বিছানায় শুয়ে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছি, জীবনে কোনো রোমাঞ্চ নেই। এমন সময় বন্ধুর মেসেজ
-“কি রে কালকে যাবি নাকি?গেলে রেডি হইয়া থাকিস।
সাদামাটা জীবনে কিছু শিহরনময় এডভেঞ্চার দরকার, ওকে হ্যাঁ বলে দিয়ে মোবাইল ডাটা টা অফ করলাম। পরদিন শুক্রবার, জুম্মার নামাজ শেষে জিলা স্কুল মোড় দাঁড়িয়ে আছি, মা’কে বলে দিয়েছি আজ দুপুরে খাবো না। মাঞ্জা মেরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি বন্ধুর অপেক্ষায়, দশ মিনিটে দেরি করে হতচ্ছাড়ার আগমন।
-“চল, কিরে আবার ডরাইবি না তো?” প্রশ্নটা গায়ে এসে খোচার মতো বিধলো।
-“ডরামু কেন বাল! চল।” এই লাইনে ও বেশ অভিজ্ঞ, এর আগেও বেশ কয়বার এই কাজ করে এসেছে তবে এটা ছিল আমার প্রথমবার।আগ্রহী স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম – “কই যাবি?”
-“কই আবার?জোবেদা!”
-“আচ্ছা চল।”
নিজের প্রথম অভিজ্ঞতা, একটু হলেও ভেতরটা ধুকপুক করছিল। সেটা সামাল দিয়ে সদর্পনে জোবেদার ভিতর প্রবেশ করলাম৷ ভিতরে ঢুকে দেখি ব্যস্ত পরিবেশ, আমাদের দিকে সেভাবে লক্ষ করার মতো তেমন কেউ নেই। টেবিলে বসে পড়লাম, ওয়েটার এসে পোলাও আর মুরগির রোস্ট দিয়ে গেল। সেটা মুখে পুরে শুরু হল আমার প্রথম বিনামূল্যে বিবাহ ভোজন। আস্তে আস্তে জোবেদা,অনুভব, আমিরে ফ্রিতে দাও মেরে আমরা হয়ে উঠলাম “ডেস্ট্রাকটিভ ফ্রাইডে ডুয়ো”। তবে বিনামূল্যে বিবাহ ভোজন ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলাম সেটা তার ধারেকাছেও ছিলো না৷ ব্যাপারটা প্রথম বুঝতে পারলাম পরপর ৭ বার ফ্রি দাও মেরে সফল হওয়ার পর।
অষ্টমবার যখন বিনামূল্যে ভোজন উৎসব করতে আমরা জোবেদা যাই সেদিন দেখা হয়ে যায় আরেক বিনামূল্যে ভোজনকারী বন্ধুর সাথে যে কিনা খুব শীগ্রই সেঞ্চুরি করতে চলেছে। এ আনন্দে সে তার সাথে কিছু ছোকরা নিয়ে এসেছে যাদের নূন্যতম ড্রেসঅাপ সেন্সও নেই, কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকেছে চেক শার্ট আর সানগ্লাস পরে৷ এদিকে কনে পক্ষের বুইড়াটাকে দেখে বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না, একটু পরপর একেকজনের খাবার টেবিলে গিয়ে তাদের ভাল-মন্দ জিজ্ঞাসা করছেন আর অতিথি মুখ পরখ করে দেখছেন। আমি আর আমার বন্ধু নিশ্চিন্তে মুরগির রোস্ট সাটাচ্ছি। এমন সময় দেখলাম পাশের টেবিলে থাকা চেক শার্ট পরা ছোকড়াটার ঘাড়ে খপ করে ধরে ফেলল বুড়োটা। খাবার টেবিলের সবার মনোযোগ এখন সেদিকে।
-” এই ছেলে তুমি কোথায় থাকো?তোমার বাবা কি করে? ভদ্রতা শিখো নাই?” এ অবস্থা দেখে কজন বিনামূল্যে ভোজনকারী টেবিল থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। এদিকে বুড়োটা ছোকরাটাকে অপমান করেই চলছে।ওই ব্যাটারাও আবার গন্ডারের চামড়া,অপমান শুনতে শুনতে ঠিকই মুখের ভিতর পোলাও-রোস্ট সাটাচ্ছে। শেষে বুড়োটা গরু মেরে জুতো দান করার ভাব নিয়ে বলে, ” খেয়ে যাও, তবে আর কখনো এখন কাজ করবা না।” তবে বুড়োর কথার একদমই গুরুত্ব দিচ্ছিল না ছেলেটা, উল্টো আরো এক চামচ পোলাও নিল। বুড়ো ব্যর্থ হয়ে বাকি টেবিলগুলোতে আর গোয়েন্দাগিরি করলেন না।
দশম বিনামূল্যে বিবাহ ভোজনের সময় টেবিলের উল্টোপাশে দেখা হয় কিছু বড় ভাইদের সাথে, এনাদের আগেও দেখেছি। তারাও ফ্রি পার্টি তবে এবার ভাগ্যক্রমে সব বিনামূল্যে ভোজনকারী একই টেবিলে। ভাইদের সাথে আলাপ-পরিচয় হলো,খাওয়া শেষে হেন্ডশ্যাক করলাম। পরদিন সন্ধ্যায় টিভিতে দেখি মেস ছাত্র অপহরন-নির্যাতন চক্রের চারজন আটক । দু’জনের মুখ দেখে পূর্বপরিচিত মনে হল, হঠাৎ মনে পড়ল এদের সাথে আগের শুক্রবার একই টেবিলে বসে দশম ভোজন এপিসোড এর সফল শুটিং করেছি।
একাদশতম বিবাহ ভোজন পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙ্গে সাসপেন্সের পরিমাণ আরো এগারো গুন বাড়িয়ে দিল। এবার গেলাম অনুভবে ভোজন সারতে। বিধিবাম, প্রবেশ পথেই বাধা। বর এসেছে, তাকে আটকে রাখা হয়েছে গেইটে টাকা না দিলে ছাড়া হচ্ছে না। কিন্তু এতে আমাদের কি! আমরা তো উভয়পক্ষ। তাই গোপন রাস্তা দিয়ে কমিউনিটি সেন্টারের ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি এক টেবিল খালি সেখানে অতিথিদের বসার প্রস্তুতি চলছে। আমরা দু’জন গিয়ে সেই টেবিলে বসে পড়লাম কিন্তু এখানেও বিধিবাম। পাত্র- পাত্রী পক্ষের টেবিলে বসা নিয়ে ঝগড়া লেগে এক পক্ষ রেগেমেগে উঠে চলে গেল। কিন্তু আমরা তখনও সেখানে বসে আছি, আমরা তো উভয়পক্ষ।
দু’পক্ষের কেউই বুঝতে পারল না আমরা কোন পক্ষের তাই কেউ কিছু জিজ্ঞাসাও করলো না। কিন্তু কথায় আছে না ‘ঘরপোড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখে ডরায়’। এখানেও একই কাহিনী, আমার পাশে বসলো এক বুড়ো। আগেরবারের অভিজ্ঞতার কথা বারবার মনে পড়ে যেতে লাগল,এবার হয়তো আমার কলারটাই চেপে ধরবে। কিন্তু যা ঘটলো তার অদ্ভুতত্ব নিয়ে চিন্তা করলে একটা বড় উপন্যাস লেখা যাবে এই বুড়োকে নিয়ে,সেদিকে আর না আগাই। ওয়েটার এসে টেবিলের সবাইকে খাবার সার্ভ করে গেল। হঠাৎ একটু পর আমার পাশে থাকা বুড়োটি চেয়ার হতে দাঁড়িয়ে বজ্রকন্ঠে চেঁচিয়ে বলল -“আমার রান কই?” বুড়োর কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি। ইতিমধ্যে কনে পক্ষের একজন পরিস্থিতি সামাল দিতে এল।
-“কি হয়েছে চাচা?” বুড়ো আবার বজ্রকন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ” আমার রান কই! ১০ লাখ টাকা দিয়া মুরগি কিনছোছ আমার রান কই?” অবস্থা বেগতিক বুড়োর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রানের জন্য স্ট্রোক করবে, আর সে স্ট্রোক না করলেও আমি স্ট্রোক করে মারা যাবে। কনপক্ষের সেই লোক ওয়েটারকে ডেকে আনলো বুড়োকে রান দেওয়ার জন্য। ওমা, ওয়েটার শালা এসে বলল, “রান নাই,দিবার পাইতাম না।” এবার বুড়োর “ইনক্রেডিবল হাল্কে” রূপান্তরিত হবার পালা।
বুড়ো বলল রান না দিলে সে খাবে না, উঠে চলে যাবে। এমন সময় আমি নিজ খাবারের দিকে তাকিয়ে দেখি রানটা আমার পাতে। এবার বুড়ো না আমায় খেয়ে ফেলে এই ভয়ে ঘেমে একাকার হয়ে গেলাম। একটু পর ওয়েটার আসলো মাংসের পিস নিয়ে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওটাও রান ছিলো না । তবে বুড়োকে ততক্ষণে শান্ত করা গেছে, সে তার পাগলামি বন্ধ করে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “বাবা,কিছু লাগবে নাকি?” একটু পরে বুড়োর দলের তিনজন মহিলা আসে আমাদের খাবার টেবিলের সামনে, ওরা এই ব্যাচে বসার জায়গা পাইনি। তাদের মধ্য থেকে এক মহিলা আমাদের লক্ষ করে বলেন, “ওরা কারা?” এই প্রশ্নের পর ওই মহিলার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তিনি বুঝে যান আমরা কারা। সেদিন খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে দেখি যা খেয়েছি সব ঘামের সাথে বেরিয়ে গেছে।
অনুভবের এই বিভিষীকাময় অভিজ্ঞতার পর পরবর্তী শুক্রবার গেলাম জোবেদায়। জোবেদায় ঢুকতে যাবো কিন্তু কেন জানি মনে হলো গোড়ায় গলদ আছে। প্রতিবারের মতো কমিউনিটি সেন্টারে লোকসমাগম থাকার কথা কিন্তু এখানে খুব কম। পরিস্থিতি অবলোকন করে আমি বন্ধুকে বললাম,”চল ভাই অনুভবেই যাই।” এমন সময় দুই ভদ্রলোক এসে বললো, “কি আংকেল?” আমার বন্ধু বলল, ” ওর বাবার দাওয়াত, আমরা আসছি।” ভদ্রলোক দু’জন কিছু বলল না,আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম কিন্তু কনে কই! যাই হোক এরই মাঝে খাবার এসে গেছে। ‘উফ!কাচ্চি!’ এই প্রথম কাচ্চি পেলাম বিনামূল্য ভোজনে। কি স্বাদ!খুব তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া শেষে বেরিয়ে দেখলাম এটা কোনো বিবাহ ভোজন নয়, একমি কোম্পানির কলিগদের অনুষ্ঠান। ঢোক গিলে বাসায় ফিরলাম দু’জন।
এসব ভুতুড়ে কাহিনী দেখে পরেরবার ভাই ব্রাদারদের নিয়ে গেলাম রুম ফোরে। ভিতরে ঢোকার সময় সিকিউরিটি পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে বললাম, “আমরা বর পক্ষ।” ভিতরে ঢুকে দেখি এক বুড়া বেটার জন্মদিন। তিনি আমাদের দেখে বলেন, “বাবা আসছো যখন খেয়ে যাও।” পরেরবার এই কুফা কাটাতে গেলাম অনুভবে। কুফা কাটলো তবে সেখানে এক পরীর সচক্ষে সাক্ষাত হলো। যার মাটি স্পর্শ কাপড় ধরে আছে একজন, শুধুমাত্র ওজনের কারনে পরীটা আকাশে উড়াল দিতে পারছে না নইলে ততক্ষনে আকাশে উড়াল দিতো। সবই হলো শুধু হচ্ছিল না কনের সাথে ছবি তোলা। সতেরো তম বিনামূল্যে ভোজনে সেটাও পূরন হলো। এবারো কাচ্চি! উফ! খাওয়া শেষে সাহস করে গেলাম কনের কাছে।
-“আপু আমাকে চিনছো?আমি সাদমান।”
-” না, কে তুমি ভাইয়া চিনতে পারলাম না তো?”
-” আরে, আমি সাদমান। আমার বাসায় কত গেছো যখন আমি ছোটো ছিলাম।”
-” সরি ভাইয়া, আমার না একদমই মনে পড়ছে না। “
পাশে থাকা বন্ধু বলল, “আচ্ছা আপু মনে করতে হবে না আসো ছবি তুলি।” বাসায় এসে ফেসবুকে ক্যাপশন দিলাম, “আমার ১৭ আর তকির ৭১ তম বিবাহ।” তাড়াহুড়োয় ভোজন কথাটা লিখতে একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসার সব শুনে এক গাল হেসে খাবারের থালিটা সেলের ভিতর ঠেলে দিয়ে বললেন – “আঠারো নাম্বার বিনামূল্যে ভোজনটা না হয় এখানেই হোক।”
গল্পের বিষয়:
গল্প