আজ ওরা চারজন ভীষণ ভারাক্রান্ত। দুজন খুবই ক্রুদ্ধ, দুজন প্রতিবাদী। দুজন ড্রইংরুমে বসে আছে, দুজন শোবার ঘরে। বাড়িটা বাবা-মায়ের।
শায়লা দেখতে পায় বড়ভাই ফয়সল পেছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনবরত সিগারেট ফুঁকছে। চেহারার ক্রুদ্ধ ভাব এখনো কাটেনি।
ছোটোভাই ড্রইংরুমে টেবিলের উপর দুপা তুলে সোফায় বসে আছে। সে বড় ভাইয়ের মতো চেইন স্মোকার না, তারপরও এ্যাস্ট্রে ভরে আছে। এখন পেছনে মাথা হেলিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল নাড়াচ্ছে। বোঝা যায় রাগ কমেনি।
শায়লা শোবার ঘরে আসে। শর্মিলা শুয়েছিল। ওকে দেখে উঠে বসে। জিজ্ঞেস করে, কি করছে ওরা?
ওদের যা খুশি তা করছে।
করুক গে। আজ থেকে আমাদের সম্পর্কটা ভাঙল। বাবা মারা যাবার পাঁচ দিন পরে।
শায়লা কোনো কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে। দরজার শব্দ প্রবল আলোড়ন তোলে শর্মিলার মনে। ভাবে, ও কার উপর রাগ ঝাড়লো? শৈশব-কৈশোরে এক আশ্চর্য মধুর সম্পর্কের ভেতরে বড় হয়েছে চার জনে। বাবা-মা দুজনে শিক্ষকতার পেশায় ছিলেন। ভালো উপার্জন করেছেন। নিজেদের বাড়ি বানিয়েছেন শহরের অভিজাত এলাকায়। চাকরির শেষ দিকে বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। চমৎকার কেটেছে দিন। এখন সম্পর্কের তটে ভাঙন।
শর্মিলা আবার শুয়ে পড়ে। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। ও বুঝতে পারে শায়লা ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়েছে। ও নিজেকে শীতল করার চেষ্টা করছে হয়ত কিংবা সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে পানির স্পর্শে। মানুষের মানসিক জটিলতা ধরে রাখার সাধ্য খুবই কঠিন। একজীবনে এর সবটুকু ধরে রাখা সম্ভব নয়। শর্মিলা মুহূর্তে নিজেকে নিজের ভেতরে গুটিয়ে ফেলে। এমন দার্শনিক চিন্তায় নিজেকে যুক্ত করার দরকার নেই। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্ক ধুয়ে পানি খাওয়ার দরকার নেই বলে, শর্মিলা নিজেকে ধমকায়।
আজ সকালে ঘটনা যেটি ঘটেছে সেটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। ওরা মানুক আর নাই মানুক। কিছু এসে যায় না তাতে। ও উঠে বারান্দায় আসে। বারান্দা ফাঁকা। ফয়সল হয়ত নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। ড্রইংরুমে উঁকি দিয়ে দেখে ফেরদৌস নাই। ও হয়ত কোথাও আছে। শর্মিলা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে। গ্রিলে ঝোলানো অর্কিডের দিকে তাকিয়ে ভাবে গাছগুলোর পরিচর্যা দরকার। অর্কিড ওর মায়ের শখের ফুল ছিল। এখন শায়লা পরিচর্যা করে। চমৎকার ফুল ফুটে আছে কোনো কোনো লতায়। শায়লা বাবা-মায়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন। যে কাজটি ওরা বাকি তিন ভাইবোন যত্ন নিয়ে করেনি। ফয়সল দেশেই থেকেছে। ও আর ফেরদৌস মাঝে মাঝে দেশে আসে। সময় কাটিয়ে যায়। বাবা-মায়ের শারীরিক খোঁজখবর নেয়। প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। দায়িত্ব এতটুকুই মনে করে। কখনো ভেবেছে টানটা রুটিনের মতো। নিয়মের মধ্যে বাঁধা। শায়লা এর বাইরে। ও মনে করাটা এর চেয়ে বেশি- বুকের গভীর থেকে উঠে আসেত হবে টানের মোচড়, নইলে হবে না। তাহলে দূরে থাকাই সঙ্গত।
চার ভাইবোনের মধ্যে শায়লার সময়ই খুব খারাপ যাচ্ছে। ও হয়ত শাওয়ারের নিচে ভিজছে আর কাঁদছে। কে জানে, এমনটাই করে ও এই মুহূর্তে নিজেকে বুঝ দিচ্ছে। বাকি তিন ভাইবোনের বুকের মধ্যে এত কান্না নেই। ড্রইংরুমের বাতাসে সিগারেটের গন্ধ। শর্মিলা ঠিকমতো শ্বাস টানতে পারছে না। ভাবে, বুকের ক্ষত একটা আবর্জনা। ওটাকে টিকিয়ে রাখার মানে নেই। ডাস্টবিনে ফেলে দেয়াই উচিত।
আজকে যা ঘটেছে তা তেমন কথাই বলেছে। দৃশ্যে-অদৃশ্যে কথাগুলো ভাসছে। শ্রবণে- চিন্তায় বিন্দুর মতো স্থির হয়ে আছে। ওটা কখন ডাস্টবিনে যাবে ও জানে না। শর্মিলা ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা সিগারেটের দুটো টুকরোকে লাত্থি দিয়ে বারান্দায় ছুঁড়ে দেয়। বুঝতে পারে না টুকরো দুটো সম্পর্কের ভগ্নাংশ কিনা! যে ভাইদুটো ওর সামনে এখন নেই। এই সময়ে ওরা ভাই হিসেবে সামনে নেই, অদৃশ্য পুরুষ হয়ে আড়ালে আছে। পুরুষের অধিকার নিয়ে ভিন্ন টোনে কথা বলছে।
তখন গোসল শেষে ভেজা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে শায়লা ড্রইংরুমে আসে। শর্মিলার দিকে তাকায়, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করে না।
কি রে কি হলো?
কি আবার হবে? ও নির্বিকার উত্তর দেয়।
ওর চুল থেকে পানি ঝরে। আজ ও হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করেনি। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে এখন আঁচড়াচ্ছে। চিরুনির সঙ্গে পানি আসছে চুলের ডগায়।
তুমি কি আজকের ঘটনায় চিন্তিত আপু?
হ্যাঁ চিন্তিত তো।
চিন্তা শিকায় তুলে রাখ। যেদিন লন্ডনে ফিরবে বলে ঠিক করেছ সেদিন গিয়ে বিমানে ওঠ।
শায়লা ওর হাত ধরে বলে, আয় বসি। মনটা খারাপ লাগছে।
শায়লা বসতে বসতে বলে, ন্যাকামী কোরো না আপু।
ওরা চার ভাইবোন। দুই ভাই দুই বোন।
একটি বয়স পর্যন্ত একসঙ্গে দিন কাটিয়ে বড়ো হয়েছে। একের সঙ্গে অপরের বয়সের ব্যবধান দুই-চার-তিন-পাঁচের মধ্যে। এখন ওরা সবাই বয়সের একটি প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা যায় মধ্যবয়সের সীমানায় আছে ওরা। কবেই তো শৈশব শেষ হয়েছে, তারপরে কৈশোর। যৌবনও শেষ। এখন ওরা একক মানুষ, ভাইবোন সম্পর্কের সূত্রটুকু মাথায় রেখে। তবে প্রত্যেকের ভেতরে এমন একটি ধারণা জন্মেছে যে, সম্পর্কের সূত্রে জোড়াতালি না থাকলেও শক্ত গিটঠু নেই। যেন ওরা এক একজন দিগন্তরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন তালগাছ।
একই পরিবারে একই ধরণের সময়-প্রবাহে বড় হলেও প্রত্যেকের ভাবনার সূত্র এক নয়। এক হবে না এটা ধরে নেয়া সঙ্গত কারণ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির চৈতন্যে নিবিষ্ট থাকে। যার দ্বারা মানুষ এক থেকে অপর হয়। অপর থেকে আলাদা। ওরা প্রত্যেকেই বোঝে শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে যে মাধুর্য এবং মমতা ছিল বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সম্পর্কে নানা ধরণের জটিলতা ঢুকে গেছে। প্রত্যেকে ব্যক্তিস্বার্থে স্বাতন্ত্র্যের জায়গা তৈরি করেছে। যে যার মতো করে পথ চিনে নিয়েছে।
চার ভাইবোনেই নিজেদের পরিবার আছে। ছেলেপুলে নিয়ে যে যার মতো করে দিন কাটাচ্ছে। তারপরও দেখাশোনা, যাতায়াতের মতো সম্পর্কের জায়গাটি তো আছে। সেখানে সূত্রটি নাটাইয়ের সুতোর মতো নিয়ম-মাফিক ছাড় হয়। আবার গুটিয়েও আসে। ঘুড়ির সুতো কাটাকাটি হয় না। এইটুকু সম্পর্কের বাঁধনকে ঠিক রাখে। শিথিল হয়ে যাওয়া জায়গা আবার ফিরে আসে। এতে সবাই মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকে। মনে করে সবাই ভালো আছে। তারপরও একই পরিবারের একই ধরণের সময়-প্রবাহে বড়ো হলেও প্রত্যেকের ভাবনার সূত্র এক নয়। শৈশব-কৈশোরে দিনগুলোতে যে মাধুর্য এবং মমতা ছিল বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে-সম্পর্কে নানা ধরণের জটিলতা ঢুকে গেছে। প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বার্থে স্বাতন্ত্রের জায়গা তৈরি হয়েছে। যে যার মতো করে পথ চিনে নিয়েছে।
বাবা-মা খুশি।
তাদের মতে, মেধাবী ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভালো চাকরি করছে। স্ট্যাটাসের চাকরি। অনেক টাকা বেতন পাচ্ছে। ভালো দিন কাটাচ্ছে।
এসব কথা ছেলেমেয়েদের বললে, ওরা মৃদু হাসি ছড়িয়ে রাখে মুখে, কিন্তু ভাবে, বাবা-মার এর বেশিকিছু চাইবার নাই।
হ্যাঁ, তাইতো, বাবা-মা এর বেশিকিছু চাইবে কেন?
ফয়সল, অন্য ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে।
শর্মিলা মাথা নাড়িয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিক বলেছ।
ফেরদৌস ঝট করে বলে, কিছুই কি চাইবার নাই? আমরা যা তাদের কাছে থেকে নিয়েছি তা কি শুধুই স্বার্থপরের মতো নেয়া হলো?
শায়লা ঘন ঘন মাথা নাড়ায়। বলে, আমিও মেজো ভাইয়ার সঙ্গে একমত। মনে করি, বাবা-মায়ের অনেক কিছু চাইবার আছে।
ফয়সল দাঁত কিড়মিড় করে বলে, আমার মেধা আমার পুঁজি। আমার শ্রম আমার পুঁজি। এখানে বাবা মায়ের কোনো কনট্রিবিউশন নাই।
বাজে কথা।
শায়লা আঙুল উঁচিয়ে বলে।
তোমার পুঁজির যা-কিছু সমৃদ্ধি তা বাবা-মায়ের অবদান। লেখাপড়া না শিখলে পুঁজি বাঁশের মাথায় উঠত। আর মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যেত। যেটুকু বলেছ, এর বেশি আর বলতে যেওনা।
ফয়সল গলার স্বর উঁচু করে বলে, তুই আমাদের সবার ছোট, কিন্তু তোর গলা সবার চেয়ে উপরে।
সত্য কথা গলা উঁচু করেই বলতে হয় বড় ভাইয়া।
এভাবে ভাইবোনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। এভাবে নিজের মতামত তৈরি করার জায়গায় পৌঁছে যায় ওরা। আজও কথা বলার জন্য শায়লার হাত ধরে টেনে বসালেও শর্মিলার মুখে কথা নেই। ও আসলেই ভারাক্রান্ত বাবার মৃত্যুর পাঁচ দিনের মাথায় এমন ঘটনা ঘটল যে ভাবতেও খারাপ লাগছে।
বছর আটেক আগে মারা গেছে মা।
মায়ের মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে সময় লেগেছে সবার। ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। তারজন্য কোনোকিছু করার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রত্যেকের কষ্ট হয়েছে কেমন সেটা কেউ কাউকে বোঝাতে পারেনি। কারও জন্য মায়ের কোনো শেষ কথা ছিল না। উপরন্তু নিঃসঙ্গ বাবা দীর্ঘ সময় ধরে ওদের সামনে ছিল। অসুখে ভুগেছে অনেকদিন। ফেরদৌস আর শর্মিলা বিদেশে থাকে। বাবাকে দেখাশোনার দায়িত্ব ওরা নিতে পারেনি। ফয়সল বরাবরই অন্যরকম। বাবাকে দেখাশোনা করতে হবে এমন দায়-দায়িত্বের সঙ্গে ও নিজেকে যুক্ত করেনি। আগেও করেনি, অসুস্থতার সময়ও না। তার ধারণায় প্রতিটি ব্যক্তি আপন নিয়মে স্বতন্ত্র। তিনি বাবা-মা, ভাইবোন বা অন্য যে কেউ হন না কেন। একজনের দায় আর একজনের উপর চাপানো অনৈতিক।
সেদিন বাকি তিন ভাইবোন একসঙ্গে বলেছিল, ছিঃ। ছিঃ ভাইয়া। কেউ যে এমন করে ভাবতে পারে তা আমাদের ধারণায় আসে না।
তা, না আসতে পারে। তোমরা বোকার স্বর্গে বাস কর। তোমরা ব্যক্তি নও, সমষ্টি। আমি কখনোই সমষ্টি হতে চাই না।
আজকের ঘটনার পরে বড় ভাইয়ের সেদিনের কথাগুলো শায়লার মনে বারবার ফিরে আসে। অসংখ্য দিন কথাগুলো ওকে ভাবিয়েছে, কিন্তু ওর কাছে এই ভাবনার জবাবে একটি মাত্র শব্দ ছিল, স্বার্থপর। কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি। পড়াশোনায় বড়ো ভাইয়ের ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট সবাইকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। কেউ তাকে নিয়ে ভিন্ন কিছু ভাবেনি। তাহলে আজ ভাবছে কেন?
শায়লা শর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলে, বড় ভাইয়ার কথাটা আমাদের গায়ে লেগেছে বলে আমরা এমন মুষড়ে পড়েছি। না আপু?
শর্মিলা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির। এই মুহূর্তে শায়লার দিকে তাকায় না এবং জবাবে কিছুই বলে না। মনে মনে ভাবে, শায়লার ব্যাখ্যাটাই ঠিক। এমন অনেক কথা যখন বাবা-মায়ের উপর দিয়ে গেছে তখন কেউ গায়ে মাখেনি। শুনেছে, ছিঃ বলেছে। এমন ভাবনা খুবই খারাপ বলে মন্তব্য করেছে। এর বেশি কিছু নয়। সম্পর্কের সূত্র ধরে একই ভাবনা এখন নিজেদের মধ্যে গড়িয়েছে। সম্পর্ক কি? লোকে বলে রক্তের সম্পর্ক। তাহলে এই সম্পর্কেও ফাটল আছে। এটা সামাজিক সম্পর্ক। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির জায়গা নির্ধারণ। তারপরও সম্পর্কের অনেক ব্যাখা আছে। পথ খোঁজা আছে। ব্যক্তিকে সেটা ভাবতে হয় এবং সূত্রগুলোকে নির্ধারণ করতে হয়।
শর্মিলার দিকে তাকিয়ে শায়লা বলে, কি ভাবছ আপু?
নিজেদের কথা।
শব্দ করে হেসে উঠে শায়লা বলে, এ ভাবনার শেষ নেই। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তই আমাদের শেষ কথা। আমরা চুপ করে বসে থাকব। ওরা যা করে করুক।
ড্রইংরুমে আসে ফয়সল।
দু’ বোনে একসঙ্গে বড়ো ভাইয়ের মুখের ওপর দৃষ্টি ফেলে। ফয়সল শর্মিলা থেকে দু’বছরের বড়। শায়লার চেয়ে সাত বছরের। শর্মিলার সঙ্গেই তার মধুর স্মৃতি বেশি। ফেরদৌস হওয়ার আগে পর্যন্ত দুজনের খুবই দারুণ সম্পর্ক ছিল। মা শর্মিলাকে কাপড় দিয়ে ছোটো ছোটো পুতুল বানিয়ে দিত। ফেরদৌস ওগুলো ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে বলতো, এগুলো কোনো খেলার জিনিস হলো! মা যে কিসব ছাইমাথা বানায়। এগুলো দিয়ে খেলবি না। আমার যে কাঠের ঘোড়া আছে ওটার উপর উঠবি আর দুলবি। এটাই হলো মজার খেলা।
তুমিতো আবার মাঝে মাঝে আমাকে বকা দিয়ে থামিয়ে দাও।
দেবোই তো। তুই যদি বেশি দাবি করিস তাহলেতো আমি নামিয়েই দেব।
ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিতে পার না?
ইস শখ কতো! তুই একটা লোভী মেয়ে।
লোভ! এইটুকুতে লোভ হয়? এটাতো একটা খেলনা।
আমার জিনিসের উপরে হাত দিলেই আমি মনে করবো লোভ।
আচ্ছা, আমি আর কখনো তোমার ঘোড়ার পিঠে চড়বো না।
মনে রাখিস। লোভ আমি সহ্য করি না।
তোমার লোভও আমি সহ্য করব না। মনে রেখো।
কচু করবি। তুই আমার সঙ্গে পারবি?
শর্মিলা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না। ছোটবেলা এখন নেই। এখন বড়ো বেলার গনগনে সূর্য মাথার উপরে।
শর্মিলা ভায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, চা খাবে তুমি?
হ্যাঁ, চা আনতে পারিস।
ফ্রিজে পুডিং আছে আনব?
না। শুধু চা।
ফয়সল ড্রইংরুমের সোফায় বসে। সেন্টার টেবিল থেকে খবর কাগজটা তুলে নিয়ে শায়লাকে আড়াল করে টানটান করে মুখের উপর মেলে ধরে। দু’হাতের মাঝখানে চিরুনিটা নাড়াচাড়া করে শায়লা। গতকাল বাবার মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে কাগজে। ভাবে, ফয়সল হয়ত সে খবরটা পড়েছে অথবা নাও পড়তে পারে। তাতে বোঝা যাচ্ছে না। শায়লা যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। শব্দ টের পেয়ে ফয়সল কাগজ সরিয়ে বলে, যাচ্ছিস?
তুমি যেভাবে কাগজ দিয়ে আমার মুখ দেখতে চাইছ না, তাকে না গিয়ে কি করব? বাড়িতে ঘোড়া নেই যে ঘাস কাটব।
চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলিস কেন?
শুরুটা তুমিই করেছ। মেজো ভাইকেও দলে টেনে ফেলেছ।
কারণ আমাদের দুজনের অবস্থান এক। দুজনেই পুরুষ।
হাঃ পুরুষ! বাবার অসুখের দেখাশোনার সময় পৌরুষত্ব ছিল না। এখন জন্মদাতার সম্পর্কের সূত্রে পৌরুষত্বের দাবি।
চড় মেরে তোর দাঁত ফেলে দেব। কেবল বড় কথা। তুই হলি যত নষ্টের গোড়া।
শায়লা কিছু বলার আগেই শর্মিলা চা নিয়ে ড্রইংরুমে আসে। চায়ের কাপ টেবিলে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ফয়সল ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে, খাব না চা।
চায়ের কাপ পিরিচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মেঝেয় গড়ায় চা।
তুমি এটা কি করলে ভাইয়া?
কথা বলবি না আমার সঙ্গে। তোদের মুখ দেখতে চাই না।
বেশি দিন দেখতে হবে না। আমিতো চলেই যাচ্ছি।
শায়লা বলে, আমি তো দেশেই থাকব। দেখব তুমি কি করতে পার।
যাচ্ছি, দেখবি কি করতে পারি।
ড্রইংরুমের দরজা হাট করে খুলে রেখে বেরিয়ে যায় ফয়সল। পেছন ফিরে তাকায় না।
দু’বোনে চুপচাপ থাকে। কারো মুখে কথা নেই। অল্পক্ষণে ড্রইংরুমে আসে ফেরদৌস। প্রথম কথা, আমি আমার সিগারেটের প্যাকেটটা এখানে ফেলে গেছি।
প্যাকেটটা ফেলে যাসনি। এ্যাসট্রে বোঝাই টুকরোগুলো রেখে গেছিস। গন্ধে ঠিকমতো শ্বাস টানতে পারছি না।
শ্বাস টানতে বলে কে? বন্ধ করে রাখ।
মরে যেতে বলছিস?
ইচ্ছে হলে তা করতে পারিস।
শায়লাকে ধমক দিয়ে শর্মিলা বলে, শায়লা চুপ কর। আমরা ভাইবোনেরা কখনো একে অপরকে এভাবে কথা বলিনি।
ফেরদৌস গলা উঁচু করে বলে, আজ বলছি। কারণ তোদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ভয়েস তো রেইজ করতে হবে।
বাবা-মা স্বেচ্ছায় যে কাজ করেছেন তাকে তোরা ষড়যন্ত্র বলছিস?
কাজটি করার জন্য তোরা বাবা-মাকে খুঁচিয়েছিস।
শায়লা চেঁচিয়ে বলে, মোটেই না। তারা নিজেদের বিশ্বাস থেকে কাজটি করেছিলেন। তাঁরা মনে করেছেন তাঁদের কাছে ছেলেমেয়ে সমান।
ফুঃ! ফেরদৌস সজোরে পা দাপায়। বাড়ির কাজের লোকেরা দরজায় এসে উঁকি দেয়। তারপর নিজেরা সরে পড়ে। কেউ ফয়সলের ফেলে দেয়া কাপের ভাঙ্গা টুকরো তুলতে ঘরে ঢোকেনি। তখন ফেরদৌস কাঁচের এ্যাসট্রে লাত্থি দিলে সেটা বারান্দায় পড়ে ভেঙে টুকরো হয়। সিগারেটের টুকরো ও ছাই ড্রইংরুমে ছড়িয়ে পড়ে। দু’বোন একসঙ্গে ফেরদৌসের দিকে তাকায়।
ফেরদৌস চেঁচিয়ে বলে, সবকিছু অসহ্য লাগছে।
বাবার মৃত্যুও? শায়লা সরাসরি তাকায়। ভুরু কুঁচকে আছে। চোখ ছুঁচালো হয়ে গেছে। ফেরদৌস আবার চেঁচিয়ে বলে, তোকে একটা ডাইনির মতো লাগছে।
শর্মিলা ধমক দিয়ে বলে, তুই কি সুস্থির হবি ফেরদৌস। সবকিছুর সীমা আছে।
সীমা তোমরা ছাড়িয়েছ। আমি না। এসব কথা আমাকে বলে লাভ নেই।
কোনো কথাই কাউকে বলে লাভ নেই। এখন তোমাদের মানার সময়। যা হয়েছে, সেটুকু মানো।
অসম্ভব। এ হতে পারে না। মানার প্রশ্নই ওঠে না।
অসম্ভব হলে, অসম্ভব। আর কোনো কথা বলবে না।
তুমি আমার সঙ্গে একদম অন্যরকম ছিলে মেজোভাই। আমাকে খুব স্নেহ করতে।
শায়লার কথায় এক মুহূর্ত থমকে যায় ফেরদৌস। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলে, সেইসব দিনগুলোর কথা এখন ভুলে যাওয়াই উচিত।
তারপর ড্রইংরুমের দরজা ঠাস করে খুলে বেরিয়ে যায় ও। শর্মিলা দরজা বন্ধ করে। তারপর শায়লার দিকে তাকিয়ে বলে, আমারও মনে হচ্ছে কোথাও চলে যাই।
আমারও যেতে ইচ্ছে করছে।
কোথায় যাবি?
স্মৃতির রাজ্যে। আমাদের অনেক ভালো স্মৃতি আছে আপু।
এসব হেঁয়ালী এখন থাক শায়লা। চল দু’বোন বাবা মায়ের এ্যালবাম নিয়ে বসি।
ওটাইতো স্মৃতির রাজ্য। চলো চোখের পানিতে ভিজিয়ে দেই ছবিগুলো। এখন এই সম্বল আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে।
রাতের বেলা খাবার টেবিলে ফয়সল জিজ্ঞেস করে, সম্পত্তির ভাগ চার ভাইবোন সমান পাবে এই উইলটা কবে করেছে আমাদের বাবা?
শায়লা সরাসরি তাকিয়ে বলে, দলিলতো তুমি দেখেছো।
আমি তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করছি?
শায়লা কথার উত্তর না দিয়ে খাবারে মনোযোগী হয়। অন্যরা কথা বলে না। বাটির গায়ে চামচ লেগে শব্দ হয় কিংবা ঠক করে কেউ গ্লাস রাখে, নইলে কি বাজে রান্না হয়েছে বলে মন্তব্য করে দুই পুরুষের একজন। হঠাৎ করে শায়লা চেঁচিয়ে বুয়াকে ডাকে, কয়েকটা কাঁচামরিচ দেন তো বুয়া।
বুয়া কয়েকটা কাঁচামরিচ এনে টেবিলে রাখে।
আম্মা এই বাটিতে কাঁচামরিচ রাখতেন। কাঁচামরিচ ছাড়া ভাতই খাওয়া হতো না তাঁর।
আপনেরাতো আব্বা-আম্মাকে ভুলে গেছেন। কেবল ঝগড়া করেন।
চুপ, আর একটা কথা বলবি না। ন্যাকামি করছে। যেন তিনি মায়ের পেটের সন্তান। দরদ বেয়ে পড়ছে। পাজী একটা।
তিন ভাইবোন ফয়সলের দিকে তাকায়। বিদেশে পড়ালেখা করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পাওয়া ছেলেটি কি বাজে ভাষায় কথা বলছে! বুয়া নিঃশব্দে সরে পড়ে। বিড়বিড় করে বলে, বাপ মরার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েগুলো আর আগের ছেলেমেয়ে নেই। ওদের যেন কি হয়েছে। ওরা একজন আর একজনকে ছেড়ে কোথাও চলে যাবে। শরীরে যাবে না, মনে মনে যাবে। রান্নাঘরে গিয়ে বুয়ার ভীষণ কান্না পায়। ভাবে, বাড়িতে কান্নার রোল থাকার কথা ছিল। তার বদলে কি সব হচ্ছে। ও পিঁড়িতে বসে পা ছড়িয়ে রাখে। সিদ্ধান্ত নেয় কেউ ডাকলে আর খাবার ঘরে যাবে না। ওদের যা খুশি তা করুক। কিন্তু ও টের পায় অনেকক্ষণ কেটে যাবার পারও কেউ ওকে ডাকে না। একসময় জোরে চেয়ার টানার শব্দ পায়। শোনা যায় ফয়সলের গলা, আমি দেখে ছাড়ব। কাউকে কোনো ছাড় দেব না।
কেউ কথা বলে না। ফেরদৌসও না। বেশ কিছুক্ষণ পরে শায়লা বলে, বড় ভাইয়ের পিছে পিছে তুমি যে গেলে না মেজোভাই।
আমিতো ওর সঙ্গেই আছি। আমার যাওয়া না যাওয়া সমান। ভেবো না যে, তোমাদের জন্য বসে আছি।
হাসিতে ভেঙে পড়ে দুজন। শর্মিলা হাসতে হাসতে বলে, তোমাদের আস্ফালনই হবে মাত্র। কিছুই করতে পারবে না। দেশের আইন-কানুন আছে না।
ফেরদৌস চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। দুই বোন বেসিনে হাত ধোওয়ার জন্য দাঁড়ায়। বুয়া এসে প্লেট-বাটি সরায়। বিষণœ দুপুর ছড়িয়ে থাকে বাড়ির ভেতরে। বাইরে খাঁ-খাঁ রোদ। জৈষ্ঠ্য মাসের গরম। মায়ের মৃত্যুর পরে আট বছর তাদের বাবা এই বাড়িতে বেঁচে ছিলেন। অসুখে ভুগেছেন। শেষের দিকে মাস দুই অচেতন হয়ে হাসপাতালে থেকেছেন। তারপরে পাঁচদিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সবই যেন একরকম নিয়মমাফিক হয়েছে। কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ব্যত্যয় ঘটেছে ভাইবোনের সম্পর্কে। সেটা এখন চড়চড় শব্দে ফাটছে। এই ফাটল বিশাল পাহাড়-সমান হয়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শর্মিলা ভাবে আজকের বিষণœ দুপুর এই বাড়ি থেকে আর কখনো বুঝি সরবে না।
তিন দিন পরে শর্মিলা আর শায়লাকে ড্রইংরুমে ডেকে এনে বোমা ফাটায় ফয়সল আর ফেরদৌস।
আজ কোর্টে মামলা ঠুকে দিয়ে এসেছি। ব্যারিস্টার চৌধুরী আমাদের উকিল। কয়দিনের মধ্যেই নোটিশ পাবে তোমরা।
বাবা-মা তাদের সম্পত্তিতে মেয়েদেরকে ছেলেদের সঙ্গে সমান ভাগ দিয়েছেন। এর মধ্যে আইনের কোনো প্যাঁচ নেই।
মামলা চলুক। কি আছে, না আছে বুঝবে তখন।
তাহলে মেয়েদের রাইট নিয়ে যেসব গবেষণা করেছ তার সবটাই জিরো তোমাদের কাছে?
ফুঃ। হাসে দু’ভাই। সে হাসিতে ভেঙে পড়ে সম্পর্কের তটরেখা।
ওদের হাসি থামলে হেসে ওঠে শর্মিলা আর শায়লা। হাসতে হাসতে বলে, আমাদের উকিলও আছে। লড়াইটা সমানে সমানে হবে।
সে রাতে চার ভাইবোন ঘুমুতে পারে না। কেবলই মনে হয় ঘড়জুড়ে বাবা-মা ছোটাছুটি করছেন। তাদের পায়ের শব্দ সমস্ত ঘরে সরে সরে যাচ্ছে। মা বলছে, ইট-কাঠের জন্য তোরা আমার পেটে লাত্থি দিলি রে সোনামানিকরা। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, মরণেও শান্তি নেই।
হিম হয়ে থাকে দুই ভাইয়ের শরীর।
মুহূর্ত সময় মাত্র পার হয়েছে, ফয়সল গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের বাতি জ্বালায়। পানি খায়। দরজা খুলে বাইরে আসে। দেখতে পায় বারান্দার রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ফেরদৌস।
কি রে এখানে কি করছিস?
খুব একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে।
আমারও তাই হয়েছে। ঘুমুতে পারছি না।
শর্মিলা আর শায়লা বেশ ঘুমুচ্ছে।
ওরাতো আনন্দে আছে।
ফেরদৌস মিনমিন করে, ওরা আমাদেরই বোন। মা এমন কথাই বলেছে।
মানুষের জন্মের সূত্র দিয়ে শুধু সম্পর্ক হয় না। সম্পর্কের পরিসর অনেক বড়।
ফয়সলের কথার উত্তর না দিয়ে ফেরদৌস ঘরে গিয়ে ঢোকে।
বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে থাকে ফয়সল। রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ভাবে, আকাশ দেখব না। বাতাস আমার শরীর স্পর্শ করুক তাও চাই না। লড়াইটা আমাকে করতেই হবে। ভাঙুক চারদিক। আমার সামনে শূন্য সাদা দেয়াল।
ফয়সল দাঁত কিড়মিড় করে।