার হুট টা উপরে তুলে দেন নিস্তব্ধ রাতের মৃদু বাতাস উপভোগ করতে চাই ।
রাস্তায় তেমন কোন মানুষ চোখে পরলো না , খুলনা হচ্ছে নীরব শহর । মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি হুস করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় । আমরা দুজন রাস্তার পাশ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই ।
– সে বললো , আপনার আত্মহত্যা করার কারণ টা কি ? বলেন !
– আচ্ছা আমি এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বলতে থাকি আর আপনি রিক্সা চালানোর পাশাপাশি মন দিয়ে শুনতে থাকুন । যদি মনের মধ্যে কোন প্রশ্ন থাকে সেটা সবার শেষে করবেন ।
– আচ্ছা ঠিক আছে ।
– যেদিন আমার জন্ম হলো সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে তাই মা-বাবা আমার নাম রাখেন বৃষ্টি ।
কিন্তু সেদিন সেই জন্ম থেকেই যে জীবনের মাঝে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আজও সেই বৃষ্টি অব্যাহত আছে । আর সেটা প্রথম দেখা দেয় যখন আমার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর ৷ আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে । তারপর সেই দ্বিতীয় স্ত্রী সাথে নিয়ে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেল আর আমার মায়ের চোখে অশ্রু । বাবা চলে যাবার পরে মা আমাকে নিয়ে নানার বাড়ি চলে আসেন ।
আমার নানা তখন জীবিত ছিল , তাই তিনি মা’কে নিজের কাছে আশ্রয় দেন । দুই বছর পরে যখন আমার বয়স পাঁচ বছর তখন আমার নানা আমার মা’কে আবার করে বিয়ে দেয় । আমি তখন নানার কাছে বড় মামার বাসায় থাকতাম আর মা তখন নতুন স্বামীর ঘরে চলে গেল । নানা যতদিন জীবিত ছিল ততদিন মোটামুটি ভালোই ছিলাম কিন্তু আমার বয়স যখন আট বছর তখন নানা মারা গেল । নানার মৃত্যুর পরে আমার জীবনে আবার কষ্টের দিনগুলো ফিরে এলো । দাদার বাড়িতে আমার ঠাই হলো না তাই মামীর গালাগাল আর নির্যাতন সহ্য করেও রয়ে গেলাম তাদের সাথে ৷ মা মাঝে মাঝে আসতো কিন্তু তার অভাবের সংসারে আমার ঠাই কিভাবে হবে ? ক্লাস থ্রিতে পড়ার পরে আমি আর পড়াশোনা করতে পারি নাই ।
আমার বয়স যখন ১৬ বছর তখন আমার বিয়ে ঠিক করা হলো কিন্তু প্রধান শর্ত হচ্ছে এক লাখ টাকা যৌতুক দিতে হবে । আমাদের মত গরিবের সংসার চলতে হিমসিম খেতে হচ্ছে সেখানে এক লাখ টাকা যৌতুক কিভাবে দেব ? ছেলে পক্ষ অনেক বড় গৃহস্থ পরিবার তাই আমার মা সেখানেই বিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেন । কিন্তু এতগুলো টাকা যোগাড় কিভাবে হবে সেটাই তো সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় । পাত্র পক্ষের কাছে মা টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন , মায়ের ভাবনা ছিল নানার সম্পত্তির মধ্যে মায়ের ভাগের অংশ বিক্রি করে দিবেন । সেই টাকা দিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠাবেন যেন আমি সুখী হতে পারি ।
জমি বিক্রি করার কথা বলতেই দুই মামা হঠাৎ করে বেঁকে বসলো । তাদের বক্তব্য হচ্ছে নানা নাকি সব সম্পত্তি মামাদের নামে লিখে দিয়ে গেছে । আমাকে লালন পালন করার দায়িত্ব মামাদের উপর দিয়ে সব সম্পত্তি নাকি তাদের দিয়ে গেছে । এ নিয়ে একটা ঝামেলা আরম্ভ হলো কিন্তু আমার মা তেমন কিছু করতে পারলো না । দলিল দস্তাবেজ থেকে কোনো কিছু বের করা গেল না কারণ সকল দলিল নতুন করে মামারা নিজেদের নামে করে নিয়েছেন । তবুও আমার মা দুই মামার কাছে হাতে পায়ে ধরতে লাগলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না । এদিকে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলো কিন্তু যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে পারলো না মা ।
বিয়ের জন্য তেমন আয়োজন করার কথা ছিল না কারণ আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার বাবা মানে শশুর সাহেব খুব বুদ্ধিমান । নিজের সন্তানের বিয়েতে প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করে খাইয়ে নিজের অর্থ ব্যয় করার মত বোকা তিনি নন । তাই মাত্র ৬/৭ জন এসে আমাকে কাবিন করে বিয়ে পরিয়ে নিয়ে যাবে । কিন্তু যখন তারা জানলো যে আমার মা যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে পারে নাই তখন ৩৬০° এঙ্গেলে বাঁকা হয়ে গেল । পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু তিনি টাকা ছাড়া তার সন্তানের সাথে আমার বিয়ে দেবেন না । সেদিন মনে মনে ভাবলাম , তিনি মনে হয় কোরবানি গরু এতদিন লালন পালন করেছেন । আর এখন সময় মত নির্দিষ্ট দামে সেটা বিক্রি করতে চান ।
অনেক অনুরোধ করার পরে তিনি বিয়ের জন্য রাজি হলেন কিন্তু শর্ত হচ্ছে ২ দুই মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে হবে নাহলে আমাকে যেন ফিরিয়ে নিয়ে আসে । আমি কারো কোনো কথার জবাব দিতে পারি নাই কিন্তু আমার মায়ের নিষ্পাপ করুন আকুতি দেখেছি ।
বিয়ে হয়ে গেল এবং আমাকে নিয়ে তারা তাদের বাড়িতে চলে এলেন । আমার স্বামীর বয়স আমার চেয়ে ১০/১২ বছর বেশি ছিল বাসর ঘরে বুঝতে পেরেছিলাম জীবন থেকে যত তাড়াতাড়ি ছুটি পাবো ততই মঙ্গল । বউভাত বলে কোন অনুষ্ঠান করা হলো না বিয়ের দুতিন দিন পরেই আমি ওই সংসারের একজন দাসী হয়ে গেলাম । তখন ধান কাটার কাজ চলছে তাই বাড়ি ভর্তি প্রচুর ধান ছিল এবং সেই ধান সিদ্ধ করা শুকানোর কাজ চলছিল ।
আমার শাশুড়ি বললেন , নবাবগিরী করে লাভ নেই কাজের মৌসুমে কাজ করতে হবে । মামার বাড়িতে কাজ করতে করতে আমি কাজকে কখনো ভয় পেতাম না তাই শশুর বাড়ি গিয়েও কোন প্রকার কাজ করতে সমস্যা হলো না । কিন্তু এত পরিমাণ কাজ করেও আমি কারো মন পেতাম না কারণ আমার মা যৌতুকের টাকা দিতে পারে নাই । সারাদিন পরিশ্রম করতাম তাই ক্ষুধা একটু বেশি লাগতো কিন্তু খেতে গেলে পেট ভরে খেতে পারতাম না । প্লেটের ভাত ফুরিয়ে গেলে শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম নিজের হাতে নিতে গেলে বলতো , ” এখনো দুতিনজন খাওয়া বাকি আছে কম করে খাও । আর এত বেশি বেশি খাবার খাও কেন ? চাল কি তোমার মা দিয়ে গেছে ? নাকি বিয়ের সময় হাজার হাজার টাকা দিয়েছে ? “
এমন কথা শুনে পেটে ক্ষুধা থাকা সত্বেও মুখ থেকে খাবার নামতে চায় না । কাজ করতে করতে আমি হাঁপিয়ে যেতাম কিন্তু কেউ শান্তনা দেবার মত ছিল না । একা একা কান্নাও করতে পারতাম না তাই বুক ফেটে কষ্ট আগুন হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে । মাসখানেক পেরিয়ে গেছে কিন্তু মা একটা টাকাও দিতে পারে নাই । আমি জানতাম আরো এক বছর কিংবা একযুগ পেরিয়ে গেলেও মা টাকা দিতে পারবে না । কারণ আমরা গরিবের উপর আরো বড় গরীব আর অসহায়ের চেয়ে আর বড় অসহায় ।
বাড়ির সব কাজ করে রাতে একটু অবসর পেতে চাইতাম কিন্তু আমার স্বামী প্রচুর সিগারেট খেত । আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না তাই সে কাছে এলে বমি বেরিয়ে আসতে চায় । রাতের আধারে আমি কখনো তার কাছে ভালবাসার ছোঁয়া পাইনি । সে তার নিজের দেহের তৃষ্ণা মিটিয়ে আমাকে সেভাবে বিছানায় ফেলে বাহিরে বেরিয়ে যেত । বাহির থেকে ঘুরে এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরতো আমাকে একবার ছুয়েও দেখত না । এমন করে জীবন চলে না কিন্তু পৃথিবীতে আমার যে আর কোন ঠাই নেই । সকাল বেলা মসজিদের মুয়াজ্জিন ঘুম থেকে ওঠার আগে আমাকে উঠতে হতো । দেরি হলে আমার জন্য সকালের নাস্তা হিসেবে অজস্র গালাগালি অপেক্ষা করতো ।
বারবার মা’কে টাকার কথা বলতে বলতে মা তিনিও অতিষ্ঠ হয়ে গেলেন । আমার শশুর তাকে টাকার জন্য কল করতো কিন্তু মা আর কল ধরতো না । তাই আমাকে উঠতে বসতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতো । একদিন আমাকে নিয়ে আমার শশুর আমার মায়ের কাছে নিয়ে গেল । মা’র যেখান দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে সেখানে গিয়ে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলেন । মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হতে পারে আমি জানিনা । মায়ের কাছে গিয়ে কিছু বলতে পারিনি শুধু জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলাম অনেক । তারপর মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরলাম কিন্তু রাস্তায় দাঁড়ানো শশুর আমার যম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ।
আমাকে রাস্তায় ফেলে তিনি গজগজ করতে করতে বাড়িতে চলে এলেন । আর আমি সেদিন সেই অনেক টা পথ একা হেঁটে হেঁটে চলে আসলাম । বাড়িতে এসে কেউ আমার সাথে কথা বলে না , কেউ খেতে ডাকে না আমাকে । আমার স্বামী সেদিন আমাকে প্রচুর মারধর করলো , আমি শুধু যতটুকু সহ্য করার ক্ষমতা ছিল ততটুকু সহ্য করেছি তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছি । এভাবেই চরম সুখের মধ্যে দিয়ে দুই বছর পেরিয়ে গেল , আমার মা আমাকে নদীতে ঝাপ দিয়ে মরতে বলে দিলেন । শশুর বাড়ি একটা কাজের মেশিন হয়ে কাজ করতে করতে পার হয়ে গেল দুই বছর । কিন্তু আর কাটতে চায় না , তাই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল ।
রাতে স্বামীকে কাছে আসতে দিতাম না , কাজ করতে মন না চাইলে করতাম না । আমার এমনই পরিবর্তন দেখে তারা আরো জ্বলে উঠলো তাই আমাকে বিতাড়িত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য । পরশু রাতে আমার স্বামীর সাথে প্রচুর ঝগড়া হলো , আমিও অনেক রাগারাগি করে বাহিরে এসে বসে রইলাম । তারপর ভোর রাতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা আছে , আমি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে নিজের কিছু কাপড় একটা ব্যাগে নিয়ে স্বামী মানিব্যাগ থেকে সব টাকা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম । হাঁটতে হাঁটতে পার্বতীপুর রেলস্টেশন আসলাম সেখানে দাঁড়িয়ে হাজার মানুষের আসা যাওয়া দেখতে ইচ্ছে করছে । তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মানুষের আনাগোনা দেখলাম । বেলা এগারোটার দিকে একটা ট্রেনের মধ্যে উঠে পরলাম আর সেই ট্রেনের মধ্যে করে এখন দিন শেষে রাতের শেষাংশে আমি তোমার শহরে এসেছি কাব্যসজীব ।
– এতটা কষ্ট মানুষের থাকে তাই না ?
– হয়তো ।
– তোমার মত আমার জীবনের ছোট্ট একটা গল্প আছে তবে সেটা খুবই ছোট ।
– বলো তাহলে ।
– নাহহহ থাক ।
– আরে বলো বলো ।
– রাত শেষ হয়ে গেছে প্রায় , আমরা ব্রিজের কাছে চলে আসছি । আর ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে ব্রিজের কাছে পৌঁছে যাবো তাই এখন আর সেগুলো বলতে চাই না ।
– ১৫/২০ মিনিট অনেক সময় , তুমি শুরু করো ।
– আচ্ছা ঠিক আছে তবে আগেই বলছি যে আমার গল্পটা খুব ছোট ।
– হুম ।
– আমাদের বাসা ছিল খালিশপুর ঝুট মিলের সামনে কারণ মা মিলে কাজ করতো ।
আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ব্যাক্তি ছিল আমার বাবা । কারণ বাবা কোন কাজ করতো না , কিন্তু নেশা করতে গিয়ে আমার বাবাকে হারিয়ে দেবে এমন কেউ আমার জানা নেই । প্রতিদিন রাতে বাবাকে নেশার টাকা যোগাড় করে দিতে হতো । নাহলে বাবা আমার মা’কে প্রচুর মারধর করতো কিন্তু আমার মা কখনো প্রতিবাদ করতো না । বাবা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে যেত তখন মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতো । এগুলো সবকিছু আমার ছোটবেলার কথা তখন বয়স ছিল ৫/৬ বছর ।
একদিন রাতে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম , হঠাৎ করে মায়ের তীব্র চিৎকার শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম । বাবা মা’কে প্রচুর মারছিল আর মা মাটিতে পরে কোন কথা বলতে পারছিল না । হঠাৎ করে একটা ছোট্ট আওয়াজ করে মা আমার নাম ধরে ডাক দিল এবং আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল । আমি বিছানা থেকে উঠে রান্না ঘরেন ভেতর থেকে  একটা দা এনে পিছন থেকে পিঠে এক কোপ । বাবা চিৎকার দিয়ে পিছনে তাকিয়ে মাটিতে পরে গেল ।
পরদিন সকালে গোয়ালখালি কবরস্থানে দুটো লাশ দাফন করা হলো , একটা মা আরেকটা বাবা । পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল , সেই অবুঝ বয়স থেকে অনেকগুলো বছর আমি জেলখানায় কাটিয়ে দিলাম । বছর খানিক আগে জেল থেকে বেরিয়েছি , মা-বাবার কবরের কাছেই , গোয়ালখালি রেললাইন এর পাশে একটা রুম ভাড়া করে একলা থাকি । দিনের বেলায় বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাই এবং রাতের আধারে রিক্সা নিয়ে বের হই ।
কারণ রাতের আধারে একলা ঘরে ঘুমাতে পারি না তাই পথে পথে রিক্সার টুংটাং শব্দ করে কাটাই । এটাই আমার জীবনের ছোট গল্প । রিক্সা থেমে গেল , তাকিয়ে দেখি সামনে বিশাল ব্রিজ দেখা যাচ্ছে । সোডিয়ামের হলুদ বাতি জ্বলছে তবে মাঝে মাঝে সাদা এনার্জি বাল্ব আছে । মনে হয় হলুদ বাতি নষ্ট হয়ে গেছে তাই পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু নতুন বাল্ব । আমি রিক্সা থেকে নামলাম , সামনেই দুই ধারে দুটো সিড়ি ঘুরতে ঘুরতে ব্রিজের উপর উঠে গেছে । সেই সিড়ি বেয়ে পথচারী , দর্শনার্থীরা হেঁটে হেঁটে ব্রিজে ওঠে । গাড়ি চলাচলের জন্য অনেকটা দুরে গিয়ে ব্রিজ রাস্তার সাথে মিলিত হয়েছে । কাব্যর দিকে তাকিয়ে দেখি সে রিক্সা তালা দিচ্ছে এখনো ফজরের আজান দেয়নি তাই চারিদিকে রাতের অন্ধকার বিদ্যমান ।
– আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম “রিক্সা তালা দিচ্ছো কেন ?”
– সে বললো , ” আকাশে মেঘ জমেছে তাই আজকে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ভোরের বৃষ্টিতে ভিজবো ।
– আকাশে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি রাতের আধারে ও আকাশের মেঘ দেখা যাচ্ছে । বললাম , তাহলে চলুন উপরে যাই ।
– এভাবে এমন সময় আমাদের যদি কেউ দেখে তাহলে দুজনের কপালে দুঃখ আছে কিন্তু ।
– আমি তো একটু পরে মারা যাবো তাই এসব কথা চিন্তা করে লাভ নেই ।
– না মরলে হয়না ?
– আপাতত উপরে যেতে হবে তারপর উপরে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেবো ।
– আচ্ছা ঠিক আছে চলো ।
– উপরে উঠতে উঠতেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমে এসেছে । দুজনেই বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের মাঝখানে চলে গেলাম । ভোরের বৃষ্টি তাই বাতাসের সাথে সাথে ঠান্ডা শুরু লাগছে খুব । ব্রিজের ঠিক মাঝখানে এসে দুজনে দাঁড়িয়ে আছি , কাব্য আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমিও তার দিকে তাকিয়ে আছি , ব্রিজের সারাসারি বাতিগুলো জ্বলছে । কাব্যের মাথা ভিজে বৃষ্টির পানি কপাল নাক বেয়ে বেয়ে দাড়ি দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পরছে । বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার হয়ে হয়ে আমার পোশাক শরীরের সাথে মিশে গেছে ।
– আমি কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয়ে কাব্যের দিকে তাকিয়ে বললাম , এমন করে তাকিয়ে আছো কেন ?
– কাব্য বললো , অনেক দিন পরে নিজের গভীরের চোখ দিয়ে একটা মানুষ দেখছি ।
– মানে ?
– আমি আমার বাসায় রাতের আধারে একা একা ঘুমাতে পারি না । আপনি কি আমার সাথী হয়ে সারাজীবন সেই ঘরে রাতের আধারে থাকবেন ? কথা দিচ্ছি আপনার সমস্ত অতীতের কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে নতুন করে ভালবাসতে শেখাবো । পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না গিয়ে সবকিছু নতুন করে শুরু করবেন আমার সাথে ?
– তুমি কি বলছো কাব্য ?
– আমি চাই , আজকের এই ভোরের বৃষ্টিতে ভিজে তোমার জীবনের পিছনের সকল স্মৃতি যাক । তোমার ওই মনের মাঝে কাব্যের জন্য নতুন করে ভালবাসা সৃষ্টি হোক । আজকের এই ভোরের বৃষ্টিতে ভিজে তুমি আমার জীবনের বৃষ্টি হয়ে থাকো ।
– তুমি কি সত্যি সত্যি পারবে কাব্য ? আমার জীবন থেকে সকল দুঃখ কষ্ট বেদনা সবকিছু দুর করে দিয়ে পারবে কি আমাকে নতুন পৃথিবী উপহার দিতে ?
– পারবো , কথা দিলাম ।
– তাহলে চলো আজকের এই ভোরের বৃষ্টিতে দুজনে পোশাকের মতো মিশে যাই ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত