শেষ চিঠি

শেষ চিঠি
আমি যখন ছয় মাসের গর্ভবতী তখন শুনি আমার স্বামী আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। কথাটা শুনে আমার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল। একথা আমি বিশ্বাস করিনি। আমি শুভ্রতা। দুই সন্তানের জননী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়লাম ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে। পরিবারের একমাত্র মেয়ে বলে বাবার কলিজার টুকরা ছিলাম আমি। এক সময় বাবা আমাদের বিয়েটা মেয়ে নেই, যখন আমার প্রথম সন্তান পুষ্পের জম্ম হয়। সবকিছু ঠিকটাক চলছিলো।
কিন্তু বিয়ের দুবছর পর বুঝতে পারলাম আমার স্বামী অতোটা ভালো না। প্রথম প্রথম আমি তার ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম বলে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারিনি। আমার স্বামীর মেয়েদের সাথে গোপন সম্পর্ক রয়েছে। বাবার বাড়ির কাউকে যে বলবো সেই উপায়ও নেই। কারণ তারা তো আমায় বিয়ে দেন নি। আমি সেচ্ছায় লোকটিকে বিশ্বাস করে বাড়ি ছেড়ে ছিলাম। বুঝিনি তার আসল রূপের আড়ালে আরো একটি কুৎসিত চরিত্র রয়েছে। তবুও সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে পড়ে রইলাম তার সংসারে। তার উপর সংসারে টানাপোড়ন। নুন আনতে পান্তা পুরাই অবস্থা। ঠিকমতো সে রুজিরোজগার করতো না। করলেও সেগুলা বেপথে নষ্ট করতো। তবুও আমি লোকটাকে কিছু বলতাম না। অল্পদিনে বড্ড ভালোবেসে ফেলে ছিলাম লোকটাকে। নিজের মতো সংসার সাজালাম। বাবার বাড়ি থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসল। একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া দেখালাম: আমার স্বামী পাশে নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমার স্বামীর সাথে পাশের বাড়ির এক বাড়ির সাথে পরকীয়া চলছে।
রাগে, দুঃখে, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মরতে পারি নি, আমার যে দুইটা কলিজার টুকরা আছে। আমি চলে গেলে তাদের কে দেখে রাখবে। নিজের কাছে নিজেই হেরে গেলাম আমি। আমার স্বামী কে আমি বুঝাতাম। কিন্তু লোকটা ভীষণ পাষান্ড। উল্টো আমাকে মারধর করতো। আমি ভয়ে চুপসে যেতাম। মাঝে মাঝে মনে হতো, আমি তার কাছে একটি ভোগ পন্য। শরীরের ক্ষিধে মিটে যাওয়ার পর তার কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। অমানুষটার কাছে আমি কেবল রাতের রাণী। অথচ আমারো স্বপ্ন ছিলো, আমার স্বামীর একটু স্পর্শ পেতে, তার কোলে মাথা রেখে গল্প শুনতে, সে একটু রোমান্টিক হবে, ভালোবেসে আমার চুলে বিলি কেটে দিবে।
দুজন ভালোবাসার খুনশুঁটিতে মেতে থাকতাম সবসময়। কিন্তু আমার দূভার্গ্য পোড়া কপাল। তবে আমার ধারণা ছিলো, একদিন লোকটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভালো হয়ে যাবে। এই আশায় চোখের জলে পার করছি দিনের পর দিন। একবার আমার স্বামী রোড এক্সিডেন্ট করে। ১ মাস অসুস্থ ছিলো। তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো। তার চিকিৎসার খরচ জোগাতে আমি বাধ্য নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দেই। ফলে আমি একটু দূর্বল হয়ে পড়ি। ১ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম ও সেবা করে তাকে সুস্থ করে তুললাম। পৃথিবীর প্রতিটা মেয়েই বোধহয় স্বামীকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। নিজে মারা যাবে তবুও স্বামীর এতোটুকু ক্ষতি হতে দিবে না।
মানুষটা যতই খারাপ হোক, আমার কাছে তিনি ছিলেন দেবতুল্য। যদিও উনার চরিত্রে একটু দূর্বলতা ছিলো কিন্তু তিনি আমায় অনেক ভালোবাসতেন। যদিও মুখ ফুঠে প্রকাশ করতো না, কাজ কর্মে আমি বুঝে নিতাম। সুস্থ হওয়ার পর তিনি অনেকটা ভালো হয়ে যান। সংসারের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেন। আমার বেশ ভালো লাগল। স্বামীর জন্য আমার এই ত্যাগ তার বিবেক খুলে দেয়। তার কৃতকর্মের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চান। আমি উনার পায়ে জড়িয়ে বললাম। একথা বলে আপনি আমায় লজ্জিত করবেন না। আমার স্থান আপনার পায়ে। তিনি আমায় নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন স্বামী, স্ত্রী হচ্ছে একটি টাকার এপিঠ আর ওপিঠ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের কেউ আলাদা করতে পারে না। একটি গাড়ির দুটি চাকা যদি সমান না হয় তাহলে গাড়িটি তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। তেমনি স্বামী, স্ত্রী যদি দুজন সমান না হয় তাহলে সেই সংসারে সুখী হওয়া যায় না।
আমি তার বুকে মুখ লুকালাম। আমার মনে হলো, এই মূহুর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। মাঝে মাঝে তিনি আমায় এতো ভালোবাসতেন যে আমি দিনশেষে সব যাতনা ভুলে যেতাম। আমার সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগতো।
কেমন ছিলো মানুষটা আজ কেমন হয়ে গেলো। একটু ভালোবাসা ও যত্ন পেলে মরুভূমিতে ফুল ফুটানো যায় আর উনি তো মানুষ। আমাদের ভালোবাসার ফসল আজ আমার পেটে। আমি তৃতীয় বারের মতো মা হতে যাচ্ছি। আমার বড় ছেলের নাম পুষ্প। বয়স আট ও ছোট মেয়ের নাম পুষ্পিতা, বয়স পাঁচ। ভাবছি এবার যদি মেয়ে হয় নাম রাখবো ফুলি আর ছেলে হলে রাখবো প্রশান্ত। পাঁচ বছর পর ঘরে নতুন অথিতি আসছে।
আমার স্বামীকে কখনো এতো খুশি হতে দেখিনি। খুশিতে আমাকে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু খেলেন। তার স্পর্শে আমি বারংবার মাতাল হয়ে যায়। আমি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার স্বামী একটা চাকরীর খোঁজ পেয়ে ঢাকাতে চলে যায়। আমি নিসঙ্গ হয়ে পড়ি। ছোট ছোট বাচ্চা দুটোকে নিয়ে একলা বাড়িতে থাকি আমি। এখন আমি আট মাসের গর্ভবতী। ঢাকাতে যাওয়ার পর প্রায় তিন মাস আমার স্বামীর কোনো খোঁজ পাই না। জমানো টাকা আর জমির চাল দিয়ে কোন মতে সংসার চালাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার দূশ্চিন্তা হতো। মানুষটা কিভাবে এতোটা বদলে গেলো। চোখের আড়াল হলেই কি মানুষ মনের আড়াল করে দেয়। আমি আজও মানুষটাকে বুঝতে পারি নি।
গত পরশু হঠাৎ তার একটা চিঠি পেয়েছিলাম, সাথে কিছু টাকাও পেয়েছিলাম। যেটাতে লিখেছেন; তিনি আরেকটা বিয়ে করেছেন। আমার বিশ্বাস হয় নি। মূহুর্তেই আমার পৃথিবীটা যেন উল্টে গেলো। ভীষণ কান্না করলাম সেদিন।
চিঠির প্রত্যুত্তরে লিখলাম; আস্লামুয়ালাইকুম, প্রিয় পুষ্পের আব্বু আশা করি ভালো আছেন। চিঠিতে লিখেছেন; আপনি নাকি আবার বিবাহ করেছন। শুনে প্রচন্ড কষ্ট পেলাম। মনে হচ্ছে কেউ আমার কলিজাটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা অসম্ভব। গত তিন মাস আপনার কোনো খোঁজ পাই না। এই চিঠিটা আপনার কাছে পৌঁছানো মাত্রই বাড়িতে আসবেন। আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
অনেক ক্লান্ত লাগে। এদিকে আমার ডেলিভেরি ডেট ঘনিয়ে আসছে। এসময়ে আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। আমার বড্ড ভয় হয়। আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার এই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা দুটিকে কে দেখবে? আমার মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবোনা। পারলে একটা অনুরোধ রাখবেন, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বাচ্চা দুটোকে আপনার বুকের মাঝে আগলে রাখিয়েন। আপনার পথ চেয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। ইতি আপনার, শুভ্রতা। সপ্তাহ খানের পর জানলাম, তিনি কাল বাড়ি আসছেন। ঘরের পোষা মুরগিটা জবাই করে রান্না করলাম। তার সকল পছন্দের খাবারও সাথে আছে। এদিকে আমার ডেলিভেরি ডেটও ঘনিয়ে আসছে। আম্মুকে খবর পাঠিয়েছে। চুলোয় গরম পানি দিয়ে রাখছি।
অতিরিক্ত পরিশ্রম ও দূর্বলতার কারণে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। সেদিন রাতেই আমার প্রসব ব্যাথা উঠে। প্রসব বেদনায় আমি কাতরাতে থাকলাম। আমার চিৎকারে বাচ্চা দুটোর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। রক্তে ভেসে গেছে পুরো খাট।
আমার রক্ত দেখে বাচ্চা দুটো হাউমাউ কেঁদে দিলো। তাদের আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিলাম। চোখ দিয়ে নদীর স্রোত বয়ে গেলো। বাচ্চা গুলো জন্য বেশ মায়া হচ্ছে। কি করবো আমি যে আর টিকে থাকতে পারছি না। সারারাত রক্তক্ষরণ হলো। খাট চুইয়ে পড়ে পুরো রুম রক্তাক্ত হয়ে গেলো। শেষ রাতে আমার শরীর অবশ হয়ে নিস্তেজ হয়ে গেলাম। ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ উল্টে জ্বিবে কামড় পড়লো আমার। মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলাম আমি।
পরিশিষ্ট : মেয়েটির স্বামী ঠিকই পরেরদিন বাড়ি এসেছে। সাথে ছিলো তার প্রিয়তমার জন্য রঙিন শাড়ি ও প্রসাধনী সামগ্রী। বাচ্চাদের জন্য অনেক খেলনা। চিঠি পাওয়া মাত্রই সে ছুটে এসেছে বাড়িতে।সে ভাবল এবার শুভ্রতাকে একা বাড়ি রেখে যাবে না। তাকে সাথে করে ঢাকা নিয়ে যাবে। তার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেলো। কারণ তার প্রিয়সী যে আর বেঁচে নেই। তার প্রিয়সীর লাশ দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না লোকটি। তার আর্তনাদে প্রকম্পিত হয় আকাশ বাতাস। লোকটার কান্নায় কেঁদে ছিলো উপস্থিত স্বজনরা। সে শুভ্রতার কথা ঠিকই রেখেছিলো, তার বাচ্চা দুটোকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। শুভ্রতার স্মৃতি ঐ শেষ চিঠিটা পড়ে লোকটাকে আজও মাঝে মাঝে কাঁদতে দেখা যায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত